বুধবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০১৮

কংগ্রেস না বিজেপি ~ আর্কাদি গাইদার

সম্প্রতি কলকাতায় অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম) এর কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং নিয়ে আপাতত বাজার গরম। 
কেন?
কারন সেই কেন্দ্রীয় কমিটি মিটিং এ আগামী সম্মেলনের জন্যে যে খসড়া প্রস্তাব ভোটাভুটিতে পাশ হয়েছে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ন কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে।
যেমন,
১)বর্তমান পরিস্থিতিতে বিজেপিকে ভারতের ক্ষেত্রে প্রধান শত্রু চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পেছনে যে কারন দেখানো হয়েছে তা হলো - বিজেপি ভারতের নাগরিকদের ওপর অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক আক্রমন নামিয়ে এনেছে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়ে। নিওলিবারাল পলিসির নোংরাতম রুপ তারা বাস্তবায়িত করছে একের পর এক, এবং অর্থনীতি এবং বিদেশনীতি, দুই ক্ষেত্রেই দেশকে বিদেশীদের হাতে বেচে দিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কব্জা করে তাদের একে একে দূর্বল করছে, গনতন্ত্র এবং ভাবনা ও চেতনার স্বাধীনতাকে ধ্বংস করছে। এ ছাড়াও একটা সামগ্রিক সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী কর্মসূচীর রুপায়ন তারা করছে, যাতে তাদের অর্থনীতির নোংরা অভিমুখ থেকে মানুষের নজর ঘুরিয়ে রাখা যায়, এবং যা দেশের অখন্ডতা এবং সার্বভৌমত্বকে ঝুকির মুখে ফেলছে।
২)এই প্রধান শত্রুকে পরাস্ত করবার লক্ষ্যে কংগ্রেসের সাথে কোনরকম জোট করা যাবে না। আগামী দিনে বামপন্থীদের নিজেদের বিকল্প অর্থনীতি এবং সমাজব্যাবস্থার কথাকেই সামনে রেখে লড়াই আন্দোলন গড়ে তুলে এককভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠতে হবে, তাহলেই বিজেপিকে টক্কর দেওয়া যাবে, এবং পরাস্ত করা যাবে। 

আপাতত যারা যারা এই নিয়ে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, তাদের বোঝাপড়ার জন্যে একটু প্রক্রিয়া সংক্রান্ত জ্ঞান দিতে চাই। এটা হলো খসড়া প্রস্তাব। প্রতি তিন বছর অন্তর পার্টির যে সম্মেলন হয়, সেখানে এই প্রস্তাব পেশ করা হবে সারা দেশ থেকে নির্বাচিত করে পাঠানো ডেলিগেটদের কাছে। তার আগেও, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে, এই খসড়া ছাপিয়ে বা ইন্টারনেটে সবার পড়বার জন্যে প্রকাশ করে দেওয়া হবে। এর মধ্যে, আপনি যেই হন, মানে বাম, কংগ্রেস, বিজেপি, টিএমসি, পুরুষ, মহিলা, ছাত্র, পুলিশ, আপনার মূল্যবান মতামত বা কোন সংশোধনী চিঠি লিখে বা ইমেল করে পাঠাতে পারেন। যদি কেন্দ্রীয় কমিটির মনে হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বা গুরুত্বপূর্ন কোন বক্তব্য আছে, তাহলে তা প্রস্তাবে যোগ করা হবে বা পালটানো হবে। সম্মেলনের সময় এই প্রস্তাব পেশ করা হবে। ডেলিগেটরা তাই নিয়ে আলোচনা করবেন। ভোটাভুটিতে সংখ্যাধিক্যের নিরিখে সেই প্রস্তাব এই আকারে বা কিছু বদল এনে পেশ করা হবে। অর্থাৎ উপরোক্ত দুটি গুরুত্বপূর্ন পয়েন্টই সম্মেলনের মঞ্চে পুরোপুরি পালটে যেতে পারে।

আপাতত আমার আলোচনা সিপিআই(এম) বা এই প্রস্তাবের পয়েন্টগুলো নিয়ে না। তা ঠিক না ভুল তা সময় বলবে। Nothing succeeds like success, nothing fails like failure.
আমার আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন বিজেপি বিরোধী বা লিবারাল বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে। তাদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে সংবাদপত্রে, মিডিয়ায় বা ওয়েবে লম্বা লম্বা লেখা ছাপিয়ে বকাবকি শুরু করে দিয়েছেন, যে এই প্রস্তাব কতটা অবাস্তব, এবং একেবারেই প্রায়োগিক না। তাদের বক্তব্য, বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে কংগ্রেসের সাথে কাধে কাধ মিলিয়ে লড়তে হবে, বা সমর্থন জানাতে হবে, নাহলে বিজেপিকে কিছুতেই হারানো যাবে না। 
যেটা অদ্ভুত, সেটা হলো, এই একই বুদ্ধিজীবীরা একদা ইউপিএ সরকারকে সমর্থন জানানোর জন্যে সিপিএমকে তীব্র আক্রমন করেছিলেন। তারা বলেছিলেন এটা মেকি বামপন্থা, সংশোধনবাদ,  শাসকশ্রেনীর সাথে আপস, শ্রেনী সংগ্রামের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, ইত্যাদি। ২০১৬তে বাংলায় কংগ্রেসের সাথে জোটকেই এরা সুবিধেবাদী, আদর্শবর্জিত, নীতিহীণ আখ্যা দিয়েছিলেন। আজকে হঠাত করে এনাদের মতামত পালটে গেছে। কেন? কারন আজকে এনাদের যে আপাত নিরাপদ পরিসর, তা আক্রান্ত। এনাদের মনে সত্যিকারের ভয় ঢুকেছে। তাই আপাতত এনাদেরই কথিত নীতি আদর্শকে সম্পূর্নরুপে ভুলে এনারা যেনতেন প্রকারে বিজেপিকে হারিয়ে কংগ্রেসকে জেতাতে চান। যেই শ্রেনীসংগ্রামের কথা এনারা বলেন, তা যে আদতে স্রেফ নৈশভোজের কথোপকথনে পাঞ্চলাইন, তা স্পষ্ট। কারন আপামর জনগন, তাদের কাছে যে শোষন এবং শ্রেনীসংগ্রাম সত্য, তা তো কংগ্রেস জিতলে শেষ হয়ে যাবে না। তাহলে একটি কমিউনিষ্ট পার্টি নিজেদের আগামীদিনের কর্মসূচী কেন স্রেফ বিজেপিকে হারানো আর কংগ্রেসকে জেতানোর ওপর ভিত্তি করে তৈরি করবে? তারা তো নিজেদের স্বতন্ত্র বৃদ্ধির স্বার্থেই চাইবে যে সত্যিকারের বিকল্পের কথা এই সুযোগে মানুষকে জানানোর, তাদেরকে ব্যাপক আকারে গনআন্দোলনে যুক্ত করা, এবং অর্থনীতির প্রশ্নকেই প্রধান করে সামনে তুলে ধরা। আর যদি বিজেপিকে হারানোর ক্ষেত্রে লক্ষ্য একমাত্র কংগ্রেসকে জেতানো হয়, তাহলে আলাদা পার্টির দরকার কি? সবার তো কংগ্রেসে যোগ দিয়ে বা তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচির সাথে যুক্ত হয়ে কংগ্রেসকেই শক্তিশালী করে তোলা বেশি যুক্তিযুক্ত অবস্থান হবে। এই বুদ্ধিজীবীরাই সেটা দিয়ে শুরু করতে পারেন। বামপন্থা তো কোন ফ্যাশন স্টেটমেন্ট না, যে সেই তকমা গায়ে না থাকলে, একটা বিশেষ সামাজিক পরিসরে প্রেস্টিজ বা সোশ্যাল ক্রেড থাকবে না। নাকি এনাদের কাছে বামপন্থা তাই?

আমাদের সমস্যা হলো যে বিজেপি বিরোধীরা এরকম সংগতিহীন অবস্থান নেন এবং সেটা মানুষের কাছে ভন্ডামি হিসেবে উপস্থাপিত করতে বিজেপির সুবিধে হয়। 

সংঘ পরিবার একটি behemoth. এই প্রথমবার তারা তাদের এজেন্ডাকে সম্পূর্নরুপে দেশের সামনে উন্মুক্ত করে লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছে। তাই লড়াইটা শুধু ২০১৯ এ তাদের হারানোর লড়াই না, লড়াইটা তাদের এই দেশ থেকে সম্পূর্নরুপে নিশ্চিহ্ন করবার। শত্রুকে চিহ্নিত করবার সাথে সাথে অত্যন্ত জরুরী তার শক্তিকে চিনতে পারা। যতদিন এই দেশের কোন কোনে একটিও আরএসএসের শাখা থাকবে, ততদিন বিজেপি জীবিত থাকবে। তাদের ধ্বংস করবার এই লড়াই দীর্ঘমেয়াদি লড়াই, কঠিন লড়াই, হয়তো অনন্তকালের লড়াই। কিন্তু ২০১৯ এ তাদের হারিয়ে যে এই লড়াই থামবে না তা নিশ্চিত। তাই যারা এই লড়াই সত্যি সত্যি লড়তে চান, তারা আম্বানির কথিত 'আপনি দুকান' কংগ্রেসের সাথে কাধ মিলিয়ে আগামী দিনের নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা, নিজেদের ভিত্তি দূর্বল করবেন কিনা, তাই নিয়ে ভাবুন। দীর্ঘসময় নিয়ে ভাবুন। সাংঘাতিক সংকটময় পরিস্থিততে পড়লে আমরা আতংকিত হয়ে ততকালীন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। কিন্তু যে কোন সিদ্ধান্তের রেশ কিন্তু দীর্ঘদিন রয়ে যায়। ২০১৯ এ গুরুত্বপূর্ন লড়াই। কিন্তু শেষ লড়াই না। আগামী ৫ বছরের কথা ভাবুন। বা ১০ বছর। বা ৫০ বছর। ভাবুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন