শুক্রবার, ৫ মে, ২০১৭

দেশদ্রোহী ~ সুশোভন পাত্র

এবং স্মৃতি ইরানি মঞ্চে উঠলেন। তখন ২০১৩। তখন ইন্দোর। জম্মু-কাশ্মীরের মেনঢর সেক্টরে দুই জওয়ানের মাথা কেটে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা তখন টাটকা। অতএব 'কিঁউকি শাশ কভি বহু থি' সার্টিফায়েড মেলোড্রামাটিক আর্দ্র ভাষণে তিনি বললেন "পাকিস্তান ঘরে ঢুকে আমাদের জওয়ানের মাথা কেটে নিয়ে যাচ্ছে, আর দিল্লির সরকার হাতে চুড়ি পরে বসে আছে।" সেলিব্রেটির চরম মিসোজিনিস্ট মন্তব্য কে সেদিন করতালি তে ভরিয়ে দিয়েছিল রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ ¹। 
তখন কর্ণাটক। তখন বিরোধী। জম্মু-কাশ্মীরের পুঞ্চ থেকে তখন হেলিকপ্টারে আনা হচ্ছে জওয়ান হেমরাজ আর সুধাকর সিং'র মৃতদেহ। অতএব দ্ব্যর্থহীন বিশুদ্ধ হিন্দি তে সুষমা স্বরাজ জানালেন, "সরকার জবাব দিক। একটা মাথার বদলে দশটা মাথা আসুক।" লোকসভার বিরোধী নেত্রী'র উগ্রবাদী মন্তব্য' সেদিন সিক্সটি পয়েন্ট হেডিং হয়ে চুইয়ে পড়েছিল প্রিন্ট মিডিয়ার লুস মোশেনে ² ।    
তখন গুজরাট। তখন মুখ্যমন্ত্রী। পাকিস্তানের জেলে নৃশংস ভাবে আক্রান্ত সরাবজিৎ তখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে নরেন্দ্র মোদী টুইট করলেন, "পাকিস্তানের অমানবিক কাজের পরেও দিল্লী সরকার অকর্মণ্যের মত ঘুমোচ্ছে।" ৫৬ ইঞ্চির ছাতির প্রশংসায় সেদিন ভেসে গিয়েছিলো কেন্ট থেকে ক্যাওড়াতলা, লন্ডন থেকে লোনাভেলা ³ ।   
প্রভুর 'ইমেজ বিল্ডিং-এ', গবুমন্ত্রী অমিত শাহ সেদিন বলেছিলেন "নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে পাক হানাদাররা আর নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রমের হিম্মত করবে না ⁴ ।" সেই নিয়ন্ত্রণ রেখা, যে নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গত সোমবার কৃষ্ণঘাটি এলাকায় জওয়ান পরমজিত সিং ও প্রেম সাগরের মাথা কেটে হত্যা করল পাকিস্তানের 'বর্ডার অ্যাকশন টিম'। সেই পাকিস্তান যে পাকিস্তান কুলভূষণ কে 'গুপ্তচর' সাজিয়ে, ইরান থেকে অপহরণ করে, ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে দিল বে-শক ⁵। গত ৩৫ মাসে জম্মু-কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটেছে ১৭২টি, পাকিস্তান অস্ত্রসংবরণ সমঝোতা ভঙ্গ করেছে ১৩৪৩ বার, জওয়ান শহীদ হয়েছেন ১৯৮ জন। শুধু ২০১৬তেই ৬৪ জন। বিগত ৬ বছরে সর্বোচ্চ ⁶ ⁷। এযাবৎ অবশ্য স্মৃতি ইরানি, সুষমা স্বরাজ স্পিক-টি-নট। অমিত শাহ স্পিক-টি-নট। নরেন্দ্র মোদী আরও আরও স্পিক-টি-নট। বশংবদ কর্পোরেট মিডিয়া অবশ্য গুজব ছড়িয়ে সরকারের ড্যামেজ কন্ট্রোলে নিবেদিত।   
ভারতীয় জওয়ান'দের মাথা কেটে হত্যার রিপোর্ট প্রকাশিত হবার বারো ঘণ্টা পর 'আজতক' চ্যানেলে টেলিকাস্ট করল ভারতীয় সেনা নাকি 'প্রতিশোধ নিয়ে কৃপাণ' ও পিম্পলে' পাকিস্তান সেনার আর্মি পোস্ট ধ্বংস করেছে এবং এনকাউন্টার ৭-১০ জন পাকিস্তান সেনারও মৃত্যু হয়েছে'। 'ইন্ডিয়া টুডে', 'ইন্ডিয়া টিভি', 'জি নিউজ' -আগুনের স্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়ল গুজব। সোশ্যাল মিডিয়াতে যখন হাজার হাজার শেয়ার হয়ে সেই খবর পৌঁছে যাচ্ছে ফেসবুকের দেওয়ালে, টুইটারের নিউজ ফিডে কিংবা হোয়াটস অ্যাপের স্ক্রিনে তখন জানা গেলো, 'কৃপাণ' আর্মি পোস্ট আদেও পাকিস্তান আর্মির নয় নয় বরং ভারতের ⁸।  হিন্দুস্থান টাইমস পত্রিকা তে সেনার নর্দান সিনিয়র কমান্ডার সাফ জানিয়ে দিলেন "ভারতীয় সেনা কোনও এনকাউন্টার করেনি, বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রকাশিত খবর ভিত্তিহীন" ⁹। 
মিডিয়ার এই নির্লজ্জ চাটুকারিতা অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং প্রত্যাশিত। দীর্ঘদিন ধরেই বিজেপির কোষাগার পুষ্ট হয়েছে কর্পোরেট ডোনেশেনে। বিনিময়ে সরকারি নীতির মারপ্যাঁচে মুনাফা কুড়িয়েছে কর্পোরেট হাউসগুলো। চক্রাবর্ত নিয়মে কর্পোরেট'দের মালিকাধীন মিডিয়াই তাই গুজব ছড়িয়ে সরকারের ব্যর্থতা আড়ালে প্রতিশোধের রূপকথা পরিবেশন করছে।  
কিন্তু মিডিয়া আপনার হয়ে সরকার কে কখনও প্রশ্ন করেনি যে; জম্মু-কাশ্মীরের এই উত্তাল পরিস্থিতিতে দেশে একটা স্থায়ী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নেই কেন? জিজ্ঞেস করেনি যে বিজেপির দাবি মত ডিমনিটাইজেশান যদি মাওবাদী'দের মেরুদণ্ড ভেঙেই গিয়ে থাকে, তাহলে সুকমা'তে ২৬ জন সি.আর.পি.এফ কে মরতে হল কেন? জিজ্ঞেস করেনি যে, ছত্তিসগড়ে সি.আর.পি.এফ'র চিফের পদ ২৮শে ফেব্রুয়ারি থেকে খালি রইলো কেন ¹⁰? প্রশ্ন করেনি যে আদানি গ্ৰুপের ফ্যাক্টরির জন্য জমি অধিগ্রহণের অজুহাতে ছত্তিসগড় সরকার বনজ জমির উপর আদিবাসীদের অধিকারের আইন সম্পূর্ণ বাতিল করেছে কেন? প্রশ্ন করেনি যে জগদলপুর লিগ্যাল অ্যাড গ্রুপ ও আদিবাসীদের নেত্রী সোনি সোরির মুখে সলওয়া জুডুমের উত্তরসূরি 'সামাজিক একতা মঞ্চে'র গুণ্ডারা অ্যাসিড ছুঁড়ল কেন ¹¹? 
সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর, উৎপল দত্ত সাহিত্য অ্যাকাডেমির বক্তৃতায় বলেছিলেন; পথের পাঁচালি দেখে দিল্লীর এক উচ্চপদস্থ আমলা অগ্নিশর্মা হয়ে দেশের গরিবির এই মলিন ছবি সেলুলয়েডে পরিবেশনেই জন্য সত্যজিৎ রায় কে তীব্র ভর্ৎসনা করেন। গোটা বিশ্বের কাছে ভারতবর্ষের মাথা হেঁট করে দিয়েছেন এই অভিযোগে তৎক্ষণাৎ পথের পাঁচালি'র যেকোনো রকম পরিবেশনা বন্ধ করার দাবিও করেন। প্রত্যুত্তরে সেদিন সত্যজিৎ রায় ইস্পাত কাঠিন্যে বলেছিলেন "নীতি প্রণয়নের শীর্ষে  বসে দেশের গরীব'দের এই অবস্থা দেখে যদি আপনার মাথা হেঁট না হয়, তাহলে আমি সেই গরিবি সেলুলয়েডে পরিবেশন করলে নতুন করে ভারতবর্ষের আর মাথা হেঁট হবে না" 
তাই যে সরকার রায়বাহাদুরের অবহেলায় আজ সিয়াচেন থেকে কাশ্মীর, সুকমা হয়ে মহারাষ্ট্রে জওয়ান'রা শহীদ হচ্ছে তারা যদি প্রকৃত 'দেশদ্রোহী' না হয়; তাহলে সেই সরকারের দায়-দায়িত্ব-কর্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করলে নতুন করে আর কেউ 'দেশদ্রোহী' হবে না, সেই সরকারের ব্যর্থ বিদেশনীতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন করলে নতুন করে আর কেউ 'দেশদ্রোহী' হবে না, সেই সরকারের ভ্রান্ত কাশ্মীর নীতি বিরুদ্ধে প্রশ্ন করলে নতুন করে আর কেউ 'দেশদ্রোহী' হবে না। জওয়ান'দের শহীদ হওয়ার আবেগ মাখিয়ে, মিথ্যে দেশপ্রেমের বুলি কপচে প্রধানমন্ত্রী কেন নওয়াজ শরিফের সাথে পাকিস্তানে বিরিয়ানি খান  -জিজ্ঞাসা করলে নতুন করে আর কেউ 'দেশদ্রোহী' হবে না। সেনা কে উলুখাগড়া বানিয়ে রাজায় রাজায় যুদ্ধ আর কদিন –জানতে চাইলে নতুন করে আর কেউ 'দেশদ্রোহী' হবে না। তাই প্রশ্ন করুন। একটা নয়, একশোটা করুন। কেন হচ্ছে প্রশ্ন করুন। কাদের দায় জিজ্ঞেস করুন। কবে থামবে প্রশ্ন করুন। কারণ একমাত্র প্রশ্নেই আছে সমাধান। প্রশ্নেই আছে উত্তর। এই জন্যই আজকের ২০০তম বার্থ ডে'র বুড়োটা কবেই বলে গেছে.. "কোশ্চেন এভরিথিং"।এভরিথিং…



​ 







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন