রবিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৭

চিকিৎসার খরচ ~ কৌশিক দত্ত

আপনাদের আগলে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়েন যে মানুষেরা, তাঁরা যদি দলবদ্ধভাবে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে থাকেন, তবে তা বৃহত্তর অর্থে আপনাদের স্বার্থেই। স্বাস্থ্যক্ষেত্রের পরিবেশ বিষিয়ে দিয়ে আসলে আপনাদের স্বাস্থ্যকেই গভীর অতলে ঠেলে ফেলে দেবার চেষ্টা চলছে। না, কোনো সরকার বা দলের বিরুদ্ধে অভিযোগটা নয়। তাঁদের ভোটকেন্দ্রিক রাজনৈতিক স্বার্থ চিরকাল থেকেছে, আছে, থাকবে, কিন্তু আপনাদের বড় বিপদ সেটা নয়। বড় বিপদ হল, চিকিৎসা পরিষেবাকে আপনাদের নাগালের বাইরে নিয়ে যাবার দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা চলছে। চক্রান্তটা বহুজাতিক বাণিজ্যগোষ্ঠীগুলির।  

সহজভাবে ভাবুন। একজন চিকিৎসক আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চিকিৎসা করলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিজের ক্লিনিকাল স্কিল আর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আপনার চিকিৎসা করবেন। যদি তাঁর ভেতর আতঙ্ক ঢুকিয়ে দেওয়া যায় যে পান থেকে চুন খসলে তিনি বিপদে পড়বেন, তাহলে তিনি নিজের ডায়াগনোসিস বা চিকিৎসার পক্ষে যুক্তি বা প্রমাণ সাজানোর জন্য পাঁচরকম পরীক্ষা করাবেন এবং চারজন স্পেশালিষ্টকে রেফার করতে বাধ্য হবেন। পেটে আর বুকে একটু কষ্ট থাকলেই কার্ডিওলজিস্ট, পালমোনোলজিস্ট, গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট। যাঁদের কাছে রেফার হল, তাঁরাও ভয়ে ভয়ে ওপিনিয়ন দেবেন। "তেমন কিছু তো পাচ্ছি না, কিন্তু ইকো আর অ্যাঞ্জিও করিয়ে নিলে হয়।" "পেটে ব্যথা আছে যখন, পেটের একটা সিটি স্ক্যান আর এণ্ডোস্কোপি হোক", কারণ বইতে সেসব লেখা আছে আর না করালে কোর্ট দোষী সাব্যস্ত করবে। ১০০ জন রোগীর মধ্যে একজনের যদি একজনের ক্ষেত্রে কোনো অঘটন ঘটে (এমনকি সম্পূর্ণ অন্য কারণে) তাহলে "ফেঁসে যাবার" ভয়। অতএব ১০০ জনের ক্ষেত্রেই এই পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হবে।   তাতে আপনার চিকিৎসার খরচা বাড়বে ৮-১০ গুণ। খেয়াল করে দেখুন, দুই দশক আগের তুলনায় এখন আপনার চিকিৎসার খরচ কতটা বেড়েছে? আরো বাড়বে। 

সম্প্রতি আদালতের নির্দেশ এসেছে আল্ট্রাসাউন্ড গাইডেন্স ছাড়া প্লুরাল ট্যাপ (ফুসফুসের বাইরে জমে যাওয়া জল বের করা) করলে ৪১ লক্ষ টাকা জরিমানা। আমরা প্রত্যেকেই বোধহয় কয়েকশ রোগীর এই প্রসিডিওর করেছি ওয়ার্ডেই, নিখরচায়। আর কোনো ডাক্তার সাহস পাবেন না। এবার থেকে এই কাজটির জন্য আপনার হাজার কুড়ি-ত্রিশ টাকা খরচা হবে। তবে সর্বনাশের উল্টো পিঠেই থাকে পৌষ মাস। হাজার হাজার আল্ট্রাসাউন্ড, সিটিস্ক্যান, এম আর আই মেশিন বিক্রি হবে। সিমেন্স-ফিলিপ্সের রমরমা বাণিজ্য। খরচা সামলাতে আপনারা সকলে ইনসিওরেন্স করাবেন। গ্রাহকসংখ্যা বাড়লেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে প্রিমিয়াম। একসময় দেখবেন বছরে পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা স্বাস্থ্যবীমার প্রিমিয়াম জমা দিচ্ছেন এবং চিকিৎসার সময় নানা ছুতোয় আপনার খরচা দিতে অস্বীকার করছে বীমা কোম্পানি। 

এসব আইনি প্যাঁচ নিয়ে তাও সরাসরি কোনো আপত্তি নেই, বিতর্ক থাকলেও। দেশে আইন থাকা উচিত এবং আদালতকে আমরা সম্মান করি। কিন্তু নিত্যদিনের মারপিট? ওয়ার্ড সিস্টার আর মহিলা ডাক্তারের শ্লীলতাহানি? এগুলো আপনারা তো নিজেরা করেন না বা সমর্থনও করেন না। তাহলে আপনাদের নাম নিয়ে যারা এসব করছে, তাদের থামাবেন না? তাদের উদ্দেশ্যটা কী? তাদের উদ্দেশ্য হল চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক এতটাই তিক্ত করে দেওয়া, যাতে চিকিৎসকেরা আপনাদের শত্রু ভাবেন, ভয় পান। কোনো চিকিৎসক যাতে আর আপনাদের কথা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে না পারেন। পাশ্চাত্যের বহুজাতিক বাণিজ্যপুঁজিগুলি আসন্ন সঙ্কটের মুখে। তাদের দেশে স্যাচুরেশন এসে গেছে। এখন তৃতীয় বিশ্বের বাজার দখল করতে হবে। এই বাজার থেকে সর্বাধিক মুনাফা লোটা তখনই সম্ভব হবে, যখন এখানকার পারস্পরিক বিশ্বাস নির্ভর সরল মানবিক আদানপ্রদান একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া যাবে। ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি নষ্ট করে দিতে পারলেই স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে ব্যবসায়িক মৃগয়াক্ষেত্র বানানো সম্ভব হবে। হচ্ছে ইতোমধ্যে।

গত আড়াই দশক এদেশে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে পরিবর্তন এবং অশান্তি চলছে, তা একটি বৃহৎ এবং সুনিপুণ পরিকল্পনার অংশ। নিখুঁত গেমপ্ল্যান। যেসব বুদ্ধিজীবী এবং সংবাদমাধ্যম নিয়মিত আপনাদের উসকাচ্ছেন অশান্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে, তাঁদের অনেকেই (সবাই নন) চুক্তি অনুযায়ী অর্থের বিনিময়ে এ কাজ করছেন। এঁদের চিনুন। মুখোশের আড়ালে মুখগুলো দেখুন। ইতিহাস মনে করুন, কীভাবে রেড ইন্ডিয়ানদের মিথ্যায় ভুলিয়ে তাদের জমি-জিরেত লুটে নেওয়া হয়েছিল। এবার ইন্ডিয়ানদের পালা। উসকানিতে নাচবেন কিনা, প্রলোভনে পা দেবেন কিনা, সে সিদ্ধান্ত আপনাদের। 

ডাক্তারকে যতই শত্রু মনে হোক, সত্যিটা হল, আপনার এবং বৃহৎ পুঁজির সর্বগ্রাসী ক্ষুধার মধ্যে যে একমাত্র পাঁচিল দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম চিকিৎসক, কারণ একমাত্র তার সঙ্গেই আপনার সরাসরি মানবিক সম্পর্ক। এই পাঁচিলটিকে ধসিয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। তখন আপনি বাঘের মুখে। এমতাবস্থায় চিকিৎসকেরা যদি সংগঠিতভাবে এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন, তবে তা রোগী-চিকিৎসকের যৌথ স্বার্থে, কারণ এই দুই গোষ্ঠীর স্বার্থ অনাদিকাল থেকেই যৌথ। আপনি কী করবেন? বাঘের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন, নাকি পাঁচিলটা ভেঙে ফেলার কাজেই হাত লাগাবেন? সিদ্ধান্ত আপনার। ভবিষ্যতও আপনারই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন