শনিবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৭

এফ আর ডি আই বিল ~ পুরন্দর ভাট

এফআরডিআই বিল নিয়ে অনেক লেখাপত্র ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যম এবং ফেসবুকে এসেছে। অনেকেই পড়েছেন, বুঝেছেন যে এ এক বিপজ্জনক আইন। অনেকে আমাকে বলেছেন এই নিয়ে লিখতে তাই একটা ছোট লেখা লিখছি, যদিও আমার নতুন করে এতে সংযোজন করার মতো কিছু নেই, সামান্য দু একটা পয়েন্ট ছাড়া।

প্রথমত, এই এফআরডিআই বিল বিষয়টা কী? কেন্দ্র সরকার একটা নতুন আইন প্রণয়ন করার ভাবনাচিন্তা করছে, আপাতত বিলটা জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে আছে, সেই আইনের নাম হলো ফিনান্সিয়াল রেজোলিউশন এন্ড ডিপোজিটরি ইনসিওরেন্স বিল, ছোট করে এফআরডিআই। দেশের ব্যাংকগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে যে আইন সেই আইনকে সংস্কার করাই এই বিলের উদ্দেশ্য। সংস্কারের প্রয়োজন পড়ল কেন? পড়ল কারণ দেশের অধিকাংশ ব্যাংক বর্তমানে সংকটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। বিভিন্ন ব্যাংক মোট ৬ লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণের ভারে ন্যুব্জ। সেই টাকা আর ফেরত আসবে না। এই অনাদায়ী ঋণের অধিকাংশটাই বড় কর্পোরেটদের কাছে পাওনা। আম্বানি-আদানি-এসার-বেদান্ত-কিংফিশার, প্রভৃতি। টাকা ফেরত না দিতে পারায় এদের কোনো শাস্তি হয়নি। কেউ লন্ডনে বসে উইম্বলডন দেখছে তো কেউ নিজের ছেলের বিয়ের কার্ড ছাপাচ্ছে যার এক একটার দাম দের লক্ষ টাকা। তো যাই হোক, অনাদায়ী ঋণ নিয়ে ভবিষ্যতে কী হবে? যে কোনো অনাদায়ী ঋণ ব্যাংকের ক্ষতির অংকে যুক্ত হয়। ব্যাংককে নিজের রোজগার থেকে অনাদায়ী ঋণের অংকের ভরণ করতে হয়। ব্যাংকের রোজগার যদি অনাদায়ী ঋণের অংক ভরণ করবার মতো যথেষ্ট না হয় তাহলে ব্যাংকটি শেয়ার বিক্রি করে বা বন্ড বিক্রি করে বা অন্য কোনো ভাবে ধার নিতে পারে। যদি ধারও না পায় তাহলে ব্যাংকটিকে দেউলিয়া ঘোষণা করে, বন্ধ করে দিতে হয়। দেউলিয়া ঘোষিত হলে যাঁরা ব্যাংকে আমানত জমা করেছেন তাঁদের যত জনেরটা সম্ভব ব্যাংক ফেরত দেবে, যাদেরটা পারবে না তাদেরটা ফেরত দেবে সরকার। বর্তমানে ব্যাংকিং ব্যবস্থার যে আইন আছে তাতে এটাই দস্তুর। বর্তমান ব্যবস্থায় কিন্তু আমানতকারীদের টাকায় অনাদায়ী ঋণ বা ব্যাংকের অন্য কোনো ক্ষতির ভরণ করবার কোনো উপায় নেই, আইনত সেটা নিষিদ্ধ। বর্তমান আইনে ব্যাংক অনাদায়ী ঋণের ফলে হওয়া ক্ষতির ভরণ আমানতকারীদের টাকা দিয়ে করতে পারে না।

কিন্তু নতুন যে বিল আসছে তাতে এই নিয়ম বদলে যাবে। সেই বিলে একটি ক্লজ আছে, যাকে "বেইল ইন ক্লজ" বলা হচ্ছে, যা আমানতকারীদের টাকা দিয়ে ব্যাংকের ক্ষতি ভরণ করবার রাস্তা খুলে দেবে। এই আইন পাশ হলে ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা আটকে রাখতে পারবে যদি সে সংকটে পড়ে। এমনকি আমানতকারীদের টাকা থেকে ব্যাংক ইচ্ছে মতো ঋণ নিতে পারবে অথবা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার বদলে তাদের ব্যাংকের শেয়ার দিয়ে দেবে যাতে ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা থেকে প্রয়োজন মত টাকা তুলে নিতে পারে ক্ষতি ভরণ করতে। অর্থাৎ সংকট এড়াতে আপনার তিন বছরের ফিক্সড ডিপোজিটের মেয়াদ বাড়িয়ে ৬ বছর করে দিতে পারে যাতে ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত টাকার যোগান থাকে। 

বর্তমান আইনে আপনার আমানতের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে আপনাকে টাকা ফেরত দিতে ব্যাংক বাধ্য। যদি না দেয় আপনি কোর্টে যেতে পারেন। কোর্টে যদি ব্যাংক বলে যে তাদের ফেরত দেওয়ার মত যথেষ্ট টাকা নেই তাহলে ব্যাংকের কর্তারা ওপর কেলেঙ্কারির মামলা হবে এবং সরকার যে কোনো উপায় আপনার টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। নতুন আইনে কিন্তু এই নিশ্চয়তা আর থাকবে না। ব্যাংক টাকা ফেরত না দিলেও আপনি কোর্টে যেতে পারবেন না কারণ আইনেই এই সুযোগ ব্যাংকের কাছে থাকছে। অর্থাৎ যারা ঋণ খেলাপি করলো আর যারা বেপরোয়া ভাবে ঋণ দিলো তাদের ক্ষতি হলো না, হলো সাধারণ আমানতকারীদের। 

এই বিল নিয়ে হই চই শুরু হওয়ায় সরকার এখন বলছে যে নতুন আইনেও ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে সরকার আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেবে, অরুণ জেটলি প্রেস কনফারেন্স করে বলেছেন যে অযথা ভয় তৈরি করা হচ্ছে মানুষের মনে। কিন্তু যেটা উনি বললেন না সেটা হলো যে ব্যাংককে দেউলিয়া ঘোষণা করার ভিত্তিই তো বদলে যাচ্ছে নতুন আইনে। বর্তমান আইনে ব্যাংক আমানতকারীর টাকা সময়মত ফেরত না দিতে পারলেই তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়ে থাকে আর আমানতকারীদের টাকা ফেরতের দায়িত্ব সরকার নেয়। কিন্তু নতুন আইনে তো সময়মত টাকা ফেরত না দেওয়ার রাস্তাই খুলে দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকগুলোর সামনে, সময় মত ফেরত না দিলেও তাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হবে না এবং তাই সরকারের টাকা ফেরতের দায়িত্ব নেওয়ার প্রশ্নও উঠবে না।

এই অবধি মোটামুটি অনেকেই লিখেছেন, আলোচনা করেছেন মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে। কিন্তু একটা বিষয় এখনো অবধি কোনো লেখায় আমার চোখে পড়েনি। তার আগে সামান্য ইতিহাস। ব্যাংকে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার গ্যারান্টি সরকার দেওয়া শুরু করে ১৯৩৩-এ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তার আগে অবধি কোনো ব্যাংক ডুবলে তার আমানতকারীরাও ডুবত, সরকার তাদের টাকা ফেরানোর কোনো গ্যারান্টি দিত না। ১৯৩৩-এ আমেরিকায় পাশ হয় "গ্লাস স্টেইগাল এক্ট।" এই আইনে বলা হয় যে যদি কোনো ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষিত হয় তাহলে সরকার ছোট এবং মাঝারি আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার গ্যারান্টি দেবে। সকলেই জানেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা আদ্যপান্ত পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, সেখানে বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থ সব সময় প্রাধান্য পায়। তাহলে এহেন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কেন হঠাৎ ছোট আমানতকারীদের জন্যে উতলা হয়ে উঠলো? না, আমানতকারীদের প্রতি মানবিকতা থেকে আইন বানানো হয়নি, হয়েছিল ব্যাংকগুলোর স্বার্থের কথা ভেবেই। কী রকম? ১৯২০-এর দশকে আমেরিকায় যে ভয়াবহ আর্থিক সংকট তৈরি হয়েছিল তার মূলে ছিল ব্যাংকের সংকট, তাদের দেউলিয়া হওয়া। কয়েকটি ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার মত যথেষ্ট টাকা জোগাড় করতে অক্ষম হয় এবং দেউলিয়া ঘোষিত হয়। সেই ব্যাংকে আমানতকারীরা তাদের সঞ্চয় হারান। এতে সাধারণ আমানতকারীদের মধ্যে ব্যাপক ভীতির সঞ্চার হয়। সকলেই ভাবতে থাকেন যে কোনো ব্যাংকই বোধয় আর নিরাপদ নয়। সকল আমানতকারী একযোগে সব ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে শুরু করেন, এমন কি যে ব্যাংকে কোনো সংকট নেই সেই ব্যাংক থেকেও। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ভীতি সঞ্চার হওয়া আশ্চর্য্যের কিছু না, যদি আপনার প্রতিবেশীর সব সঞ্চয় চোট হয়ে যায় তাহলে আপনিও নিজের ব্যাংকের ওপর সন্দিহান হবেন, আপনার ব্যাংক আলাদা হলেও। যেমন নোটবন্দীর সময় সবাই একসাথে ব্যাংকে দৌড়েছিলো পুরোনো নোট জমা দিয়ে ১০০ টাকার নোট তুলে, সঞ্চয় করে রাখতে যদিও অত টাকার হয়তো তক্ষুনি প্রয়োজন ছিল না। মানুষ ভীত হলে কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। সব আমানতকারী যদি একসাথে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে যায় ব্যাংক সেই টাকার যোগান দিতে পারবে না কারণ কোনো ব্যাংকই আমানতকারীদের সব টাকা জমিয়ে রেখে দেয় না, বেশিটাই সে ঋণ দিতে ব্যবহার করে। যেহেতু সাধারণত সব আমানতকারী একসাথে একদিনে টাকা তুলতে যায় না তাই আমানতকারীদের সব টাকা ধরে রাখার কোনো কারণ নেই ব্যাংকের, কিছু টাকা রাখলেই রোজের প্রয়োজন মিটে যায়। অতএব সব আমানতকারী একসাথে টাকা তুলতে এলে ব্যাংক যোগান দিতে পারবে না এবং এর ফলে একটা স্বাস্থ্যবান ব্যাংকও সংকটে পড়বে ও দেউলিয়া হয়ে যাবে। এই প্যানিক রিয়াকশনের ফলে ১৯২০-৩০ এর মধ্যে আমেরিকার অধিকাংশ ব্যাংক সংকটে পড়ে যায়। যাদের আগে কোনো সংকটই ছিল না, শুধুমাত্র ভীত আমানতকারীদের একসাথে টাকা তুলে নেওয়ার ফলে তারাও দেউলিয়া হয়। প্রায় সমস্ত ব্যাংকই ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া বন্ধ করে দেয় এই ভয়ের চোটে - যে আমানতকারীরা একসাথে টাকা ফেরত চাইলে যোগান দিতে পারবে না যদি সেই টাকা থেকে ব্যবসায়ীদের  ঋণ দেয়। এতে ক্রমশ ব্যবসা বাণিজ্য সব বন্ধ হয়ে যেতে থাকে, চরম অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়। অর্থনীতির ভাষায় এর নাম হলো "Contagion" অর্থাৎ ছোঁয়াচে রোগ। একটি ব্যাংকের অসুখের ফলে সব ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাই এহেন নাম। এই সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক হলো - টাকা ফেরতের সরকারি গ্যারান্টি। সরকার যদি গ্যারান্টি দেয় তাহলে আমানতকারীরা আর প্যানিক করবে না, একসাথে সবাই টাকা তুলতেও যাবে না, এবং সংকট ছড়াবে না। এই এক্ট অব্যর্থ টিকার কাজ করে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে সাধারণ আমানতকারীদের কথা ভেবে এই আইন আসেনি, এসেছিল পুঁজিবাদী সংকট থেকে বাঁচতে, ব্যাংকিং সিস্টেমকে সংকট থেকে বাঁচাতে।

যদি এফআরডিআই বিল পাশ হয় তাহলে ব্যাংকের সংকট কমার বদলে উল্টে বেড়ে যেতে পারে। এক্সিস ব্যাংক যদি সংকটে পড়ে ঘোষণা করে যে তারা আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারবে না এক্ষুনি, এক বছর পরে ফেরত দেবে, তাহলে অন্যান্য ব্যাংকের আমানতকারীরাও ভীত হয়ে উঠতে পারে যে তাদের ব্যাংকও হয়তো এমন করবে। এই ভয়ের ফলে একযোগে সবাই ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়া শুরু করতে পারে। অন্য কোনো ব্যাংক, ধরা যাক পাঞ্জাব ব্যাংক, যে হয়তো কোনো সংকটেই ছিল না, সেও আমানতকারীদের একযোগে টাকা তুলে নেওয়ার হিড়িকে সংকটে পড়ে যাবে এবং এই ভাবে একটা ব্যাংকের সংকট গোটা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ছড়িয়ে পড়বে। তাই এই বিলের বিরোধিতা শুধু আমানতকারীরা নয়, যাঁরা এইসব ব্যাংকে চাকরি করেন তাদেরও করা উচিত কারণ এই বিল তাঁদের ব্যাংককেও অনিশ্চয়তায় ফেলে দিতে পারে।

মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭

"হিন্দু রাষ্ট্র' ~ পুরন্দর ভাট

"হিন্দু রাষ্ট্র কাকে বলে?"

কোনো বিজেপি সমর্থককে এই প্রশ্ন করা হলে অবধারিত ভাবে সে উত্তর দেবে - গুজরাট। সংঘিদের ভাষায় "হিন্দু রাষ্ট্র গুজরাট।" নিন্দুকদের ভাষায় "হিন্দুত্বের ল্যাবরেটরি গুজরাট।" গুজরাটের সমস্ত কিছুতে ধর্ম। হাজার হাজার মন্দির। প্রতি অলিতে গলিতে ধর্মনাম ধর্মগান লেগেই রয়েছে সারা বছর। সেখানে মুসলমানরা একঘরে। ২০০২ এর পর থেকে ভয় সিঁটিয়ে থাকে তারা। ২২ বছর একটানা হিন্দুত্বের শাসন। সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে খোলাখুলি গলার আওয়াজ তোলা বারণ। নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গেলে সেখানে সিবিআইয়ের জাজ পর্যন্ত খুন হয়ে যায়। পুঁজিপতিদের কাছে মডেল গুজরাট। সেখানে কোনো শ্রমিককে ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয় না। বন্ধ বা স্ট্রাইক নেই। হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ সেখানে প্রতি বছর। তার জন্য সাধারণ মানুষের কত লাভ হলো সেই প্রশ্ন তোলাও গুজরাটে অপরাধ। আম্বানি আদানিদের জায়গীর হলো গুজরাট। ২২ বছরের একটানা শাসনে সেখানকার সমস্ত ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করেছে হিন্দুত্ব। স্কুলের পাঠক্রম থেকে শুরু করে ইতিহাসের গবেষণা - সর্ব ক্ষেত্রে হিন্দুত্বের প্রভাব। সংঘের হাজার হাজার স্কুল। একটা গোটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যাদেরকে সংঘের মতাদর্শ গেলানো হয়েছে। রাজনীতি বিজ্ঞানের গবেষকরা বলেন যে সংঘ কোনো নতুন নীতি নেওয়ার আগে তার পরীক্ষা করে নেয় গুজরাটে। গুজরাট মডেল।

এই গুজরাট থেকেই জয়যাত্রা শুরু করেছিলেন হিন্দু হৃদয় সম্রাট নরেন্দ্র মোদি। সারা ভারতকে গুজরাট বানাবেন - এই আশায় হিন্দুত্ববাদের সমর্থকরা তাকে ভোট দিয়েছিলেন। বিজেপির সভাপতিও ওই রাজ্য থেকেই। অমিত শাহ যে প্রবাদপ্রতিম পার্টি মেশিনারি তৈরি করেছে তার হাতেখড়িও গুজরাটে। নিজের হাতের তালুর চেয়েও গুজরাটের পার্টি সংগঠনকে ভালোভাবে চেনে অমিত শাহ। ভোটের আগে সমস্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেদের কাজ কম্ম ফেলে পড়েছিলেন গুজরাটে। পার্লামেন্টের শীতকালীন অধিবেশন স্থগিত রয়েছে গুজরাটের জন্য। যে রাজ্যের টানা চারবারের মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সেই রাজ্যে তো এমনিতেই ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার কথা, সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু গুজরাটি সেন্টিমেন্টের জন্য জিতে যাওয়ার কথা। তবুও কোনো ঝুঁকি নেননি প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্র এবং রাজ্যে তারা ক্ষমতায়, বিরোধীরা দাঁড়াবে কী ভাবে সেখানে? ২০১২-তে, যখন কংগ্রেসের সূর্য মধ্যগগনে, যখন একের পর এক নির্বাচন হারতে হারতে বিজেপি হাতে গোনা তিন চারটে রাজ্যে সীমাবদ্ধ, সেই তখনও গুজরাটে ১১৫-টা আসন জিতে নরেন্দ্র মোদি প্রমান করে দেন যে তিনিই একা কুম্ভ। সেইখানে ২০১৭-তে নির্বাচনের ফল তো পুনর্নির্ধারিত হওয়া উচিত।

কিন্তু কী হলো?

সেই হিন্দুত্বের পুণ্যভূমিতে কোনো মতে তরী পাড়ে লাগলো। মাত্র ৭ টি আসনের বহুমত। গত বিধানসভার থেকে ১৬ টি আসন কম। ভোট বেড়েছে ১ শতাংশ, কিন্তু কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে ৪ শতাংশ। আর লোকসভার তুলনায় বিজেপির ভোট কমেছে ১০ শতাংশেরও বেশি। বিহার নির্বাচনে নীতিশ কুমারের সঙ্গ হারিয়েও এত শতাংশ ভোট কমেনি বিজেপির। ৮-টি আসনে বিজেপি জিতেছে ১৮০০ ভোট বা তার কম ভোটের ব্যবধানে। কয়েকটি ৫০০ এরও কম ব্যবধানে। এই অসনগুলোয় মোট ৪৫০০ ভোট বিজেপির থেকে কংগ্রেসে ঘুরে গেলেই কংগ্রেস সরকার গড়ত। মাত্র ৪৫০০। একবার ভাবুন। একটা বড় বিয়েবাড়িতেও ওর চেয়ে বেশি মানুষ নিমন্ত্রিত থাকেন। বিভিন্ন পোল সার্ভে বলছে কংগ্রেসের ভোট সবচেয়ে বেশি অল্পবয়সীদের মধ্যে। সেই অল্পবয়সীরা যাদেরকে ২০১৪-তে বিজেপির প্রধান নির্বাচনী সম্পদ বলা হয়েছিল। হিন্দুত্বের কেন্দ্রতে হিন্দুত্ব এরকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কয়েক মাস আগেও কেউ ভেবেছিলেন? যে মডেলে গোটা দেশকে গড়ে তোলার কথা বলে মোদিজি প্রধানমন্ত্রী হলেন সেই মডেলই হাতছাড়া হতে পারে এরকম ভেবেছিলেন? যাঁরা তাদের দলের প্রধান সম্পদ ছিল, সেই যুবক যুবতীরা বিরোধীদের সব থেকে বড় সম্পদ হয়ে উঠবে কেউ ভেবেছিলেন?

হিন্দু রাষ্ট্রের প্রধান পীঠস্থান হলো সোমনাথ। যেখানে সোমনাথ মন্দির, যে সোমনাথ মন্দিরে ভিসিটর বুকে সই করার খবর রটিয়ে রাহুল গান্ধীকে অহিন্দু বলে রটনা করেছিল বিজেপি। সেই সোমনাথে কংগ্রেস ২০ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছে।

শুক্রবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৭

কর্পোরেট মিডিয়া ও শ্রমিক স্বার্থ ~ সুশোভন পাত্র

মিত্তির মশাই সকালে মেরি বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে আনন্দবাজার পড়েন। চিত্তরঞ্জন পার্কের অগ্নিমূল্য সবজি বাজারে ২টাকা বাঁচাতে দরদাম করেন। তারপর ধোঁয়া ওঠা ভাতে ঘি মেখে খেয়ে, হাতের গন্ধ শুকতে শুকতে অফিস বেরিয়ে পড়েন।

মিত্তির মশাই'র সরকারী চাকরি আছে। ই.পি.এফ আছে; মেডিক্লেম আছে। একটা মিউচুয়াল ফান্ড আর দুটো এল.আই.সি আছে। ছুটির দিনে সর্ষে ইলিশের জোগাড় আছে।
মিত্তির মশাই'র সেদিন বড্ড ভোগান্তি গেছে। পার্লামেন্ট স্ট্রিটে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে আধ-ঘণ্টা ট্রাফিকে কেটেছে। অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টারে সই করতে গিয়ে বড় বাবুর টিপ্পনী হজম করতে হয়েছে। আসন্ন প্রমোশনে সঙ্কট মোচনের কথা ভেবে রাতে তিনবার বেশি পাশ ফিরতে হয়েছে। মিত্তির মশাই তাই বেজায় চটেছেন। স্মগে ডোবা সান্ধ্য আড্ডায় খাকিয়ে বলেছেন
- যতসব মিছিল-মিটিং। ডিসগাস্টিং পলিটিক্স। রবিবার কর, ছুটির দিন দেখে কর, আপিসের দিনগুলো বাদ দিয়ে কর। বলি, তোদের কাজ নেই বলে কি কারও নেই? সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধাটা একবার ভাববি না ?

ব্যাসিক্যালি মিত্তির মশাই ঠিকই বলেছেন। ১৩৫ কোটি ৫০ লক্ষ'র তামাম ভারতবর্ষে ৪৮.৭ কোটি শ্রমিকের, অনেকেরই হাতে 'কাজ নেই', পেটে ভাত নেই। অনেকেরই প্রতিদিন 'রবিবার', প্রতিদিনই 'ছুটির দিন।' সেদিক থেকে মিত্তির মশাই'রা 'প্রিভিলেজড'। প্রিভিলেজড কারণ, মিত্তির মশাই'রা দেশের 'শ্রমিক শ্রেণী'র, সেই ৩.৫৫% বিরল প্রজাতি যারা সরাসরি রাজ্য কিম্বা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী। অর্থনীতির পোশাকি ভাষায় যারা 'অরগানাইজড সেক্টর'। যাদের মাস গেলে বেতনের নিশ্চয়তা আছে, চাকরি'র নিরাপত্তা আছে, ওভারটাইমে মজুরি আছে, সরকার ধার্য ছুটি আছে, শ্রম আইনে বোনাস আছে, ইনক্রিমেন্ট আছে, প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে, প্রোমোশন আছে। সরকারী, আধা-সরকারী এবং বেসরকারি মিলিয়ে ভারতবর্ষে 'অরগানাইজড সেক্টর'র লাক্সারি উপভোগ করেন ৫.৬% শ্রমিক ¹। 'ক্রিম অফ দি ক্রপ'। 

আর মিউনিসিপালিটির যে ঝাড়ুদারটা প্রতিদিন সকালে এঁটোকাঁটা ভর্তি ব্যাগটা ডাস্টবিন থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, যে লোকটা স্কুলে-স্কুলে মিড ডে মিলের রান্না করছে, আপনার হবু স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টের স্বপ্নে যে রাজমিস্ত্রিটা একের পর এক ইট গাঁথছে, যে আশা-অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা সার্ভের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরছে, যাঁদের প্রতিদিনের রক্ত জল করা পরিশ্রমে সভ্যতার পিরামিড আকাশে পাড়ি দিচ্ছে, ঝাঁ চকচকে স্মার্ট সিটির ইমারত গুলো ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে -দেশের সেই ৯৪.৬% শ্রমিকই আসলে 'আন অরগানাইজড'। যাদের মাস গেলে ন্যূনতম বেতন নেই, চাকরি'র নিরাপত্তা নেই, ওভারটাইমে মজুরি নেই, সরকার ধার্য ছুটি নেই, শ্রম আইনে বোনাস নেই, ইনক্রিমেন্ট নেই, প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই, প্রোমোশন নেই ² ।

১৯৫৭'তে অর্থনীতিবিদ গুলজারি লাল নন্দা'র নেতৃত্ব ১৫তম ইন্ডিয়ান লেবার কংগ্রেস বলেছিল –"শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি, চারজনের পরিবারের প্রতিজন কে প্রতিদিন ২৭০০ ক্যালরির ব্যালেন্স ডায়েট, পরিবার প্রতি বছরে ৬৫ মিটার কাপড়, সরকারি আবাসন প্রকল্পে প্রদত্ত এলাকার সংশ্লিষ্ট ঘর ভাড়া এবং জ্বালানি, বিদ্যুৎ সহ বিবিধ খরচা পুরোপুরি ভাবে বহন করার উপযুক্ত হওয়া প্রয়োজন ³ ।" ১৯৯২'এ সুপ্রিম কোর্ট এই ন্যূনতম মজুরির উপর আরও ২৫% ছেলেমেয়ের পড়াশুনা, চিকিৎসা, বিনোদন এবং উৎসবের জন্য সংযোজনার নির্দেশ দেয়। সব মিলিয়ে বর্তমান বাজার মূল্যে ন্যূনতম মজুরিটা প্রায় মাসিক ২৬,০০০ টাকা। বাস্তবে, এই 'আচ্ছে দিনের' রামরাজত্বেও যে ন্যূনতম মজুরিটুকু উপার্জন করেন দেশের মাত্র ৭% শ্রমিক। আর তুলনায় মাসিক ১০,০০০ টাকারও কম উপার্জন করা শ্রমিকের সংখ্যাটা ৬৮% ⁴ । 
১৯৮৭-২০১৫, যে ২৮ বছরে সেনসেক্স-নিফটি-জিডিপি'র ঊর্ধ্বগামী অর্থনীতিতে শ্রমিক'রা ২১০% নিট মূল্য সংযোজন করেছে, সেই ২৮ বছরেই শ্রমিক'দের নিট পারিশ্রমিক নাম মাত্র ১৪% বেড়েছে ⁵ । যে ২৮ বছরে ভারতবর্ষে বিলিয়নারির সংখ্যা ১ থেকে বেড়ে ১৩২ হয়েছে, সেই ২৮ বছরেই ১০০ টাকা উৎপাদন মূল্যে শ্রমিক'দের প্রাপ্য মজুরি কমতে কমতে ৯.৯ টাকায় ঠেকেছে ⁶ ⁷ ।

শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে উদ্বৃত্ত সম্পদ বণ্টনের এই বৈষম্য দেখে যখন চক্ষু চড়ক গাছ অক্সফামের মত আন্তর্জাতিক গরিবি গবেষক সংস্থার ⁸, 'মার্কেট ফ্লেক্সিবিলিটি'র অজুহাতে যখন নতুন শ্রম আইনে মালিক শ্রেণীর হাত শক্ত করা হয়েছে ⁹, আই.এল.ও-র বুনিয়াদি শ্রমমান সম্পর্কিত ৪টি কনভেনশন কে যখন ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ¹⁰ , ৪৩তম শ্রম সম্মেলনের 'ঠিকা শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ ও বিলোপ' আইনের সংশোধনী কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে যখন স্থায়ী কাজে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ বেড়েছে ¹¹ -মিত্তির মশাই'দের টেবিল তখন ব্লেন্ডার্স প্রাইড আর চিকেন ললিপপে সেজেছে। যে আনন্দবাজার বিরাট কোহলির ফুটওয়ার্কে খুঁত খুঁজতে কফিন থেকে ডন ব্র্যাডম্যান কে তুলে আনে, যে অর্ণব গোস্বামীরা পদ্মাবতী নিয়ে রোজ প্রাইম টাইমে মাছের বাজার বানিয়ে ফেলে, যে জি-নিউজ নতুন দু-হাজারের নোটে জি.পি.এস চিপ বসিয়ে ফেলে, যে আজতকের ক্যামেরা মঙ্গলে গিয়ে জলের ছবি তুলে আনে; সেই কর্পোরেট মিডিয়ার লেন্সেই ৯৪.৬% শ্রমিক'দের দুর্দশার ছবি ধরা পড়েনা। সেই কর্পোরেট মিডিয়ার পাতাতেই নাকের ডগার শ্রমিক বিক্ষোভের খবর দু কলম জায়গা পায়না ¹² । পায়না, কারণ কর্পোরেট মিডিয়া শ্রমিক'দের স্বার্থের কথা বলে না। বলে মালিক'দের মুনাফার কথা। পায়না, কারণ কর্পোরেট মিডিয়া শ্রমিক'দের পয়সায় চলে না। চলে আম্বানি-আদানি'দের পয়সায়। 

তাই কর্পোরেট মিডিয়া কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই, ৩ লক্ষ শ্রমিকের সমাবেশে উত্তাল হয়েছে দিল্লি। মুষ্টিবদ্ধ হাত আর তুমুল ইনকিলাবি শ্লোগানে ভেসেছে দিল্লি। গণহত্যা কারী মাস্টার মাইন্ড'দের দিল্লি কে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে সফদারের গন্ধ মাখা দিল্লি। ধর্মীয় ভেদাভেদের পিণ্ডি চটকে লাল ঝাণ্ডার তলে হক আদায়ের শপথের সাক্ষী থেকেছে দিল্লি। শপথ, ১৮,০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবী আদায়ের। শপথ, দাবী পূরণ না হলে অনির্দিষ্ট কালের ধর্মঘটের। শপথ, কারখানার'র গেটে তালা ঝুলিয়ে রক্ত চোষা মালিকের বিরুদ্ধে হাল্লা বোলের। 

সেদিন সকালে স্তব্ধ হবে সভ্যতা, থমকে যাবে চাকা। সেদিন সকালে সিক্সটি পয়েন্ট হেডিং-এ ছাপা হবে শ্রমিক'দেরই কথা। সেদিন সকালে প্রতিটা কুঁড়ি বারুদ গন্ধে মাতাল করেই ফুটবে। সেদিন সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।