শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০১৯

ধর্ষণ, শ্রেণী ও এনকাউন্টার ~ অনির্বান মাইতি

আপাতত হায়দ্রাবাদ ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের নিয়ে নেটিজেনরা দুই ভাগে বিভক্ত। একদল দুই হাত তুলে আশীর্বাদ করছে সিস্টেমকে, আর একদল সিস্টেমের প্রতি ঘৃণা উগরে দিচ্ছে। আমি যেহেতু অত্যন্ত ধান্দাবাজ একজন লোক, আমি দুইদিকের বক্তব্যকেই আংশিক সমর্থন যুগিয়ে চলেছি। এই ডিবেটগুলো আমি পছন্দ করি কারণ এগুলোর মাধ্যমে ক্রমশ ঘটনার মোড়ক খুলছে। অনেক কিছু সামনে আসছে।

ধর্ষকরা সমাজের ঘৃণ্যকীট তাদের মৃত্যুতে কোন দুঃখ নেই বরং এই ভেবে ভালো লাগছে যে চারটি নষ্ট হয়ে যাওয়া মানসিকতা এই পৃথিবী থেকে মুছে গেল। কিন্তু এতে উক্ত মানসিকতা নষ্ট হয়ে গেল না। এখনো রাস্তায় ঘাটে মহিলারা নিরাপদে ঘুরে বেড়াতে পারে সেরকম আশা করা যাচ্ছে না। এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রয়োজন, আসুন আলোচনা করি।

সারা দেশের ধর্ষকদের প্রথমেই আমি দুইটি ভাগে ভাগ করে নেই, ১) প্রিভিলেজড ধর্ষক ২) আনপ্রিভিলেজড ধর্ষক। হায়দ্রাবাদে যারা নিহত হল তারা আনপ্রিভিলেজড ধর্ষক গোত্রীয়, এরা সমাজের নিচু স্তরের ধর্ষক। যারা অন্ধকারে লুকিয়ে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তাদের গন্ডীর মধ্যে এসে পড়া প্রিয়াঙ্কা রেড্ডিকে পেয়েই কর্ম সম্পাদন করেছে। দিল্লীর ক্ষেত্রেও এদেরই দেখা গেছিল। সারা ভারতবর্ষ তোলপাড় করে ফেলা দুটি ধর্ষণ কান্ডই আনপ্রিভিলেজড ধর্ষকদের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছিল। এই তোলপাড়ের ব্যাপারটা অপারেট করে মূলত মিডিয়া। তারা ক্রমাগত ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে মানুষকে চাগিয়ে তোলে, উত্তেজিত করে, মানুষের হয়ে তারাই দাবী ছুঁড়ে দেয়। মানুষ সেইমত প্রতিক্রিয়া জানাতে জানাতে যায়। কিন্তু এই মিডিয়ায়ই আবার নিজেদের সংযত করে ফেলে প্রিভিলেজড ধর্ষকদের ক্ষেত্রে। উন্নাও বা এরকম হাজারটা ধর্ষণ কান্ড এর প্রমাণস্বরূপ দেওয়া যেতে পারে। মানু্ষ ও প্রিভিলেজড দের ভয় পায়। দুম করে এদের শাস্তিবিধান করতে পারে না। কিন্তু অসুখটা যেহেতু ধর্ষণ, আর অসুস্থ যেহেতু প্রিভিলেজড এবং আনপ্রিভিলেজড উভয় পক্ষই সেহেতু এক পক্ষের শাস্তিতে অসুখটা ফুরোচ্ছে না। বরং প্রিভিলেজডদের মনে এই সাহসটুকু ঢুকছে যে শাস্তি পেলে ওরা পাবে, আমরা সেফ। আমরা হয়তো অনেকেই ভুলে গেছি সুপ্রীম কোর্টের চিফ জাস্টিসের বিরুদ্ধেও একটি মেয়ে মলেস্টেশনের অভিযোগ এনেছিল। তারপর সেই অভিযোগ কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সেই বিচারপতিই রামমন্দির বিতর্কের অবসান করেন তার ঐতিহাসিক রায় এ।

এবার কথা হল মানুষ যাবে কোথায়? করবে কী? উন্নাও এর অপরাধীরা ছাড়া পেয়েই মেয়েটিকে জ্বালিয়ে মেরে দিল। এর আগেও গাড়ি চাপা দিয়ে মেয়েটিকে মারার চেষ্টা হয়েছে। যেহেতু উন্নাও এর ধর্ষক দেশের শাসকদলের ঘনিষ্ঠ, সেহেতু হায়দ্রাবাদ নিয়ে আমরা যতটা উত্তেজিত, উন্নাও নিয়ে ততটা নই। কিন্তু ক্রমাগত ভিক্টিমের ওপর আক্রমণ করে এই প্রিভিলেজড ধর্ষক প্রমাণ করছেন যে তাঁরা কিন্তু "সেফ"। আর একজন ধর্ষক যেখানে সেফ সেখানে আমরা কী করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারি? যতদিন একজন ধর্ষক জীবিত থাকবে ততদিন কী করে আমাদের ভরসা ফিরতে পারে?

এনকাউন্টার স্পেশ্যালিস্ট সাজ্জনার কে দিয়ে ঘটনার পুনঃনির্মাণ এ পাঠানোর সময়েই প্রশাসন কী ঠিক করে ফেলে নি কী ঘটতে চলেছে? আমরা তো এমন আইন চেয়েছিলাম যার ইমপ্লিমেন্টেশনের মাধ্যমে ধর্ষণ নামক অভিশাপ থেকে মানুষ মুক্ত হয়। অপরাধীদের হত্যার মাধ্যমে সেই আইন প্রতিষ্ঠার পথ ব্যহত হল না? কারণ কেসটাই তো বন্ধ হয়ে যাবে এবার। হায়দ্রাবাদে অপরাধীর মৃত্যু, উন্নাও এ ভিকটিমের মৃত্যু দুটো ধর্ষণ সংক্রান্ত কেস বন্ধ হওয়া ভারতে ধর্ষণ বিরোধী শক্তিশালী আইন প্রতিষ্ঠার পথে কত বড় বাধা হল সেটা নিয়ে আলোচনা উঠবে না? দিনের শেষে লাভবান হল তো প্রিভিলেজডরাই।

অনেকে বলছেন নিজের ঘরে রেপ হলে বুঝতে কেন এই এনকাউন্টারকে সমর্থন করছি। কাউন্টারে এটাও সত্যি যে নিজের ঘরে এনকাউন্টার হলে বুঝতে কেন আমরা রেপ এবং এনকাউন্টার দুটোরই বিপক্ষে। আপনি ক্ষেত্রবিশেষে এনকাউন্টার এর সমর্থক হতে পারেন না। হয় আইন অথবা এনকাউন্টার যে কোন একটার পক্ষে দাঁড়াতে হবে। আমার দুই মামাকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যুক্ত থাকার অপরাধে পুলিশ বাড়িতে ঢুকে তাদের মায়ের সামনে গুলি করে মেরেছিল ৭২ সালে। আমি যদি এনকাউন্টার সমর্থন করে ফেলি তাহলে এই ঘটনাকেও সমর্থন জানাতে হয়। কারণ আইন না হলে এনকাউন্টার যে কোন একটাই বেছে নিতে পারেন আপনি। আর এনকাউন্টারকে বেছে নিলে প্রিভিলেজডরা যে কোনদিনই শাস্তি পাবে না সে ব্যাপারে নিঃসংশয় থাকুন। আর আরো বেশি আশঙ্কিত হোন এই ভেবে যে শুধু প্রিভিলেজড ধর্ষকে ভর্তি পৃথিবী আরো কত ভয়ঙ্কর হতে পারে।

***একটা কথা সবাই মাথায় রাখুন, গণতন্ত্রের শর্ত এই যে আমরা সকলেই সহমত না হয়েও যেন আলোচনা চালিয়ে যেতে পারি। এমন কিছু করবেন না, যাতে আলোচনা ঘেঁটে যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন