শনিবার, ১৭ নভেম্বর, ২০১৮

বনপলাশীর পাখ-পাখালি ~ মিনহাজ

এই যে আমরা শহুরে বাঙালিরা ইট কাঠ পাথরের জঙ্গলে দৌড়তে দৌড়তে হাঁপিয়ে গিয়ে একটু খানি দম ফেলার ফুরসত পেলেই ছুটে যাই গ্রাম বাংলায় তার একটা উদ্দেশ্য নিশ্চিত ভাবে গাছপালা নদী নালা পাহাড় টিলা র সৌন্দর্য্য আর সঙ্গে দূষন মুক্ত পরিবেশে ফুসফুসে কিছুটা বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়ে নেওয়া। তারপর ফিরে এসে নতুন উদ্যমে আবার দৌড় শুরু করা। কেউ ইঁদূরর আর কেউ বা বেড়াল হিসাবে।এরকম ই এক উদ্দেশ্যে গত পুজোয় ১১ জন বন্ধু বান্ধব কাচ্চা বাচ্চা মিলে ঘুরে এলাম মুরুগুমা। পুরুলিয়ার পশ্চিম প্রান্তে অযোধ্যা পাহাড়ের ঢালে মুরুগুমা ড্যাম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন প্রাক্তন ছাত্রের যৌথ উদ্যোগে প্রকৃতির কোলে ছবির মত সুন্দর রিসর্ট-বনপলাশী ইকো হাট। ছিম ছাম-খোলা মেলা গাছ গাছালি পুকুর- আড্ডা ঘর-গেজিবা সমেত একটা দারুণ ব্যাপার।প্রয়োজনীয় সব আছে কিন্তু বাহুল্য নেই। ড্যামের পাশে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা- পাকদন্ডি ধরে গাড়িচালিয়ে উঠে যাওয়া পাহাড়ে জঙ্গলে আদিবাসী গ্রামে ঘুরে বেড়িয়ে তিনটে দিন কেটে গেল হুস করে। মাঝে একটা দিন বাঁশপোড়া চিকেন আর ঝলসানো শোল মাছ সহযোগে খানাপিনা আর একটা সন্ধে পুরুলিয়ার বিখ্যাত ছৌ নাচের আসর আমাদের বেড়ানোর আনন্দ কানায় কানায় ভরিয়ে দিয়েছিল। সে কথা বিস্তারে লেখা যাবে অন্য কোন সময় । আজ লিখব একটু অন্য বিষয়ে।











এরকম পারিবারিক বেড়ানোর পাশাপাশি আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের একটি বিষয় হল পাখি। রঙ বেরঙ এর বিভিন্ন ধরনের দেশ বিদেশের পাখি বিভিন্ন সময় আসে আমাদের এই বাংলার আনাচে কানাচে। তাদের দেখা আর ছবি তোলার মধ্যে একটা অনাবিল আনন্দ আছে। সেই কারণে কোথাও বেড়াতে গেলে আমার ক্যামেরার ব্যাগ টা সঙ্গে নিয়ে নিই।

মুরুগুমা আলাদা করে পাখির জন্য খুব একটা বিখ্যাত জায়গা না হলেও গাছ পালা-খাল বিল আছে আর পাখি থাকবে না এমন হয়?
পৌঁছনর পরের দিন তাই একটু ভোর ভোর উঠে আশপাশ টা ঘুরে দেখার বাসনায় বেরতে যাব ওমনি দেখি আড্ডা ঘরের খড়ের চালে বাসা বানাতে ব্যস্ত বেশ কয়েকটা মুনিয়া পাখি। এদের ইংরেজী তে বলে Silver bill। পাশেই ছোট্ট পুকুর। পুকুর পাড়ে মাছ কিম্বা ব্যাঙ পাকড়ানোর ধান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে ধবধবে সাদা বক (Little egret) আর ল্যাজ নেড়ে নেড়ে খেলা করছে ছোট্ট পাখি খঞ্জনা (White Wagtail)। সারা গরম কাল ইউরোপ আর উত্তরের দেশগুলোতে কাটিয়ে শীত পড়তে না পড়তে সে চলে এসেছে আমাদের বাংলায়। 

গেটের মুখে পৌঁছে দেখি মিস্টার অ্যান্ড মিসেস রবিন (Indian robin)খেলা করছেন ইতি উতি। রিসর্টের নামের সাথে সাযুজ্য রেখেই বনপলাশীর আঙিনায় রয়েছে বেশ কয়েকটা পলাশ গাছ। পলাশের ডালে ডালে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট সব পাখি। বসন্তে যখন পলাশ ফুটবে -পাখিদের আনা গোনাও নিশ্চয় বাড়বে। আপাতত দুর্গা টুনটনি (purple sunbird) আর pale billed flowerpecker দেখতে পেলাম। দূরে ক্ষেতের মধ্যে একটা ছোট পলাশ চারার ওপর চুপটি করে বসে আছে কাজল পাখি (Brown shrike)। চোখের ওপর কালো দাগ থেকেই এমন নাম তার। ওই টুকু ছোটো পাখি-কিন্তু কি জোর তার ওই টুকুনি ডানায়! যার ওপর ভরসা করে সুদূর মোঙ্গলিয়া কিম্বা সাইবেরিয়া থেকে পাড়ি দিয়েছিল আকাশ পথে একটু উষ্ণতার জন্য। জিপিএস নেই কম্পাস নেই-শুধু অভিজ্ঞতা আর দুডানায় ভরসা করে হাজার হাজার নটিক্যাল মাইল জিওডেসিক পেরিয়ে সে পৌঁছে গেছে আমাদের দেশে।সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল আমাদের সাথে কাটিয়ে আবার ফিরে যাবে ওদেশে। ভিসা ও লাগবে না-ইমিগ্রেশনের ঝামেলা ও নেই। সংস্কৃত দেশ কথাটা র অর্থ যে ভৌগলিক সীমাবদ্ধ ভূখন্ড মাত্র নয়- এক ব্যাপক বিশাল পরিসর তা তথাকথিত সভ্য মানুষেরা না বুঝলেও এই পুঁচকে পরিযায়ী রা বোঝে।আর তাই বুঝি ছুটে আসে সেই সূর্যের দেশে যেখানে সংগীত এর নাম দেশ।
আমাদের দলনেত্রী অঙ্কের অধ্যাপিকা নীলাঞ্জনার (বউ এর ও বন্ধু আমার ও বন্ধু) ও পাখি দেখার সখ আর বেশ ভালো কোম্পানির দূরবীন দুই ই রয়েছে। সে ও দেখি ভোর ভোর উঠে রাস্তার ওপর থেকে ড্যাম এর দিকে তাক করে পাখি খুঁজছে। তার দূরবীনের অভিমুখ অনুসরণ করে দেখি একদল বেশ বড়সড় বাঁকাঠোঁট ওয়ালা পাখি আপন মনে খাওয়া দাওয়া সারছে। ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে দেখলাম লাল ঝুটি ওলা Black Ibis বা Red Naped Ibis (কালো দোচারা) এর দল রাস্তার ওপারে প্রায় ২০০ মিটার দূরে ড্যামের অর্ধেক শুকিয়ে যাওয়া অংশটায় চরে বেড়াচ্ছে। মিশরীয় হায়রোগ্লিফিক হরফে খুব দেখা যায় এই ধরণের পাখি র ছবি।আমিও গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম যদি একটু কাছ থেকে ওদের ছবি পাওয়া যায়। এইখানে বলে রাখি, পাখিরা কিন্ত খুব সহজেই বুঝতে পারে কেউ তাদের দিকে বাড়তি নজর দিচ্ছে কিনা।তাই যে পাখির ছবি তুলতে চান তার কাছাকাছি যাওয়ার উপায় হল তার দিকে নজর না দিয়ে এটা ওটা করতে করতে অন্যান্য দিকে তাকিয়ে রয়ে বসে এগোতে থাকা। মানে এমন একটা ভাব করা যেন ওই পাখি গুলিই সব থেকে তুচ্ছ আর বাকি সব কিছুই আপনার কাছে ভীষণ মূল্যবান। যাওয়ার পথে দেখা হয়ে গেল বেশ কিছু মাঠ চড়াই (Paddy Field Pipit) এর সাথে। তারা বেশ জোড়ায় জোড়ায় খেলা করছে নিজেদের মধ্যে। তা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে পৌঁছে গেলাম প্রায় আধ ঘন্টা মত সময় নিয়ে আইবিস গুলোর ৩০/৪০ মিটার এর মধ্যে। তারাও খুব বেশী গুরুত্ব দিলনা আমাকে। আর আমিও প্রাণ ভরে ছবি তুল্লাম। কিছুক্ষণ পরে দেখি উল্টো দিক থেকে দুজন মানুষ দুটো সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে আসছেন পাখি গুলোর দিকে। এমনি তে পাখিরা এলাকার পরিচিত পোষাক আসাক পরা মানুষ দের খুব একটা পাত্তা দেয়না। তা বলে খুব কাছে চলে এলে ওরাই বা চান্স নেবে কেন? সাইকেল আরোহীদের কৃপায় আমিও পেয়ে গেলাম ফ্লাইং শট্। ব্ল্যাক আইবিস এর ডানার সাদা দাগ গুলো উড়ন্ত অবস্থায় যতটা পরিস্কার হয় বসা অবস্থায় ততটা হয় না। আইবিস এর ছবি তুলে ফিরছি তখন। রাস্তায় ওঠার মুখে একটা বন কলমি র জঙ্গল আছে।ওটার পাশ দিয়ে আসার সময় দেখি একজোড়া ছোট্ট পাখি মাটি ঘেসে উড়ে বেড়াচ্ছে। হাভভাব আর আকারে অনেকটা ভিরিরি বা Bengal bush lark এর মত। কিন্তু দেখতে যেন একটু আলাদা! ক্যামেরার টেলি লেন্স এ চোখ লাগিয়ে বুঝলাম ইনিও Lark তবে Bushlark নন Sparrowlark। বাড়ি ফিরে Inskipp এর বই দেখে চিনলাম এর নাম Ashy Crowned Sparrowlark. এইটুকু রাস্তায় আরো চমক অপেক্ষা করছিল আমার জন্য! Sparrow Lark এর ছবি তুলে রাস্তায় উঠেছি অমনি দেখি মিহি সুরেলা গলায় ডেকে চলেছে একটি হলুদ চোখো ছাতারে (Yellow Eyed Babbler)। নামে এরা ছাতারে হলেও আমাদের পরিচিত ছাতারে বা সাতভাই এর থেকে আকারে অনেকটাই ছোটো, সুন্দর আর সুরেলা। 

ফিরে এসে আড্ডা ঘরে বসে নাস্তা সারতে সারতে ই দেখি পশ্চিমের মাঠে খেলা করছে একজোড়া ল্যাপউইং। বাংলায় আমরা যাদের বলি হো টি টি (Red Wattled Lapwing) এরা তাদের জাতভাই Yellow Wattled Lapwing. নীচে দেওয়া ছবি দেখলেই বোঝা যাবে এদের নামের উৎস কি। ব্রেক ফাস্টের পর আমি আর আমার সদ্য কৈশোর পার করা ভাইপো প্রত্যয় মিলে একটু চরতে বেরোলাম যদি আর কিছু পাখির দেখা মেলে। রাস্তা ধরেই একটু এগিয়েছি-ওমনি দেখি একটা চন্দনা মাথার ওপর চক্কর কাটছে। ইংরেজি তে এদের বলে Alexandrine parakeet। চক্কর কাটতে কাটতে কি হল কে জানে-আমাদের বুঝি তার ভীষণ পছন্দ হয়ে গেল-সে এসে বসল আমার একেবারে কয়েক হাতের মধ্যে একটা পলাশ চারার ওপর। আর আমিও কন্টিনিউয়াস মোড এ কতকগুলো স্ন্যাপ নিয়ে নিতে কসুর করলাম না। আর একটু ঘোরাঘুরি করে ভাইপো কে কিছু গাছ-পাখি চেনাতে চেনাতে ই বেশ রোদ উঠে গেল। আর রোদ কড়া হয়ে গেলে পোকা মাকড় রা ও গাছের পাতা- ছালের আড়ালে চলে যায়। ফলে পাখি দের ও আনা গোনা কমে যায়। তাই আমরা ও নিলাম ফেরার পথ। বনপলাশীর গেটে ঢোকার ঠিক আগে দেখলাম একটা কাঠ শালিখ বা Chestnut Tailed Starling শুকনো ডালের ওপর বসে আড়মোড়া ভাঙছে। কাঠ শালিখের ভঙ্গিমা ক্যামেরা বন্দি করে আর ক্যামেরা ব্যাগবন্দি করে ফেললাম সেদিন এর মত। কোলকাতা ফেরার দিন প্যাকিং এর ঠিক আগে সকাল সকাল একবার বেরিয়েছিলাম। সূর্য তখন উঠে গেছে।আগে শুনেছিলাম মুরুগুমা র ড্যামে পরিযায়ী হাঁসেরা নামে না। কিন্ত আকাশে ওগুলো কি উড়ছে দল বেঁধে? দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে। ক্যামেরার টেলি তে চোখ লাগিয়ে পরিস্কার দেখলাম বেশ বড় আকারের হাঁস! আলোর উল্টো দিকে থাকায় রঙ বুঝতে পারলাম না। কিন্ত এটা আশা করাই যায় যে মুরুগুমার জলে এবার হাঁস নামবে। 

আজ আর সময় নেই-ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে এখনি। প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। 'আবার আসিব ফিরে' -বনপলাশীর আঙিনায়-এবার বসন্তে।
  

নভেম্বর, ২০১৮

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন