শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০২৪

কার্ল মার্ক্স ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

নিজেকে মার্ক্সিস্ট বলে দাবি করার খোয়াব কবেই মিলিয়ে গেছে ঠিক যেমনটা মিলিয়ে যায় সুগন্ধির সুবাস এক নিমেষে যখন দামী এসইউভি গাড়ির দরজা দড়াম করে খুলে দিলে। নিজেকে মার্ক্সসিস্ট বলে দাবি করার খোয়াব মিলিয়ে গেছে বাতাসে বিলাস বহুল বিয়েবাড়ির হাজার টাকা প্লেটের ডিনার শেষের তোলা তৃপ্তির উদগার এর মতো। নিজেকে মার্কসিস্ট বলে দাবি করতে হওয়ার মতো ধৃষ্টতার আর কিছুই অবশেষ বাকি নেই নাগাসাকি বিস্ফোরণ শেষের ধ্বংসস্তুপ এর মতো  দুনিয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে। তবুও আজকের দিনটায় রাউল, রাউল ব্র্যাংকো কেন যেন ভেসে আসেন চিন্তা চেতনায় নিশির ডাকের মতো। পেরুর স্বৈরাচারী শাসক এর হাতে আগুনে আধপোড়া কবি রাউল মনে করেই দেন, মানুষ মারা গেলেও তার চিন্তা চেতনা বেঁচে থাকে, যদি তিনি হন পৃথিবী এর শ্রেষ্ট চিন্তা নায়ক। কার্ল মার্ক্স ইজ ডেড, লং লিভ কার্ল মার্ক্স।

কার্ল মার্ক্স
---------------------------
মার্ক্স, যখন পুঁজি গোটাচ্ছে তার তহবিল, ছড়াচ্ছে চিহ্ন জড়াচ্ছে ভূগোল, নগ্ন দিগন্তে ধেয়ে উড়ে চলেছে তার প্ৰযুক্তির ডানা;
তখন মার্ক্স, আপনার কণ্ঠস্বর আবারো গমগম করে, গমগম করে।

পুঁজি বারে বারে তারে তারে নাচে কুঁদে অকাতরে,
পুঁজি কর্ক ফুঁসে ওঠা কোকাকোলার বোতলে বোতলে,
পুঁজি নিকারাগুয়া থেকে নাইজেরিয়ার কারখানায়,
পুঁজি ফিক করে হাসা ফিকশনে ফিকশনে,
পুঁজি বেয়নেটে বিদ্ধ পোয়াতি নারীর পেটে,
পুঁজি টুপটাপ টুপটাপ রক্ত আর খুনের লাল ফিনকি,
পুঁজি বাজারে ছন্দে ছন্দে দুলে ওঠা দানবীয় হাত,
পুঁজি খুবলে খাওয়া ডলারের দাঁত বসানো সাম্রাজ্যবাদ;
মার্ক্স, এখানেই অনিবার্য হয়ে ওঠে আপনার কণ্ঠস্বর, আবারো গমগম করে, গমগম করে।

বিপ্লবী শিল্পীদের ভায়োলিনে ভায়োলিনে জাগে আপনার তত্বের মূর্ছনা,
ফিলিপিন্সের গেরিলার বন্দুকে বন্দুকে বেরিয়ে আসে আপনারই তরতাজা অক্ষর সব, মহান মার্ক্স।

বদলাও পৃথিবী, পৃথিবী বদলাও, বদলাও পৃথিবী;
বুলেট ব'লে, বদলাও পৃথিবী,
প্রেম ব'লে, বদলাও পৃথিবী,
ঘৃণা ব'লে বদলাও পৃথিবী,
নদী ব'লে বদলাও পৃথিবী,
মা ব'লে বদলাও পৃথিবী।

তৃতীয় বিশ্বের প্রতিটি শ্রমিকের আর কৃষকের দেহে দেহে, ঘামে ঘামে, জবানে জবানে
আপনি মার্ক্স, ঝলকাতে থাকেন, কেবল ঝলকাতে থাকেন; আর
আপনার তত্ব, বুলেট আর বারুদ হয়ে,
ঘৃণা আর প্রেম হয়ে,
ভাঙ্গন আর নির্মাণ হয়ে বেরোতে থাকে; অবিরাম বেরোতে থাকে।

পুয়েরটরিকো থেকে ফিলিপিন্স,
ব্রাজিল থেকে বাহামাস
মার্ক্স, আপনি মহান মার্ক্স,
থাকেন এইখানে, মুহুর্তের উদ্ভাসনে।

কার্ল মার্ক্স ইজ ডেড, লং লিভ কার্ল মার্ক্স।

বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

ত্রাণ শিবিরের সনেট ~ শুভাশীষ মোদক চৌধুরী

১২ই নভেম্বর ২০০৭: ওই বছরে নিহত নন্দীগ্রাম এলাকার ২৭ জন সিপিএম কর্মীদের নাম প্রকাশ হলো। একই সাথে গত এগারো মাস ঘরছাড়া শতাধিক সিপিএম পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল অস্থায়ী ত্রান শিবিরে। সেই ঝুপড়িগুলো পুড়িয়ে দিল তৃণমূল, অতিবাম, বিজেপি চক্র। বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া আশঙ্কা ব্যক্ত করলো - পরিবার গুলি বাড়ি ফিরতে চাইলে সংঘাত বাড়বে। কবিতাটা ওই সময়েই লেখা। তারপর গত ষোলো বছরে অনেক জার্সি বদল হয়েছে, ঘর পুড়েছে, পুড়ছে। লেখাটার প্রাসঙ্গিকতা বদলায়নি বোধ হয়...



ত্রাণ শিবিরের সনেট
শুভাশীষ মোদক চৌধুরী

চেষ্টাও কোরোনা, তোমার ঘরে ফিরতে মানা।
তোমার জন্যে এই কলমে কান্না ঝরবেনা।
তোমার মরা ছেলের শরীর আঁকবেনা রং-তুলি,
তোমার গায়েও চিহ্ন আছে। বাতাসেতে শুনি
সেটার বাজার বিশেষ নেই। তুমি অপাঙক্তেয়।
আমরা তোমার বেঁচে থাকাই করেছি সন্দেহ!

তোমার ভাঙ্গা বাড়ির কথা দু-এক জনে জানে,
কিন্তু বাড়ি ফিরতে গেলে জানবে উনিশ কোটি।
এখন সুশীল সমাজ কাঁদি এগারো মাস পরে -
তোমার দিকে নজর দিলেই তৃতীয় পাতার ক্ষতি।
বদলে জামা সেই পাতাতেই জায়গাটুকু করে,
বুদ্ধিজীবীর নিয়ম মত পাল্টি খাবো পরে
সময়বুঝে। বিকিকিনি খানিক চোখের জল...
মিডিয়া চায়, আমিও চাই - জানতে তোমার দল।

বুধবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০২৪

গান্ধীজি ও কুষ্ঠ রোগ ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

সেবাগ্রামে থাকার সময় গান্ধীজি সময় পেলেই লম্বা হাঁটা লাগাতেন। ১৯৩৯ এর ডিসেম্বর আশ্রম থেকে বেড়িয়ে গান্ধীজি দেখলেন  হাতে পুঁটুলি নিয়ে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলেন। গান্ধীজি চিনতে পারলেন, শাস্ত্রীজি। গান্ধীজির মুখে একটা চিন্তার ছায়া পড়লো। শাস্ত্রীজি সেটা লক্ষ করেই বললেন, "আপনার কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছিলাম তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল আমার। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারলাম না। হরিদ্বারে বসে নিজের হাতে কাটা সুতো আপনার হাতে তুলে দিতে এসেছি। আমি আশ্রমের ভেতরে যাবো না, এই গাছতলায় শুয়ে রাতটা কাটিয়ে দেবো  সকালে চলে যাবো"। কে এই শাস্ত্রীজি, কেনই বা তিনি আশ্রমে না ঢুকেই চলে যেতে চাইছেন এটা জানতে গেলে আমাদের একটু ফিরে যেতে হবে।

গান্ধীজি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং তার সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। উনি ও অন্য নেতারা গ্রেপ্তার হন, পুনের ইয়েরওয়ারা জেলে পাঠানো হয়। জেলে থাকার সময়, গান্ধীজি জেলসুপার ভান্ডারী সাহেবের কাছে দত্তাত্রেয় পারচুরে শাস্ত্রী নামের সহবন্দী সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। উনি ভান্ডারী কে অনুরোধ করেন খোঁজ নিতে যে কোথায় শাস্ত্রীজিকে আটকে রাখা আছে, ভান্ডারী কে বলেন " যদি উনি আমার সংগে একসাথে থাকেন তাহলে আমরা একে অন্যকে সংগ দিতে দিতে পারি, আলাপ আলোচনা করে সময় কাটাতে পারি।

ভান্ডারী তার উত্তরে বলেন, " শাস্ত্রীজির কুষ্ঠ আছে বলে তাকে জেলের অন্য সেকশনে রাখা হয়েছে।" এটা শুনে গান্ধীজি স্তম্ভিত হয়ে যান। শাস্ত্রীজি একজন পড়াশোনা করা শিক্ষিত, পন্ডিত মানুষ যার বেদ সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান। 

এরপরে গাঁধীজি শাস্ত্রীকে একটি চিঠি লেখেন মন খারাপ না করতে এবং অনুরোধ জানান চিঠিপত্র এর মাধ্যমে যোগাযোগ বজায় রাখতে, কোনো প্রয়োজন এ সাহায্য চাইতে।

শাস্ত্রীজি তার উত্তরে লেখেন, " যদি সম্ভব হয় তাহলে কিছু তুলোর ব্যবস্থা করবেন যাতে আমি আমার ক্ষত গুলি পরিস্কার রাখতে পারি; আর যদি কিছু বই এর ব্যবস্থা করা যায়।

চিঠি পাওয়ার পরে মহাদেব দেশাই যখন গাঁধীজি কে দেখতে আসেন জেলে, তখন গাঁন্ধীজির নির্দেশে দেশাই ওইসব ব্যাবস্থা করেন ও শাস্ত্রীজিকে খবর পাঠান যে "শরীর আমাদের অসুস্থ হতে পারে কিন্তু চৈতন্য আমাদের জাগিয়ে রাখবে।"

গান্ধীজীর এই চিঠি "মৃত সঞ্জীবনী এর মতো কাজ করে শাস্ত্রীজির জন্য এবং তিনি গাঁধীজির এই কথাতে বিপুলভাবে উজ্জীবিত হন।
 
কোনোও সময়ে গাঁধীজি জেলে অনশন করতেন। তাঁর জীবন যখন একটা সুতোয় ঝুলছে, সেই সময়ে সরকার সমঝোতা করেছে।  কে গাঁধীজিকে অনশন ভঙ্গ এর সময় প্রথম ফলের রস খাওয়াবে সে প্রশ্ন উঠে এসেছে। বাপু চেয়েছিলেন শাস্ত্রীজি এই কাজের ভার নিক। সরকার বাহাদুর মেনে নেওয়ার পরে সেটাই হয়। শাস্ত্রী এগিয়ে আসেন।। জেলার ভাণ্ডারী সাহেব এই দৃশ্য দেখে নিজের চোখের জল আটকাতে পারেন নি।

কুষ্ঠরোগীর প্রতি গান্ধীজির এই মনোভাবের শুরু কিন্ত অনেক আগে। দক্ষিণ আফ্রিকায়, নাটাল এ এক জনসভায় বক্তব্য রাখছিলেন গাঁধীজি। হটাৎ খেয়াল করলেন দূরে একটা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে একদল লোক খুব মন দিয়ে তাঁর কথা শুনছে। হাত নেড়ে কাছে এসে ভিড়ের সাথে মিশে যাওয়ার জন্য ডাকলেও তারা সাড়া দিল না। 

গাঁন্ধীজি ওদের দিকে এগিয়ে এলেন ব্যাপারটা বোঝার জন্য। এগিয়ে আসা মাত্রই ওদের একজন চেঁচিয়ে উঠলো, "গান্ধীভাই আমাদের কাছে আসবেন না।। আমরা লেপার, কুষ্ঠরুগী।" এসব শোনার পরেও গান্ধী এগিয়ে এলেন, কথা বললেন ওদের সাথে।

কয়েকজনের হাতের আঙ্গুল খসে গেছে তো কারুর পায়ের আঙ্গুল। কারুর ভুরুর লোম উঠে গেছে। ওরা কে কি চিকিৎসার সুযোগ পায়, গান্ধী জানতে চাইলেন। উত্তর শুনে স্তম্ভিত, স্তব্ধ।

ওদের কথায়, " কোনো ডাক্তার আমাদের চিকিৎসা করতে চায় না; আমরাই যে যার নিজের চিকিৎসা করি নিমপাতার রস দিয়ে।" যখন জানতে চাওয়া হল যে ওই রসে কোনো উপকার হচ্ছে কি না, তখন সবারই উত্তর না, ওরা কেবল ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে। 

ঠিক ওই মুহূর্তে গান্ধীজি ঠিক করলেন যে ওই মানুষগুলির জন্য ওনাকে কিছু করতেই হবে। উনি ওদের বাড়িতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন কিন্তু দিনের বেলায় কারুর সাহস হল না তার বাড়ি গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ার। 

গান্ধীজি যখন রাতে ঘুমোতে যাচ্ছেন তখন ওরা গিয়ে উপস্থিত। ওদের ডেকে নিলেন ভেতরে। ওদের ঘা পরিষ্কার করে দিলেন, কিছু খাবার দাবার বের করে খাওয়ালেন, আর ওদের জীবন কাহিনী শুনলেন, কিভাবে ওরা গ্রামের বাইরে একটা খণ্ডহরে বাসা করে থাকে আর বাঁচার চেষ্টা করে। 

ওদের জলের অভাব, নাগাল পায় না, তাই বরুনদেব যখন কৃপা করে মুখ তুলে চান তখন ওরা সেই বারিধারাতে স্নান করে। তা না হলে ওরা ওদের সেই ছেঁড়াখোঁড়া জামাকাপড় ই না কেচে দিনের পর দিন পড়ে থাকে কারণ স্নান করার বা কাপড় কাচার জল থেকে ওরা বঞ্চিত। 

গ্রামের আনন্দ-অনুষ্ঠানের উচ্ছিষ্ট দিয়েই পেট ভরাতে হয়। জীবন কাহিনী বর্ণনা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে লোকগুলি বিদায় নিতে চায়। গান্ধীজি বিদায়ের সময় বলেন যে তিনি ওদের জন্য কিছু করতে চান। করেওছিলেন,  পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা, ওষুধপত্র এর ব্যবস্থা।

সেবাগ্রামের সেই দিনটাতে ফেরত যাই আমরা। 
এই সেই শাস্ত্রীজি। গাঁধীজি  দক্ষিণ ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবক ভেলাধুন কে নির্দেশ দেন শাস্ত্রীজির জন্য একটি নতুন ধুতি ও বেনিয়ান আনতে।

পরের দিন যথানিয়মে প্রার্থনা সভায় মিলিত হলেন সব আশ্রমিকরা। যেখানে গাঁধীজি ঘোষণা করেন, "আজ আমাদের মধ্যে বেদ ও অন্যান্য বিষয়ে পারঙ্গম একজন পন্ডিত মানুষ শাস্ত্রীজি আমাদের মধ্যে উপস্থিত। উনি কুষ্ঠ রোগ এ ভুগছেন। আপনারা কি ওনাকে সমর্থন করবেন  ও ওনাকে এই আশ্রমে থাকতে দেবেন ? " 

চারদিকে তখন সূচ পতনের নীরবতা। আশ্রমিকদের অনুৎসাহিত মনোবাসনা বুঝে গাঁধীজি আবেদন রাখলেন, " যদি আপনাদের বিবেক অনুমোদন দেয় তাহলেই আপনারা সম্মতি দেবেন।"

গান্ধীজীর কথায় সেদিন কাজ হয়েছিল। মানুষ তার কথায় ভরসা রেখেছিল। শাস্ত্রীজি আশ্রমেই থেকে যান। আশ্রমের পূর্বদিকে তার জন্য একটি কুটির তৈরি হয়। গান্ধীজি প্রতিদিন সময় পেলে নিজের হাতে তার সেবা করতেন, ক্ষতস্থান ধুয়ে দিতেন, জামাকাপড় পড়িয়ে দিতেন।  তার সাথে সংস্কৃত কাব্য আবৃত্তি করতেন। ডাঃ জীবরাজ মেহেতা এর দেওয়া ওষুধ সেবনের পরে শাস্ত্রীজির উন্নতি দেখে গাঁধীজি খুবই সন্তুষ্ট হন। কাছেই দত্তপুরে ওয়ার্ধায় মনোহর দেওয়ান কুষ্ঠ পুনর্বাসন কেন্দ্র খোলেন। শাস্ত্রীজি সেখানে স্থানান্তরিত হ'ন ও আমৃত্যু সেখানেই থেকে যান। গান্ধীজি এই মনোহর দেওয়ান কে "প্রকৃত মহাত্মা" খেতাবে সম্ভাষিত করেন। 

কুষ্ঠরোগ নিয়ে গান্ধীজির এই অবদানের দুটি বৈশিষ্ট্য আছে। এক। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন লোক দেখানো ঘটনা নয়। এর ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। আগ্রহী পাঠক-পাঠিকার জন্য একটি সংক্ষিপ্ত কালানুক্রম দেওয়া হল। দুই। গান্ধীজির এর সেবার মনোভাবের সাথে আগাগোড়া বিজ্ঞান জড়িয়ে ছিল। দেশ বিদেশের বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সাধারণ স্বাস্থ্যকর্মী যারা কুষ্ঠরোগ নির্মূল করার অভিযানে জড়িত তারা অনেকেই নিয়মিতভাবে ওয়ার্ধা সেবাগ্রামে এসেছেন গান্ধীজির সাথে আলাপ আলোচনা পরামর্শ করেছেন। উনি আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে কিভাবে এই রোগ দূর করা যায় তাতে উৎসাহী ছিলেন। 

আজ ৩০শে জানুয়ারি। শহীদ দিবস। সারা ভারত জুড়ে পালিত হচ্ছে কুষ্ঠ-বিরোধী দিবস গান্ধীজীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে। একজন সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ গাঁধীজিকে আজকের দিনে খ্যাপা কুকুরের মতো রাগের জ্জ্বালায় গুলি করে খুন করে। সেই সাইকোপ্যাথ মানসিক রুগীকে আজ ততোধিক মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত কিছু মানুষ হিরো বানাতে চাইছে। কুষ্ঠরুগীদের মানুষ হিসেবে বাঁচার লড়াইতে কুষ্ঠ রোগের নির্মূল অভিযানে জড়িত একজন সামান্য স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে আজ বাপুকে এই স্মরণ। উনি বড় মাপের মনের অধিকারী ছিলেন। আশা রাখি বিপরীত মেরুর মতাদর্শের রাজনীতির একজন ভারতবাসীর কাছ থেকেও উনি এই শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রহণ করবেন, ফিরিয়ে দেবেন না। ঘেন্না ও বিদ্বেষ এর সব রকম চাষ আবাদ বন্ধ হয়ে আমার দেশ হয়ে উঠুক "সকল দেশের সেরা"

জাতীয় কুষ্ঠ-বিরোধী দিবসে শপথ: ঘেন্না মুক্ত ভারত, কুষ্ঠ মুক্ত ভারত। আসুন মানুষে মানুষে হাত বাড়াই।

সংক্ষিপ্ত কালানুক্রম:
১৮৯৪-৯৫: ডারবান: রাস্তায় গান্ধীজির সাথে কুষ্ঠরোগীর সাক্ষাৎ।
১৮৯৭: ডারবান: নিজের বাড়িতে গান্ধীজি কুষ্ঠরোগীর পরিচর্যা করলেন।
১৯০৫: দক্ষিণ আফ্রিকা: ভারতে কাজ করতে গিয়ে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছেন এমন একজন মিশনারিকে নিয়ে গান্ধীজি একটি ছোট প্রবন্ধ লিখলেন।
১৯১৩-১৪: পুনে: সান্ধ্য ভ্রমণে বেরিয়ে গান্ধীজি একজন কুষ্ঠরোগীকে উদ্ধার করলেন।
১৯১৩-১৫: মাদ্রাজ: একজন কুষ্ঠরোগী যিনি বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন তার ক্ষতস্থান গান্ধীজি নিজের কাপড় দিয়ে মুছে দিলেন।
১৯১৭: চম্পারণ: বিখ্যাত চম্পারণ যাত্রার সময় গান্ধীজি একজন কুষ্ঠরোগীকে সঙ্গে করে  পৌঁছে দিলেন গন্তব্যে।
১৯২৫: কটক: ১৯শে আগস্ট, গান্ধীজি কটক কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন।
১৯২৫: পুরুলিয়া: ১২ই সেপ্টেম্বর গান্ধীজি পুরুলিয়া কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন।
১৯২৭: কটক: ২১শে ডিসেম্বর গান্ধীজি কটক কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন। তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ওয়ার্ড ছেড়ে চলে আসার আগে কয়েকজনের সাথে মেলালেন হাত।
১৯২৯: আলমোড়া: কাঁসাই, বাগেশ্বর এর কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন গান্ধীজি।
১৯৪৪: সেবাগ্রাম: কস্তুরবা ট্রাস্ট গঠিত হ'ল। কুষ্ঠরোগ নিয়ে কর্মসূচি ওই ট্রাস্টের অন্যতম লক্ষ্য।
১৯৪৪: সেবাগ্রাম:  গান্ধীজি দত্তপুর কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করলেন ও তার কর্ণধার মনোহর দেওয়ানকে "প্রকৃত মহাত্মা" বলে আখ্যা দিলেন।
১৯৪৫: সেবাগ্রাম: ৯ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বিখ্যাত কুষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ডঃ ককরেন এসে দেখা করলেন গান্ধীজির সাথে।
১৯৪৬: মাদ্রাজ: ৪ঠা ফেব্রুয়ারি চেনগেলপুট উইলিংডন কুষ্ঠ হাসপাতালে রুগীদের সাথে দেখা করলেন গান্ধীজি।
১৯৪৭: ১২ই জানুয়ারি গান্ধীজি হরিজন পত্রিকায় কলম ধরলেন সিন্ধ প্রদেশের কুষ্ঠরোগীদের বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাকরণ নিয়ে উত্থাপিত বিল কে ধিক্কার জানিয়ে।
১৯৪৭: নোয়াখালী:  ৫ই ফেব্রুয়ারি তার প্রার্থনা শেষে সভায় গান্ধীজি কুষ্ঠরোগী ও অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের বিশেষ প্রতিনিধিত্ব এর কথা উল্লেখ করলেন।
১৯৪৭: কলকাতা: ৪ঠা সেপ্টেম্বর গান্ধীজি দেখতে গেলেন গোবরা মানসিক হাসপাতাল, বললেন যে এদের দুর্দশা কুষ্ঠরোগীদের চেয়েও খারাপ।
১৯৪৭: দিল্লি: ২৩শে ও ২৪শে অকটবর পরপর দু'দিন প্রার্থনা শেষের সভায় গান্ধীজি কুষ্ঠরোগের উল্লেখ করলেন। বার্তা পাঠালেন সারা ভারত কুষ্ঠরোগ কর্মী সম্মেলনে।

শুক্রবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০২৪

বাল্মিকী রামায়ণের যুদ্ধ কান্ডের ১১৫তম এবং ১১৬তম সর্গ ~ নবারুণ ঘোষাল

বাল্মিকী রামায়ণের যুদ্ধ কান্ডের ১১৫তম এবং ১১৬তম সর্গ দুটিতে লঙ্কার অশোকবনে রামের সাথে সীতার দেখা হওয়ার পর তাঁদের কথোপকথন বাংলায় অনুবাদ করলাম। 🙏🙏

বাল্মিকী রামায়ণ যুদ্ধ কান্ড ১১৫ সর্গ

প্রথম শ্লোকঃ
तां तु पार्श्वे स्थितां प्रह्वां रामः संप्रेक्ष्ये मैथिलीम् |
हृदयान्तर्गतं भावं व्याहर्तुमुपचक्रमे ||
অতঃপর অবনতা মৈথিলীকে পার্শ্বে দেখিয়া রাম হৃদয়ের অন্তর্গত ভাব ব্যক্ত করিলেন।

দ্বিতীয় শ্লোকঃ
एषासि निर्जिता भद्रे शत्रुं जित्वा रणाजिरे |
पौरुषाद्यदनुष्ठेयं मयैतदुपपादितम् ||
হে ভদ্রে, শত্রুকে রণক্ষেত্রে পরাজিত করিয়া তোমাকে আমি জয় করিয়াছি। পৌরুষের দ্বারা যাহা করণীয়, তাহা আমি সম্পন্ন করিয়াছি।

তৃতীয় শ্লোকঃ
गतोऽस्म्यन्तममर्षस्य धर्षणा संप्रमार्जिता |
अवमानश्च शत्रश्च युगपन्निहतौ मया ||
আমার লজ্জাজনক অবস্থা এবং আমার প্রতি অন্যায়ের অবসান হইয়াছে। আমার অবমাননাকারী এবং আমার শত্রু যুগপৎ আমার দ্বারা নিহত হইয়াছে।

চতুর্থ শ্লোকঃ
अद्य मे पौरुषं दृष्टमद्य मे सफलः श्रमः |
अद्य तीर्णप्रतिज्ञोऽहं प्रभवाम्यद्य चात्मनः॥
অদ্য আমার পৌরুষ প্রদর্শিত হইয়াছে, অদ্য আমার শ্রম সফল হইয়াছে। অদ্য আমি প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিয়াছি, অদ্য আমি নিজেই নিজের প্রভু।

পঞ্চম শ্লোকঃ
या त्वं विरहिता नीता चलचित्तेन रक्षसा |
दैवसंपादितो दोषो मानुषेण मया जितः ||
যে তুমি এক চপলমতি রাক্ষসের দ্বারা অপহৃতা হইয়াছিলে, আমি এই মনুষ্য, দৈবদোষের অপসারণ করিয়া তাহাকে জয়লাভ করিয়াছি।

ষষ্ঠ শ্লোকঃ
संप्राप्तमवमानं यस्तेजसा न प्रमार्जति |
कस्तस्य पौरुषेणार्थो महताप्यल्पचेतसः ||
যিনি নিজের তেজের দ্বারা নিজ অবমাননা দূর করিতে না পারেন, সেই অতি অল্পচেতন পুরুষের পৌরুষের কি অর্থ?

সপ্তম শ্লোকঃ
लङ्घुनं समुद्रस्य लङ्कायाश्चापि मर्दनम् |
सफलं तस्य च श्लाघ्यमद्य कर्म हनूमतः॥
যিনি সমুদ্র লঙ্ঘন করিয়া লঙ্কা ধ্বংস করিয়াছিলেন, সেই হনুমানের প্রশংসনীয় কর্ম অদ্য সফল হইয়াছে।

অষ্টম শ্লোকঃ
युद्धे विक्रमतश्चैव हितं मन्त्रयतस्तथा |
सुग्रीवस्य ससैन्यस्य सफलोऽद्य परिश्रमः ||
যিনি যুদ্ধে বিক্রম দেখাইয়াছেন এবং  হিতকারী মন্ত্রণা দিয়াছেন, সেই সুগ্রীব এবং তাঁহার সেনাদিগের পরিশ্রম অদ্য সফল হইয়াছে।

নবম শ্লোকঃ
विभीषणस्य च तथा सफलोऽद्य परिश्रमः |
विगुणं भ्रातरं त्वक्त्वा यो मां स्वयमुपस्थितः ||
যে বিভীষণ তাঁহার গুণহীন ভ্রাতাকে পরিত্যাগ করিয়া স্বয়ং আমার নিকট উপস্থিত হইয়াছেন, তাঁহার পরিশ্রম অদ্য সফল হইয়াছে।

দশম শ্লোকঃ
इत्येवं वदतः श्रुत्वा सीता रामस्य तद्वचः |
मृगीवोत्फुल्लनयना बभूवाश्रुपरिप्लुता ||
রামের মুখে এইরূপ বচন শুনিয়া মৃগীর ন্যায় উৎফুল্লনয়না সীতা অশ্রুপরিপ্লুতা হইলেন।

একাদশ শ্লোকঃ
पश्यतस्तां तु रामस्य समीपे हृदयप्रियाम् |
जनवादभयाद्राज्ञो बभूव हृदयं द्विधा ||
নিজ সমীপে হৃদয়প্রিয়াকে দেখিয়া জন অপবাদের ভয়ে রামের হৃদয় দ্বিধাগ্রস্ত হইল।

দ্বাদশ শ্লোকঃ
सीतामुत्पलपत्राक्षीं नीलकुञ्चितमूर्धजाम् |
अवदद्वै वरारोहां मध्ये वानररक्षसाम् ||
বানর এবং রাক্ষসদিগের মধ্যে উৎপলাক্ষী, নীলকুঞ্চিতকেশী,  সুনিতম্বিনী সীতাকে দেখিয়া (রাম) এইরূপ বলিলেন

ত্রয়োদশ শ্লোকঃ
यत्कर्तव्यं मनुष्येण धर्षणां प्रतिमार्जता |
तत्कृतं रावणं हत्वा मयेदं मानकाङ्क्क्षिणा ||
নিজ অপমানের প্রতিকার করিবার জন্য মনুষ্যের যাহা কর্তব্য, সম্মানার্থে রাবণকে হত্যা করিয়া আমি তাহা করিয়াছি।

চতুর্দশ শ্লোকঃ
निर्जिता जीवलोकस्य तपसा भावितात्मना |
अगस्त्येन दुराधर्षा मुनिना दक्षिणेव दिक् ||
যে দক্ষিণ দিক বিশুদ্ধহৃদয় তপস্বী অগস্ত্যের পক্ষেও দুরতিক্রম্য ছিল, সেই জীবলোককেও (দেশকেও) আমি জয় করিয়াছি।
পঞ্চদশ শ্লোকঃ 
विदितश्चास्तु भद्रं ते योऽयं रणपरिश्रमः |
सुतीर्णः सुहृदां वीर्यान्न त्वदर्थं मया कृतः ||
হে ভদ্রে, তোমার জানা উচিত যে এই রণকার্য যাহাতে আমি আমার সুহৃদদিগের বীরত্বের সাহায্যে উত্তীর্ণ হইয়াছি, তাহা তোমার নিমিত্ত করি নাই।

ষোড়শ শ্লোকঃ
रक्षता तु मया वृत्तमपवादम् च सर्वतः |
प्रख्यातस्यात्मवंशस्य न्यङ्गं च परिमार्जता ||
(আমি ইহা করিয়াছি) সর্বত্রব্যাপী অপবাদ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য এবং আমার প্রখ্যাত বংশের হীনাবস্থার পরিমার্জনের জন্য।

সপ্তদশ শ্লোকঃ
प्राप्तचारित्रसंदेह मम प्रतिमुखे स्थिता |
दीपो नेत्रातुरस्येव प्रतिकूलासि मे दृढम् ||
চরিত্রসন্দেহ প্রাপ্ত হইয়া আমার সম্মুখে উপস্থিত তুমি নেত্ররোগীর সম্মুখে দীপের ন্যায় অত্যন্ত অবাঞ্ছিত হইয়া আছ।

অষ্টাদশ শ্লোকঃ
तद्गच्छ त्वानुजानेऽद्य यथेष्टं जनकात्मजे |
एता दश दिशो भद्रे कार्यमस्ति न मे त्वया ||
সেইহেতু হে জনকাত্মজা, অদ্য আমি তোমাকে এই দশ দিকের মধ্যে যে কোনও দিকে যথেচ্ছ যাইবার অনুমতি দিতেছি, তোমাকে দিয়া আমার আর কোনো কাজ নাই।

উনবিংশতি শ্লোকঃ
कः पुमांस्तु कुले जातह् स्त्रियं परगृहोषिताम् |
तेजस्वी पुनरादद्यात् सुहृल्लेख्येन चेतसा ||
কোন সদ্বংশজাত তেজস্বী পুরুষ পরগৃহে আশ্রিতা স্ত্রীকে প্রফুল্লচিত্তে পুনরায় গ্রহণ করিবে?

বিংশতি শ্লোকঃ
रावणाङ्कपरिक्लिष्टां दृष्टां दुष्टेन चक्षुषा |
कथं त्वां पुनरादद्यां कुलं व्यपदिशन् महत् || 
তুমি রাবণের অঙ্কে ক্লিষ্ট হইয়া, তাহার দুষ্ট চক্ষুর দ্বারা দৃষ্ট হইয়া কিরূপে আমার মহৎ কুলে পুনরায় গৃহীত হইবে তাহা বল। 

একবিংশতি শ্লোকঃ 
तदर्थं निर्जिता मे त्वं यशः प्रत्याहृतं मया |
नास्थ् मे त्वय्यभिष्वङ्गो यथेष्टं गम्यतामितः || 
তোমাকে আমি জয় করিয়াছি আমার হৃত যশের পুনরুদ্ধারের জন্য। তোমার সম্পর্কে আমার আর কোনো গভীর অনুভূতি নাই, তুমি যথা ইচ্ছা গমন করিতে পার। 

দ্বাবিংশতি শ্লোকঃ 
तदद्य व्याहृतं भद्रे मयैतत् कृतबुद्धिना |
लक्ष्मणे वाथ भरते कुरु बुद्धिं यथासुखम् || 
হে ভদ্রে, সেই হেতু  অদ্য আমি কৃতবুদ্ধি হইয়া তোমায় বলিতেছি, তুমি যথাসুখে লক্ষ্মণ কিম্বা ভরতের প্রতি মনঃসংযোগ করিতে পার। 

ত্রয়োবিংশতি শ্লোকঃ 
शत्रुघ्ने वाथ सुग्रीवे राक्षसे वा विभीषणे |
निवेशय मनः सीते यथा वा सुखमात्मनः || 
শত্রুঘ্ন অথবা সুগ্রীব অথবা রাক্ষস বিভীষণ যাহার কাছে সুখী হইবে, হে সীতা তুমি তাহাতে মনোনিবেশ কর। 

চতুর্বিংশতি শ্লোকঃ 
न हि त्वां रावणो दृष्ट्वो दिव्यरूपां मनोरमाम् |
मर्षयेत चिरं सीते स्वगृहे पर्यवस्थिताम् || 
হে সীতা, তোমার ন্যায় দিব্যরূপা মনোরমা নারীকে স্বগৃহে অবস্থিত দেখিয়া রাবণ দীর্ঘকাল নিজেকে সংযত রাখিতে পারে না। 

পঞ্চবিংশতি শ্লোকঃ 
ततः प्रियार्हश्रवणा तदप्रियं प्रियादुपश्रुत्य चिरस्य मैथिली |
मुमोच बाष्पं सुभृशं प्रवेपिता गजेन्द्रहस्ताभिहतेव वल्लरी ||
ততঃপর চিরকাল প্রিয়বাক্য শ্রবণে অভ্যস্ত মৈথিলী প্রিয়মুখে এইরূপ অপ্রিয় বাক্য শুনিয়া হস্তীর দ্বারা আক্রান্ত লতার ন্যায় দীর্ঘক্ষণ কম্পমান হইয়া প্রভূত অশ্রু মোচন করিতে লাগিলেন।

ইতি ঋষি বাল্মিকী বিরচিত আদিকাব্য রামায়ণের যুদ্ধ কান্ডের পঞ্চদশোত্তর শততম সর্গ। 

বাল্মিকী রামায়ণ যুদ্ধ কান্ড ১১৬ সর্গ 

প্রথম শ্লোকঃ 
एवम् श्रुत्वा तु वैदेही परुषं लोमहर्षणम् |
राघवेण सरोषेण भृशं प्रव्यथिताभवत् || 
রাঘবের এরূপ রোষপূর্ণ কঠোর লোমহর্ষক কথা শুনিয়া বৈদেহী অত্যন্ত ব্যথিত হইলেন। 

দ্বিতীয় শ্লোকঃ
सा तदश्रुतपूर्वं हि जने महति मैथिली |
श्रुत्वा भर्तृवचो रूक्षं लज्जया व्रीडिताभवत् || 
এতজনের সম্মুখে পতির এসকল অশ্রুতপূর্ব কথা শুনিয়া মৈথিলী লজ্জায় ব্রীড়াবনতা হইলেন। 

তৃতীয় শ্লোকঃ 
प्रविशन्तीव गात्राणि स्वान्येव जनकात्मजा |
वाक्षल्यैस्तैः सशल्येव भृशमश्रूण्यवर्तयत् ||
স্বীয় গাত্রে এইসকল সুতীক্ষ্ণ বাক্যবাণগুলির প্রবেশ অনুভব করিয়া জনকদুহিতা অজস্র অশ্রুবর্ষণ করিতে লাগিলেন। 

চতুর্থ শ্লোকঃ 
ततो बाष्पपरिक्लिष्टं प्रमार्जन्ती स्वमाननम् |
शनैर्गद्गदया वाचा भर्तारमिदमब्रवीत् ||
ততঃপর নিজ বাষ্পপূর্ণ আনন পরিমার্জন করিয়া ধীরে ধীরে গদগদ বাক্যে পতিকে বলিলেন। 

পঞ্চম শ্লোকঃ 
किं मामसदृशं वाक्यमीदृशं श्रोत्रदारुणम् |
रूक्षं श्रावयसे वीर प्राकृतः प्राकृताम् इव ||
হে বীর, কিহেতু আমার ন্যায় নারীকে এইরূপ দারুণ রুক্ষ বাক্য শুনাইতেছেন, যেরূপ কোনও সাধারণ পুরুষ কোনো সাধারণ নারীকে শুনাইয়া থাকে? 

ষষ্ঠ শ্লোকঃ 
न तथास्मि महाबाहो यथा त्वमवगच्छसि |
प्रत्ययं गच्छ मे स्वेन चारित्रेणैव ते शपे ||
হে মহাবাহু, আপনি যেরূপ ভাবিতেছেন, আমি সেইরূপ নহি। আমি নিজের চরিত্রের দিব্য দিয়া বলিতেছি, আমার কথা বিশ্বাস করুন। 

সপ্তম শ্লোকঃ 
पृथक्स्त्रीणां प्रचारेण जातिं त्वं परिशङ्कसे |
परित्यजेमां शङ्कां तु यदि तेऽहं परीक्षिता || 
আপনি আশঙ্কাবশতঃ আমাকে পতিতা স্ত্রীজাতিসদৃশ বলিয়া প্রচার করিতেছেন। যদি আমি আপনার দ্বারা পরীক্ষিতা হইয়া থাকি, তবে এই আশঙ্কা ত্যাগ করুন। 

অষ্টম শ্লোকঃ 
यद्यहं गात्रसंस्पर्शं गतास्मि विवशा प्रभो |
कामकारो न मे तत्र दैवं तत्रापराध्यति || 
হে প্রভু, যদি আমি গাত্রসংস্পর্শে যাইবার জন্য বাধ্য হইয়া থাকি, তবে তাহাতে আমার কোনও ভূমিকা নাই, তাহা দৈবের বশে হইয়াছে। 

নবম শ্লোকঃ 
मदधीनं तु यत्तन्मे हृदयं त्वयि वर्तते |
पराधीनेषु गात्रेषु किं करिष्याम्यनीश्वरा ||
আমার অধীন যে হৃদয়, তাহা আপনাতেই স্থির ছিল। পরাধীন এই গাত্রের আমি অসহায় অবস্থায় কি করিতে পারিতাম? 

দশম শ্লোকঃ 
सहसंवृद्धभावाच्च संसर्गेण च मानद |
यद्यहं ते न विज्ञाता हता तेनास्मि शाश्वतम् || 
হে মানদ, একসঙ্গে বৃদ্ধিলাভ করিয়া এবং এক সংসর্গে থাকিয়াও যদি আমি আপনার কাছে অজ্ঞাত হইয়া থাকি, তবে আমি চিরকালের জন্য হতসর্বস্ব হইলাম। 

একাদশ শ্লোকঃ 
प्रेषितस्ते यदा वीरो हनूमानवलोककः |
लङ्कास्थाहं त्वया वीर किं तदा न विसर्जिता || 
হে বীর, আমি লঙ্কায় থাকাকালীন যখন আপনি বীর হনুমানকে অবলোকন করিবার জন্য প্রেরণ করেন, সেই সময়েই কেন আমাকে বিসর্জন দিলেন না? 

দ্বাদশ শ্লোকঃ 
प्रत्यक्षं वानरेन्द्रस्य त्वद्वाक्यसमनन्तरम् |
त्वया सन्त्यक्तया वीर त्यक्तं स्याज्जीवितं मया ||
হে বীর, বানরশ্রেষ্ঠের মুখে আপনার দ্বারা ত্যক্ত হইবার সংবাদ শুনিবামাত্র আমি তাঁহার সম্মুখে জীবন ত্যাগ করিতাম। 

ত্রয়োদশ শ্লোকঃ 
न वृथा ते श्रमोऽयं स्यात्संशये न्यस्य जीवितम् |
सुहृज्जनपरिक्लेशो न चायं निष्फलस्तव || 
তাহা হইলে আপনার এই বৃথা শ্রমব্যয় হইত না, আপনার জীবনও বিপন্ন হইত না, আপনার সুহৃদজনেরও এই নিষ্ফল ক্লেশভোগ হইত না। 

চতুর্দশ শ্লোকঃ 
त्वया तु नरशार्दूल क्रोधमेवानुवर्तता |
लघुनेव मनुष्येण स्त्रीत्वमेव पुरस्कृतम् || 
হে নরশার্দুল, আপনি ক্রোধের বশবর্তী হইয়া আমার সহিত লঘু মনুষ্যের স্ত্রীর ন্যায় আচরণ করিলেন। 

পঞ্চদশ শ্লোকঃ 
अपदेशेन जनकान्नोत्पत्तिर्वसुधातलात् |
मम वृत्तं च वृत्तज्ञ बहु ते न पुरस्कृतम् ||
জনকের দ্বারা আমার জন্ম এক ছল, আমি বাস্তবে বসুধার সন্তান। আমার এই বৃত্তান্ত জানিয়াও হে বৃত্তজ্ঞ আপনি তাহার মর্যাদা দিলেন না। 

ষোড়শ শ্লোকঃ 
न प्रमाणीकृतः पाणिर्बाल्ये बालेन पीडितः |
मम भक्तिश्च शीलं च सर्वं ते पृष्ठतः कृतम् || 
আমার বাল্যকালে আপনি আপনার বাল্যাবস্থায় আমার পাণিপীড়ন (বিবাহ) করিয়াছিলেন, তাহার অমর্যাদা করিলেন, আমার ভক্তি, শীলতা সকলই আপনি অগ্রাহ্য করিলেন। 

সপ্তদশ শ্লোকঃ 
इति ब्रुवन्ती रुदती बाष्पगद्गदभाषिणी |
उवाच लक्ष्मणं सीता दीनं ध्यानपरायणम् ||
বাষ্পাকুল গদগদ কন্ঠে এত বলিয়া ক্রন্দনরতা সীতা দুঃখিত, চিন্তান্বিত লক্ষ্মণকে বলিলেন। 

অষ্টাদশ শ্লোকঃ 
चितां मे कुरु सौमित्रे व्यसनस्यास्य भेषजम् |
मिथ्यापवादोपहता नाहं जीवितुमुत्सहे || 
হে সৌমিত্র, আমার জন্য চিতা প্রস্তুত কর, যাহা আমার এই দুর্দশার ঔষধ। মিথ্যা অপবাদের ভাগিনী হইয়া আমি আর জীবিত থাকিতে ইচ্ছা করি না। 

উনবিংশতি শ্লোকঃ 
अप्रीतेन गुणैर्भर्त्रा त्यक्ता या जनसंसदि |
या क्षमा मे गतिर्गन्तुं प्रवेक्ष्ये हव्यवाहनम् ||
পতি যখন আমার চরিত্র সম্পর্কে অসন্তুষ্ট হইয়া জনসমক্ষে আমাকে ত্যাগ করিয়াছেন, তখন অগ্নিতে প্রবেশ করাই আমার একমাত্র গতি। 

বিংশতি শ্লোকঃ 
एवं ब्रुवाणा रुदती बाष्पगद्गदभाषिणी |
अब्रवील्लक्ष्मणं सीता दीनं ध्यानपरं स्थितम् || 
ক্রন্দনরতা সীতা বাষ্পাকুল গদগদ কন্ঠে গভীর চিন্তামগ্ন দুঃখিত লক্ষ্মণকে এই সকল বলিলেন। 

একবিংশতি শ্লোকঃ 
स विज्ञाय मनश्छन्दं रामस्याकारसूचितम् |
चितां चकार सौमित्रिर्मते रामस्य वीर्यवान् || 
রামের ইঙ্গিতে রামের মনোভাব জানিয়া বীর সৌমিত্র রামের মতানুসারে চিতা সাজাইলেন। 

দ্বাবিংশতি শ্লোকঃ 
न हि रामं तदा कश्चित्कालान्तकयमोपमम् |
अनुनेतुमथो वक्तुं द्रष्टुं वा प्यशकत्सुहृत् || 
সেই সময়ে রামের কালান্তক যমের ন্যায় মূর্তি দেখিয়া সুহৃদবর্গের কেহই তাঁহাকে কিছু বলিতে অথবা তাঁহার প্রতি  দৃষ্টিপাত করিতে সাহস করিল না। 

ত্রয়োবিংশতি শ্লোকঃ 
अधोमुखं ततो रामं शनैः कृत्वा प्रदक्षिणम् |
उपासर्पत वैदेही दीप्यमानं हुताशनम् || 
অতঃপর ধীরে ধীরে অধোমুখ রামকে প্রদক্ষিণ করিয়া বৈদেহী প্রজ্জ্বলিত হুতাশনের প্রতি অগ্রসর হইলেন। 

চতুর্বিংশতি শ্লোকঃ 
प्रणम्य देवताभ्यश्च ब्राह्मणेभ्यश्च मैथिली |
बद्धाञ्जलिपुटा चेदमुवाचाग्निसमीपतः || 
দেবতাগণ এবং ব্রাহ্মণগণকে প্রণাম করিয়া মৈথিলী কৃতাঞ্জলিপুটে অগ্নির সমীপে গিয়া এইরূপ কহিলেন। 

পঞ্চবিংশতি শ্লোকঃ 
यथा मे हृदयं नित्यं नापसर्पति राघवात् |
तथा लोकस्य साक्षी मां सर्वतः पातु पावकः ||
যেহেতু আমার হৃদয় কখনো রাঘব হইতে অপসৃত হয় নাই, অতএব জগৎকে সাক্ষী মানিয়া অগ্নিদেব আমাকে সকল দিক হইতে পরিত্রাণ করুন। 

ষড়বিংশতি শ্লোকঃ 
यथा मां शुद्धचरितां दुष्टां जानाति राघवः |
तथा लोकस्य साक्षी मां सर्वतः पातु पावकः ||
যেহেতু আমি শুদ্ধচরিত হওয়া সত্ত্বেও রাঘব আমাকে দুষ্টা বলিয়া জানিয়াছেন, অতএব জগৎকে সাক্ষী মানিয়া অগ্নিদেব আমাকে সকল দিক হইতে পরিত্রাণ করুন।

সপ্তবিংশতি শ্লোকঃ 
कर्मणा मनसा वाचा यथा नातिचराम्यहम् |
राघवं सर्वधर्मज्ञं तथा मां पातु पावकः || 
যেহেতু আমি কর্মে, চিন্তায়, বাক্যে কখনো ধর্মজ্ঞ রাঘবের বিরুদ্ধাচরণ করি নাই, অতএব অগ্নিদেব আমাকে সকল দিক হইতে পরিত্রাণ করুন।

অষ্টবিংশতি শ্লোকঃ 
आदित्यो भगवान् वायुः दिशश्चन्द्रस्तथैव च ।
अहश्चापि तथा सन्ध्ये रात्रिश्च पृथिवी तथा ।
यथान्येऽपि विजानन्ति तथा चारित्रसंयुताम् ॥
যেহেতু ভগবান সূর্য, বায়ু, চন্দ্র, দিবা, সন্ধ্যা, রাত্রি, পৃথিবী সকলেই আমাকে সচ্চরিত্রা বলিয়া জানেন। 

উনত্রিংশতি শ্লোকঃ 
एवमुक्त्वा तु वैदेही परिक्रम्य हुताशनम् ।
विवेश ज्वलनं दीप्तम् निःशङ्केनान्तरात्मना ॥
এই বলিয়া বৈদেহী হুতাশনকে পরিক্রমা করিয়া নিঃশঙ্কচিত্তে একাত্ম মনে জ্বলন্ত অগ্নিতে প্রবেশ করিলেন। 

ত্রিংশতি শ্লোকঃ 
जनः स सुमहांस्तत्र बालवृद्धसमाकुलः ।
ददर्श मैथिलीं दीप्ताम् प्रविशन्तीं हुताशनम् ॥
তথায় উপস্থিত বিপুল সংখ্যক আবালবৃদ্ধজন মৈথিলীকে জ্বলন্ত হুতাশনের মধ্যে প্রবেশ করিতে দেখিল।

একত্রিংশতি শ্লোকঃ 
सा तप्तनवहेमाभा तप्तकाञ्चनभूषणा ।
पपात ज्वलनं दीप्तम् सर्वलोकस्य सन्निधौ ।
তপ্ত নবহেমবর্ণা তিনি তপ্তকাঞ্চন ভূষণে সজ্জিতা হইয়া সর্বজনের সম্মুখে জ্বলন্ত অগ্নিতে পতিত হইলেন। 

দ্বাত্রিংশতি শ্লোকঃ 
ददृशुस्तां विशालाक्षीम् पतन्तीं हव्यवाहनम् ।
सीतां सर्वाणि रूपाणि रुक्मवेदिनिभां तदा ॥
সর্বরূপা বিশালাক্ষী সীতাকে সকলে স্বর্ণবেদীর ন্যায় জ্বলন্ত অগ্নিতে পতিত হইতে দেখিল। 

ত্রয়োত্রিংশতি শ্লোকঃ 
ददृशुस्तां महाभागाम् प्रविशन्तीं हुताशनम् ।
सीतां कृत्स्नास्त्रयो लोकाः पुण्यामाज्याहुतीमिव ॥
ত্রিলোক দেখিল, মহাপুণ্যবতী সীতা পুণ্য ঘৃতাহুতির ন্যায় হুতাশনে প্রবেশ করিলেন। 

চতুর্তিংশতি শ্লোকঃ 
प्रचुक्रुशुः स्त्रियः सर्वान् तां दृष्ट्वा हव्यवाहने ।
पतन्तीं संस्कृतां मन्त्रः वसोर्धारामिवाध्वरे ॥
তাঁহাকে মন্ত্রপূত পবিত্র ঘৃতের ন্যায় অগ্নিতে পতিত হইতে দেখিয়া উপস্থিত সকল স্ত্রীগণ চীৎকার করিয়া উঠিল। 

পঞ্চত্রিংশতি শ্লোকঃ 
ददृशुस्तां त्रयो लोका देवगन्धर्वदानवाः ।
शप्तां पतन्तीं निरये त्रिदिवाद्देवतामिव ॥
তিন লোকের দেব, গন্ধর্ব, দানব সকলেই দেখিল, তিনি যেন অভিশপ্তা দেবীর ন্যায় স্বর্গ হইতে নরকের অগ্নিতে পতিত হইলেন। 

ষড়ত্রিংশতি শ্লোকঃ 
तस्यामग्निं विशन्त्यां तु हाहेति विपुलस्वनः ।
रक्षसां वानराणां च सम्बभूवाद्भुतोपमः ॥
তাঁহাকে অগ্নির গভীরে প্রবেশ করিতে দেখিয়া বানর এবং রাক্ষস সকলেই বিপুল হাহাকার করিয়া উঠিলে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির উদ্ভব হইল। 

ইতি ঋষি বাল্মিকী বিরচিত আদিকাব্য রামায়ণের যুদ্ধ কান্ডের ষোড়শোত্তর শততম সর্গ।


সোমবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২৪

উনিজি ~ অরিন্দম বসু

"চিত্ত যেথা ভয়পূর্ণ লুচ্চা যেথা বীর,
জ্ঞান যেথা শুষ্ক যেথা কারার প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
পেয়াদারা ভাবিতেছে আজ কাকে ধরি
যেথা কটুবাক্য নির্দয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
গোটা দেশে দিকে দিকে গুণ্ডাগণ ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চাটুকারিতায়
যেথা উচ্চবিত্তের ধনরাশি রাশি
বিচারের পথটিকে পুরোটাই গ্রাসি,
পৌরুষের সে কি স্পর্ধা, নিত্য যেথা
উনিজিই সর্ব কর্ম চিন্তনের নেতা,
নিজহস্তে নির্দয় আঘাত করি, বস
ভারতেরে সেই নরকে কোর না কো টস" 

মোহ ~ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

মোহ
আলপনা কাটা ছিল বাবুদের চাতালের মাঝে,
মনোরম ছবি, আহা, ঠিক যেন পিকাসোর আঁকা,
হিজিবিজি কারুকলা, আচমকা মুখ গোঁজা খাঁজে,
তার পাশে হাত, কান, নাভিমূল, খানিকটা বাঁকা।
সুন্দর আলপনা, তাও দেখি বাবু মাথা নেড়ে
রাগ ভরে বলে যান, হয়নি মোটেও কাজ ভালো,
ছবিতে দেখছি রাম, হনুমান, সীতা, সব ছেড়ে
মানুষের বাঁকা ছবি আঁকা আছে, তাও কিনা কালো?
রূপকার এই শুনে হেসে ওঠে, বলে, বাবু, শোনো,
জানো কি সীতার নাম, জানো কি সীতার কী বা মানে?
হাল চাষ দেখেছো কি? শুনেছো কি ইউ টুর বোনো?
দেখেছো কী ভাবে দালি ছবি আঁকে বুরুশের টানে?
আসলে, সব তো মায়া, সব মরীচিকা, স্থলে জলে,
ক্ষ্যাপা তাও ক্রমাগত পরশ পাথর খুঁজে চলে।
রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
(২২/০১/২০২৪)

রবিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০২৪

লেনিন কে নিয়ে কুৎসা ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

কুৎসা প্রচার টা কেউ কেউ আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আর সুলভ ইন্টারনেট ও গুগল বাবার দৌলতে এই উত্তর সত্য কালে কোনটা যে সত্যি আর কোনটা যে মিথ্যে সেটা ধরাও মুশকিল। আজকের দিনেও দেখলাম লেনিনের মারা যাওয়া নিয়ে সেই কুৎসা অব্যাহত। লেনিন নাকি সিফিলিসে মারা গেছিলেন। এই জাতীয় বক্তব্য পশ্চিমা গণমাধ্যমে অনেক সাংবাদিক, গবেষক, ঐতিহাসিক নানান সময়ে হাজির করেছেন এমনকি ইজরায়েল এর তিনজন ডাক্তার একটি প্রবন্ধও লিখে ফেলেছেন বৈজ্ঞানিক জার্নালে। এসব থেকে উৎসাহিত হয়ে আমাদের দেশেও একটি রাজনৈতিক দলের নেতা কর্মীরা বলে থাকেন যে "সিফিলিস"!! "যৌনরোগ"!! এমনকি সেই যৌনকর্মীর নাম অবধি বের করে ফেলেছেন কেউ কেউ। যথারীতি হোয়াটস এপ, ফেসবুক টুইটারে এসব গল্প ঘরে। এর একটা ফ্যাক্ট চেক দরকার। 

১৯১৮ এর তিরিশ আগস্ট ফানি কাপলান লেনিনকে লক্ষ্য করে তিনটি গুলি চালান। ব্রাউনিং পিস্তলের একটি বুলেট লেনিনের কোটের মধ্যে দিয়ে চলে যায়, একটি বুলেট লেনিনের বাম কাঁধে লাগে, তৃতীয় বুলেটটি লেনিনের গলার বাম দিক দিয়ে বাম ফুসফুসে প্রবেশ করে বেরিয়ে এসে ডান কলার বোন এ আটকে যায়। প্রচুর রক্তপাত হলেও গুলির আঘাতে লেনিন মারা যান নি। গুলি চালানো পরে লেনিনের অপারেশন হয়।

ওই হত্যা প্রচেষ্টা মামলার একজন সাক্ষীর বয়ান অনুযায়ী বুলেটগুলো বিষ মাখানো ছিল। থাকতে পারে, কিন্তু ফরেনসিক মেডিসিন অনুসারে ওই হাই টেম্পারেচারে ওই বিষ এর যা কেমিক্যাল চেঞ্জ হবে তাতে ওটা কাজ করার কথা নয়, করেও নি, লেনিনের শরীরে বিষক্রিয়ার কোনও লক্ষণ ছিল না। 

লেনিনের উপসর্গ শুরু হয় ১৯২১ সালে - মাথাব্যাথা, অনিদ্রা, মাঝে মধ্যে মাথা ঘুরে পরে যাওয়া। গোর্কিকে চিঠিতে লেনিন লিখছেন, "খুব ক্লান্ত লাগে। কিছুই করতে ইচ্ছে করে না।" 

২২শে এপ্রিল বিঁধে থাকা বুলেট বের করার জন্য লেনিনের অপারেশন হয়। এর পরে ১৯২২ সালের ২৬শে মে লেনিন প্রথমবারের জন্য স্ট্রোক বা মস্তিষ্কের পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। এফাসিয়া ও রাইট হেমিপ্লেজিয়া হয়। লেনিন আস্তে আস্তে সেরে ওঠেন। এর পরেও লেনিনের আরো দুটি স্ট্রোক হয় - ১৯২২ এর ডিসেম্বর ও ১৯২৩ এর মার্চ। শেষ পর্যন্ত লেনিন মারা যান ১৯২৪ এর ২১শে জানুয়ারি। 

বুলেট এর আঘাত নয়, লেনিন এর মৃত্যুকে ঘিরে যাবতীয় বিতর্কের মূলে ওই স্ট্রোক বা মস্তিষ্কের পক্ষাঘাত। এই পক্ষাঘাত এর কারণ খুঁজতে গিয়ে কেউ কেউ এই তত্ত্ব হাজির করেন যে ওই কারণটা হল সিফিলিস বা নিউরোসিফিলিস। এই তত্ত্বের মস্তবড় ফাঁক এটাই যে লেনিন যদি সত্যি সত্যি সিফিলিসে আক্রান্ত হতেন তাহলে শুধুমাত্র মস্তিক নয়, লেনিনের অন্যান্য অংঙ্গও ক্ষতিগ্রস্ত হতো। লেনিনের হৃদযন্ত্র বা হাড়ে সিফিলিস এর কোনও চিন্হ পাওয়া যায় নি। 

এই বিভ্রান্তির জন্য অপপ্রচারই কেবল দায়ী নয়, লেনিনের নিজের কিছু চিকিৎসকও দায়ী। ওই "অল্পবয়সে" লেনিনের স্ট্রোক হওয়ার কথা নয়, লেনিন ধূমপান করতেন না, মদ্যপান পরিমিত, হরমোনের কোনো অসুখ ছিল না, যথেষ্ট শক্ত সমর্থ ছিলেন ওভারওয়েট ছিলেন না, তাঁর সেরিব্রাল আর্টারিতে অমন পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়, তাই ডায়াগনোসিস হিসেবে কেউ কেউ নিউরোসিফিলিস এর কথা ভেবেছিলেন এমন কি সেই মতো চিকিৎসাও করেছিলেন। 

পরে প্রমাণিত হয়েছে যে রোগটা সিভিয়ার আথেরোস্ক্লরসিস। ধমনীতে পরিবর্তন, বিশেষ করে মস্তিষ্কের ধমনীতে। এই পরিবর্তন এতটাই ছিল যে অটোপসির সময়, সার্জেন বলেছিলেন যে ফরসেপস লাগাতে "ধাতব আওয়াজ হচ্ছে।" লেনিনের পারিবারিক হিস্ট্রিও আছে। একই রোগে ৫৪ বয়সে লেনিনের বাবাও মারা যান, আরো তিন ভাইবোন মারা যান। তাই জিনগত কারণেই অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সে লেনিনের ওই অসুখ হয়েছিল। তাতেই উনি মারা যান। 

এতদিন আগে মৃত এই বিপ্লবী এখনও বহু দক্ষিণ পন্থীদের হাড় মজ্জায় আতঙ্ক তৈরি করে। তাই লেনিনের সুনাম ধ্বংস করার এত আয়োজন। আমরা যদি একটু সজাগ থাকি তাহলে যে যেখানে পারি যেভাবে পারি এই চক্রান্তের প্রতিবাদ আমরা করতে পারি। লেনিন অমর হয়ে থাকুন আমাদের মননে। 

বড় হব কবে (পান্তুম) ~ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

বড় হব কবে

(পান্তুম)

সকলেই বসে ভাবে বড় হব কবে।
পিপীলিকা ডানা মেলে পাখি হতে চায়।।
বনসাই পাতা খোলে দেড় ফুট টবে।
কোলা ব্যাঙ কল ঘরে সা রে গা মা গায়।।

পিপীলিকা ডানা মেলে পাখি হ'তে চায়।
পাঁচ গজ উড়ে ভাবে, পৃথিবী কী বড়।।
কোলা ব্যাঙ কল ঘরে সা রে গা মা গায়।
কচি খোকা সেই শুনে ভয়ে জড়সড়।।

পাঁচ গজ উড়ে ভাবে, পৃথিবী কী বড়।
অথচ ওপরে তারো আকাশ অশেষ।। 
কচি খোকা সেই শুনে ভয়ে জড়সড়।
কোলে মুখ গুঁজে খোঁজে চেনা পরিবেশ।।

অথচ ওপরে তারো আকাশ অশেষ। 
নভচর উড়ে চলে ছোট পরিসরে।।
কোলে মুখ গুঁজে খোঁজে চেনা পরিবেশ।
নদী পারে আড় বাঁশি মেঠো সুর ধরে।।

নভচর উড়ে চলে ছোট পরিসরে।
কখনো বা বসে যায় ছাতিমের ডালে।।
নদী পারে আড় বাঁশি মেঠো সুর ধরে।
নিমেষেই মিশে যায় কোন মহাকালে।।

কখনো বা বসে যায় ছাতিমের ডালে।
ওড়ে ফের অজানা সে খেয়ালের টানে।।
নিমেষেই মিশে যায় কোন মহাকালে।
মৌমাছি গান গায় গোলাপের কানে।।

ওড়ে ফের অজানা সে খেয়ালের টানে।
ভোলা মন খোঁজে ফেরে পরশপাথর।।
মৌমাছি গান গায় গোলাপের কানে।
পাষাণের মন তবু কাঁপে থরোথর।।

ভোলা মন খোঁজে ফেরে পরশপাথর।
বনসাই পাতা খোলে দেড় ফুট টবে।।
পাষাণের মন তবু কাঁপে থরোথর।
সকলেই বসে ভাবে বড় হব কবে।।
.

~ রজত শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

(কলকাতা, জ্যানুয়ারি ২০১২)

শুক্রবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০২৪

অঞ্জন দত্ত ~ অমিতাভ গুপ্ত

ছেলেটা বাংলায় ৭০পেত। মাছ - ভাত ভালোবাসত। 

ছেলেটা রঞ্জনা নামের একটা মেয়েকে খুব ভালোবাসত।

ছেলেটা ভরদুপুরে সাইকেল নিয়ে রঞ্জনার পাড়ায়, রঞ্জনার বাড়ির সামনে এসে ঘুরপাক খেত - একবার বারান্দায় রঞ্জনাকে দেখবে বলে। 

ছেলেটা অল্প বয়সী ছিল, সদ্য প্রেমে পড়েছিল।

প্রেমে পড়ার সাহস থাকলেও, রঞ্জনার মেজদা'র কব্জির কারিকুরি মোকাবিলা করার সাহস ছিল না, নিজের ঠ্যাং হারানোর মত বুকের পাটাও ছিল না
ছেলেটার। 

ছেলেটা রঞ্জনাকে দুপুরে ঘুমানোর পরামর্শ দিয়ে, কোনো একটা নির্জন বিকেলে রঞ্জনার জীবন থেকে নিশ্চুপে  সরে গেছিল। আমরা অঞ্জন দত্তর গলায় শুনেছিলাম সেই অসফল প্রেমের গল্প। 

ততদিনে আমরা পা দিয়েছি কৈশোরের দোরগোড়ায়.... দেখে নিয়েছি ভেঙে পড়েছে সোভিয়েত রাশিয়া, উদার অর্থনীতি কড়া নেড়েছে আমদের দোরগোড়ায়... সুদূর অযোধ্যায় চোখের সামনে এক এক করে ভেঙে গেছে বাবরি মসজিদের তিনটে আস্ত গম্বুজ... সেই ধূলোয় ঢেকে গেছে গোটা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আকাশ। 

আবছা হয়ে আসছিল আমাদের চারপাশ; দমবন্ধ লাগছিল; খুব দ্রুত মসজিদের সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে যেত ছেলেরা, প্রাণপণে মন্দিরের রাস্তা এড়ানোর চেষ্টা করত একটা সম্প্রদায়। 

আমরা আরো একটু বড় হলাম, জিভের তলার কষাটে স্বাদটা আরো একটু বাড়ল... সুদূর গুজরাটের গোধরার একটা পোড়া কামরার গন্ধ কিভাবে যেন চারিয়ে গেল গোটা দেশটায়। অবাক হয়ে দেখলাম, ভোটার লিস্ট ধরে মুসলমান খুন করা একজন নেতা আবার যখন মসনদে বসেন, আমার বাংলা থেকে তাকে হলুদ গোলাপের তোড়ার মোড়কে বন্ধুত্বের ইঙ্গিত পাঠান বাংলারই এক নেত্রী.... 

শিখ দাঙ্গা - বাবরি মসজিদ ভাঙার কলঙ্কিত অধ্যায় - গোধরার লজ্জার মধ্যেও যেখানে আমার বাংলায় একটাও লাশ পড়ে নি, সেখানেই কোথাও খুব সংগোপনে চাষ হচ্ছিল বিষবৃক্ষের। 

রঞ্জনার মুসলিম প্রেমিক হারিয়ে গেছে... কোথায় গেছে আমরা কেউ জানি না... রঞ্জনাও হয়ত আজ কারো গৃহিণী... ওর মেজদাদা হয়ত কাল বা পরশু ট্রেন ধরবে অযোধ্যার উদ্দেশ্যে... 

রাম বাড়ি পাবেন ২২তারিখ... 

ধন্যবাদ অঞ্জন দত্ত, আজ আপনার জন্মদিন, আপনি আমাদের কিশোরবেলাতেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আগামী ভারতের ছবিটা... 

আমরা বুঝি নি - দোষ আমাদের।

মঙ্গলবার, ১৬ জানুয়ারী, ২০২৪

সিঙ্গুরে বিপ্লব ~ সৌম্য চট্টোপাধ্যায়

কোলকাতা থেকে গাড়িতে সিঙ্গুরের রাস্তা গুগল ম্যাপে দেখায় দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে। যে সময়ের কথা বলছি, তখন ২০০৮ এর সেপ্টেম্বর মাস।পুরো দেশ, হুগলির সিঙ্গুরের দিকে তাকিয়ে, জমি আন্দোলন তুঙ্গে। ন্যাশানাল হাইওয়ে অবধি যখন তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শয়ে শয়ে ট্রাক চুপচাপ দাঁড়িয়ে, এখানে ওখানে টায়ার পোড়ানো, রাস্তায় বিভিন্ন জায়গা আটকে, যে পারছে শুয়ে-বসে পড়ছে।বোম্বে রোডের ঝামেলা বাইপাস করে সিঙ্গুরে আসার অন্য রাস্তা হচ্ছে জিটি রোড ধরে সোজা শেওড়াফুলি- বৈদ্যবাটী, সেখান থেকে তারকেশ্বর রোড। এভারেস্টের যেমন বেস-ক্যাম্প হয়, তেমনি স্ট্যালিনগ্রাদ সিঙ্গুর যাবার বেস-ক্যাম্প হলো শেওড়াফুলি। 

ফাঁড়ির মোড়ে, বৈদ্যবাটী চৌমাথায় আকছার ইটিভি বা আজতকের গাড়ি দাঁড়িয়ে। গলায় ব্যাজ ঝুলিয়ে রিপোর্টার পরোটা খাচ্ছে, কোল্ড ড্রিঙ্কস কিনছে।ফাস্ট-ফুডের দোকানের বেঞ্চে খদ্দরের পাঞ্জাবী, লিনেন শাড়ি, অক্সিডাইজড জুয়েলারি পরা বিপ্লবীদের দল। শান্তিতে গোল্ডফ্লেক কিংসটা শেষ করে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেবেন। প্রণয় রায় ন্যাশানাল টেলিভিশানে বললেন, মনে রাখবেন, হুগলীর এই ছোট্ট গ্রাম ঠিক করে দেবে জমির অধিকার কার! এরকম আনন্দমেলার কমিকস পড়তাম, এস্টেরিক্স-ওবেলিকস, গলেদের ছোট্ট গ্রাম, রোমানরা ঘিরে ফেলেছে, কিন্তু এই গ্রাম লড়ছে। সিঙ্গুরও তাই, চারিদিকে লোভী বুর্জোয়ারা জিতে গিয়ে কোকা-কোলা খাচ্ছে। বিবেক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একা সিঙ্গুর, এযুগের লেনিন সাদা শাড়ি পরে ধর্নায় বসে।  
  
এনডিটিভির রিপোর্টার সেদিন যেখানে দাঁড়িয়ে ন্যাশানাল টেলিভিশানে লাইভ এসেছিলো, সেটা সিঙ্গুর ছিলো না, শেওড়াফুলি ছিলো, চৈতালি সঙ্ঘ ক্লাবের সামনে।তার পাশে আমরা আড্ডা মারতে যেতাম। আমার এক বন্ধু আজো দাবী করে ন্যাশানাল টেলিভিশানে তাকে দেখিয়েছিল, স্ট্যালিনগ্রাদ সিঙ্গুরে ক্যাপিটালিস্টদের চোখে চোখ রেখে, সে হাফপ্যান্ট পরে বিড়ি খাচ্ছে।অক্টোবরের ৩ তারিখ, ২০০৮, দিনটা স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন রতন টাটার কলকাতায় প্রেস কনফারেন্সে টাটাদের পাততাড়ি গোটানো কনফার্ম হয়েছিলো। 

স্টেশান থেকে বেরিয়ে ওষুধের দোকানে দাঁড়িয়েছি যখন, দেখি জিটি রোড বন্ধ করে বিজয় মিছিল হচ্ছে। মিছিলের শেষে একটা রিকশায় লাল ভেলভেটের জামা পরে একটা ছেলে কীবোর্ডে "সাত সমুন্দর পার ম্যায় তেরে পিছে পিছে আ গ্যয়ি' বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে, সামনে ড্রাম বাজাচ্ছে আরো কয়েকটা লাল ভেলভেট। ব্যাঞ্জো থেমে গেলে, মাইকে ঘোষণা হয় আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সিঙ্গুর থেকে শেওড়াফুলি আসছেন মহাশ্বতা দেবী, মেধা পাটেকার সবাই। উত্তেজনা তুঙ্গে। শেষ সেলেব নাম ঘোষণা হয়, অপর্ণা সেন। মিছিলের জনতা ফুটছে পাগলা আনন্দে, মনে হচ্ছে দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস। 

সেই নাম ঘোষণার পরেই সেদিন শনি-মন্দিরের সামনে ফলের দোকানদার তপাদাকে ফেলে পেটানো হয়, ছোট্ট ঘটনা বলতে পারেন। বিপ্লবে তো তাই হয়, বুর্জোয়া মার খায় ইত্যাদি প্রভৃতি।  বড় পিয়ারা আর নাসপাতিগুলো তপাদার দোকানে সাদা ফোমের নেটে জড়ানো থাকতো। মেরে যখন তপাদার মাথাটা ড্রেনে ঢুকিয়ে দিয়েছে, জল থেকে বিজগুড়ি কাটছে শ্বাসটুকু, তপার মাথার পাশেই ড্রেনের জলে ক্যাম্বিস বলের মতো ভাসছে ইয়া বড়ো বড়ো পিয়ারা। রিকশার লাল ভেলভেটের জামা বাজাচ্ছে, 'ও জুলফি মেরী জাআন, তেরে কাদমো কে নীচে আ গাই, ও ও সাত সমুন্দর...'। মেধা পাটেকার, মহেশ্বতা দেবী সেদিন আসেননি। অপর্ণা সেনও না। আসার কথাও ছিলো না মনে হয়। 

পরের দিন শাসক, মানে তখনকার শাসক, সভা করে বলেছিলো, আমরা জবাব দেবো, ভুলবো না একদম, এইসব আরকি। যিনি বলেছিলেন, তিনি একমাস পরে দলবদল করেন। ভদ্রলোক বলতেন ভালো। বিরোধী দলে, মানে তখনকার আরকি, গিয়ে গ্রামীণ সাবঅলটার্ণদের উত্থান, ভদ্দরলোকেদের এলিটিজমের পতন, উচ্চবর্ণের বাবুদের উঁচু-নাক তিনি দেখেছেন, এসব বলতেন। হাততালিও পেয়েছেন মন্দ না। সেইদিনটার তেরো বছর পর, ৩১শে জানুয়ারী, ২০২২, রাজ্য সরকার সিঙ্গুরের জমিতে মাটি কেটে ভেড়ি বানিয়ে চারাপোনা চাষের সিদ্ধান্ত নেয়। 

জানি না এই লেখা কি করে শেষ করবো, কথায় কথা আসে হইহই করে। ফেসবুকে এরকম লেখা মুশকিল, ফেসবুক বড় লেখার জায়গা না। এই লেখাতে কোন গন্তব্য নেই, এইরকম বহমান লেখা ফেসবুকের পোলারাইজড স্পেকট্রামে দাঁড়াতে পারে না। সোশ্যাল মিডিয়া এনগেজমেন্টে বেঁচে থাকে। কিন্তু সবদিন একটা শোম্যানশিপ, প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারি থেকে লেখা আসে না, কিছু লেখা শুধুই কথা বলার জন্য। যেটা বলে শেষ করি, তপাদার ছেলে পলিটেকনিক করে বাইরে থাকে জানতাম। কাল পাড়ার হোয়াটসয়াপ গ্রুপে জানলাম মুম্বাইয়ের অটল সেতুর কাজে যুক্ত ছিলো বেশ কয়েকবছর। আর নিতান্ত কাকতালীয় ভাবে, কদিন আগেই দেখলাম, সেই জ্যেঠু পোস্ট দিয়েছেন ইউক্রেন না প্যালেস্টাইন কোথায় একটা অত্যাচারের বিরুদ্ধে, ক্যাপশানে, মানুষের এতো কষ্ট ...সব ইয়াদ রাখ-খা জায়গা। 

না হে জনাব, কিছুই কেউ ইয়াদ রাখে না, ওরকম শুধু বলতে হয়, শুধু আমাদের বয়স বেড়ে যায়। কারুর ছেলে ব্রিজ বানায়, বন্দর বানায়। কেউ মাছের ভেড়ি আর চব্বিশ পরগণায় বাগানবাড়ি কিনতে থাকে, কিনতেই থাকে। আর আমি ১৫টা বছর পার করে হাসির গল্প লিখতে বসি।সোফায় বাদামী চশমা পরে বিবেক সেজে অপর্ণা সেনকে এনে বসাই। সেদিনের মতো, আজো ওনার আসার কথা নয়, তাও আসতে বাধ্য হন। 

আমি দেখি আমার টাইমলাইন জুড়ে মানুষ হাসছে, হাসতেই থাকছে।
সব রম্য নির্মল নয়। কিছু রম্য ব্যঙ্গ।

সোমবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২৪

ইনসাফ ব্রিগেড ~ অবিন দত্তগুপ্ত

সাংবাদিক - জমায়েত দেখে খুশি তো মীনাক্ষী?
মীনাক্ষী - সংখ্যার থেকেও বেশি খুশি মেজাজ দেখে।
সাংবাদিক - শুধু মেজাজ দিয়ে হয় নাকি। সংখ্যা কি বেশি গুরুত্বপূর্ন নয়?
মীনাক্ষী - একেবারেই না। কিউবার বিপ্লব শুরু হয়েছিল ৫০ জনের থেকেও কম লোক নিয়ে। কিন্তু মেজাজটা ছিল। 
সাংবাদিক - সেই মেজাজটা দেখলেন?
মীনাক্ষী - কুচবিহার থেকেই দেখছি। আজকে সারা মাঠ জুড়ে সেই মেজাজকেই দেখলাম।

এটা মেজাজ অথবা সংখ্যা, এসব কিছুই নয়। ভবিষ্যতের ছবি।


শনিবার, ৬ জানুয়ারী, ২০২৪

মাল, চাট ও কলকাতা ~ মানস নাথ

কলকাতার বার বা মদের ঠেকগুলো নিয়ে নানা কারুকার্যময় গালগল্প, মিথ ঘুরে বেড়ায় রসিক সমাজে। এই সব গল্প ঠেক আড্ডার একটা নিজস্ব জগৎ আছে।এই ঠেকগুলোর আছে নিজস্ব ডাকনাম বা আদরের নাম।  এক দাদার হাত ধরে ভবানীপুরের গ্রীন প্যালেস বারে যাওয়া থেকে সেই জগতে আমার এন্ট্রি। তবে আজকে মদের নয় চাটের গল্প বলতে ইচ্ছে করছে।
নেশাড়ু সার্কিটে গ্রীন প্যালেস বার জিপি নামেই পরিচিত। সেখানে মালের সাথে ফ্রিতে বারের তরফ থেকে চাট ছিল এক বাটি কম মশলার সাদা চানাচুর,ভিনিগারে চোবানো পিঁয়াজ আর সরু সরু করে কাটা আদার সাথে বিটনুন। প্রতি পেগ অর্ডারের সাথে চানাচুরটা রিপিট হত। আমি তখন একপেগ রাম নিয়ে টেবিলে বসে থেকে দাদাদের মুখের গল্প শোনার পাবলিক। এক বয়স্ক নেপালী ওয়েটার ছিল জিপিতে। সবাই তাকে সাথীদা বলে ডাকত। তিনি আমাকে এক প্লেট চানাচুর এক্সট্রাই দিতেন।
উল্টোদিকে যদুবাবুর বাজারের উপরে তৃপ্তি বার। একটা সরু প্রায়ান্ধকার গলি দিয়ে ঢুকে মান্ধাতার আমলের মচমচে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে পৌছাতে হয় সেই গুহায়। বড় বড় রাস্তার ধারের জানালা আর গোল গোল শ্বেতপাথরের টেবিল। দাম বেশ সস্তা। তবে বিটনুন আর আদা ছাড়া চাটে আর কিছু দিত না তখন।আলু কাবলি পাওয়া যেত, সেটার পরিমান দুজনের পক্ষে যথেষ্ট। 
    ঠেকের মধ্যেই রকমারি চাটের দোকান সাজিয়ে বসতে দেখেছি খালাসীটোলায়। যাকে বন্ধুরা কেত মেরে কেটি বলে ডাকত। খাঁচার আড়ালের কাউন্টার থেকে বোতল কিনে নিয়ে এসে টেবিলে বসতে হত। এবারে পাশেই সারি দিয়ে লাগানো চাটের দোকান থেকে ইচ্ছামত খাবার কিনে নিয়ে এসো। রকমারি মাছ ভাজা... এমনকি আমি কাতলা মাছের মুড়ো ভাজাও দেখেছি!  কারা মাছের মাথা দিয়ে মদ খায় কে জানে!  চিকেন, খাসির ছাঁট, মেটের তরকারি সাজানো থাকত। আলুকাবলি, চানা, ছোলা এসব তো ছিলই। শুঁটকি মাছের রসা অব্ধি দেখেছি! আমি যদিও দু তিনবারই গিয়েছি কেটিতে। তারমধ্যে একবার শর্মিদির সাথে কবি ফাল্গুনী রায়ের উপর একটা ডকু ছবির শুটিং করতে গিয়ে খুব মজা হয়েছিল। সে অন্য গল্প। 
    অলিপাবে মদ খেতে গিয়ে প্রথম খেয়েছিলাম বিফ স্টেক। আমার খুব একটা সুবিধার লাগেনি যদিও ; আর ছিল চিকেন আলা কিয়েভ। ছুরি দিয়ে কাটলেই এত্তটা গলানো মাখন বেরিয়ে পড়ে! তবে চাটের প্যারাডাইস হল গিয়ে ধর্মতলার মেট্রোগলির শ বার। সন্দীপনের লেখাতে পড়েছিলাম তারা সেই বারের নামকরণ করেছিলেন ছোটা ব্রিস্টল। সন্দীপনের মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন শ বারের গেট দিয়ে ঢুকে বাঁ হাতের নোটশবোর্ডে ওনার ছবি সহ শোকবার্তা ঝুলতে দেখেছি।এখানে ওয়েটারের কাছে আগে পয়সা দিয়ে টেবিলে বসতে হয়! একসাথে তিন চারটে টেবিলের গোটা পনেরো গ্লাস ওয়েটার একের উপর এক সাজিয়ে একসাথে ব্যালেন্স করে নিয়ে আসে আর প্রত্যেকের সামনে অর্ডার অনুযায়ী নামিয়ে রাখতে থাকে!  আমি প্রতিবার ভাবি কার কোনটা গ্লাস মনে রাখে কী করে!! তবে শ বারের আসল মজা হল রানিং চাট এর পসরা। ট্রেতে সাজানো চাটের প্লেট নিয়ে টেবিলের পাশ দিয়ে ঘুরতে থাকে বিক্রেতারা। রকমারি সিজিনের ফল থেকে নানা রকমের ভাজাভুজি, বাদাম, ছোলা, মটর থেকে চিজ।  মাছ এবং মাংসের বিভিন্ন পদ থেকে মেটে চচ্চড়ি অব্ধি। আর দামও বেশ সস্তা। অনেকে উল্টোদিকের টিপু সুলতান মসজিদের গলি থেকে বিফ শিক কাবাব নিয়ে আসত ঠোঙায় করে। 
    মধ্য কলকাতার বিভিন্ন বারের মধ্যে এককালে মন্টি কার্লোর কথা সবাই বলত মৌরলামাছ ভাজা খাওয়ার জন্য। ইদানীং তার অবস্থা ভাল নয়। পাশের চাংওয়া অবশ্য পর্দাঘেরা কেবিনের জন্য বিখ্যাত।মদের সাথে পর্দার আড়ালে চুমু খেয়েই পেট ভরে যায়। চাট নিয়ে আর ভাবার টাইম থাকে না। সেন্ট্রাল বারে মালের সাথে ধোঁয়া ওঠা ছোলা সেদ্ধ চাট হিসাবে টেবিলে আসে সাথে আসে আদা বিটনুন,জলজিরার বাটি! তবে ইদানীং কালে সবচেয়ে বেশি ক্রেজ ব্রডওয়ে বার নিয়ে।ফেসবুকের চেনাজানাদের মিলনমেলা এখন ওখানেই। ওখানকার একটা চাটের খোঁজ দিয়েই আজকের গল্প শেষ করব। 
    ব্রডওয়ের মেনুকার্ড হাঁতড়েও আপনি সে পদটির সন্ধান পাবেন না। গুরু ধরতে হবে, জানতে হবে। পাশেই আনন্দবাজার এর অফিস,তাদের অনেকেরই নিত্য আনাগোনা ব্রডওয়েতে।আমিও এক আনন্দবাজারের কর্মীর থেকেই সেই গুপ্তধনের আর তার দরজা খোলার চিচিং ফাঁক মন্ত্রের খোঁজ পেয়েছিলাম। আপনারাও পরেরবার গিয়ে এ্যাপ্লাই করে দেখতে পারেন।ফ্লোর ম্যানেজারকে ডেকে বলতে হবে আজ ভালো ভেটকি এসেছে? উনি যদি একগাল হেসে সম্মতি দেন তাহলে বলতে হবে,  এক প্লেট মাস্টার্ড ফিস বানিয়ে দেওয়া যাবে কী?  উনি রান্নাঘরে ঘুরে এসে যদি মুন্ডি হেলিয়ে যান তাহলে নিশ্চিত জেনে রাখুন আপনার দিনটা ভালো হয়ে গেলো। তবে যদি ফিরে এসে বলে স্যার মাস্টার্ড চিকেন বানিয়ে দেবো?  তবে আপনার ইচ্ছা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাবেন কিনা।

    আমার এক বান্ধবীর সাথে বারকয়েক ব্রডওয়েতে মাস্টার্ড ফিস খেয়ে এই পদটির প্রেমে পাগল হয়ে যৌথভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নি এটা একদিন বাড়িতে বানিয়ে দেখতেই হবে কতটা ধারেকাছে আসে। সেইমত বাজারে আসল কলকাতা ভেটকি কিনতে গিয়ে জোর ধাক্কা খাই। বিয়ের সিজিন, বেটাচ্ছেলে গোটা মাছ ছাড়া বেচবে না!  শেষে বাধ্য হয়ে দুজনের মত ভোলা ভেটকি নিয়ে আসি। কম্পোমাইজময় মধ্যবিত্ত জীবন শালা। কোন রেসিপি ছিল না, স্বাদের অভিজ্ঞতা থেকে রাঁধা। তাই আমিও কোন রেসিপি লিখছি না। আমার বান্ধবী রন্ধনে দ্রৌপদী না হলেও কাছাকাছি। ভালোই নামিয়েছিল পদটা, ছবি দিলাম। সাথে ব্রডওয়ের মাস্টার্ড ফিসের ছবি দিলাম।

বৃহস্পতিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২৪

একটা মেঠো প্রেমের গল্প ~ শেখ ফইজুল অালম

একটা মেঠো প্রেমের গল্প........ ‌💘
এটা ওদের কম বয়সের ছবি, চোখ মুখ দেখুন। কি উজ্বল, ঝকঝকে, বুদ্ধিদীপ্ত! ওরা নাটক করতো। করতো কারন, ছেলেটি অার বেঁচে নেই। মেয়েটি ছেলেটির স্মৃতি অাঁকড়ে বয়সের ভারে ক্লান্ত। অাজ একটু পরে ওদের কম বয়সের একমাত্র প্রেম ওদের নাটক ওরা করবে গাজিয়াবাদের সাহিবাবাদে, ঝান্ডাপুর এলাকায়।
পিছিয়ে চলুন তিন দশক, মনে করুন অাজ ১৯৮৯ সালের ১লা জানুয়ারী। ওরা রাস্তায় নাটক করে। সাধারন মানুষ, খেটে খাওয়া মজুর, দোকানি, পথচলতি মানুষ ভীড় করে দেখে সে নাটক। ওরা নাটকে শোষনমুক্তির কথা বলে। নাটকের নাম তাই " হল্লা বোল "। গাজিয়াবাদ পৌরসভার র্নিবাচনে ওরা খেটে খাওয়া মানুষের জোট কে অারো শক্তিশালী করতে চায়। সফদর হাসমি অার মলয়শ্রী। নাম দেখে আবার ধর্মের নিক্তি বার করবেন না যেন! বরং ভালোবাসার গল্পটা শুনুন অাজ অাপনার এই ফুর্তির দিনে, মন ভালো হবে। ‌♥️
নাটক শুরু হতেই ভীড় জমে গেল। বেশ জমে উঠছে নাটক এমন সময়ে স্থানীয় এক রাজনৈতিক মাফিয়া মুকেশ শর্মা অার তার দলবল ঝাঁপিয়ে পড়লো নাটকের উপর। বোমার পর বোমা, রড়, লাঠি চলতে লাগলো। সফদরকে ওরা ফেলে রড়, লাঠি দিয়ে মারতে লাগলো। মলয়শ্রী, অন্য সহকর্মীরা অাপ্রান বাঁচাতে চাইলো ওকে। জনতা ছত্রভঙ্গ। সফদর মারা গেছে ভেবে ঘাতকরা তাদের কাজ সেরে চম্পট দিলো। তাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো সবাই। না, জ্বলজ্বলে চোখের ছেলেটি বাঁচেনি। পরদিন চলে গেল মেয়েটিকে একা রেখে। মেয়েটি শ্রমজীবি মানুষের কাঁধে চড়ে অন্তিমের পথে যেতে দেখেছিলো তার ভালোবাসাকে। ‌🔥
সেদিন মেয়েটি কান্নায় ভেঙে পড়েনি। প্রতিটি স্রষ্টার কাছে সৃষ্টি যেমন সন্তানসম তেমনি ওদের সন্তান নাটক কে যে সম্পুর্ন করতে হবে। শ্রেনীশত্রুর চোখে চোখ রেখে যে বলতে হবে... " এ দেশ তোমার লুঠের জন্য নয়! "
তারপর মাত্র দুদিনের অপেক্ষা, মেয়েটি তাদের সৃষ্টি, তাদের ভালোবাসা কে মঞ্চস্থ করলো ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ওই একই জায়গায়, একই সময়ে! হ্যাঁ, মঞ্চ.... রাস্তাই যে ওদের মঞ্চ।
সে রাস্তায় ছিল সেদিন মেহনতি মানুষের অধিকারের গর্জন........ 🛑
" জব ইনকিলাব কি ঝান্ডা লহরায়েগা....
তব না কৌই সফদর নুক্কড় পে মারা যায়েগা...." ‌
ভালোবাসা শুধু পার্কস্ট্রিটে, সিটি সেন্টারে গুনগুন করেনা। কান পাতো, সে অাওয়াজ তোমার হৃদয়ে। খালি সোচ্চারে বলতে শেখো সে ভালোবাসার কথা...." হল্লাবোল ভাই হল্লাবোল "‌🔥
৩০ বছর পরে সফদরের নামটাই হয়তো জানে না আজকের প্রজন্ম। কিন্তু যাঁদের কাছে বর্ষবরণ শুধুমাত্র আনন্দের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেওয়ার নয়, কিংবা যাঁরা সেই দিনটিতেও জীবনের সেই চরম সত্যটা ভুলতে পারেন না যে সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ বর্ষবরণের রাতে ঘুমোতে গিয়েছেন ভুখা পেটে! অন্তত সেই মানুষগুলির কথা ভেবে আজ অন্তত একবার স্মরণ করুন সফদর হাসমি আর মলয়শ্রী জুটিকে, ওদের অনবদ্য প্রেমকে ! ♥️
মূল রচনা: শেখ ফইজুল অালম
ভাষান্তর ও সম্পাদনা: স্বপন সেন

রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩

পাকী তিন পোয়া হুইস্কি ~ সোমা ব্যানার্জী

কয়েকদিন জ্বরের ঘোরে পড়েছিলাম। আর আট ভাট কত কথাই ভাবছিলাম। কেন জানিনা কফি হাউজের ভেটকির কথা খুব মনে পড়ছিল। আমি তখন ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কোন এক দাদা যেন ভেটকিকে দেখিয়ে আমাকে বলেছিলো, ওই দেখ ভেটকি, কফি হাউজের মহাপুরুষ। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মদ খায়। বাকি সবার সঙ্গেও মদ খায়। মাঝে লিভারটা একটু খারাপ হয়েছিল। তাই এখন লিভ ফিফটি টু  দিয়ে মদ খায়। ভেটকিকে দেখেও যেন মনে হল দ্রব্যগুণেই আছে। চোখ মুখে সামান্য একটু লালচে আভা, যেন ঝামরে জ্বর আসছে। আমি মানসচক্ষে দেখতে পেতাম যে ভেটকি এক মনে মদ খাচ্ছে আর তার পাশে রাখা আছে চাটের বদলে একটি লিভ ফিফটি টু এর কৌটো। বিগড়ে যাওয়া মেটে, রগড়ে ঠিক করে নেওয়ার জন্য গম্ভীর মুখে, কয়েক চুমুক মদের পরেই একটি করে ট্যাবলেট গলাধঃকরণ করছে সে।

আমার তখন বাস্তবে মদ খাওয়া নিয়ে ধারণা খুব একটা স্পষ্ট ছিলো না। মদ খাওয়া যা দেখেছি সব সিনেমায়। বাবার কাছে বরাবর শুনেছি যারা মদ বা সিগারেট খায় তাদের চরিত্র খুবই খারাপ হয়। আর যে সব মহিলারা ওইসব খায় তাদের সম্পর্কে তো ইয়ে, যত কম বলা যায় ততই ভালো! হাউজে কিছুদিন আসার পর, টেবিলে এর ওর থেকে সিগারেট চেয়ে দু-এক টান দিয়ে দেখলাম। ভালোই লাগলো। আমার চরিত্র কেউ টান মেরে ধরে হিড় হিড়  করে অনেক নিচে নামিয়ে নিয়ে গেল বলে তো মনে হলো না। বরং স্বামী বিবেকানন্দের মতো জিজ্ঞাসু মনে এর তার হুঁকোয় পরীক্ষামূলক টান মেরে দেখা হল জাত যায় কিনা। পরীক্ষার ফলাফল? দেখা গেল আমার মন পবিত্র হলে কি হবে আশেপাশের ছেলেরা খুবই হিংসুটে। দু'দিন যেতে না যেতেই তারা বললো তুই তোর সিগারেট কিনে খা! আমারটা দেব না, ইত্যাদি। 

তবে কফি হাউজের নিভে আসা মরা মরা আড্ডায় সবসময় দেখতাম মাতালদের নিয়ে চুটকি বলা হতো। ডজন খানেক এইধরণের চুটকি সব টেবিলেরই হট ফেভারিট ছিল। আড্ডার মরা আঁচে ফুঁ দিতে, বহু ব্যবহৃত ক্লিশে চুটকি গুলো কিন্তু বেশ কাজে দিত! মাঝে মাঝে ওই সবকটা জোকস পুনরায় বসে শোনবার ভয়েও লোকজন তাড়াতাড়ি উঠে বসে কথা শুরু করে দিত! ছেলেরা কোথাও তিনদিনের জন্য বেড়াতে গেলে ফিরে এসে সাতাশ দিন ধরে তার গল্প শোনাত। এক দিন বলতো বেড়াতে গিয়ে কি কি দেখেছে, আর ছাব্বিশ দিন ধরে বলতো কে কে মদ খেয়ে কি কি বিচিত্র আচরণ করেছে! এইসব খিল্লির ফার্স্ট হ্যান্ড অভিজ্ঞতা থেকে আমরা মেয়েরা বঞ্চিতই রয়ে যেতাম। কারণ বাড়ি থেকে কোনোভাবেই অনুমতি পাওয়া যেত না বেড়াতে যাওয়ার। একদল ছেলের সঙ্গে চার-পাঁচ দিন টানা বেড়াতে যাওয়ার প্রসঙ্গ তোলাই যেত না বাড়িতে। আমার বাড়িতে তো একটা একদিনের পিকনিক যাওয়ার জন্য অনুমতি নিতে যা পরিশ্রম করতে হতো, যে আসল পিকনিকের দিনটায় আমার খুব ক্লান্ত লাগতো। মনে হতো গাছতলায় শুয়ে একটু  বিশ্রাম নিই। বা এইসব তুশচু হাসি ঠাট্টা খাওয়া দাওয়ার প্রলোভন পরিত্যাগ করে বানপ্রস্থে চলে যাই। চিত্রকূট পাহাড়ে গিয়ে দুর্বাসা মুনির পেছনে লুকিয়ে থাকি। যে শালা আমাকে খুঁজতে আসবে সে ভস্ম হয়ে যাক বা হাফ ডজন অভিশাপের গুঁতোয় ধরাশায়ী হোক!

যাই হোক, বহু ক্লাস মিস করে, গভীর মনোযোগ সহ সব বেড়ানোর গল্প শুনে, ভালো রেজাল্টের আশা অলকানন্দার জলে ভাসিয়ে দিয়ে, আমি আমার চেনা বন্ধুদের মনে মনে কিছুটা ক্লাসিফাই করতে শুরু করি। প্রথম দল ছিলো চার আনার খেয়ে আট আনার নাটক করা টাইপ। এই দলে সবার আগে নাম ছিল বোধহয় বুম্বা আর কামুর। এরা শক্ত পানীয় দু তিন চুমুক খেয়েই, নিজ নিজ বন্ধুবৃত্তে নিজেদেরকে হলমার্ক যুক্ত 'আসল মাতাল' প্রমাণ করার জন্য মহা উৎসাহে ড্রামা আরম্ভ  করতো। টিভির সব ঝুল সিরিয়ালে এবং হলে সব হিট সিনেমায় মাতালদের যা যা করতে দেখেছে সবই এক এক করে করত এরা। কিছুই বাদ যেত না।

এদের ঠিক বিপরীত মেরুতে ছিল আরেকটি দল। এরা অনভ্যস্ত শরীরে কিছু পরিমাণ অ্যালকোহল ঢোকায় মাথা ভোঁ ভোঁ করলেও কিছুতেই তা স্বীকার করত না।  কিচ্ছুটি হয়নি ভাব দেখিয়ে, নির্লিপ্ত মুখে ঘরের এক কোনায় একটি চেয়ারে চুপ করে বসে থাকতো। হঠাৎ করে 'একটু আসছি' বলে বাইরে গিয়ে বমি করে আবার এসে অম্লানবদনে বসে থাকতো। 'কিছুই হয়নি'র প্রমাণ স্বরপ মাঝে মাঝে স্মিত হেসে 'পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ' আবৃত্তি করে শোনাতো। তিন চার লাইন আবৃত্তির পর যেখানটাতে হোঁচট খেত, সেখানে থমকে গিয়ে আবার গোড়া থেকে শুরু করতো। তারপর কেমন একটা লুপে পড়ে যেত। এটা মোটামুটি চলতেই থাকতো।

আর একদল ছিল যারা নিজেদের মস্ত বড় কনোসার ভাবতো। কোনরকম লঘু ক্রিয়া-কলাপ বা বালখিল্যের মধ্যে এরা নিজেকে জড়াতে অপছন্দ করতো। এরা এসে থেকে আকাশে নাক তুলে বসে থাকতো আর বলতো, এই তোরা যে যা পারবি খেয়ে নে। দেখি কার কতটা দম আছে। একটু পরেই অ্যামেচারের দল কাত হয়ে গেলে এরা গম্ভীর মুখে নীলকন্ঠ অবতারের মতন এসে যেখানে যা মদ পড়ে আছে সব ঢক ঢক করে অনায়াসে খেয়ে শেষ করে ফেলত। তবে এরা নিজেদের যোগ্য সম্মান পেতো না দলের কাছে। এদেরকে সবাই ব্লটিং পেপার বলে ডাকতো। অথবা স্পঞ্জ।

এইসবের বহু বছর পরে আমি বাচ্চা নিয়ে সুকল্পদের সাথে বেড়াতে গিয়ে মোনালিসার অভিজ্ঞতা শুনি। সেটা এখানে না বললেই নয়। বিয়ের আগেই সুকল্প তার প্রেসিতে পড়া মিষ্টভাষী হবু স্ত্রীকে বলে নিয়েছিল, আমি কিন্তু বেড়াতে গেলে মদ খাই। মোনালিসা বেচারা এতে দোষের কিছুই দেখতে পায়নি । সে সোনামুখ করে আচ্ছা বলেছিল। বিয়ের দু এক মাস বাদেই সুকল্প বলে চলো, বেড়াতে চলো। তারপর সুকল্প তার তিরিশজন বন্ধুর বিশাল দলে বউ নিয়ে মহাসমারোহে দীঘা ঘুরতে গেল।
সকালবেলায়  বন্ধুদের নিয়ে সমুদ্রে চান করতে গেল। গেল তো গেল, আর ফেরার নাম নেই!  উদ্বিগ্ন মোনালিসা  তখন জনে জনে জিজ্ঞেস করতে থাকলো, হ্যাঁ গো, আমার বর কোথায়? অধিকাংশই টইটুম্বুর মদ খেয়ে ওকে পাত্তাই দিলো না। পরে, কে একজন মায়া করে আঙুল দেখিয়ে বলে দিল, ওই তো আসছে। সেদিকে তাকিয়ে মোনালিসা কিছুই দেখতে পেল না। তারপর সেদিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখতে পেল সুকল্পকে চ্যাংদোলা করে আনা হচ্ছে। হুঁশ নেই। বিকেলবেলায় মোনালিসা সুকল্পকে অনেক ডাকাডাকি করেও তার ঘুম ভাঙাতে পারেনি। সন্ধ্যেবেলায় নিরুপায় মোনালিসা দলের মধ্যে এক দাদার সঙ্গে কি সব মালা ফালা কিনতে দোকানে গেছে। সেখানে আবার এক পরিচিতের সঙ্গে দেখা হয়েছে। দু এক কথার পরেই সে জুলজুল করে চেয়ে মোনালিসাকে ফিসফিস করে বলে, তোর বরের ছবি তো আমরা দেখেছি আগে। তোর সাথে আজ যাকে দেখছি এ তো তোর বর নয়! থতমত খেয়ে মোনালিসা হ্যাঁ মানে, না মানে, বর নয় ঠিক, বরের বন্ধুর সাথে... এইসব আবলান জাবলান অসংলগ্ন উত্তর দিয়ে রাগ করে হোটেলে ফিরে আসে...

কাল বছরের শেষ দিন। তাই আজ সমস্ত মদের দোকানে প্রচণ্ড ভিড়। বুড়ো বাচ্চা লেডিজ জেন্টস সবাই লাইন দিয়েছে। বছর শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে। হয় দুঃখে নয় আনন্দে, কি জন্যে ঠিক বলতে পারবো না। হেমিংওয়ে বলতেন, "I drink to make other people more interesting." সেটাই হল কি? আমরা সকলে কি একে অপরের মুখ দেখে খুব বোর হচ্ছি? চারপাশে সবার সবাইকে খুব বিস্বাদ লাগছে?  নিজের মোবাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতেই ভাবি, সত্যি মাইরি, কি আত্মমগ্ন, যান্ত্রিক লোকজন আমরা সবাই। এর চেয়ে ভেটকি অনেক ভালো ছিলো, ইন্টারেস্টিং ছিলো! কাব্যলোকে আসছে কাল মনে হয় মোবাইল নিয়ে ঢোকা বারণ। মধ্যরাতে মুমূর্ষু তেইশ সালটিকে আলতো করে মদিরায় ভাসিয়ে দেবেন শক্তি আর ভেটকি। নতুন বছরের চিবুক ধরে আদর করে বলবেন, "থুৎনিপরে তিল তো তোমার আছে/ এখন? ও মন, নতুন দেশে যাবি?"

মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

জীবনের ধাঁধা ~ রজত শুভ্র ব্যানার্জী

মানুষের মেজো ছেলে লোম পরে হুপ হাপ করে,
নিজেকে দেখিয়ে বলে, দেখো, আমি কত বড় হনু,
ওই দূরে বড় মাঠে গোটাকত গরু মোষ চরে,
মেঘ কাটে অবশেষে, আকাশে গজায় রামধনু।

উঠনে তুলসী তলা, ছাগলেরা তায় মাথা ঠোকে,
দু'খানা নেংটি এসে এক কোণে দানা পানি গোঁজে,
পাখিরা বাসায় ফেরে, ইয়ে ক'রে সম্মুখে ঝোঁকে,
পাশে কটা বুড়ো ভাম বসে থাকে সুযোগের খোঁজে।

হঠাৎ পটকা ফাটে, সবাই শিউরে ওঠে ত্রাসে,
আগুন জ্বলতে থাকে সীমানার এধারে ওধারে,
পিপীলিকা ভ্যাবাচ্যাকা, সভয়ে লুকিয়ে পড়ে ঘাসে,
দু'একটা সারমেয় ইতি উতি চেয়ে ল্যাজ নাড়ে।

আর কেউ জানুক বা না জানুক, জন্তুরা জানে
অবশেষে ভগবান ভুলেছেন জীবনের মানে। 

RSB (2023-12-19)

শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৩

মৎসপুরাণ ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

পারশে নাহয় সর্ষে দিয়ে রেঁধে 
শীতের দুপুর ট্যাংরা পেঁয়াজকলি
বাজার গেলাম চিংড়ি দিল সেধে
ইলিশ কে কি মাছের সেরা বলি!!

গোল বাঁধাল মৌরলা আর পুঁটি
মাছ কাটবার বিভিন্ন পদ্ধতি 
আছেন মাসি, সামান্য ভুল ত্রুটি 
ভেটকি নিলেও এমন কি আর ক্ষতি।।

রুই কাতলা রাজার মত শুয়ে
কেউ খুঁজেছে চিতল মাছের পেটি
মাগুর সিঙ্গি পাবদা বরফ ছুঁয়ে 
কাজরি যেন বড়লোকের বিটি।।

বোয়াল যেন ধ্যানস্থ এক সাধু
উদাস চোখে তাকিয়ে থাকে শোল
ওভাররেটেড তোপসে জানে জাদু
তেলাপিয়া বাঁধায় গন্ডগোল।। 

সাতসকালে মাছের বাজার টানে
মৎসপুরাণ স্বাদকাহনের মানে।।

শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩

সুজানা ~ কৌশিক মজুমদার

প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সাত খুন মাফ সিনেমাটা আছে না? ওই যে যেখানে উষা "দিদি" উত্থুপ আর রেখা ভরদ্বাজ মিলে "ডা-র-র-র-লিং" বলে একটা গান গেয়েছিলেন (যেটা আবার রাশিয়ান গান কালিঙ্কা থেকে অনুপ্রাণিত)...মজার ব্যাপার এই সিনেমাটার আসল শিকড় লুকিয়ে আছে চুঁচুড়ার মাটিতে। 

খাদিনা মোড় থেকে প্রিয়নগরের দিকে যেতে বাঁ হাতে জি টি রোডের ধারে সাদা মন্দির টাইপ একটা স্থাপত্য চোখে পড়ে। অচেনা লোকেরা এঁকে মন্দির ভাবেনও..কিন্তু এখানকার বাসিন্দারা জানেন এই মাটিতে শুয়ে রয়েছেন "সাত সাহেবের বিবি" সুজানা আনা মারিয়া ভারকার্ক। নামটা চেনা চেনা লাগছে? রাস্কিন বন্ড তাঁর বিখ্যাত চার পাতার গল্প Susanna's Seven Husbands এ নায়িকার ঠিক এই নামই দিয়েছিলেন। গল্পের প্লট এক কথায় বন্ড এই রকম বলেছেন "When a guy visits the ruins of an old haveli on G T Road, Old Delhi, he was told the story of the mysterious haveli owner, Susanna and killings of her husbands..."

দিল্লীকে আপাতত ভুলে জি টি রোড আর সুজানা নাম দুটো আমাদের আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে। এই গল্প থেকেই কিন্তু গোটা সাত খুন মাফ সিনেমার জন্ম।

কে ছিলেন আসল সুজানা? অষ্টাদশ শতকে ওলন্দাজ ব্যবসায়ীরা দলে দলে চুঁচুড়ায় এসে ভিড় জমালেন। সাথে তাঁদের স্ত্রীরাও। এমনই একজন ছিলেন পিটার ব্রুয়িস। তিনি ১৭৫৪ নাগাদ চুঁচুড়ায় ঘাঁটি গাড়েন। সাথে স্ত্রী সুজানা।  তাঁদের একটি ছেলে , দুটি মেয়েও ছিল।  ১৭৮৩ তে পিটারের মৃত্যু হয়। সুজানা এক ইংরেজ টমাস ইয়েটস-এর প্রেমে পড়েন।  ১৭৯৫ সালের ৩০ মার্চ কলকাতার অ্যাংলিকান চার্চে তাঁদের বিবাহ হয়। সাথে সাথে পুত্র কন্যা সমেত সুজানা খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। এই ছিল সুজানার দুটি বৈধ বিবাহ। কিন্তু লোকে বলে মাত্র দুটি পুরুষে সন্তুষ্ট থাকার মহিলা ছিলেন না সুজানা। অসংখ্য প্রেমিক ছিল তাঁর। ওলন্দাজ, রাশিয়ান, ইংরেজ এমনকি কেউ কেউ বলেন দু -এক জন ভারতীয় থাকলেও আশ্চর্য হবার কিছু নেই। পতঙ্গরা যেমন আগুনে পুড়ে মরে, সুজানার রূপের আগুনে এসে ঝাঁপ দিত পুরুষেরা, আর সবাই কোন না কোন অদ্ভুত ভাবে মারা যেত। কেউ আত্মহত্যা করত বিষ খেয়ে,কাউকে কে যেন বুকে ছুরি বসিয়ে যেত,  বাড়ি শুদ্ধু আগুনে পুড়ে মরত বা কেউ...

১৮০৯ সালের ১২ মে সুজানা মারা যান। তাঁকে কবর দেওয়া হয় আয়েস বাগে। কবরের উপর তৈরী করা হয়  ডাচ- ভারতীয় স্থাপত্যের মিশ্রনে এক অপূর্ব সৌধ। সেখানে আজও শুয়ে আছেন সুজানা। তাঁর কবরে লেখা ""SUSANNA ANNA MARIA YEATS REBOORE VERKERK OBiIT 12 MAY ANNO 1809"। এই REBOORE VERKERK মানে তাঁর আসল পদবি হল ভারকার্ক। সাত স্বামীর সাথে সম্পর্কের পরেও সুজানা তাঁর পিতৃদত্ত পদবিকে ছাড়েন নি।

সুজানার প্রথম স্বামী পিটার ব্রুয়িসও শুয়ে আছেন চুঁচুড়ার মাটিতে। তবে সুজানার থেকে অনেক দূরে। ফুলপুকুর রোডের সেই ওলন্দাজদের কবরস্থানে। কবরখানার দক্ষিন-পশ্চিম কোণের বিশাল ওবেলিস্কটা আসলে পিটারেরই সমাধি। ভাঙাচোরা ইঁট এদিক ওদিক দাঁত বের করে আছে। তার মাঝে এখনও বিবর্ণ ফলকে দেখা যায়  ৫২ বছরে মারা যাওয়া মানুষটির নাম, যারও স্ত্রীর জীবন বাস্তবিক তাঁর থেকে অনেক রঙিন ছিল।

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ~ অহনা বিশ্বাস

আজ মহামহিম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মদিনে তাঁকে অনন্ত শ্রদ্ধা জানাই। আজ এই উপমহাদেশের সকল মেয়েদের, বিশেষত নবপর্দায় শোভিত মেয়েদের তাঁকে বড় প্রয়োজন।

তাঁর 'অবরোধবাসিনী' (1931) বইটি থেকে খানিক উদ্ধৃত করলাম। যদি কারুর ইচ্ছা হয় তো পড়বেন। 

'প্রায় ৪০/৪৫ বৎসর পূর্ব্বের ঘটনা-কয়েক ঘর বঙ্গীয় সম্ভ্রান্ত জমীদারের মাতা, মাসী, পিসী, কন্যা ইত্যাদি একত্রে হজ করিতে যাইতেছিলেন। তাঁহারা সংখ্যায় ২০/২৫ জন ছিলেন। তাঁহারা কলিকাতায় রেলওয়ে ষ্টেশন পৌঁছিলে পর সঙ্গের পুরুষ প্রভুগণ কার্য্যোপলক্ষে অন্যত্র গিয়াছিলেন। বেগম সাহেবাদিগকে একজন বিশ্বস্ত আত্মীয় পুরুষের হেফাজতে রাখা হয়। সে ভদ্রলোকটীকে লোকে হাজী সাহেব বলিত, আমরাও তাহাই বলিব। হাজী সাহেব বেগম সাহেবাদের ওয়েটিং রুমে বসাইতে সাহস পাইলেন না। তাঁহারা উপদেশ মতে বিবি সাহেবারা প্রত্যেক মোটা মোটা কাপড়ের বোরকা পরিয়া ষ্টেশনের প্লাটফরমে উবু হইয়া (Squat) বসিলেন; হাজী সাহেব মস্ত একটা মোটা ভারী শতরঞ্জি তাঁহাদের উপর ঢাকিয়া দিলেন। তদবস্থায় বেচারীগণ এক একটা বোচকা বা বস্তার মত দেখাইতেছিলেন। তাঁহাদিগকে ঐরূপে ঢাকিয়া রাখিয়া হাজী সাহেব এক কোণে দাঁড়াইয়া খাড়া পাহারা দিতেছিলেন। একমাত্র আল্লাহ জানেন, হজযাত্রী বিবিগণ ঐ অবস্থায় কয় ঘণ্টা অপেক্ষা করিতেছিলেন-আর ইহা কেবল আল্লাহতালারই মহিমা যে তাঁহারা দম আটকাইয়া মরেন নাই।

ট্রেণ আসিবার সময় জনৈক ইংরাজ কর্ম্মচারীটী ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দিতে হাজী সাহেবকে বলিলেন, "মুন্সি! তোমারা আসবাব হিয়াসে হাটা লো। আভি ট্রেণ আবেগা-প্লাটফরম পর খালি আদামি রহেগা-আসবাব নেহি রহেগা।" হাজী সাহেব যোড়হস্তে বলিলেন, "হুজুর, ঐ সব আসবাব নাহি-আওরত হায়।" কর্ম্মচারিটী পুনরায় একটা "বস্তায়" জুতার ঠোকর মারিয়া বলিলেন, "হা, হা-এই সব আসবাব হাটা লো।" বিবিরা পর্দ্দার অনুরোধে জুতার গুতা খাইয়াও টু শব্দটী করেন নাই।'
******

'আমরা বহু কাল হইতে অবরোধ থাকিয়া থাকিয়া অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি সুতরাং অবরোধের বিরুদ্ধে বলিবার আমাদের-বিশেষতঃ আমার কিছুই নাই। মেছোণীকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায় যে, "পচা মাছের দুর্গন্ধ ভাল না মন্দ?"-সে কি উত্তর দিবে?

এস্থলে আমাদের ব্যক্তিগত কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা পাঠিকা ভগিনীদেরকে উপহার দিব-আশা করি, তাঁহাদের ভাল লাগিবে।

এস্থলে বলিয়া রাখা আবশ্যক যে গোটা ভারতবর্ষে কুলবালাদের অবরোধ কেবল পুরুষের বিরুদ্ধে নহে, মেয়েমানুষদের বিরুদ্ধেও। অবিবাহিতা বালিকাদিগকে অতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া এবং বাড়ীর চাকরাণী ব্যতীত অপর কোন স্ত্রীলোকে দেখিতে পায় না।

বিবাহিতা নারীগণও বাজীকর-ভানুমতী ইত্যাদি তামাসাওয়ালী স্ত্রীলোকদের বিরুদ্ধে পর্দ্দা করিয়া থাকেন। যিনি যত বেশী পর্দ্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশী পেঁচকের মত লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশী শরীফ।

শহরবাসিনী বিবিরাও মিশনারী মেমদের দেখিলে ছুটাছুটি করিয়া পলায়ন করেন। মেম ত মেম-সাড়ী পরিহিতা খ্রীষ্টান বা বাঙ্গালী স্ত্রীলোক দেখিলেও তাঁহারা কামরায় গিয়া অর্গল বন্ধ করেন।'
******

'কবির ভাষায় বলিতে ইচ্ছা করেঃ

"কাব্য উপন্যাস নহে, এ মম জীবন,
নাট্যশালা নহে, ইহা প্রকৃত ভবন!"

প্রায় তিন বৎসরের ঘটনা, আমাদের প্রথম মোটর বাস প্রস্তুত হইল। পূর্ব্বদিন আমাদের স্কুলের জনৈকা শিয়িত্রী, মেম সাহেবা মিস্ত্রীখানায় গিয়া বাস দেখিয়া আসিয়া সংবাদ দিলেন যে, মোটর ভয়ানক অন্ধকার···"না বাবা! আমি কখনও মোটরে যা'ব না।" বাস আসিয়া পৌঁছিলে দেখা গেল,—বাসের পশ্চাতের দ্বারের উপর সামান্য একটু জাল আছে এবং সম্মুখ দিকে ও উপরে একটু জাল আছে। এই তিন ইঞ্চি চওড়া ও দেড় ফুট লম্বা জাল দুই টুকরা না থাকিলে বাসখানাকে সম্পূর্ণ "এয়ার টাইট" বলা যাইতে পারিত।

প্রথম দিন ছাত্রীদের নূতন মোটরে বাড়ী পৌঁছান হইল। চাকরাণী ফিরিয়া আসিয়া সংবাদ দিল-গাড়ী বড্ড গরম হয়,—মেয়েরা বাড়ী যাইবার পথে অস্থির হইয়াছিল। কেহ কেহ বমি করিযাছিল। ছোট মেয়েরা অন্ধকারে ভয় পাইয়া কাঁদিয়াছিল।

দ্বিতীয় দিন ছাত্রী আনাইবার জন্য মোটর পাঠাইবার সময় উপরোক্তা মেম সাহেবা মোটরের দ্বারের খড়খড়িটা নামাইয়া দিয়া একটা রঙীন কাপড়ের পর্দ্দা ঝুলাইয়া দিলেন। তথাপি ছাত্রীগণ স্কুলে আসিলে দেখা গেল,—দুই তিন জন অজ্ঞান হইয়াছে, দুই চারিজনে বমি করিয়াছে, কয়েক জনের মাথা ধরিয়াছে, ইত্যাদি। অপরাহ্নে মেম সাহেবা বাসের দুই পাশের দুইটী কড়খড়ি নামাইয়া দুই খণ্ড কাপড়ের পর্দ্দা দিলেন। এইরূপে তাহাদের বাড়ী পাঠাইয়া দেওয়া গেল।

সেই দিন সন্ধ্যায় আমার এক পুরাতন বন্ধু মিসেস মুখার্জ্জি আমার সহিত দেখা করিতে আসিলেন। স্কুলের বিবিধ উন্নতির সংবাদে আনন্দ প্রকাশ করিয়া বলিলেন,—"আপনাদের মোটরবাস ত বেশ সুন্দর হয়েছে। প্রথমে রাস্তায় দেখে আমি মনে করেছি যে আলমারী যাচ্ছে না কি-চারিদিকে একেবারে বন্ধ, তাই বড় আলমারী বলে ভ্রম হয়! আমার ভাইপো এসে বলেল, "ও পিসীমা! দেখ, সে Moving Black Hole (চলন্ত অন্ধকূপ) যাচ্ছে।" তাই ত, ওর ভিতর মেয়েরা বসে কি করে?"

তৃতীয় দিন অপরাহ্নে চারি পাঁচ জন ছাত্রীর মাতা দেখা করিতে আসিয়া বলিলেন, "আপকা মোটর ত খোদা কা পানাহ! আপ লাড়কীয়োঁ কো জীতে জী ক্ববর মে ভয় রহি হয়ঁ।" আমি নিতান্ত অসহায়ভাবে বলিলাম, "কি করি, এরূপ না হইলে ত আপনারাই বলিতেন, "বেপর্দ্দা গাড়ী।" তাঁহারা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া বলিলেন, 'তব কেয়া আপন জান মারকে পর্দ্দা করেঙ্গী? কালসে হামারী লাড়কীয়াঁ স্ড়্গুল নেহী আয়েঙ্গী।" সে দিনও দুই তিনটী বালিকা অজ্ঞান হইয়াছিল। প্রত্যেক বাড়ী হইতে চাকরাণীর মারফতে ফরিয়াদ আসিয়াছিল যে, তাহার আর মোটর বাসে আসিবে না।

সন্ধ্যার পর চারিখানা ঠিকানারহিত ডাকের চিঠি পাইলাম। ইংরাজী চিঠির লেখক স্বাক্ষর করিয়াছেন, "Muslim Brotherhood" বাকী তিনখানা উর্দ্দু ছিল-দুইখানা বেনামী আর চতুর্থখানায় পাঁচজনের স্বাক্ষর ছিল। সকল পত্রেরই বিষয় একই-সকলেই দয়া করিয়া আমাদের স্কুলের কল্যাণ কামনায় লিখিয়াছেন যে, মোটরের দুই পার্শ্বে যে পর্দ্দা দেওয়া হইয়াছে, তাহা বাতাসে উড়িয়া গাড়ী বে-পর্দ্দা করে। যদি আগামীকল্য পর্য্যন্ত মোটরে ভাল পর্দ্দার ব্যবস্থা না করা যায়, তবে তাঁহারা তাতোধিক দয়া করিয়া "খবিছ" "পলীদ" প্রভৃতি উর্দ্দু দৈনিক পত্রিকায় স্কুলের কুৎসা রটনা করিবেন এবং দেখিয়া লইবেন, এরূপ বে-পর্দ্দা গাড়ীতে কি করিয়া মেয়েরা আসে।

এ তো ভারী বিপদ,—
"না ধরিলে রাজা বধে,—ধরিলে ভুজঙ্গ!"

রাজার আদেশে এমন করিয়া আর কেহ বোধ হয় জীবন্ত সাপ ধরে নাই! অবরোধ-বন্দিনীদের পক্ষে বলিতে ইচ্ছা করিল,—

"কেন আসিলাম হায়! এ পোড়া সংসারে,
কেন জন্ম লভিলাম পর্দ্দা-নশীন ঘরে!"

শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২৩

পুরনো লেত্তি পুরনো লাট্টু ~ সংকলন সরকার

সে অতি অদ্ভুত বিদঘুটে ভূতুড়ে জায়গা বাপরে বাপ! সাত সক্কাল বেলা ঘুম ভেঙ্গে গেলেই খিদে পেয়ে যায়। বরং বলা ভালো অত সকালে খিদের চোটেই ঘুম ভাঙ্গে! খিদে পেলে হাতের কাছে কিছু না থাকলে চাদর দিয়ে নিজেকে মুড়ে নিয়ে হালকা কুয়াশা ঠেলে গুটি গুটি হেঁটে পৌঁছে যাও থানার পাশে পাঁড়েজীর চায়ের দোকানে। শীত এখানে ভালই পড়ে গেছে। এই সকাল সাড়ে ছটার সময় পাঁড়েজীর দোকানে গরমা গরম চা ছাড়া আর কিছুই গরম পাবে না। কিন্তু খিদে পেয়ে গেছে যে...! একটু মাথা ঘোরালে দেখবে দোকানে মোটে তিন রকমের বিস্কুট আছে, একটা কাচের ঘেরাটোপে গুটিকয় গতকাল সন্ধ্যেবেলার বানানো শিঙ্গাড়া আর গতকাল বিকেলের বানানো জিলিপি। সারারাতের ঠাণ্ডা খেয়ে সে সব খাদ্যবস্তুর গায়ে জমাট ডালডার সাদা পরতের কারুকার্য্য! প্রথম দর্শনে মনে মনে তলপেট থেকে একটা কাল্পনিক চোঁয়াঢেঁকুর খাদ্যনালী বেয়ে উঠে আলজিভের তলায় ঘুরপাক খেতেই পারে। হাজার হোক বাংলার মাটি বাংলার জল বাংলার বায়ু বাংলার ফল খাওয়া পেট তো! কিন্তু বাস্তব ঘটনা আরো খারাপ। সেটা হল পেটের বেসমেন্ট থেকে পেটের টপ ফ্লোর অবধি এখন কম করে খান কুড়ি ছুঁচো দৌড়চ্ছে! তাই আর ডালডার আর্টওয়ার্ক না দেখে ঐ বাসি শিঙ্গাড়া আর জিলিপিই সই। চোখ কান বুজে খেয়েই নেওয়া যাক আপাতত। পরের কেস নাহয় পরে সাল্টে নেওয়া যাবেখন! 

পাঁড়েজীর লোক এখন সবে খোসা সমেত আলুর তরকারীর মালমশলা কেটে বীর বিক্রমে আটা মাখতে লেগেছে। গরমাগরম পুরি তরকারী পেতে পেতে কমকরে আরো ঘন্টা দেড়েক দেরী। সকাল আটটা সোয়া আটটার আগে কোনো মতেই নয়! এখন দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করলে ছুঁচোগুলো সংখ্যায় বেড়ে খান চল্লিশেক হয়ে গিয়ে ছুটোছুটি করে পেট ফুটো করে দিতে পারে। অতএব ছুঁচোগুলোকে ঐ আগের দিনের গোটাচারেক করে ডালডা জমা ঠাণ্ডা বাসি শিঙ্গাড়া জিলিপি খাইয়েই ঠাণ্ডা করে দাও আপাতত। তারপর ছোটো কাচের গেলাসে গরম চা দু' হাতের তালুর মধ্যে নিয়ে আয়েশ করে ছোটো ছোটো চুমুকে শেষ করে আবার গুটি গুটি হেঁটে ফিরে আসা যাক নির্ভেজাল ভূতেদের আড্ডার জন্য বিখ্যাত লালকোঠিতে। এবার এটা ওটা খুটখাট করতে করতে সকালের কাজকম্মো গুলো সেরে নেওয়ার পালা, আমাদের কাজ বলতে সামান্যই। দাঁতমাজা, দাড়িছাঁটা বড়বাইরে ইত্যাদি বাথরুমের কাজ মূলত। এ ছাড়া বেড়াতে এসে তোমার আর কাজ কী! 

অদ্ভুত রকমের রুক্ষ অথচ সতেজ প্রকৃতি শিমুলতলায়। এখানকার লোকজনদের জীবনযাপন আরো অদ্ভুত... কিছুটা সপাট সতেজ কর্মঠ সময় দেখার পরেই দেখতে পাবে, এখানে আর কোনো কাজ নেই। সব কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে... অতএব আবার যেদিকে তাকাবে দেখবে আলস্য বাবাজী সবখানে চাদর বিছিয়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছে। ভাবখানা এই... আয় আয়, আয় এবার একটু চুপটি করে আমার দালানে ঠেস দিয়ে বোস দিকিনি... হুশহুশিয়ে অনেক কাজ তো করলি রে বাপ, এখন আমায় একটু শান্ত হয়ে বল তো দেখি কী কী কাজ করলি এতক্ষণ ধরে অত হৈহল্লা করে?! তো, এই সব ভাবতে ভাবতে প্রায় পৌনে আটটা বেজে যাবে, আর আমরা আবার প্রচণ্ড অবাক হয়ে খেয়াল করব যে জানলা দিয়ে একটা মন উদাস করা মৌরীফোড়োন দেওয়া খাবারের সুগন্ধ আসছে। সেটা সম্ভবত পাঁড়েজীর দোকানে আলুর তরকারী রেডি হয়ে যাওয়ার গন্ধ... এইবার এক কড়াই গরম তেলে আটার লাল লাল পুরি ভাজা হবে! এবং আরো ভয়ানক অবাক হয়ে আমরা খেয়াল করব, পেটে গোটাপাঁচেক ছুঁচো নড়াচড়া শুরু করেছে! কোলকাতা বা তৎসংলগ্ন অঞ্চলে থাকলে কিন্তু ওই একগন্ডা বাসী শিঙ্গাড়া আমাদের বিকেল পাঁচটা অবধি খিদে পাওয়া থেকে বিরত করে রাখতে পারত। কিন্তু আমরা এখন বাড়িতে নেই... তাই এবার একটা হাফ সোয়েটার চাপিয়ে গুটি গুটি আবার রওয়ানা দেব পাঁড়েজীর দোকানের উদ্দেশ্যে। এবার অবশ্য আর আমরা আর চাদর নেব না। ঝকঝকে রোদ উঠেছে যে... রোদ মাখতে মাখতে হাঁটা যাক। 

তারপর সারাদিন অল্প ঘোরাঘুরি খানিক আড্ডা, ঘুরতে ঘুরতে চলে যাওয়া ধু ধু মাঠে পড়ে থাকা বিশাল রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষের কাছে... তারপর আবার গঞ্জের দিকে ফিরে এসে ফের আমরা ঘুরঘুর করব বিশাল বিশাল গেট ওয়ালা এক কালে জাঁকিয়ে বসা, অধুনা পলেস্তরাখসা ইটের মধ্যে থেকে গাছ গজানো পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর চারপাশে... কারো কোনো গেটের থামে মুখোমুখি বসে আছে এক জোড়া বিগতশ্রী সিমেন্টের সিংহ...  যাই হোক... দুপুরে আবার একচোট ভাত ডাল দেশীমুরগীর ঝোল দিয়ে পেটপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়ার পরে নাহয় ভাবতে বসা হবে, আমাদের এত খিদে ছিলো কোথায়!? এবং, এই বিকট পরিমাণ খাদ্যাখাদ্য পেটের কোথায় কোথায় চালান হচ্ছে শেষ অবধি?!!!! 

শীতের বেলা ঝটপট শেষ হয়ে আসার তাড়ায় থাকবে। এখানে এখনো লো ভোল্টেজ থাকে। টিমটিমে বাল্বের আলোয় দিনের শেষে সন্ধ্যাকে বরণ করে নেওয়া হবে... এটাই এখানকার দস্তুর। ঝকঝকে তকতকে কোনো ব্যাপার কোত্থাও নেই, সবই ম্যাড়ম্যাড়ে আর ভয়ানক মায়াবী। মায়াবী সন্ধ্যে নেমে গেলেই দেখতে পাবে এই এলাকায় কী বেশী পরিমাণে থিকথিক করছে ভূত! 

এলাকার সমস্ত গহন অন্ধকার জুড়ে কনসেনট্রেটেড ঘন ভূতের দল মাইল কে মাইল ছড়িয়ে পড়ে থাকা অতীত ঘিরে গিজগিজ করছে। ভূতেদের মধ্যে সাহেব বাঙালি দেহাতি সবাই রয়েছে। দু' চারটে ঘোড়া আর অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ভূতও রয়েছে। রাতের রাস্তা জুড়ে ঘোড়া ভূতে সওয়ার সাহেব ভূত তার সঙ্গে প্রিয় পোষ্য অ্যালসেশিয়ান কুকুরের ভূতকে সঙ্গে নিয়ে এ অঞ্চলের ভুতুড়েহাওয়া খেতে বের হয়। এখানকার ভূতের দল ভীষণ নির্লিপ্ত। এরা কাউকে একেবারেই ভয় টয় কিচ্ছু দেখায় না! শুধু লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে! কিন্তু বেড়াতে আসা কেউ কেউ হয়ত অত পরিমাণ ভূত একসঙ্গে দেখে ফেলে ভয় পেতেই পারে! তার জন্য অবশ্য এখানকার ভূতদের কোনোভাবেই দোষ দেওয়া উচিৎ নয়! 

রাতের টিমটিমে আলোমাখা জমাট অন্ধকারে ভূতেদের দু হাতে ঠেলে সরিয়ে সরিয়ে আমাদের এক পা দু' পা করে এগিয়ে যেতে হবে তাজা সবজীর দোকানে। সেই সবজীর দোকান থেকে আমরা ড্যামচিপ তাজা বেগুন কিনবো, পোকা এবং রাসায়নিক ছাড়া সস্তায় তাজা বড় বড় বেগুন কিনে আমরা আবার দু' হাতে ভূত সরাতে সরাতে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যাবো পাঁড়েজীর দোকানে। পাঁড়েজী ওই তাজা বেগুনগুলোর গায়ে মাপ মতন ছুরি চালিয়ে ছ্যাঁদা করে ঢুকিয়ে দেবে চার পাঁচ কোয়া রসুন আর কাঁচা লঙ্কা। তারপর কয়লার উনোনো বেগুনগুলোকে দেশী টমেটোর সঙ্গে খুব যত্ন করে নিজের হাতে পোড়াতে পোড়াতে পাঁড়েজী আমাদের বলবে, যে এখন তো এখানে আর কিছুই নেই... তবে একসময় এই যায়গাটার একটা 'সময়' ছিলো বটে! পাঁড়েজীর সহকারীরা মুখ বন্ধ করে একের পর এক রুটি বেলে তাওয়ায় সেঁকে উনোনে চিমটে দিয়ে ফুটবলের মতন ফুলিয়ে নরম কাপড়ের ওপর রেখে পাঁজা খানেক রেডি হয়ে গেলে চিল চিৎকার করে কর্কশ গলায় বলবে - ফুলকা তৈয়ার হো গ্যায়া হ্যায়। আমরা অবাক হয়ে নিজনিজ পেটে সেই পাঁজা পাঁজা রুটি অবলীলায় পাকস্থলীর বারমুডা ট্র্যাঙ্গেলে ঠেসেঠুসে ভ্যানিশ করে দিয়ে, দু' হাত দিয়ে ঠেলেঠুলে ভূত সরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার ভূতের ডেরার লালকোঠিতে পৌঁছে যাবো। 

হ্যাঁ মশাই শিমূলতলার কথা বলছিলাম...  আগামী সপ্তাহের মাঝখানে দিন চারেকের জন্যে আবার একবার বিহারের শিমূলতলা ঢুঁ মারতে চলেছি একটা ছোটোখাটো ড্রাইভে। যাওয়ার আগে ব্যাগ পত্তর গোছাতে গোছাতে হালকা করে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েছিলাম তাই ছোট্টো একটা স্মৃতিনির্ভর ভূমিকা ছেড়ে রাখলাম। এরপর ফাঁকে ফোঁকরে অথবা ফিরে এসে দু একটা ছবিছাবা আপলোডিয়ে দেবোখন! আসানসোলের পর থেকে চিত্তরঞ্জন পেরিয়ে 'জামতাড়া-গোড্ডা রোড ধরে' নিলেই রাস্তার দু'পাশ পৌঁছানোর আগেই পয়সা উশুল করে দেবে! আশা করছি প্রতিবারের মতন এবারেও শিমূলতলায় পৌঁছে নেট ফেট পাবো না! আর ইয়ে, একটা ভীষণ জরুরী ইনফো দিয়ে রাখি। যাঁরা শিমূলতলা গিয়ে ইঁদারার মিনারেল মেশানো জলের বদলে প্লাস্টিকের বোতলে কেনা মিনারেল ওয়াটার খেয়ে থাকেন তাঁরা অবশ্যই অ্যান্টাসিড ক্যারি করবেন। নইলে ঐ ডালডা মাখা ঠাণ্ডা শিঙ্গাড়া জিলিপি কিন্তু আপনাদের মাথায় চড়ে চেপে বসবে। ওসব হজম করানো বা পাকস্থলীতে বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল বানানো কেনা প্লাস্টিকের জলের বোতলের কম্মো নয়... এইবেলা সবাইকে বলে কয়ে রাখলুম!

পুরনো লেত্তি পুরনো লাট্টু... 
শিমুলতলা, ডিসেম্বর ২০১৭

An idea, like a ghost, must be spoken to a little before it will explain itself... 
...Lord Sinha's place, Shimultala. 

বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৩

বেলা আর বাতুল ~ অরিজিৎ গুহ

বেলা আর বাতুল এর গল্প শুনেছেন? অনেকেই শোনেন নি হয়ত। আসুন শুনে নি। গল্পটা আমরা শুনছি বোম্বের প্রসিদ্ধ ফরাস রোডের এক তওয়াইফের মুখ থেকে।
বেলা ছিল রাওয়ালপান্ডির কাছের একটা গ্রামের মেয়ে। ক্লাস ফোরে পড়ত। বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিল। এগারো বছর বয়স। আর কয়েকবছর পরেই হয়ত গ্রামেরই কোনো গরীব ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হত, তারপর সুখে ঘরকন্না করতে পারত।
কিন্তু হঠাৎ করেই কী হল, একদিন আল্লাহ হো আকবর বলে একদল লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল বেলার বাড়ির ওপর। বেলার বাবাকে তরোয়ালের কোপে ধর থেকে মুন্ডুটা আলাদা করে দিল, মায়ের স্তন কেটে দিল, আর আরো যেসব হিন্দু বাড়ি ছিল সব বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিল। গ্রান্ট রোডের এপারে ফরাস রোডে জিন্নাহ্ সাহেব কোনোদিনও আসবেন না। শরিফ আদমিরা কখনো গ্রান্ট রোড ক্রস করেন না।কিন্তু জিন্নাহ্ সাহেব একবার যদি বেলার সাথে দেখা করতেন, তাহলে হয়ত বেলাকে বোঝাতে পারতেন বেলার সাথে যা হয়েছে তা করার অধিকার কোরাণে কোনো মুসলমানকে দেয় নি।
বেলা এরপর পালিয়ে চলে আসে রাওয়ালপিন্ডি। সেখানে এক মুসলিম দালাল ওকে নিজের হেপাজতে করে নেয়। সেই দালালের থেকে আরেক দালাল ওকে কিনে নেয়। তারপর বেলার ঠাঁই হয় ফরাস রোডের তওয়াইফখানায়। বেলার মুখটা যদি জিন্নাহ্ সাহেব দেখতে পেতেন, তাহলে বুঝতেন 'মাসুমিয়াত কি কোই মজহব নেহি হোতি'। এক সরল নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়ের মুখ। সেই মুখে ধর্ম লেখা নেই। সেই মুখে হিন্দুস্তান পাকিস্তান লেখা নেই। সেই মুখ হিন্দু মুসলিম শিখ ইসাই যে কারো মুখ হতে পারে। জিন্নাহ্ সাহেবের বাংলোতে যে বেলার চিৎকারের আওয়াজ পৌঁছায় না!
বাতুল থাকত জলন্ধরের কাছের এক গ্রামে। বাবা খুবই গরীব। মুটে মজুরি করে চালায়। অনেকগুলো দিদি আর ভাইদের নিয়ে তার মধ্যেও শান্তিতে থাকত ওরা। বাতুলদের গ্রামে 'নমাজ আদা' করার কোনো হুকুম ছিল না। বাতুল কোনোসময়ে জিন্নাহ্ সাহেবের গল্প শুনেছিল। সেই থেকে জিন্নাহ্ সাহেবকে খুব পছন্দ করত। গলায় একটা লকেট ঝুলিয়েছিল জিন্নাহ্ সাহেবের ছবি দিয়ে।
হিন্দুস্থান পাকিস্থান ভাগ হওয়ার পর বাতুল স্লোগান দিয়ে ফেলেছিল পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে। ঠিক যেরকমভাবে পাঁচ ছ'বছরের বাচ্চা কোনো কিছু না বুঝেই ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে ফেলে, সেরকমই আরকি।
সেই স্লোগান শুনে গ্রামের জাঠরা এসে প্রথমে ওর বাবার জামা কাপড় খোলাল, তারপর মুখে পেচ্ছাপ করল, তারপর বাবার বুকে ছুরি ঢুকিয়ে দিল। দিদিদের টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল আড়ালে।
এরপর বাতুলকে যখন এক হিন্দু দালালের থেকে ফরাস রোডের ওই তওয়াইফ কিনে নিল, তখন সে দেখেছিল বাতুলের সারা গায়ে আঁচড় কামড়ের দাগ। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তো অনেক পণ্ডিত মানুষ আর উনিও অনেক শরিফ আদমি। তাই উনিও কখনো ফরাস রোডের তওয়াইফখানায় ঢুকবেন না কোনোদিন। কাজেই বাতুলকেও দেখতে পাবেন না কোনোদিন। যদি দেখতে পেতেন, তাহলে হয়ত উনি বোঝাতে পারতেন যখন বাতুলের সাথে এরকম হচ্ছিল, তখন ঋকবেদ স্তম্ভিত হয়ে গেছিল। গুরু গ্রন্থসাহিব বোবা হয়ে গেছিল। কারণ দুই কিতাবের কোথাও যে লেখা ছিল না বাতুলের সাথে এরকম ব্যবহার করার কথা।
নেহেরুজি'র বাংলোতে যে বাতুলের চিৎকারের আওয়াজ পৌঁছায় নি। নেহেরু জি কী করবেন!
কৃষণ চন্দর যখন 'এক তওয়াইফ কি খৎ জিন্নাহ্ সাব অউর নেহেরু জি কো' লিখেছেন তার কিছু আগেই আজাদি এসেছে। কিন্তু তাও বারেবারে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করে গেছেন কৃষণ চন্দর।
'মহালক্সমী কা পুল' গল্পে মহালক্সমী পুলের পাশে বসবাসকারী নিম্নবিত্ত শ্রমিক বস্তির যে ছবি এঁকেছেন তার প্রতিটা ছত্রে লুকিয়ে রয়েছে ভদ্র সভ্য উচ্চবিত্তদের প্রতি বিদ্রুপ।
পুলের পাশে মিল মজদুররা তাদের নিজেদের নিজেদের চওলে থাকে। পুলের ওপর ওদের স্ত্রীদের শাড়ি শুকোতে দেওয়া হয়। পাশাপাশি ছটা শাড়ি শুকোতে দেওয়া হয়েছে। শান্তাবাঈ এর ফ্যাকাসে বাদামী রঙের শাড়ির পাশে যে শাড়িটা ঝুলছে শুকোতে দেওয়ার জন্য, সেই শাড়িটাও পাঠকদের চোখে ফ্যাকাসে বাদামী রঙই মনে হবে। কিন্তু কথক, যিনি একজন পয়ষট্টি টাকা মাইনের ক্লাস টেন পাস করা ক্লার্ক, যখন থেকে শাড়িটা দেখেছেন তখন সেটার রঙ ছিল গাঢ় বাদামী। পুরনো হয়ে রঙ হাল্কা হয়ে হয়ে সেটা ফ্যাকাসি বাদামী রঙে পর্যবসিত হয়েছে। তার পাশে রয়েছে মিল থেকে বহিষ্কৃত শ্রমিক ঝাব্বুর স্ত্রী লোড়ির শাড়ি। লোড়ির শাড়ির পাশে ঝুলছে মঞ্জুলার শাড়ি। সব থেকে ঝকমকে শাড়ি ওটা। কারণ মঞ্জুলার কয়েকমার আগে বিয়ে হয়েছে আর বিয়ের শাড়িটাই ঝুলছে। মঞ্জুলার স্বামী কিন্তু অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। মঞ্জুলার পাশে শেষ যে শাড়িটা ঝুলছিল সেটা ছিল বুড়ি মা'র। যার ছেলে সিতু এখন জেলে। সরকার থেকে যখন হরতাল বে আইনি ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন সিতুরা জুলুস বের করেছিল হরতালের সমর্থনে। পুলিশ থেকে মহালক্সমি পুলের পাশের চওলে গুলিবৃষ্টি চলে। সবাই ভয় পেয়ে নিজের নিজের চওলের দরজা বন্ধ করে দেয়। পরে যখন সব শান্ত হয়ে যায় তখন দেখা যায় সিতুর মা গুলি খেয়ে মরে পড়ে আছে। বুড়ি মানুষ, হয়ত তাড়াহুড়ো করে নিজের খোপরে ঢুকতে পারে নি। সেই লাল শাড়িটা এখন পরে সিতুর বৌ। সিতু হরতাল করার জন্য জেলে রয়েছে।
একটু পরই মহালক্সমী পুলের ওপর দিয়ে 'ওয়াজির এ আজম' মানে প্রধানমন্ত্রীর কনভয় যাবে। প্রধানমন্ত্রীর চোখেও সেই ঝোলানো শাড়িগুলো চোখে পড়বে না। যতক্ষণ না প্রধানমন্ত্রীর কনভয় যায় ততক্ষণ ধরে সেই শান্তাবাঈদের কলোনির গল্প শুনিয়েছেন কৃষণ চন্দর।
যুবতী শান্তাবাঈ, বৃদ্ধা জীবনা বাঈ বা কথকের মধ্যবয়সী স্ত্রী সবার গল্প মোটামুটি একইরকমের। প্রতি পদে অর্থের হাহাকার, ছোট্ট ছোট্ট সাধ আহ্লাদ আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ না হওয়ায় জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা আর তারই সাথে কুসংস্কার, সব যেন একসাথে হাত ধরাধরি করে রয়েছে। সবার শাড়িগুলো একসাথে যখন পাশাপাশি উড়তে থাকে তখন প্রত্যেকের শাড়ির রঙগুলো আর আলাদা করে চেনা যায় না।
প্রত্যেকের গল্প বলতে বলতেই কখন যে প্রধানমন্ত্রীর কনভয় চলে যায় বোঝাও যায় না। আসলে কনভয় তো এই মহালক্সমী পুলের পাশে দাঁড়াবে না, প্রধানমন্ত্রীর অত ঠেকাও পড়ে নি। কিন্তু ওই ছ'টা শাড়ি যেন ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিদিনের গল্প বলে যায়।
১৯৩৬ সালে যখন প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয় প্রেমচন্দকে সভাপতি আর সাজ্জাদ জাহিরকে সম্পাদক করে, তখন সেই সংগঠন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইকবাল আর নজরুলের আশীর্বাদ ধন্য হয়ে ওঠে। উর্দু সাহিত্য সেই সময়ে মোটামুটি আগের অবাস্তব আবেগের জায়গা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে বাস্তবের মাটিতে।
প্রথম সম্মেলনে আহম্মদ আলি, আলি আব্বাস হুসায়নী, মুলকরাজ আনন্দ, খাজা আহমেদ আব্বাস, শওকত সিদ্দিকে, গোলাম আব্বাস, আহমেদ নাদিম কাশমী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য নাম হলেও চারজন যারা পরবর্তীকালে উর্দু সাহিত্যের স্তম্ভে পরিণত হয়েছিলেন তারা হলেন সাদাত হাসান মান্টো, রাজিন্দার সিং বেদি, ইসমাত চুঘতাই আর কৃষণ চন্দর। বলা যায় এই চারজন উর্দু সাহিত্যকে শাসন করেছেন। তবে বাকি তিনজন যেমন চরিত্রদের মনস্তাত্ত্বিক জগৎ নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা করেছেন কৃষণ চন্দর আবার চিরকাল সাহিত্য রচনা করে গেছেন শোষিত শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে। প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশনের পতাকা সার্থক ভাবে বয়ে নিয়ে গেছেন। মান্টোর মতই দাঙ্গা আর দেশভাগকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন।
'গাদ্দার' গল্পে বৃদ্ধ বুলাকি শাহ চারিদিকের শয়ে শয়ে পড়ে থাকা লাশের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে কী যেন খুঁজতে থাকে। বৈজনাথের কন্ঠে চমকে উঠে বলে 'আমি মুসলমান। আমাকে মেরো না।' জবাবে বৈজনাথ যখন বলে মুসলমান হলে এখানেই তোর লাশ ফেলে দেব, তখন উত্তরে বুলাকি শাহ জানায় আমি বুলাকি শাহ। বৈজনাথ এবার আশ্চর্য হয়। গ্রামের সব থেকে বড় মহাজন বুলাকি শাহ! বৈজনাথ জিজ্ঞাসা করে এখানে কী করছ? ততক্ষণে বুলাকি শাহ ভয় কাটিয়ে উঠেছে। বলে সব তো মরে পড়ে রয়েছে এখানে। আমার পরিবারেও কেউ বেঁচে নেই, সম্পত্তিও সব লুঠপাট হয়ে গেছে। শুধু মেয়েটা বেঁচে রয়েছে। তা মেয়েটাকে তো বিয়ে দিতে হবে। যা পাচ্চি এখান থেকে সোনাদানা তাই হাতিয়ে নিচ্ছি পকেট থেকে। তুমিও এসো না। যা পাব ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়ে নেব।
স্তম্ভিত হয়ে যায় বৈজনাথ। মানুষ কোথায় নামতে পারে ভেবে! বুলাকি শাহ বলে মেয়ের বিয়ের যৌতুক ছাড়া কেউ তো মেয়েকে বিয়ে করবে না।
দেশভাগ আর দাঙ্গার নানারূপ দেখেছেন কৃষণ চন্দর। বরাবর গল্প বলেছেন নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া গরীব মানুষের। তাঁদের দুঃখ দুর্দশা, লড়াই করা হেরে যাওয়া এবং আবার জানকবুল লড়াই এর জন্য উঠে পড়া, এই গল্পই শুনিয়ে গেছেন। তেলেঙ্গানা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে 'রোটি কাপড়া মকান' এক অদ্ভুত গল্প।
খাজা আহমেদ আব্বাস যখন সিনেমা করবেন বলে ঠিক করলেন, তখন বাংলার বিজন ভট্টাচার্যের 'নবান্ন' আর 'জবানবন্দি' এই দুটো নাটকের গল্প শোনা হয়ে গেছে। ৪৩ এর মন্বন্তরকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন আব্বাস। এরপর কৃষণ চন্দরের 'অন্নদাতা' গল্পে পড়ে ঠিক করলেন তিনটে গল্পকে একসাথে নিয়ে একটা সিনেমা বানাবেন বাংলার ৪৩ এর মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে।
যথা সময়ে 'ধরতি কে লাল' সিনেমা তৈরি হল আইপিটিএ র সব রথী মহারথীর সাহায্যে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিও পেল সেই সিনেমা। এটাই একমাত্র সিনেমা যা আইপিটিএর নিজস্ব প্রযোজনায় তৈরি। সেখান থেকেই ফিল্ম জগতের সাথে যোগাযোগ তৈরি হয় কৃষণ চন্দরের।
এক সময়ে সিনেমার স্ক্রিপ্ট আর গল্প লেখার পেছনে এত সময় দিতে হয়েছিল যে তাঁর নিজের গল্পে সেই প্রভাব পড়েছিল। গল্পের ধার গেছিল কমে।
নীহাররঞ্জন গুপ্তের লেখা 'উত্তর ফাল্গুনি' হিন্দি স্ক্রিপ্ট 'মমতা' কৃষণ চন্দরেরই লেখা। এছাড়াও অসিত সেনের আরেকটি সিনেমা 'সরাফত' যেখানে ধর্মেন্দ্র হিরো ছিল তার গল্পও কৃষণ চন্দরের। কিন্তু তিনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন যে সিনেমার জগতে থাকলে তার গল্পের মান নেমে আসছে। অবশেষে ছেড়ে দিলেন সিনেমার জগত। ১৯৭৭ এ যখন মৃত্যু হয় তখন হাসপাতালে তার বেডের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন দ্বিতীয় স্ত্রী সালমা সিদ্দিকি। লিখতে শুরু করেছিলেন নতুন একটি গল্প। কয়েক লাইন লেখার পরই ঢলে পড়েন মৃত্যুর মুখে। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে নিভে যায় উর্দু সাহিত্যের এক স্তম্ভ কৃষণ চন্দরের জীবন দীপ।
১৯৭৭ এ মৃত্যু হলেও একজন লেখক কতটা প্রভাবশালী হতে পারেন তার পরিচয় পাওয়া গেছে এই ২০১৯ সালেও এসে। ২০১৯ সালের এক সার্কুলার জারি করে আইসিএসসি বোর্ডের দশম শ্রেনীর সিলেবাস থেকে 'জামুন কা পেড়' বলে একটি গল্প বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। গল্পটিতে খুব তীক্ষ্ণভাবে মজার ছলে ভারতের ব্যুরোক্রেসির প্রতি, লাল ফিতের ফাঁসের প্রতি প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। সরকারের সেসব পছন্দ না হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই আজও কৃষণ চন্দর কতটা প্রাসঙ্গিক বোঝা যায়।
১৯১৪ সালের আজকের দিনেই অর্থাৎ ২৩ শে নভেম্বর জন্ম হয়েছিল কৃষণ চন্দরের।