শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০১৯

ভোট ~ সুশোভন পাত্র

পাত্তা দেওয়ার মত বামপন্থী'দের প্রার্থী তালিকায় কি আছে মশাই? না আছে চমক, না আছে গায়ক, না আছে নায়ক। প্রার্থী তালিকা হবে তৃণমূলের মত। ভোজ বাড়ির পাতের শুরুতেই রায়গঞ্জে মার্কা মারা সঙ্ঘ পরিবারের ক্যাডার থাকবে। ডাল-ভাতের পর শুক্তোর সাথে মাঝ পাতে মতুয়া'দের ধর্মীয় ভাবাবেগ চটকে দেওয়ার রেসিপি থাকবে। ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেওয়া সাংসদের এক্সচেঞ্জ অফারে, আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের কোকাকোলা খাওয়া প্রার্থীর কনটেম্পোরারি টাচ থাকবে। দক্ষিণবঙ্গে কোলেস্টরেল কে ভেংচি কেটে শিঙ্গাড়ার সাথে ঘুষ খেতে অভ্যস্ত'দের টিকিট জুটবে। আর্থিক দুর্নীতি তে অভিযুক্ত জেল ফেরত আসামীরা তালিকায় জামাই আদর পাবে। সংসদে ১১% উপস্থিতির রেকর্ড নিয়ে 'মহানায়ক' আবার ভোট চাইবে। আর শেষ পাতে মাস্টার শেফের ট্রাম্প কার্ডে গ্ল্যামার দুনিয়ার চমচম কেষ্টদা'দের প্লেটে নকুলদানা হয়ে গড়াগড়ি খাবে। মিমি কি খেলেন, নুসরত কি পরলেন -স্টুডিও তে ঘণ্টাখানেক বসবে। অবশ্য গৃহপালিত হলেই যে মিডিয়ার মেরুদণ্ড থাকতেই হবে এমন তো মাথার দিব্যি দেওয়া নেই। সরকারী বিজ্ঞাপন পেলে সরীসৃপও তো পোষ মানে।  
পাত্তা দেওয়ার মত বামপন্থী'দের ইশতেহারে কি আছে মশাই? ইশতেহার হবে এন্টারটেনমেণ্ট প্যাকেজের মত। রামমন্দিরের সুড়সুড়ি দেবে। কাশ্মীর নিয়ে গসিপ করবে। এনআরসি নিয়ে চিমটি কাটবে। ১৫ লক্ষ ঢুকিয়ে দেওয়ার হিসেব কষবে। বছরে ২কোটি চাকরির গরু গাছে চড়বে। কোথায় হালকা করে বগলের নিচে চুলকে দিয়ে পাকিস্তান নিয়ে তিনটে প্যারাগ্রাফ নামাবে, তা না, বামপন্থী'রা ইশতেহারে কৃষক-শ্রমিক-বেকার'দের নিয়ে পাতা ভরিয়ে পাড়া মাথায় তুলেছে। মাসিক ৬হাজার বার্ধক্য ভাতা চেয়েছে। জনস্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়িয়ে জিডিপির ৫% করার গাজন গেয়েছে। কি আহাম্মক বলুন দেখি? আরে, ভোটের মুখে গাজন গাইতে হলে রামের নামে গাও, তা না, আবার সর্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থা শক্তিশালী করার কাঁদুনি গাইছে? শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি ব্যয় জিডিপির ৬% করতে বলে কেত্তন করছে? ধনী'দের সম্পদের উপর ট্যাক্স বৃদ্ধি চাইছে? মগের মুল্লুক নাকি? স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতে জিডিপির ১১% ব্যয় করলে, ফি-বছরে সরকারী কোষাগার থেকে লক্ষ কোটির কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড় দেওয়ার হিসেবটা কি অরুণ জেটলির খাতায় কে সি নাগ এসে মিলিয়ে দিয়ে যাবে? আর ধনী'দের সম্পদের উপর ট্যাক্স বাড়ালে আম্বানি-আদানি'দের মালাই চেটে চর্বি জমানো নেতা গুলো কি না খেতে পেয়ে মরবে? যতসব!    
ভুলেও বামপন্থী'দের ভোট দেবেন না। ক্ষমতার লোভ নেই। লাল বাতির গাড়ি চাপার জন্য জিভে জল নেই। কুর্সির শাহানশাহ খুঁজতে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে রোমাঞ্চ নেই। ২০০৪-এ লোকসভা নির্বাচনে ৬১টা আসন জিতে একটাও মন্ত্রিত্ব নিল না মশাই। আদর্শ, সততা, প্রত্যয়, নীতিনিষ্ঠতা? কি করবেন এসব নিয়ে? পাঁপড় ভাজবেন? মনে নেই, সেদিন যখন পরিষ্কার বামপন্থীদের ছাড়া নতুন সরকার গঠন অসম্ভব, ওমনি বাজপেয়ী সরকারের বিলগ্নীকরণ মন্ত্রকের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে এ বি বর্ধন বলেছিলেন, 'ভাড় মে যায়ে উয়ো মন্ত্রক, অর উসকা মন্ত্রী।' ব্যাস, ঐ দুটো লাইনেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল আগামী ৫ বছরের রাজনীতির অ্যাজেন্ডা। ভেইল, নালকো -একের পর এক শিল্পে, শ্রমিকদের জঙ্গি মেজাজ আর ধর্মঘটের জেরে বিলগ্নী করতে নেমেও গুটিয়ে যায় কেন্দ্র। বামপন্থী'দের চাপেই তৈরি হয়ে কমন মিনিমাম প্রোগ্রাম। হাতি-ঘোড়া কি ছিল সেই প্রোগ্রামে? 
ছিল বলতে কিছু পিকচারের ট্রেলর। আজ গোটা দেশ জুড়ে চাষিরা যখন বারবার ফসলের ন্যায্য দাম চেয়ে পথে নেমেছেন, ঋণ মকুবের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন, ৫রাজ্যের ভোটে কৃষক অসন্তোষের যে পিকচার নরেন্দ্র মোদীরা দেখেছেন, সেই পিকচারের ট্রেলর। লোকে বলে, স্বামীনাথন কমিশন। আজ গোটা দেশ জুড়ে শ্রমিকরা যখন বারবার ন্যায্য মজুরি চেয়ে পার্লামেন্ট স্ট্রিট স্তব্ধ করে দিয়েছেন, সামাজিক নিরাপত্তার দাবিতে হরতাল করেছেন, ৫রাজ্যের ভোটে শ্রমিক অসন্তোষের যে পিকচার নরেন্দ্র মোদীরা দেখছেন, সেই পিকচারের ট্রেলর। লোকে বলে, অর্জুন সেনগুপ্ত কমিশন। ছিল বলতে, সবার জন্য ১০০ দিনের কাজের আইন, আদিবাসী'দের জন্য অরণ্যের অধিকার আইন, গার্হস্থ্য হিংসা বিরোধী আইন, তথ্যের অধিকার আইন। ছিল মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ দাবি, রুগ্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পুনরুজ্জীবনের দাবি। মাত্র ৬১টা আসন পেয়েই দেশের রাজনীতির অ্যাজেন্ডাই পুরো বদলে দিয়েছিল। কি বিপজ্জনক ব্যাপার ভাবুন!   
ভুলেও বামপন্থী'দের ভোট দেবেন না। সাংসদ করতে হলে মরশুমি মুনমুন সেন কে করুন, বাঁকুড়ার গরমে প্রচারে যেতে যিনি নতুন সানস ক্রিম খুঁজবেন। সাংসদ করতে হলে মিমি-নুসরত কে করুন, যাঁদের ভোটে জিতিয়ে দিলেই নিয়মিত সিনেমার পর্দায় দেখতে পাবেন। সাংসদ করতে হলে অর্জুন সিং, অনুপম হাজরা কে করুন, যাঁদের ভোটে জিতিয়ে দিলেই তৃণমূল-বিজেপির দড়ি টানাটানি দেখতে পাবেন। কৃষক আত্মহত্যা করে মরছে, মরুক; আপনি বরং গণেশের শুঁড়ের প্লাস্টিক সার্জারি নিয়ে ভাবুন। শ্রমিক না খেতে পেয়ে মরছে, মরুক; আপনি বরং গোমূত্রে ভেষজ গুন খুঁজুন। দেশের বেকারত্বের হার ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ, হোক না; ভোটে আপনার অ্যাজেন্ডা কিন্তু মন্দির-মসজিদ আর গোমাতা। 
বামপন্থীরা ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়ানো স্পিসিস। বামপন্থীরা ঠিক আজকের মতই, ভোটের পরেও পেট্রোল-ডিজেলের-গ্যাসের দামে আপনার হেঁশেলে টান পড়লেই লাল ঝাণ্ডা নিয়ে রাস্তায় নামবে। বামপন্থীরা ঠিক আজকের মতই, ভোটের পরেও কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম চেয়ে মাইলের পর মাইল পথ হাঁটবে। বামপন্থীরা ঠিক আজকের মতই, ভোটের পরেও শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি চেয়ে পার্লামেন্টে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার হুমকি দেবে। বামপন্থীরা ঠিক আজকের মতই, ভোটের পরেও ধর্মের নামে মানুষ খ্যাপানোর বিরুদ্ধে এলাকায় শান্তি মিছিল বের করবে। বামপন্থীরা ঠিক আজকের মতই, ভোটের পরেও আপনার বেকার ছেলের কাজের দাবিতেই রাত জেগে অনশন করবে। বামপন্থীদের না আছে চমক, না আছে গায়ক না আছে নায়ক। বামপন্থীরা ম্যাড়ম্যাড়ে। বামপন্থীরা সাদাকালো। বামপন্থীরা আপনার আমার মতই খুব সাধারণ। তাই একদম পাত্তা দেবেন না। আর পাত্তা দিলেও, ঐ যে বললাম ভুলেও বামপন্থী'দের ভোট দেবেন না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন