বুধবার, ১৮ জুলাই, ২০১৮

মেডিক্যাল কলেজে ১৭০ ঘন্টা অনশন ছাত্রদের ~ কৌশিক দত্ত

মাননীয় প্রফেসর উচ্ছল কুমার ভদ্র সমীপেষু,

আপনার জন্য ছয় মাস পরে ফেসবুকে ফিরতে বাধ্য হলাম। হয়ত এমবিবিএস পাশ করার প্রায় দুই দশক পরে আরো অনেক কিছুতে ফিরতে বাধ্য করবেন আপনি। শুধুমাত্র রোগীর চিকিৎসা নিয়ে সরলরৈখিক জীবন কাটাচ্ছিলাম। আপনি রাজনৈতিক হতে প্ররোচনা দিলেন। প্রায় হাত ধরে টেনে রাস্তায় নামালেন। 

অবশ্য এভাবে আমাদের পরিচালিত করার, ছাত্রাবস্থার দিনগুলো উজ্জ্বলভাবে মনে করিয়ে দেবার অধিকার আপনার আছে। আপনি আমার শিক্ষক ছিলেন। কিছু প্রশংসা আপনার প্রাপ্য। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে স্মার্ট শিক্ষকদের মধ্যে আপনি অন্যতম, আপনার ফ্যাশন সেন্স উচ্চমানের, ইংরেজি উচ্চারণ ভালো, ক্লাস নেবার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারে আপনি সমসাময়িক অনেকের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। অন্য অনেকের ক্লাসে ফাঁকি দিলেও আপনার ক্লাস আমরা করতাম। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সূত্রে আপনার সম্বন্ধে নানা বিরূপ মন্তব্য শুনে আপনাকে আরো পূর্ণভাবে চিনলেও আপনার ক্লাসগুলো মনে রেখেছি। 

আপনি যখন আমাদের Community Medicine পড়াতেন, তখনো বিষয়টার নাম ছিল "Preventive and Social Medicine", যে নামের মধ্যে বিষয়টির প্রাথমিক দুটি ভাবনার প্রতিফলন ছিল। Prevention এবং social consciousness যে জনস্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে জরুরি, সেটা ছিল প্রাথমিক শিক্ষা। আমাদের শেখালেন, অথচ আপনি নিজে সেই বিষয়ে নিদারুণ ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন। কলেজের ছাত্রদের অত্যন্ত ন্যায্য একটি দাবিকে আপনি আন্দোলনে পরিণত করলেন এবং দায়িত্ব নিয়ে সেই আন্দোলনকে সুবৃহৎ করে তুলছেন। অথচ অনায়াসে এই সমস্যাকে প্রিভেন্ট করতে পারতেন। কেমন করে? ধাপে ধাপে বলি। দেখুন, ছাত্র হিসেবে ঠিক শিখেছি কিনা। 

প্রথমেই নিয়ম মেনে হস্টেলের সিট অ্যালটমেন্টের কাউন্সেলিং করতে পারতেন এবং সঠিক পদ্ধতিতে হস্টেল সুপারিন্টেনডেন্ট নিয়োগ করতে পারতেন। তাহলে কোনো বিতর্কই হত না। একে বলে "Primordial prevention", অর্থাৎ সমস্যা সৃষ্টি হবার আগেই সুস্থ থাকার চেষ্টা। নাহয়  রাজনৈতিক চাপে গোলমাল করেই ফেলেছেন। ছাত্ররা প্রতিবাদ করামাত্র ভুল স্বীকার করে সংশোধন করতে পারতেন। সেটা হত "Primary prevention", অর্থাৎ রোগের প্রাকশর্ত বা risk factor দেখতে পাওয়ামাত্র ব্যবস্থা নিয়ে রোগটিকে আটকানোর চেষ্টা। সেটাও নাহয় করতে পারলেন না। ছাত্ররা প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করার পর আস্ফালন আর হুমকি থেকে বিরত থাকতে পারতেন, পুলিশ ডেকে না পেটাতে পারতেন। তারা মার খেয়ে অনশনে বসার পরে অন্তত তাদের স্বাস্থ্যহানি বা মৃত্যুর সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় বসতে পারতেন। সেটাকে "secondary prevention" বলা যেত, অর্থাৎ অসুস্থ হবার পর সাবধান হওয়া। তাও করলেন না। 

তার ফলে দেখুন অসুখ বেড়ে গেছে। আজ সিনিয়র ডাক্তারদের অনশনে নামিয়েছেন। অন্যান্য পেশার মানুষও এসে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছেন। এতদিনে সংবাদ মাধ্যমও নড়েচড়ে বসেছে। টিভি ক্যামেরা ঘোরাঘুরি করছে কলেজে। সংবাদপত্রের সাংবাদিকের কলম আর এসএলআরএর ফ্ল্যাশ সক্রিয়, দেখতে পাচ্ছি। বিপদ গভীর এখন। কলেজের ছোট প্রতিবাদকে রাজপথে মিছিল করে তুলেছেন, ক্রমশ বড় আন্দোলনে পরিণত করছেন নিজের উদ্যোগে। এখনও আপনার সামনে খোলা "tertiary prevention"-এর রাস্তা। এখনো শুধুমাত্র আইন অনুযায়ী ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে আপনি এড়াতে পারেন বড় মাপের ক্ষতি। এড়াতে পারতেন, কিন্তু আপনি অসুস্থতার অভিনয় করে পলায়নের পথ নিলেন। আপনার শারীরিক পরীক্ষা এবং নর্মাল ইসিজি বলছে, আপনি সুস্থ আছেন। তাতে আমরা খুশি। আপনি সত্যি সত্যি অসুস্থ হলে দুঃখ পেতাম, নাটক করছেন বুঝতে পেরে নিশ্চিন্ত বোধ করছি। 

অথচ যে রাজনৈতিক দলের হয়ে আপনি এসব করছেন, তাঁদেরও কোনো উপকার করছেন না। তাঁরা এখনো সাংগঠনিক শক্তিতে এবং ব্যালটপেপারের গুনতিতে অনেক জায়গায় ভোট জিততে সক্ষম। মেডিক্যাল কলেজে একটি হস্টেল জবরদখল করতে পারার ওপর খুব নির্ভর করে নেই তাঁরা। আপনি যা করছেন, তা নিতান্তুই গোষ্ঠীস্বার্থে। কিন্তু আপনার গোষ্ঠী কোনটা? দল কোনটা? মাল্টিপল চয়েস প্রশ্ন দিলে আপনি নিজেও গুলিয়ে ফেলতে পারেন। 

শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সত্যিটা হল, যে ছাত্র সংগঠনটিকে ধ্বংস করার অভিপ্রায় নিয়ে আপনি সংগ্রাম চালাচ্ছেন, সেই এমসিডিএসএ দলটিতে আপনিও ছিলেন এককালে। তারপর ছাত্র পরিষদ, আরএসপি এবং সিপিআইএম, কংগ্রেস, ইত্যাদি করেছেন। আপাতত তৃণমূল কংগ্রেসে আশ্রয় নিয়েছেন নিজ স্বীকৃতি মতে। এত দ্রুত গতিতে বদলেছেন নিজেকে যে হিসেব রাখা কঠিন। আগামী দিনে কোনো বিধানসভা নির্বাচনে আপনাকে বিজেপির প্রার্থী হিসেবে দেখলে অবাক হব না। তাই প্রশ্ন জাগছে, আপনি যা করছেন, তা কি সত্যিই দলের স্বার্থে করছেন? নাকি সাবোতাজ?

শোনা যায় প্রাক্তন জমানায় মালদহ এলাকাবাসী বর্তমান শাসক দলের এক নেতাকে অপমান করেছিলেন। পরবর্তীকালে সেই নেতা স্বীয় ক্ষমতাবলে উত্তম এবং মধ্যম প্রতিশোধ নেন। সেই রাগ কি আপনি পুষছেন মনে মনে? তাই কি ছাত্রদের সামান্য এবং আইনসংগত দাবিকে বিরাট গণ আন্দোলনে পরিণত করে রাজ্য সরকারকে চাপে ফেলতে চাইছেন? 

আপনি যাই করুন, আমরা কিন্তু আপনার ক্লাস করেছিলাম স্যার। শিখেছি কিছু কিছু কথা। "Prevention is better than cure" কথাটা আমরা জানি, সব সাধারণ মানুষের মতোই। আমরা জানি, আজ এই অবদমনকে প্রতিহত না করলে ভবিষ্যতে অত্যাচার মাত্রা ছাড়াবে। তাই চিকিৎসক হিসেবে রোগটিকে বাড়তে না দেবার ব্যাপারে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আপনার বর্তমান দলের উপর মহলেও যদি সচেতনক কেউ থাকেন, তবে তাঁরাও বুঝবেন, আপনাকে এবং আপনার রাজনৈতিক আশ্রয়দাতাকে এখনি না থামালে অচিরেই আপনারা দলটির বড় ক্ষতি করবেন। নিজেদের স্বার্থ রক্ষার্থে তাঁরা আপনাদের অসদাচরণে রাশ টানবেন কিনা, তা তাঁরা বুঝবেন। কিন্তু আমরা আপনাদের কাছে পাওয়া শিক্ষাকে ব্যর্থ হতে দেব না। 

অপকর্ম করারও একটা আর্ট আছে। আপনি সেই শিল্পটুকুও রাখেননি, বড়ই মোটা দাগের আচরণ করেছেন এবার। এতদিন ভাবছিলাম, আপনার মতো smart মানুষ, এত crude হয়ে গেলেন কী করে। আজ দেখলাম, আপনি এখনো স্মার্ট। আপনি জানতেন, এবার পিছনো ছাড়া গতি নেই, অথচ ইতোমধ্যে দেওয়ালে ঠেকে আছে আপনার পিঠ। তাই রোনালদো-নেইমারোচিত অভিনয়ে পালালেন। আটজন অনশনরত সদ্য-তরুণকে গুরুতর অসুস্থতার মুখে ফেলে রেখে আপনি বাড়ি চলে গেলেন গাড়ি চড়ে। এবার অন্য কেউ "acting principal" হবেন "actor principal"-এর বদলে। তিনি মেনে নেবেন ছাত্রদের দাবি। আপনি হাত তুলে রেফারিকে বলবেন, "আমি কিছু করিনি। আমাকে ফ্রি কিক দাও।" পাবেন কি ফ্রি কিক? সত্যি কি পালানোর রাস্তা আছে আপনার? আছে কোনো লুকনোর জায়গা? হাজার চোখ আপনাকে দেখছে স্যার। 

মেডিক্যাল কলেজে র‍্যাগিং হয় না। গত পঞ্চাশ বছরে কেউ র‍্যাগিং দেখেনি। আমরা এই কলেজে পড়তে এসে সিনিয়রদের কাছ থেকে অনেক ভালবাসা পেয়েছি। সেই ট্র‍্যাডিশনে আমাদের ছোট ভাই-বোনেদের আমরা ভালবাসি। অনশনরত একজন ছাত্রেরও যদি কোনো গুরুতর ক্ষতি হয়, তবে সেই ভালবাসার আঁচ আপনি অনুভব করবেন। 

অথচ এখনো একটা শেষ সুযোগ ছিল স্যার। অন্যায়ের সিংহাসন থেকে নেমে এসে এই ভালবাসার ফরাসে আমাদের সাথে, আমাদের ছোট ভাইদের পাশে আপনিও বসতে পারতেন একবার। ভুল স্বীকার করে নিয়ে শুদ্ধ হতেন আর গর্বিত অনুভব করতেন এই কলেজের প্রাক্তনি হিসেবে, যেমন অনুভব করছি আমরা। নিজেকে আরো একবার বঞ্চিত করলেন আপনি। আপনার দ্রুত আরোগ্য কামনা করি। শরীর আরো সতেজ হোক আর মন সেরে উঠুক।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন