রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

রাজীব কুমারের দৌড় ~ সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়

লাস্ট ল্যাপ দৌড়চ্ছেন রাজীব কুমার ।    
আই পি এস হয়ে ১৯৮৯ সালে পুলিশ একাডেমীর ১১ কিলোমিটার দৌড়ে প্রথম হয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন রাজীব । 
আজও সেই দৌড় থামলনা । এবারের দৌড়টা লম্বা । হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্ট আবার হাইকোর্ট  । শেষে চেপে বসল গলার ফাঁস । রাজ্যের গোয়েন্দা প্রধান বেপাত্তা । পৃথিবীর ইতিহাসে হয়তো প্রথম । তাতে কি এসে যায়  'হীরক রাণী'র । যাকে বাঁচাতে গিয়ে রাজীবের গলায় এই ফাঁস ।    

সত্যজিৎ রায় বেঁচে থাকলে বাঙালি নির্ঘাত একটা 'হীরক রাণীর দেশে' পেত । সত্যজিৎ রায় নিশ্চিত যেতেন না নজরুল মঞ্চে  কালীঘাটের কচি খুকীর আদিখ্যেতা সভায় কিন্তু  পেতেন একটা বঙ্গশ্রী কিমবা বঙ্গ বিভীষণ জাতীয় পুরষ্কার । মঞ্চে হয়তো উনি বলতেন – 'আমাদের সত্যজিৎ দা' আসতে পারেন নি । ওঁর হয়ে অরূপ নেবে পুরস্কার । পৌঁছে দেবে 'আমাদের সত্যজিৎ দা'র কাছে ......ইত্যাদি ইত্যাদি ।   
 
সেই হীরক রাণীর দৌলতেই রাজীবের প্রাণ আজ ওষ্ঠাগত । ২০১৪ এ যেদিন রাত দেড়টায় UBI ব্যাংকের লকার খুলিয়ে সুদীপ্ত সেনের স্ত্রী পিয়ালির হেফাজতে থাকা সমস্ত নথী সরিয়েছিলেন রাজীব, সেদিন কি বুঝতে  পেরেছিলেন এই দিনটা আসতে পারে যখন হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রীটের যুবরাজের দোতলায় তাঁকে রাত কাটাতে হবে । কখনো ভেবেছিলেন যে শুধু সি বি আই-য়ের অনুরাগের ছোঁয়া থেকে বাঁচতে অমিত শাহের সঙ্গে একটা এপয়েণ্টমেণ্ট পেতে দিল্লী প্রবাসী রুড়কি আই আই টির ব্যাচমেটকে ধরতে হবে ! 

ভাবেন নি । ভাবার  কোন প্রয়োজনও ছিল না । ঝকঝকে কেরিয়ার । স্কুল জীবনের পড়াশুনা শেষ করেই  রুড়কি আই আই টি । অসম্ভব ভালো রেজাল্ট নিয়ে mechanical engineer । এরপর  administrative service এ বসা । এবং উত্তীর্ণ হয়েই আই পি এস-এ আসা । বেঙ্গল ক্যাডারে । তার আগে এক বছর HCL এ চাকরি জীবন । 

বেঙ্গল ক্যাডারে যোগ দিয়েই দুর্গাপুরে পোস্টিং । বীরভূমের পুলিশ সুপার । efficient অফিসার হিসেবে ততদিনে পরিচিতি পাঁচ কান হয়েছে । বুদ্ধবাবুর  কানেও তুলেছেন সচিবরা । ২০০১ সালে যেদিন খাদিম কর্তা পার্থ রায় বর্মণকে তুলে নিয়ে গেল দুবাইবাসী আফতাব আনসারির লোকজন রাজীব তখন সি আই ডি তে । টানা সাত দিন অফিস ছেড়ে নড়েন নি । টুথ ব্রাশটাও বাড়ী থেকে আনিয়ে নিয়েছিলেন । আফতাবকে দুবাই থেকে আনিয়ে ছেড়েছিলেন । তারও আগে  মার্কিন কনস্যুলেট আক্রমণের পর এই আফতাবই দুবাই থেকে রাজীব ভাই বলে ফোনটা কেটে দিয়ে বার্তা দিয়েছিলেন ।  আলিপুরের সংশোধনাগারের আট ফুট বাই ছ ফুটের অন্ধকার কুঠুরিতে দিন কাটানো আফতাব একদিন কথায় কথায় জেলারকে বলেছিলেন – রাজীব কুমার না থাকলে আমি আজ দুবাইতেই থাকতাম । ২০০৯ এ যখন জঙ্গল মহলে ছত্রধর মাহাতোরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে পুলিশকে সাংবাদিক সাজিয়ে ছত্রধরের কাছে পাঠিয়েছিলেন । নিজে লুঙ্গি পড়ে পেছনে । ছত্রধর ধরা পড়েছিলেন । ২০০৬ এ হুব্বা শ্যামলের দাপটে পুর্ব কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ত্রাস চলছে । কলকাতার আন্ডার ওয়ার্ল্ড ডন । হুব্বা শ্যামলের মুখের কোন ছবিও নেই পুলিসের কাছে ।  পুলিশকে নাকানি চোবানি খাওয়াচ্ছে । রাজীব  সূত্র মারফৎ খবর পেলেন হুব্বা শ্যামল সল্ট লেকের মাল্টিপ্লেক্সে  কলিযুগ সিনেমা দেখতে আসবেন । প্লেন ড্রেসে একাধিক সহকর্মীকে নিয়ে মিশে গেলেন ভিড়ে । আচমকাই একজনকে পেছন থেকে রাজীব নিজেই হাঁক পাড়লেন –  শ্যামলদা ।  হুব্বা পেছন ফিরতেই রাজীব হাত বাড়িয়ে দিলেন । আজও হুব্বা শ্যামল সেন্ট্রাল জেলে । 

সহকর্মীরা বলেন রাজীব কুমারের ব্রেনটা কম্পিউটার । বাম আমলে ফোন tapping তাঁর মস্তিস্ক প্রসূত । মমতার গতিবিধি সব কিছু track করা নিপুন দক্ষতায় করতেন । মমতা জানতেন সেটা । ২০১১ এ এসে মমতা খোঁজ করেন রাজীবের । ঠিক করেন এমন জায়গায় পোস্টিং দেবেন যাতে জীবনের মত শিক্ষা হয় । মনীশ গুপ্ত  বুদ্ধি দেন  - রাজীবকে কাজে লাগান ।  he is extra-ordinary । রাজীবের সঙ্গে নয়া প্রশাসনের সমঝোতা express চালু হয় । খাগরাগড় বিস্ফোরণের মুজাহিদিন সাজিদকে পাকড়াও করেন রাজীব । আরও কাছে আসা শুরু । বিধান নগরের পুলিশ কমিশানার পদপ্রাপ্তি । ততদিনে মমতা টের পেয়ে গেছেন  রাজীব আনুগত্য বিক্রি করতে পারেন । at the cost of কেরিয়ার । রাজীবও বুঝে গেছেন কি চান তাঁর প্রভু । দ্রুতাতার সঙ্গে কাছে আসা সেই শুরু হয়   ।  EDর নাগাল এড়াতে রাত একটায় অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সুদীপ্ত সেনের স্ত্রী পিয়ালি সেনের ব্যাঙ্ক লকার খুলিয়ে সারদার সব তথ্য হাপিশ করা । সারদার অফিস থেকে সব document সরানো রাজীবের টুপিতে পালকের পর পালক গুঁজতে শুরু করেন নিজেই ।  এ সময় এমনও দিন যায় রাজ্যের ডি জি কে বাইরে বসিয়ে রেখে  কালীঘাটে রাজীবের সঙ্গে close door মিটিং করেন উনি, কয়েক ঘণ্টা । ব্যথিত ডি জি নির্বাক হয়ে অফিস ফিরে যান ।  
      এরপরই  বিধাননগর থেকে   লালাবাজারের দুরত্ব ঘুচিয়ে দেন মমতা  । অনেককে টপকে কলকাতার নতুন  নগরপাল  হন রাজীব কুমার ।  খূব দ্রুত হাঁটতে শুরু করেন রাজীব । অধীর চৌধুরী, সূর্যকান্ত মিশ্র, দিলীপ  ঘোষ, মুকুল রায় এমনকি শুভেন্দুর ফোন tap ও track  করানোর কাজগুলোতেও নিখুঁত পেশাদারিত্ব আনেন রাজীব । প্রতি বেলায় তার বয়ান চলে যায় নবান্নের নেত্রীর android সেটে । ক্রমেই হয়ে ওঠেন সাইবার বিশেষজ্ঞ । নগরপাল হয়েও বহু রাত কাটে তাঁর লর্ড সিনহা রোডের গোয়েন্দা বিভাগে । পূর্ব ভারতের transit route হিসেবে বহু criminal কলকাতাকে ব্যবহার করে । তার বিস্তৃত তথ্য থাকে রাজীবের ফোনের ডগায় । পৃথিবীর সমস্ত দেশের পুলিশ কমিশনরদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ইসরায়েল গিয়ে মোসাদের আধুনিক প্রজুক্তিকে মগজ বন্দী করে আনেন রাজীব ।      
সেই রাজীবকে মমতা কাজে লাগালেন নিজের আর দলের চৌর্যবৃত্তি আড়াল করতে । রোজভ্যালির গৌতম কুণ্ডুকে দিনের পর দিন এই রাজীব কুমার বোঝালেন – আড়াল করুন । ভুলেও নাম নেবেন না শাসক দলের beneficiary  নেতাদের । যত চাপই আসুক ।  এই রাজীব কুমারই আবার সি বি আই-এর জেরায় বলেলেন  সুদীপ্ত সেনের বিধান নগরের অফিসের কম্পিউটার মনিটারগুলো তিনি বাজেয়াপ্ত করেছিলেন । CPU গুলো নয় । কারণ তিনি নাকি জানতেন ই না যে CPU তেই জমা থাকে আসল তথ্যগুলো । CBI অফিসার রা অনেক ক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন তাঁর দিকে ।  
এই রাজীবই আবার সি বি আই কে বলেলেন – সারদা, রোজ ভ্যালি বা চিট ফান্ড-এর বিষয়ে তিনি নাকি কিছুই জানেন না । সি বি আই অফিসাররা তাঁকে মনে করান তাঁর পুরানো বয়ান যেখানে তিনি বলেছিলেন সুপ্রিম কোর্টে তিনি হাজির থাকতেন রাজ্য সরকারের উকিলদের সাহায্য করতে ।  রাজীব নিরুত্তর থাকেন । 

এই উত্তরহীন রাজীব এখন দৌড়চ্ছেন  নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে । কালীঘাটের 'উনি' এখন শেষ ভরসা, রাজীবের । ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যায় এই 'উনি'ই রাজীবের জন্য পথে বসেছিলেন ধর্নায় । সেই 'উনি' এখন কালীঘাটে আড়াইশো  প্রহরীর নিশ্চিন্ত পাহারায় ঘুমোচ্ছেন  প্রতি রাতে । রাজীব এখন রাত জাগেন প্রতি রাতে । রামকৃষ্ণ মিশনের মোহন মহারাজের  গাইডেন্সে  mathematics এ Phd করছিলেন রাজীব । মাথার ওপর টাঙানো থাকে রবীন্দ্রনাথ আর আইনস্টাইনের ছবি  । সেই রাজীব আজ বড্ড আশ্রয়হীন । মাথার ওপর টাঙানো ছবিগুলো এখনো তাঁর বাংলোয়ে হয়তো আছে । মাথার ওপর ছাদটা সরে গেছে ।  অনেক পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে 'ভুবনেশ্বর' এখন প্রতি মুহূর্তে তাঁকে ডাকছে ।     

রাজীব, শুনছেন...... আপনি যান, পালিয়ে না বেড়িয়ে । ভিটে মাটি হারানো চিট ফাণ্ডের বহু রাত জাগা মানুষগুলো আপনার ভুবনেশ্বর যাওয়ার দিনে আনন্দে ডুকরে কেঁদে উঠবে । এবারের পুজোটা  জেলের মধ্যে বসেই ঢাকের আওয়াজ শুনুন আপনি । সামনের বছর, নিশ্চিত থাকুন, কালীঘাটের যুবরাজ আপনার সঙ্গ দেবে । একাকীত্ব কেটে যাবে । 

যান রাজীব যান, ভুবনেশ্বর আপনাকে ডাকছে ।

সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়  ( ৯৮৩০৪২৬০৭৮ )

1 টি মন্তব্য: