বুধবার, ২৪ জুলাই, ২০১৯

লুচি ~ অনিন্দ্য

লুচি হলো  মশাই বাঙ্গালীর হেঁশেলের সুচিত্রা সেন । যতই মাধবী , সাবিত্রীর ধারালো অভিনয় , সুপ্রিয়ার চাপা যৌনতা , অপর্ণা সেনের আদ্যন্ত শহুরে বুদ্ধিদীপ্ত  ম্যানারিজম , গঙ্গা গার্ল সন্ধ্যা রায়ের গ্রাম্য সারল্য , বা অরুন্ধতি দেবীর রাবীন্দ্রিক সফিস্টিকেশনের কথা বলুন না কেন , দিনের শেষে ঘাড়টা বেঁকিয়ে , কাজল – কালো দীঘল চোখে উদ্ধত ভাবে বলা " ও আমাকে টাচ করতে পারবে না"--- এটাই বাঙ্গালী রোম্যান্টিসিজমের শেষ কথা । উফ ! কি তাকানো ! একটা ছুরি যেন বুকের এদিক দিয়ে ঢুকে ওদিক দিয়ে বেরিয়ে গেলো । মনে মনে  কল্পনা করুনতো রবিবারের সকাল , আপনার পাতে এসে পড়লো চারটি থেকে ছয়টি গরম লুচি , সাথে কালোজিরে , কাঁচালঙ্কা দেওয়া সাদা আলুচচ্চড়ি , বা চারটি বেগুনভাজা , নরম পান্তুয়ার মতো যার ওপরটা গাঢ় ব্রাউন , আর ভিতরের শাঁসটা নরম আর শাদাটে । আর সাথে অবশ্যই থাকবে একবাটি ঘিয়ে জবজবে মোহনভোগ , ভিতরে কাজুবাদাম আর কিশমিশে ঠাসা । আপনি আঙ্গুল দিয়ে গরম লুচির ওপরটায় আলতো ভাবে একটা টোকা দেবেন , যেন সপ্তপদীর কৃষ্ণেন্দু পরম মমতায় রীণা ব্রাউনের গালে হাত বোলাচ্ছে । এরপর ভিতর থেকে ফুস করে একটু ধোঁয়া বেরিয়ে এলো , যেন শঁপাঞের  ( বানান কার্টসি মানিকবাবু)বোতলের কর্কটা  খোলার পর সামান্য ভুড়ভুড়ি , আপনি তিনকোণা করে আঙ্গুল দিয়ে একটা টুকরো ছিঁড়লেন , চচ্চড়িটা বা বেগুনভাজাটা মাঝখানে দিয়ে গালে ফেললেন , এবার  চোখটা বুজে  আস্তে আস্তে চিবোন , মাইরি বলছি , আপনার অতিপরিচিত খাণ্ডার অর্ধাঙ্গীনিকেও সাত পাকে বাঁধায় গুণ্ডা ভেবে বসা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে মাসতুতো ভাইয়ের বাড়িতে কলেজের প্রফেসর হিসাবে আবিষ্কার করে  লজ্জিত সুচিত্রা সেনের মতো লাগবে । 

                   বাংলা ছবির সুপ্রতিষ্ঠিত নায়িকাটির মতো লুচিও তার সহযোগী নির্বাচনের  বিষয়েও অত্যন্ত খুঁতখুঁতে । এতো আর একথালা ভাত নয় যে যেমন তেমন করে গবগবিয়ে খেয়ে নেবেন , লুচি হলো গিয়ে বাঙ্গালির ভোজন সংস্কৃতির চুড়ান্ত রোম্যান্টিক স্বপ্নবিলাস । যদি হয় কোন নেমন্তন্ন বাড়ি তাহলে লুচির সঙ্গে আপনাকে রাখতেই হবে লম্বা করে কাটা বেগুনভাজা , ডাঁটিশুদ্ধ  লম্বমান , তার পরেই আসবে আলুর দম, শুকনো শাদা , কড়াইশুঁটি মাখানো ,আর ঘন , গাঢ়  ছোলার ডাল, যার  ভিতরে নারকোল কুচি আর কিশমিশের স্বাদে আপনি সদ্য বিবাহিত জামাইবাবুর প্রতি রহস্যময়ী  অবিবাহিতা শ্যালিকার দুষ্টুমির স্পর্শ পাবেন ।  আবার প্রাতরাশ হলে আগেই বলেছি এর সঙ্গে অবশ্যই থাকবে শাদা আলুচচ্চড়ি ,  স্বয়ং মহানায়ক উত্তমকুমারও নাকি এই দেবভোগ্য বস্তুটির একান্ত অনুরাগী ছিলেন ( বেণুদি উবাচ ) । আপনার নিশ্চয়ই এতক্ষণে মনে পড়ে গেছে  নিশিপদ্ম ছবিটার কথা , অনঙ্গবাবু ( উত্তম কুমার ) লুচি আলু চচ্চড়ি খাওয়ার আবদার করছেন পুষ্প ( সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়) এর কাছে , কাটলেট ভেজে খাওয়ানোর আমন্ত্রণ উপেক্ষা করে । গরম লুচির সাথে যদি তরকারি বা বেগুনভাজা তেমনই ঠাণ্ডা লুচির সঙ্গে মিষ্টি জাতীয় খাবারের সঙ্গতটাই ভালো । হেমন্তকালের কোজাগরী লক্ষীপুজোর ঘন সরপড়া পায়েসের সাথে ঘিয়ে ভাজা মিইয়ে যাওয়া লুচি ----- যেন ইন্দ্রাণী ছবিতে উত্তম সুচিত্রার লিপে হেমন্ত মুখুজ্জে – গীতা দত্তের ডুয়েট "  নীঢ় ছোট ক্ষতি নেই আকাশতো বড়" । আবার ধরুন গিয়ে মিয়োনো লুচির  ওপরের চামড়াটা  আলতো করে তুলে নিয়ে তলার মোটা অংশটা দিয়ে লালচে রঙের মিষ্টি দই ---- যেন দীপ জ্বেলে চাই বা মেঘ কালো ছবিতে বসন্ত চৌধুরীর দৃপ্ত পৌরুষের সঙ্গে মিসেস সেনের অনাবিল ন্যাকামি । আবার একটু বেশী ময়াম দেওয়া খড়খড়ে লুচির সঙ্গে আপনাকে খেতেই হবে সেন মহাশয়ের দোকানের ঘিয়ে ভাজা সীতাভোগ আর মিহিদানার মিশ্রণ , সাদা আর হলুদে মাখোমাখো , মাঝে মাঝে রম্বসাকৃতি রসে ভেজানো ছানার মুড়কির দ্রঢ়িমা । ঠিক যেন অসিত সেনের জীবন তৃষ্ণা , রুক্ষ অহংকারী , উত্তম কুমারের সঙ্গে ব্যক্তিত্বময়ী সুচিত্রা সেনের দুষ্টুমিষ্টি সংঘাতের মধ্যে দিয়ে প্রণয়ের ইতিহাস । 

                              আমাদের আম বাঙ্গালীর প্রাত্যহিক যাপনের সাথে অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে আছে লুচি । ষষ্ঠিপদ চট্টোপাধ্যায়ের পাণ্ডব গোয়েন্দা বা সুচিত্রা ভট্টাচার্যের অঘটনঘটন পটীয়সী মিতিনমাসির ভ্যাবলা স্বামী পার্থ , লুচি সবারই  হট ফেভারিট । বেড়াতে গেলে টিফিন ক্যারিয়ারে চারটি লুচি- আলুর দম , বাক্সভর্তি কড়াপাকের সন্দেশ , জলের বোতলে  জল , আর পেল্লায় সবুজ রঙের হোল্ডল ----  বাঙ্গালীর বেড়াতে যাওয়ার অনিবার্য অনুষঙ্গ ছিলো – এই প্রজন্ম যদিও তার খবর রাখে না ।  ভাবুনতো আপনার কোথাও যাবার তাড়া আছে , পরিবারের কর্ত্রী যদি " চট করে কটা লুচি ভেজে দিই" বলার পরিবর্তে বলে " কটা রুটি সেঁকে দিই" , আপনি কি একটু ইনসিকিওর্ড বোধ করবেন না ।  এমনকি  বাঙ্গালীর আল্টিমেট পরকীয়ার সাথেও কিন্তু লুচির অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে । কিরণময়ী যদি রান্নাঘরে লুচি ভাজতে ভাজতে উপেন্দ্রকে নিজের মনের কথাটা না বলতো , চরিত্রহীন উপন্যাসের ট্র্যাজেডিটা দাঁড়াতো কি ! 

                                অবশ্য একথা ঠিক সবার হাতে লুচি ঠিক ফোলে না । ফুলকো লুচি ভাজা , থোড় , মোচা আর ডুমুর কোটা , আর তিলের নাড়ুর সঠিক পাক দেওয়া ---- এই তিনটে হলো গিয়ে বাঙ্গালী গৃহিণীর সুরন্ধনকারীনি হওয়ার লিটমাস টেস্ট । মনে করুনতো পারমিতার একদিন ছবিটার কথা , সনকা ( অপর্ণা সেন)  টিভিতে আদর্শ হিন্দু হোটেল সিরিয়াল দেখছেন , দুই পুত্রবধু লুচি ভাজছে , স্বামী দুলাল লাহিড়ী খেঁকিয়ে উঠলেন লুচির  গুণমান নিয়ে । বিরক্ত সনকা উঠে লুচি ভাজতে বসলো , আর আমরা পর্দায় ফুলকো লুচি দেখলাম --- ছবিটির জন্য প্রয়োজনীয় উত্তর কলকাতার মধ্যবিত্ত জীবনের আবহটি কেমন তৈরি হয়ে গেলো । আসলে লুচি ফোলানোর একটি মেধাবী টেকনিক আছে , সেটি হলো খুব গরম তেলে লুচির লেচি ছেড়ে দিয়ে খুন্তি দিয়ে লেচির ধারটা আলতো করে চাপ দিতে হয় , তবেই লুচি ফোলে । 

                        আজ বাঙ্গালী আন্তর্জাতিক হয়েছে , তার বিবাহ অনুষ্ঠান থেকে লুচি ব্রাত্য হয়ে গেছে , এই প্রজন্মও বোধ করি জাঙ্ক ফুডের আকর্ষণে এই সব আটপৌরে খাবারের স্বাদ প্রায় ভুলতে বসেছে । আজ কষ্ট হয় সেইসব ছেলেমেয়েদের জন্য , যারা কে এফ সি , ম্যাকডোনাল্ডস , ডোমিনোজের পাঁউরুটি চিনলো কিন্তু ঘরোয়া হেঁশেলের লুচি – তরকারির অনুপম স্বাদ জানলো না ।

(লেখা ও ছবি সংগৃহীত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন