বৃহস্পতিবার, ১৬ মে, ২০১৯

বিভাজনের রাজনীতি ~ ড: রেজাউল করীম

আনন্দবাজার একটা আবেগময় পোস্ট এডিটে  মমতা বন্দোপাধ্যায়কে জেতানোর আবেদন জানিয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছি, বিজেপি একটি মুসলিম বিরোধী, সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদী দল। সেদিন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে ব্যর্থ, হতাশাগ্রস্ত হয়ে তারা বাঙালী-প্রাণপুরুষ বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছে। এ বিষয়ে ও কোন মতভেদ নেই যে, অনেক, হয়ত শতাংশের বিচারে বেশি নয় তাঁরা তবুও অনেক, শিক্ষিত মানুষ "মোদি মোদি" বলে চিৎকারের মূল কারণ যেমন মমতা বন্দোপাধ্যায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা, তেমনি বা তারচেয়ে বেশি সুপ্ত মুসলিম বিদ্বেষ । নরেন মোদির প্রচার তাঁদের অনেকের প্রাণে দোলা দিয়েছে,  "হাম পাঁচ, হামারা পঁচিশ" এই তত্বেও তাদের অগাধ বিশ্বাস। তারা এমন ও বিশ্বাস করেন যে, খুব শিগগিরই মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দুকে ছাড়িয়ে যাবে। কোন তত্বগত ভিত্তি এর জন্য দরকার নেই, বিশ্বাস ই যথেষ্ট।  যুগে যুগে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য আবির্ভাবের যে সংকল্প শ্রীভগবানের মুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছে সেই যুগবতারের আবির্ভাব হয়েছে। তিনি অপাপবিদ্ধ, তিনিই এই দেশের একমাত্র সমাধান-দুর্নীতি থেকে, বেরোজগারি থেকে, অর্থনৈতিক মন্দা থেকে এই পুণ্যভূমি তিনি রক্ষা করবেন! "ধন্য আশা কুহকিনী। তোমার মায়া অসার সংসার চক্র ঘোরে নিরবধি।"

অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষ আমার কাছে একান্তে স্বীকার করেছেন যে, মুসলিম জনসংখ্যার "স্ফীতি যথেষ্ট আশঙ্কার কারন"। ভাবনার জগতে  এই পরিবর্তন রীতিমতো স্থায়ী হয়ে যাচ্ছে দুটি কারণে। প্রথম কারণ অবশ্যই মুসলিম সম্প্রদায়ের লুম্পেন অংশকে কোন রাখঢাক না রেখে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার। সব দলই এই অংশকে ব্যবহার করে, তৃণমূল এই ব্যাপারে নির্লজ্জ, দুকানকাটা। দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই , মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সংখ্যালঘু নীতি। তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য দরকার ছিল  শিক্ষার বিস্তার ও অর্থনৈতিক মানোন্নয়ন। তিনি সে পথে না গিয়ে মাদ্রাসা প্রীতি দেখাতে শুরু করলেন, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কর্মসংস্থানের কথা না ভেবে ইমামদের ভাতার ব্যবস্থা করলেন।  মুসলিমদের আলাদা বাজার , এমনকি আলাদা মেডিকেল কলেজ ঘোষনা করলেন। সাচ্চার রিপোর্টে দেখা যায়, মুসলিমদের মাত্র চার শতাংশ মাদ্রাসা শিক্ষায় আগ্রহী ও শতকরা তিরিশ ভাগ বেশি পয়সা খরচ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের পাঠাতে আগ্রহী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কার  প্ররোচনায়  মাদ্রাসা ও ইমাম ভাতার কথা ভেবেছেন জানিনা। কিন্তু, আম ভদ্র হিন্দুর কাছে যে বার্তা পৌঁছালো তা খুব মর্মস্পর্শী- তাঁরা মুসলিম মানেই মাদ্রাসা, মুসলিম মানেই ইমাম ভাতা, মুসলিম মানেই ওবিসি এই ধারনায় আক্রান্ত হলেন। 

"নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে/নাচাও তেমনি তুমি অর্বাচীন নরে" এই পংক্তিটি শুধু কথার কথা নয়। কবির সুমন বাবু একদিন আমাকে বলেছিলেন- মমতা বন্দোপাধ্যায় হলেন খনা। দুশো বছর পর তার নামে মন্দির তৈরী হবে। তাঁর সেই কথা সত্য হবে কিনা জানিনা তবে এই রাজ্যের দরিদ্র জনতা যে তাঁকে গ্রহন করেছিলেন তার প্রমান ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। কিন্তু তিনি সবাইকে হতাশ করেছেন ও বাংলায় বিভাজন তরান্বিত করতে তাঁর ইন্দ্রজাল কাজে লাগিয়েছেন। বিশেষতঃ সচেতন অসাম্প্রদায়িক মানুষের ভাবনার জগতে হিন্দু মুসলিম বিভাজন আরো বেশি গাঢ় হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর আচরণে। মুসলিম ভোটের জন্য পাগল হয়ে তিনি বিশেষ বিশেষ মহল্লায় বেশবাশে সচেতন যত্ন নিতে শুরু করলেন। গ্রামে গঞ্জে চাষী মুসলমান, যারা এ রাজ্যের মুসলমান জনসংখ্যার সিংহভাগ, তারা আর পাঁচজন বাঙালীর মত মাথায় ঘোমটা দেন। কিন্তু বিশেষ পোষাক পরে মুখ্যমন্ত্রী একটি নতুন ঘরাণার সাথে মুসলিম সম্প্রদায়ের একাত্মতা তৈরীর চেষ্টা করলেন। তাঁর ইন্দ্রজালে মুগ্ধ হল নিরক্ষর, অনভিজ্ঞ, সহজ সরল গ্রামীন মানুষগুলি।  ওয়াহাবি চেতনার সাথে যুক্ত এই বেশবাস গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করলো। যে ভাবে ওপার বাংলায় বাঙালী-মুসলিম, মুসলিম-বাঙালীতে রূপান্তরিত হয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী সেই পরম্পরা তৈরিতে বিশেষ উদ্যোগ নিলেন। একশ্রেণীর মুসলিমদের ভোট তিনি পেলেন কিন্তু বিভাজনও হল সম্পূর্ণ । 
এই অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রী তাঁর স্বাভাবিক অভিনয় জারি রেখে বিজেপিকে হারাতে ভোট যাঞ্ছা  করছেন। এই সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির স্রষ্টা  তিনিই, খুব সচেতন ভাবে তিনি এই মহাযেজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন। আর ফেরার কোন পথ বাকি নেই। সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির উন্নতির স্বার্থে তাঁর বিদায় প্রয়োজন, হয়ত সেটাই অবধারিতও।  আনন্দবাজার যতই আবেগময়, ওজস্বীতা দেখাক, বিভাজনের রাজনীতি ঢাকিসহ বিসর্জন ভবিতব্য। বাঙালী যেমন বিজেপি কে চিনতে ভুল করে নি, তাঁর বিভাজনের রাজনীতি সম্পর্কে ও সম্যক অবহিত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন