রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৭

আচ্ছে দিন ~ সুশোভন পাত্র

চুনো-পুঁটি'দের দিন গুলো দুরকম। একদিন, যেদিন আপনি বাজারে গিয়ে দেখেন, পটল ৪০ টাকা/কেজি, শসা ৬০ টাকা, আর টোম্যাটো ৮০ টাকা, যেদিন আপনি পাঁচ-দশ টাকার জন্যও দর কষাকষি করেন; সেদিনটা, 'খারাপ দিন'। আরেক দিন, যেদিন আপনি দেখেন, পটল ৫০ টাকা/কেজি, শসা ৭০ টাকা, আর টোম্যাটো ১০০ টাকা, যেদিন আপনি দাম শুনেই আঁতকে ওঠেন; সেদিনটা 'আরও খারাপ দিন'। দাম বেড়ে যাবে আন্দাজ করে কেজি খানেক শসা যদি আপনি আগের দিনই বেশী কিনে রাখতেন, তাহলে সেটা হতে পারতো আপনার 'মাস্টার স্ট্রোক।' বিজনেসের ভাষায় 'রিস্কলেস ইনভেস্টমেন্ট'। ঐ যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন বলেছিলেন, "এদেশের বিগ-বিজনেস হাউস গুলো বরাবর রিস্কলেস ইনভেস্টমেন্টের সুবিধা উপভোগ করে" -সেই 'রিস্কলেস ইনভেস্টমেন্ট' ¹ । 
রাঘব-বোয়াল'দের দিনগুলো তিনরকম। একদিন, যেদিন আম্বানি-আদানি'রা ব্যবসায় ইনভেস্ট করে, 'শ্রম ও উৎপাদনের' সম্পর্কের বঞ্চনায় সংশ্লেষিত মুনাফা অর্জন করে; সেদিনটা 'আচ্ছে দিন'। আরেক দিন, যেদিন মুনাফা অর্জনে ব্যর্থ হন এবং নির্বাচিত জনকল্যাণকামী সরকার, রিটায়ার্ড বাপের পি-এফে সুদের হার কমিয়ে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ-কোটি টাকার লোন 'রাইট অফ' করে; সেদিনটা আরও 'আচ্ছে দিন'। আর যেদিন, বিজয় মালিয়া ১৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ৯,০০০ কোটি টাকা ঋণ বকেয়া রেখে, গোয়ার প্রাইভেট বিচে জন্মদিনে এনরিক ইগলেসিয়াসের 'ব্যালেন্ডা'র' সুরে কোমর দুলিয়ে, প্লেনে চেপে, হুশ করে লন্ডন উড়ে যেতে পারেন, সেদিনটা আরও আরও 'আচ্ছে দিন' ² । 
রাজন বলেছিলেন "সিস্টেমের কাছে যার এতো ধার বাকি, জন্মদিনের পার্টিতে তাঁর এতো অপব্যয়র বিলাসিতা মানায় না। ³" সমস্ত ব্যাঙ্ক কে নির্দেশ দিয়েছিলেন "অন্যায় সুবিধা না দিয়ে এই বিগ-বিজনেস হাউস গুলির অনাদায়ী ঋণ দ্রুত আদায় করতে হবে। ⁴" এরই মূল্য চোকাতেই সেদিন অর্থমন্ত্রীর সাথে 'লো ইন্টারেস্ট রেট' আর মুদ্রাস্ফীতির তু-তু-ম্যা-ম্যা'র অজুহাতে, রাজন কে তাড়িয়ে উৰ্জিত প্যাটেলের ক্ষমতায়নের ঘোলা জলে মাছ ধরে সম্পন্ন হয়েছিলো 'রিস্কলেস ক্রনি ক্যাপিটালিজম' কে বাঁচিয়ে রাখার আস্ত একটা 'মোডাস অপারেন্ডি'। 
আম্বানি'দের 'ব্যালেন্স শিটে' পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার নাম উঠেছে ২০১৪'তেই। যেদিন প্রকাশ পেয়েছিল পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার "গ্যাস ওয়ার্স" বইটি। নিখুঁত বর্ণনা, অলঙ্ঘনীয় নথি, আর রিলায়েন্সের কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা'দের সাক্ষাৎকারে সেদিন দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়েছিল, কৃষ্ণ-গোদাবরী বেসিনের গ্যাস উত্তোলন, নগদীকরণ, বাজারিকরণ নিয়ে আম্বানি'দের বাণিজ্যিক সংঘাতের কালো অধ্যায়। বে-আব্রু হয়েছিল তৎকালীন ক্যাগ, পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে আম্বানি'দের ব্যাক-ডোর সখ্যতার 'নেক্সাস'। তিনদিনের মাথায় 'ইচ্ছাকৃত মানহানি'র অভিযোগে ১০০ কোটির ক্ষতিপূরণ চেয়ে পরঞ্জয় কে লিগাল নোটিশ পাঠিয়েছিল রিলায়েন্স ⁵। 
কলম থামেনি পরঞ্জয়ের। বরং অ্যাকাডেমিক জার্নাল ই.পি.ডাব্লিউ'র এডিটরের দায়িত্ব নিয়ে একাধিক অনুসন্ধানী আর্টিকেলে তিনি 'ক্রনি ক্যাপিটালিজম' মুখোশ খুলে দেন। জনসমক্ষে আসে 'আদানি পাওয়ার লিমিটেড' কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মালবাহী জাহাজের খরচ ও কাস্টম ডিউটি সহ ইন্দোনেশিয়া থেকে ৩৩৫০ টাকা/মেট্রিক টন মূল্যে 'স্টিম কয়লা' আমদানি করে ৫৪৯৪ টাকা/মেট্রিক টন মূল্যে বিভিন্ন স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ড গুলিকে বিক্রি করছে। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎমন্ত্রীর তথ্যানুসারে যে দুর্নীতির পুঞ্জীভূত অঙ্ক প্রায় ৫০,০০০ কোটি ⁶। শুধু তাই নয়, ২০১৬'র অগাস্টে অর্থমন্ত্রক সংযোজনী এনে এস.ই.জেড এলাকার কোন প্রজেক্টে প্রযোজ্য ট্যাক্সের নিয়ম শিথিল করে এবং রেট্রোস্পেক্টিভ এফেক্টে অতিরিক্ত ট্যাক্স রিফান্ডেবেল ঘোষণা করে। সংসদে সেই সংযোজনী পাশ হবার দু-দিনের মাথায় 'আদানি পাওয়ার লিমিটেড' গুজরাট হাইকোর্টে পি.আই.এল ফাইল করে ৫০০ কোটি টাকার প্রদত্ত ট্যাক্স রিফান্ডের আবেদন করে। এবং ক্রিম অফ দি টপ; উপযুক্ত নথি ছাড়াই হাইকোর্টে সেই আবেদন মঞ্জুরও করে। 'ক্রনি ক্যাপিটালিজমের' নিখুঁত চিত্রনাট্য এবং তার মসৃণ বাস্তবায়ন বোধহয় একেই বলে। শুধু মিসিং ছিল এক চিমটে ট্র্যাজেডি। শেষ পাতে জুটেছে সেটাও। পরঞ্জয় কে ঐ আর্টিকেল লেখার অপরাধে ইস্তফা দিতে বাধ্য করে ই.পি.ডাব্লিউ'র মালিক পক্ষ। ওয়েবসাইট থেকে সরিয়েও নেওয়া হয় আর্টিকেল গুলি। রঘুরাম রাজনের পরে পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা। কট অর্থমন্ত্রক বোল্ড বিগ-বিজনেস হাউস ⁷ ⁸ ⁹ ।  
এবং এর পরেও আপনার মনে হতেই পারে এসব নেহাতই কাকতালীয়। কিন্তু সমস্যা কি জানেন? সমস্যাটা কাকতালীয় ঘটনা গুলোর পৌনঃপুনিকতায়। যেমন ধরুন, ২০১৪'র অস্ট্রেলিয়া সফরে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী গৌতম আদানি স্বাক্ষর করলেন কুইন্সল্যান্ড অববাহিকায় কয়লা উত্তোলন প্রোজেক্টে ¹⁰।  কিম্বা ২০১৫'র প্রধানমন্ত্রীর রাশিয়া এবং ফ্রান্স সফরে প্রতিরক্ষা সামগ্রী ম্যানুফ্যাকচারিং'র চুক্তি পেলো রিলায়েন্স ¹¹।  আবার ধরুন, প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে 'আম্বানি পাওয়ার লিমিটেডের' সাথে মৌ সাক্ষরিত হল বাংলাদেশ পাওয়ার বোর্ডের ¹² । ২০১৭'র আমেরিকা সফরে রিলায়েন্স পেল যুদ্ধজাহাজ মেরামতের বরাত ¹³ । আর ইজরাইল সফরে আদানি'রা করল ড্রোন ম্যানুফ্যাকচারিং ডিলের বাজিমাত ¹⁴ ।  
আপনি যখন ব্যস্ত আছেন হিন্দু-মুসলিম-শিখ-ক্রিশ্চানে বাছতে; আপনি যখন চায়ের আড্ডায় প্রতিদিন ঝড় তুলছেন গরু-শুকর-গোবর-ঘুঁটে নিয়ে; মেয়ের টিউশন ফিস, মায়ের বাত, বউ'র আবদার আর নিজের বিয়ার; একটু গুছিয়ে বসে যখন ভাবছেন 'এই বেশ ভালো আছি'; ঠিক তখনই এই সব কিছুর আড়ালেই বাড়ছে সরকার ও বিগ-বিজনেস হাউসের প্রতিদিনের সখ্যতা। বাড়ছে আম্বানি-আদানিরা। বাড়ছে তাঁদের মুনফা। বাড়ছে ৯৯%'র সঙ্গে ১%'র বৈষম্য।  
কাকতালীয় আজ আপনার মনে হতেই পারে কিন্তু, যে দেশে ঋণখেলাপি বিজয় মালিয়া পায়ের উপর পা তুলে নিশ্চিন্তে লন্ডনে বসে থাকেন, যে দেশে ওত্তাভিও কাত্রোচ্চিরা বোফোর্সের পরও কলার তুলে ঘুরে বেড়ান, যে দেশে ওয়ারেন অ্যাণ্ডারসেনরা ভোপালে নির্বিচারে মানুষ মেরে মন্ত্রীদের প্লেনে চেপে পালিয়ে গিয়ে আমেরিকায় নিশ্চিন্তে মরেন, সে দেশে সত্যেন্দ্র দুবেরা বাঁচতে পারে না, রঘুরাম রাজনরা থাকতে পারেন না, পরঞ্জয় গুহঠাকুরতারা লিখতে পারেন না। 
এবার আপনি ঠিক করুন আপনি কোন পক্ষে। ওত্তাভিও কাত্রোচ্চি-ওয়ারেন অ্যাণ্ডারসেন'দের পক্ষে ? না সত্যেন্দ্র দুবে'দের? আম্বানি-আদানি'দের পক্ষে? না রঘুরাম রাজন-পরঞ্জয় গুহঠাকুরতাদের?  ঠিক করুন আপনি থাকবেন কার সাথে? ঐ ১%'সাথে না  ৯৯%'দের সাথে? নিরামিষ নিরপেক্ষতা তো অনেকদিন হল। এবার না হয় পক্ষ নিন। এবার না হয় বদলে দিন।








-- 





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন