বুধবার, ১৪ মার্চ, ২০১৮

প্রসঙ্গঃ মরিচঝাঁপি – কিছু কথা ~ শ্রীতোষ বন্দোপাধ্যায়

এই বিষয় নিয়ে লিখতে ইচ্ছা হল তার কারণ বিগত কয়েকদিনে বিশেষত নির্বাচন পূর্ববর্তী এবং নির্বাচন চলাকালীন এই বিষয়ে প্রচুর পোষ্ট হয়েছে যার অন্যতম কারিগর মাননীয় শ্রীল শ্রীযুক্ত বাবু তুহিন শুভ্র নন্দি ওরফে রামকৃষ্ণ নন্দি Ramkrishna Nandi (যাকে ফেকু ফন্দিও বলা যেতে পারে) (যেমন হয় সাগর দত্ত ওরফে কানকাটা হুলো)। এই পোষ্টগুলি পুরোপুরি বামপন্থীদের দায়ী করে লেখা। অথচ যে কোন ঘটনা সম্পর্কে লিখতে গেলে জেনে নিতে হয় যে সেই ঘটনাটি কোন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা অথবা কোন একটি অবিচ্ছিন্ন ঘটনা ধারার একটি অংশমাত্র। এরা সে চেষ্টা করেন নি। আমার এ লেখায় তার পুরো ইতিহাস তুলে ধরতে গেলে সেটি একটি বই হয়ে যাবে তাই সে চেষ্টা বাতুলতা। আমি চেষ্টা করছি কিছু ঘটনা তুলে ধরার যার মধ্য দিয়ে উঠে আসতে পারে কিছু প্রশ্ন এবং কিছু বাস্তব।

প্রথমেই বলি আমার এ লেখায় সাহায্য নিয়েছি মধুময় পাল সম্পাদিত "মরিচঝাঁপি ছিন্ন দেশ – ছিন্ন ইতিহাস" বইটির এছাড়াও ইন্টারনেটের মাধ্যমে তৎকালীন সময়ের যে ইতিহাস পাওয়া গেছে সেই তথ্যগুলির। আমি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলাম এ গুলির রচয়িতাদের প্রতি।

মরিচঝাঁপি বাংলার ইতিহাসের এক দুঃখজনক অধ্যায়। প্রশ্ন এটাই কেন ঘটলো মরিচঝাঁপি? উত্তর পাই এখান থেকে "When India received its independence in 1947 some parts of India were divided into Pakistan. The Hindu people residing on the land of East Pakistan(East Bengal now Bangladesh) that was divided into Pakistan moved to India as refugees in three phases. In the first phase people were settled in the west Bengal state, and in the second phase people were settled at Assam and Tripura. Eventually there was no room for more people in West Bengal, Assam, or Tripura, so the central government (union government) decided to give them rooms at others states like part of Madhya Pradesh (which is now Chhattisgarh), Odisa and Andhra Pradesh. In the third phase refugees began being sent to places like Andaman Islands. Most of the places where Bengali refugees were resettled belonged to tribal people. So the union government (which is now central government) designed and put the Dandakaranya Project in place. Through the Dandakaranya Project the Bengali refugees would be resettled on tribal lands, and integrate and uplift the area belonging to the tribal people" 

এখানে বলা প্রাসঙ্গিক যে পশ্চিম পাকিস্থান থেকে আগত শিখ শরণার্থীদের কিন্ত দণ্ডকারণ্যে পাঠান হয় নি। তাহলে দেখা গেল প্রথম থেকেই বাঙালি রিফিউজিদের প্রতি একটি বৈষম্য মূলক আচরণ করা হয়েছে। এই হল ঘটনার সূত্রপাত। এই প্রসঙ্গে আরও বলা যেতে পারে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার রিফিউজিদের আন্দামানে পাঠানোর বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন না(যদিও তাদের কিছু অংশ আন্দামানে গেছিলেন)। তাদের মত ছিল এই রিফিউজিদের সাথে অন্যায় আচরণ করা হবে এবং ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে তাদের নির্বাসন দেওয়া হবে। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেখতে পাই – আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ যদিও ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে তবুও পূর্ববঙ্গের বাঙালি যারা নদী ও সমুদ্রের সাথে বড় হয়ে উঠেছে তাদের কাছে আন্দামান ও নিকোবরের মাটি দণ্ডকারন্যের রুক্ষ মাটির – পাথরের চেয়ে অনেক বেশী গ্রহণ যোগ্য ছিল। ২০০৪ সালে আমি নিজে যখন কর্মসূত্রে আন্দামানে পোষ্টেড ছিলাম তখন দেখেছি হ্যাভলক, নীল এই দ্বীপগুলির জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বাঙালি এবং তারা ঐ রিফিউজিদের বংশধর।এছাড়াও দক্ষিণ আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ার থেকে শুরু করে উত্তর আন্দামানের ডিগলিপুর যাওয়ার পথে কিছু ছোট জনপদের একটি বড় অংশ বাঙালি। একটু পরের পর্বে আসি। 

বর্তমানে দণ্ডকারণ্যের অবস্থা কি ? দণ্ডকারণ্য সহ ভারতের ১৮ টি প্রদেশে প্রায় ২ কোটি বাঙ্গালির স্থায়ী বসতি স্থাপনের অধিকার পাওয়া সত্বেও প্রতিদিন উৎখাত হওয়ার আশঙ্কায় প্রহর গুনছেন । কেন্দ্রে ২০০৩ সালে ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ভারতীয় জনতা পার্টি । নুতন সংশোধিত ধারায় যখন - তখন যে কোন উদবাস্তু বাঙ্গালিকে অনুপ্রবেশের তকমা লাগিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া অথবা জেলে পোরা যাবে । উত্তরপ্রদেশ - আসাম - পশ্চিমবঙ্গ সহ অন্যান্য প্রদেশেও আইনের এই ধারার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে , যা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়না । সম্প্রতি বিজেপির স্ব-ঘোষিত ভাবী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা করেছেন , 'উদবাস্তু বাঙালিরা !পোঁটলা - পুঁটলি নিয়ে তৈরী থাকো , ১৬ই মে-র পর ভারত ছেড়ে চলে যেতে হবে ।(১০ই মে ২০১৪ – বাঙালি রিফিউজি ব্রিগেডের একটি চিঠির অংশ)

তাহলে প্রথমে কি জানা গেল। মরিচঝাঁপি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রশ্ন আসে কেন তারা হঠাৎ করে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে আসতে গেল। প্রচলিত তথ্য "বাম নেতাদের কথায়"। প্রশ্ন করা যেতেই পারে বাম নেতারা কেন শুধুমাত্র দণ্ডকারণ্য থেকে চলে আসতে বললেন, আন্দামান, আসাম থেকে চলে আসতে কেন বললেন না? ১৯৭৫ সালে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হয় নি। এই রিফিউজিরা এই রাজ্যে এলেও তারা ভোট দিতে পারবে না তাহলে ভোটে জেতার তত্ব খাটে না – তাহলে কেন? আমার কাছে এর কোন উত্তর নেই। যারা এল তারা মরিচঝাঁপীকেই কেন বেছে নিল – সুন্দর বনের অন্য অঞ্চলে বা গড়িয়া, সোনারপুর, ক্যানিঙের দিকে কেন গেল না – এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমি পাই না। আমার নিজের বেড়ে ওঠা গড়িয়া অঞ্চলে। আজকের গড়িয়া কে দেখে ১৯৭৮ সময়কালের গড়িয়ার কথা চিন্তা করা যাবে না। বিঘের পর বিঘে জমি পড়ে আছে গড়িয়া থেকে সোনারপুর, বারুইপুর জয়েনপুরের বিস্তৃত অঞ্চলে। যাদবপুর, বাঘাযতীন পর্যন্ত রিফিউজিরা আসতে পারল তারপর আর আসতে পারল না। হয়তো লক্ষণের গণ্ডি কাটা ছিল। 

আবার দেখুন "রাজধানী দিল্লির ভৌগলিক অঞ্চলকে "উদ্বাস্তু" পুনর্বাসনের স্থান হিসাবে চিহ্নিত করে সেই সব জমিতে পশ্চিম পাঞ্জাব, সিন্ধু প্রদেশ বা বালুচিস্থান প্রভৃতি স্থান থেকে চলে আস পরিবারগুলির সুষ্ঠু পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছিল। তাদের সবাই "উদ্বাস্তু" হিসাবে স্বীকৃত হয়ে ঘোষিত সরকারী অনুদান লাভ করে কিছু সুবিধা পেয়েছিলেন। অথচ পূর্ববঙ্গ থেকে যে সব ছিন্নমুল পরিবার কোন রকমে দিল্লি পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন তাদের চিহ্নিত করা হল "পূর্ববাংলা থেকে স্থানচ্যুত জনসমষ্টি (displaced persons) হিসাবে। উদ্বাস্তু বলে স্বীকার করলে যেটুকু সরকারী সুজগ – সুবিধা পাওয়া যেত তা "চিত্তরঞ্জন কলোনি"র উষর জমিতে নয়া বসতি স্থাপনকারি মানুষরা পান নি। একদেশদর্শীতার এই রকম উদাহরণ বহু।" (পৃ ১৯৫ "মরিচঝাঁপি ছিন্ন দেশ – ছিন্ন ইতিহাস")

আরও একটি ঘটনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিকতার দাবি রাখে। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারির ১০ – ১২ দিন আগে "মানা শিবির"এ পুনর্বাসনের জন্য অপেক্ষারত উদ্বাস্তুরা রেশন ও অন্যান্য আর্থিক সাহায্য ঠিকমত না পাওয়ার বিরুদ্ধে রায়পুরে এক বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে যান। (মানা শিবিরের উদ্বাস্তুদের রেশন ও অন্যান্য আর্থিক সাহায্য কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ হলেও তা বন্টিত হত রাজ্য সরকারের মাধ্যমে) রায়পুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তখন এক বাঙালি অফিসার। পুলিশ এই মিছিলের উপর গুলি চালালে ৩/৪ জন উদ্বাস্তুর মৃত্যু হয় (ঘটনাটি বাম আমলে হলে হয়তো বলা হত ৩০০/৪০০ মানুষ মারা গেছেন – লেখক)। এই সময় দিয়েই জানা জায় রায়পুর ও ভিলাইয়ের পতিতালয় গুলিতে বাঙালি মেয়েদের উপস্থিতি। (পৃ ১২১ - ১২২ "মরিচঝাঁপি ছিন্ন দেশ – ছিন্ন ইতিহাস") 

এবার বলি এক মজার গবেষণার কথা। "মরিচঝাঁপির আগে সুন্দরবনের বাঘ মানুষ খেত না"। হাসবেন না – রাগ করবেন না। সত্যিই এরকম একটি গবেষণা পত্র পেশ করা হয়েছিল ২০০৩ সালের ২২ শে নভেম্বর তারিখে শিকাগোয় অনুষ্ঠিত আমেরিকান অ্যানথ্রপলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন কনফারেন্সের "বিস্মৃত বাংলা" (Forgetting Bengal) স্মারক সূচীতে পেশ করা হয়েছিল। (পৃ ২০৭ "মরিচঝাঁপি ছিন্ন দেশ – ছিন্ন ইতিহাস") "গবেষক লিখেছেন, '... একদিন সন্ধ্যের দিকে ছেলেদের খেলা দেখতে যাওয়ার পথে আবার আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো। এই নিয়ে অন্তত একশোবার আমাকে শুনতে হলো প্রশ্নটা যে, বাঘ সংক্রান্ত আমার পড়াশুনার বিষয়টা ঠিক কী। তখন আমি মাত্র কয়েকদিন হলো সুন্দরবনের এই দ্বীপটিতে এসে বাসা নিয়েছি। গ্রামবাসীরা সবসময়ই ভাবতেন আমি বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজকর্ম করতে এসেছি। প্রতিবারই তাদের বলতে হতো, বাঘ নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথাই নেই। সুন্দরবনের মানুষের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে জানাই আমার উদ্দেশ্য।... ওখানে উনিশ মাস বসবাসের অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয়ই আমি এখানে উল্লেখ করবো। তা হলো, মরিচঝাঁপির ঘটনাকে এখানকার মানুষ কীভাবে দেখেন। তাঁদের ভাবনার যোগসূত্রটি হলো, মরিচঝাঁপির ঘটনার আগে সুন্দরবনের মানুষ বাঘ খেত না। ওই ঘটনার পরেই সুন্দরবনের বাঘ মানুষখেকো হয়ে উঠলো।' গবেষণাপত্রে অনায়াসে আরও বলা হয়, '....মরিচঝাঁপির ঘটনার পরেই সুন্দরবনের বাঘ মানুষ শিকার করতে শুরু করে। তার আগে সুন্দরবনের মানুষ ও সুন্দরবনের বাঘ নির্বিরোধ সহাবস্থানে ছিল।.... কিন্তু সত্যিকারের ভদ্র ও নির্বিরোধী আচার-আচরণ ভুলে গিয়ে মরিচঝাঁপির ঘটনার পর চিরকালের মতো তারা মানুষখেকো হয়ে উঠেছে। ....পুলিস কয়েকশো নারী-পুরুষ-শিশুকে সেই সময় হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয় মৃতদেহগুলি। জঙ্গল এই ব্যাপক হিংসা হানাহানি রক্তপাতের ফলে বিরক্ত হয়ে বাঘ মানুষ মারতে শুরু করে। সেই থেকেই প্রথম তারা মানুষের রক্তের স্বাদ পায়। তাদের 'স্বভাব' পরিবর্তনে মরিচঝাঁপিই সেই মোড়।'' (কৃতজ্ঞতাঃ আমাদের কথা – অনিকেত) 

এক্ষেত্রে বলা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে নন্দী গ্রামের ঘটনার পরেই হলদি নদীর কুমির গুলো মানুষের এই ঝগড়া ঝাঁটিতে বিরক্ত হয়ে মানুষ খেকো হয়ে উঠেছে। কেন বলছি বলুন তো? মরিচ ঝাঁপিতেও হাজার হাজার মানুষ কে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অজস্র মহিলা ধর্ষিতা হয়েছিলেন – নন্দীগ্রামেও তাই। যে শিশু এখন সদ্যোজাত, কিংবা হাঁটি হাঁটি পা পা, এখন তেমন বলা না হলেও, আজ থেকে ৩০/৩৫বছর পর সেই শিশুদের যৌবন বয়সের সামনে নিশ্চয়ই এভাবেই কোনও গবেষণাপত্র পেশ করা হবে। নন্দীগ্রাম নিয়ে গবেষণাপত্র। তাতে বলা হবে, ''....নন্দীগ্রামের কাছেই হলদি নদী। এই নদীতে কুমির দেখেননি কেউ কোনওদিন। শুশুকরা থাকতো। কিন্তু ২০০৭সালের মার্চ মাসের পর সেই হলদি নদীতে কুমিরের দাপাদাপি। কেন না, যে শত শত মৃতদেহ পুলিস হলদি নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল, কুমির সেই স্বাদ পেয়ে হলদি নদীতে দাপাদাপি শুরু করে।'' কিংবা গবেষণায় বলা হবে, ''....একটা প্রজন্মের মা-বোনেরা নন্দীগ্রামে কেউ সন্তানের জন্ম দেননি। কেন না, সি পি এমের হার্মাদরা তাদের স্তন কেটে নিয়েছিল। স্তন না থাকলে শিশুকে বুকের দুধ দেবেন কিভাবে? তাই তারা সন্তানের জন্ম দিতে চাননি সেই একটা প্রজন্মে।'' (কৃতজ্ঞতাঃ আমাদের কথা – অনিকেত)। 

বাঘ আর কুমির মানুষ খায় – এ সবাই জানে। বাঘ বৃটিশ আমলেও মানুষ খেত (না হলে জিম করবেট এত বাঘ মারতেন না) মানুষের মধ্যে আমিষ – নিরামিষ ভেদ থাকলেও পশুর মধ্যে নেই। যদি কেউ মাংস খাওয়া গরু আর ঘাস খাওয়া বাঘ খুঁজে বের করতে পারেন তাকে জীব বিদ্যায় নোবেল সহ যত পুরস্কার আছে সব দিয়ে দেওয়া যাবে। 

যে কথা চেপে যাওয়া হয় তাহলঃ "শত শত হাজার হাজার মৃত্যুর গল্প লেখার মাঝেই সেই সময় বিধানসভায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মরিচঝাঁপি নিয়ে বিবৃতি ও বিতর্ক শেষে জবাবী ভাষণে কী বলেছিলেন, আসুন, পাতা উলটে একবার দেখে নিই। জ্যোতি বসু জবাবী ভাষণে বিধানসভায় তৎকালীন বামফ্রন্ট বিরোধী জনতা দলের বিধায়ক দিলীপ চক্রবর্তীর উদ্দেশ্যে বলছেন, ''...দিলীপ চক্রবর্তী নাকি বলেছেন ৭৭জন ওখানে মরেছেন। ৭৭জন, কি ১০৭জন, কি ১৮০জন, কেন হলো না, আমি জানি না, তবে আমরা বলছি ২জন ওখানে মারা গিয়েছেন। দিলীপবাবু আমার ঘরে এসেছিলেন। আমি বললাম,আপনি তো বললেন ৭৭জন মরেছে, সেটা কি আপনার কথা? তাদের নাম কী? তারা কোন এলাকার লোক, স্থানীয় নাকি অন্য কোথাও থেকে এসেছে, এগুলি আমাদের জানান। উনি বললেন, একজন পুলিস অফিসার নাকি তাকে বলেছেন। ... তিনি বলে চলে গেলেন আমার ঘর থেকে। আমি বললাম, নামগুলি বলে যান। উনি বললেন, পরে বলবো।''" সেই পরে আর আসে নি। যেমন নন্দীগ্রামের হাজার হাজার মানুষের নাম কেউ জানে না। প্রশ্ন থাকে এই সব মানুষগুলোর নাম ভোটার লিস্টে ছিল না? তাহলে ভোটার লিস্ট থেকে নাম বাদ যাওয়ার সময় তো জানা যেত। এরকম হয় নি তো নাম গুলো আছে –মানুষগুলো নেই তাই ভোটগুলো পড়ছে। কি বলেন বড়কষ্ট নন্দী ?
এ প্রসঙ্গে আরও কিছু তথ্যঃষষ্ঠ পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য থেকে জানা যায়, ৪২ হাজার ২১৩টি উদ্বাস্তু পরিবার দণ্ডকারণ্যে গিয়েছিল। এরমধ্যে ৩০ হাজার ১৫৯টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়। পরবর্তীতে দেখা যায় এই ৩০ হাজার ১৫৯টি পুনর্বাসিত পরিবারের মধ্য থেকে ৮ হাজার ৮৩৬টি পরিবার পালিয়ে যায়। আবার একই সময় ১২ হাজার পরিবার পুনর্বাসনের প্রত্যাশায় ত্রাণশিবিরে প্রহর গুনছে। আর ওই পলাতক ও প্রহরগোনা উদ্বাস্তুরাই মূলত পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় পাওয়ার আশায় ছুটে গিয়েছিল সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে। 

এরপরই দণ্ডকারণ্য থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নিয়ে শুরু হয় নতুন রাজনীতি। তখন ক্ষমতায় বামফ্রন্ট। সবেমাত্র ক্ষমতায় এসেছে। বিরোধিরা সব ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় উদ্বাস্তু ইস্যুতে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে বসিরহাট, হাসনাবাদের পথ ধরে উদ্বাস্তুরা জড়ো হতে থাকে সুন্দরবন অঞ্চলে। চলে আসে তারা সুন্দরবনের ঝড়খালি, সাতজেলি, কুমিরমারি, বাগনা, সোনাখালি এবং মরিচঝাঁপি দ্বীপে। সঙ্গে উদ্বাস্তু সেজে এই আন্দোলনে শরিক হয় স্থানীয় কিছু মানুষ। তাদের লক্ষ্য উদ্বাস্তুদের নামে জমিজমা এবং রিলিফ হাতিয়ে নেওয়া। এই লোভে তারা উদ্বাস্তু সেজে মিশে যায় উদ্বাস্তুদেরই মাঝেই। 
১৯৭৮ সালের ২৬ এপ্রিলের 'আনন্দ বাজার' পত্রিকা থেকে জানা যায়, তখন হাসনাবাদে উদ্বাস্তুর সংখ্যা ছিল ১১ হাজার ১০৬, চর হাসনাবাদে ১৬ হাজার ৯২৯ আর কুমিরমারি ও বাগনায় ছিল ৫ হাজার। এরাই পরবর্তীতে ছড়িয়ে পড়ে মরিচঝাঁপিতে। 

সুদরবন অঞ্চলের বিশিষ্ট কবি, সমাজসেবী সন্তোষ বর্মণ বলেছেন, মরিচঝাঁপি ছিল সরকারের সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ১২৫ বর্গ কিলোমিটারজুড়ে এর অবস্থান। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার গোসাবা থানার অন্তর্গত। এই মরিচঝাঁপিতে গিয়ে উদ্ধান্তুরা সেই গড়ান, সুন্দরী, কেওড়া, গেউয়া গাছপালা কেটে ভূমির দখল নিতে থাকে। এর পেছনে ইন্ধন জোগায় কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এটাই মানতে পারছিল না রাজ্য সরকার। তারা মরিচঝাঁপি থেকে উদ্বাস্তুদের ফিরে আসার আহ্বান জানানো। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ঘোষণা দেন তিনি উদ্বাস্তুদের ফের দণ্ডকারণ্যে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন। এই ডাকে অনেকে সাড়া দিলেও হাজার দুই উদ্বাস্তু অবরোধ করে রাখে মরিচঝাঁপি। তারা সুন্দরবনের গাছ কেটে অবাধে বিক্রি করতে থাকে। 

এদিকে মরিচঝাঁপিতে উদ্বাস্তুরা আরও সংঘবদ্ধ হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা কুমিরমারা পুলিশ ক্যাম্পে হামলাও চালায়। এ সময় পুলিশের গুলিতে ২ জন উদ্বাস্তু মারাও যায়। যদিও বিরোধীদের দাবি মৃতের সংখ্যা ৬। তাছাড়া খাদ্যাভাবে মরিচঝাঁপিতে মারা যায় আরও অন্তত ১৭ জন। মরিচঝাঁপি থেকে উদ্বাস্তুদের সরিয়ে দিতে না পেরে রাজ্য সরকার আইনের আশ্রয় নেয়। লঞ্চ নিয়ে পুলিশ মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নেয়। সেই ১৯৭৯ সালের ১৪ মে। ১৭ মে উদ্বাস্তুহীন হয় দ্বীপভূমি মরিচঝাঁপি। ভেঙে দেয় উদ্বাস্তুদের তৈরি বাড়িঘর। ফলে পরিসমাপ্তি ঘটে মরিচঝাঁপি ট্র্যাজেডির। (তথ্য সুত্রঃ সপ্তাহের বাংলাদেশ সাপ্তাহিক বর্ষ ৮ সংখ্যা ৪৮ ২৯ শে বৈশাখ ১৪২৩ ১২ই মে ২০১৬)। 

এই বিষয় নিয়ে আরও প্রচুর তথ্য ছড়িয়ে আছে। আমার এ লেখায় সে সব আর তুলতে চাইছি না কারণ লেখা দীর্ঘতম হবে। আমি যা বলতে চেয়েছি তা হল মরিচ ঝাঁপিতে যাই হয়ে থাকুক না কেন তা অবশ্যই দুঃখজনক কিন্ত তার জন্য তৎকালীন রাজ্য সরকারকে এক তরফা দায়ী করা হলে (যা করা হয় এবং হচ্ছে) তা হবে ইতিহাসের বিকৃতি। মরিচঝাঁপি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সেই ঘটনার জন্য সমান ভাবে দায়ী ছিল কেন্দ্রীয় সরকার কারণ তারা পশ্চিম পাকিস্থান থেকে আসা পাঞ্জাবী/শিখ উদ্বাস্তুদের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্থান থেকে আসা বাঙালী উদ্বাস্তুদের প্রতি সেই একই দৃষ্টি ভঙ্গী নেন নি। সেই কারণেই বাঙ্গালীদের গুলি খেতে হয়েছে আর পাঞ্জাবী/শিখদের হয় নি। 

যুক্তি দিয়ে কমেন্ট আশা করি।

http://bandyopadhyaya.blogspot.in/2016/05/blog-post.html থেকে নেওয়া হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন