শনিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৭

ভূতের গল্প ~ আরকাদি গাইদার

এটা একটা ভূতের গল্প।

গল্পজুড়ে অনেকগুলো ভূত। ১৮৮৬ সালে হে মার্কেটে আট ঘন্টা কাজের দাবীতে যে শ্রমিকরা ডাইনামাইট ছুড়েছিলো, এবং তারপর যাদের ফাঁসি হয়, সেই শ্রমিকদের ভূত, ডাইনামাইটের ভূত, ফাঁসির দড়ির ভূত। ঠিক ১৯ বছর পরে আবার সেই ডাইনামাইট ব্যাবহার হবে রাশিয়াতে। আবার ফাঁসির দড়িতে ঝুলবে বহু লোক।
ইউরোপের এক ছোট্ট শহর স্যারাএভোতে এক নৈরাজ্যবাদী গুলি চালাবে অস্ট্রিয়ান রাজকুমার ফার্ডিনান্ডকে লক্ষ্য করে। এইরকমভাবেই শুরু হবে বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস। সেই ইতিহাসের সমাপ্তিও ঘটবে ঠিক ৮০ বছর পরে, এই একই শহরে। ইউটোপিয়া চেয়েছিলো যারা, তাদের দিকে আঙ্গুল তুলে হাসবে গোটা বিশ্ব। ইউগোস্লাভিয়া ভেঙে টুকরো হবে। ইউটোপিয়ার শবদেহের ওপর মেমোরিয়াল স্টোনের মতন জেগে থাকবে সারাএভোর ভূত।

শতাব্দীর শুরুর দিকেই, জার্মানিতে একদিন ব্রাউনশার্টরা পিটিয়ে মারবে রোজা লাক্সেমবার্গ নামক এক শীর্ণকায় মহিলাকে। তারপর তার দেহ নদীতে ফেলে দেওয়া হবে। ওয়াইমার রিপাব্লিকের ভূত আকাশে উড়তে উড়তে দেখবে, রাইখস্ট্যাগে আগুন লেগেছে। যে রাতে আগুন লাগবে, তার পরেরদিনই বিভিন্ন খবরের কাগজে খবর হবে, যদিও আগুন লাগবার আগেই প্রেসে কাগজ ছাপা হয়ে গেছে। সেই আগুনের ভূত আবার জ্বলবে গ্যেরনিকায়, যখন ফ্রাঙ্কোকে সাহায্য করতে হিটলার আর মুসোলিনির বিমান বাহিনী গোটা শহরটিকে বোমায় মুড়ে দেবে, আর স্পেনের আকাশে উড়ে বেড়াবে কমিউনিষ্ট আর রিপাব্লিকানদের পোড়া ভূত। তবুও সেই আগুনের ক্ষিদে মিটবে না, আউশউইতজের ফার্নেসে সে জ্বলতে থাকবে ধিকিধিকি করে। আর ফার্নেসের বাইরের ঘরে পড়ে থাকবে ডাই করে রাখা চুল, যা ইহুদিদের মাথা থেকে কেটে জড়ো করা হয়েছে। ঠিক এরকম চুলের পাহাড় পাওয়া যাবে ইস্ট পাকিস্তানের পাকিস্তানি আর্মি ব্যারাকগুলোর মধ্যে। আশেপাশের গ্রামের মহিলাদের তুলে আনবার পরে দিনের পর দিন ধর্ষন করবার আগে তাদের চুল কেটে রাখা হবে, যাতে নিজেদের চুল ব্যাবহার করে ঝুলে পড়ে নিজেরা আত্মহত্যা না করতে পারে। 

গ্রীস, ইতালি আর ইউগোস্লোভিয়ার পার্টিজান ব্রিগেডের হাতে যে রাইফেল দেখা যেতো, ঠিক সেইরকম রাইফেল দেখতে পাওয়া যাবে তেলেঙ্গানার কৃষক রমণীদের হাতে। তাদের ট্রেনিং দেবেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে পালিয়ে আসা মেজর জয়পাল সিং। তারপর নিজামের রাজাকার আর পটেলের সেনাবাহিনীর হাতে খুন হয়ে যাওয়ার পর সেই রাইফেলের ভূতগুলো ঘুমিয়ে থাকবে বেশ কিছুদিন, যতক্ষন না আবার ভিয়েতনামে আধপেটা খেয়ে থাকা চাষীরা তাদের হাতে তুলে নেয়।

জার্মানিতে, ফ্রান্সে দুই আর তিনের দশকে রাস্তা জুড়ে যে মিছিল আর ব্যারিকেড দেখা যেতো ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে সেই মিছিল আর ব্যারিকেডের ভুতগুলো এলোমেলো হয়ে ঘুরে বেড়াবে ১৯৬৮ অবধি, যখন আবার একদল ছাত্র তাদের জীবন্ত করে তুলবে বার্লিন আর প্যারিসের ইউনিভার্সিটিগুলোর মধ্যে। 
বার্লিনের দেওয়াল ভেঙে ফেলবার পর স্যুভেনির হিসেবে ইটগুলো সংগ্রহ করবে বহু কালেক্টর। দেওয়ালের ভূত দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। ইটগুলোর ভূতেরা ছত্রাখান সেনাবাহিনীর মতন ছড়িয়ে পড়বে ইউরোপ থেকে সারা পৃথিবী। ইউটোপিয়ার ভুত হাসবে, কারন নিজের অদৃষ্ট সে বহুদিন আগে বুঝেছিলো, যখন তার দেহথেকে পচা গন্ধ বেরোতে শুরু করেছে। কিন্তু দিশেহারা ইটের ভূতগুলোও সবাই শেষ হয়ে যাবে না। 
এরকমই একটা ইট ছোড়া হবে পুলিশকে লক্ষ্য করে, আমেরিকার সিয়াটেল শহরে বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার সামিটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে। 

এরকম বহু ব্যারিকেড, মিছিল, ইট, বুলেট, দেওয়াল, আগুন, কবিতা গানের ভূত উড়ে বেড়াবে পৃথিবীর আকাশে। মাঝেমধ্যে উঁকিঝুকি মারতে থাকবে হাউড পার্কে, কুর্দিস্তান, শাহবাগ চত্বরে।

তারপর অনেক অনেকদিন পরে কোন এক পয়লা মে'র আগের রাতে, নিজেদের বন্ধ দরজার পেছনে নিশ্চিন্তে ঘুমোবে সব রাষ্ট্রনেতা, মিলিটারি জেনারেল, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মালিক,  পাদ্রী, ইমাম, পুরোহিতরা। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। হাওয়া বইবে মৃদু তালে। হয়তো চাঁদ ঢাকা পড়বে মেঘের আড়ালে।
তারপর খুব মন দিয়ে কান পাতলে শোনা যাবে, কারা যেন ফিসফিস করছে। রাস্তায়, গলিতে, ডকে, কারখানায়, জনমানবশূন্য নদীর তীরে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে ভৌতিক সমাগম। ফিসফিসানির আওয়াজ তীব্রতর হবে। শোনা যাবে পায়ে পা মিলিয়ে কারা যেন মার্চ করছে। নিঃশ্বাস ফেলছে। গান গাইছে। কোন এক পয়লা মে'র আগের রাতে ভৌতিক কাগজে, ভৌতিক কালিতে পৃথিবীর প্রতিটা মহাদেশে, প্রতিটা শহরে, প্রতিটা গ্রামে দেওয়ালে দেওয়ালে সাঁটা হবে ভৌতিক পোস্টার। অশরীরী অক্ষরে কারা যেন তাতে লিখে যাবে -  ইউটোপিয়া।

বৃহস্পতিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১৭

অমিতাহারী ~ শুভদীপ ঘোষ জয়

নাহয় আমি গেলাম
শূদ্র বাড়ি খেলাম
দশরথের ব্যাটার মতোন
শম্বুক - যে গোলাম
তাকে তুলে দিলাম জাতে
সব ছবিতে লটকে থাকলো
আমার সাথে সাথে

আগেও আমি গেছি
ফুলিয়ে আমার পেশী
রামের নামে কুরবানিতে
বান্দা রাশি রাশি
আমি কাটতে ভালোইবাসি

তাই
আবার আমি যাবো
লোকজন উসকাবো
জীবের আমি জীবন নেবো
এবার কৃষ্ণ হবো

আছে অনেক গুন
বধ 
করিবে অর্জুন
মারবে এবং মরবে নিজে
যে রক্তে ওই খুন
মিলে ভাসতে ভাসতে যাবে
বিপুলস্রোতা হবে
তার ধারেতেই
পূন-
পূনঃ গড়বো বৃন্দাবন
মরুক মানুষ
বাঁচুক গরু
এটাই
হিন্দুজাগরন

রবিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৭

লেনিন ~ অবীণ দত্তগুপ্ত

আজ সকালে দেখলাম কে একজন লেনিন লিখতে লেলিন লিখে ফেলেছেন । তা নিয়ে খুব হাসাহাসি । তাই লেনিনের বদলে একটা লেলিনের গল্প বলি । অশিক্ষিত গল্প । 

আনোয়ার মণ্ডল , বাড়ি ডায়মন্ড হারবার , বাঘাযতীনে রিক্সা চালান । আমার সাথে প্রথম দেখা ২০১১-র এপ্রিল মাসে । নির্বাচন চলছে তখন । কোন একটা মিছিল থেকে বাড়ি ফিরছি , হাতে একটা লাল টুপি ছিল । রিক্সায় ওঠার পর ঘাড় ঘুরিয়ে বলেছিলো , "এবার হবে নি বাবু । " আমি তর্ক জুড়লাম ,বাড়িতে নামিয়ে বলেছিল " আপনেরে শিক্ষিত মানুষ ,অনেক কিছু জানেন । কিন্তু এবার হবে নি বাবু । হলে আমি খুব খুশি হই । কিন্তু হবে নি । " 

তারপর থেকে অনেক দিন-ই দেখা হয়েছে । যা জেনেছি তার মোদ্দা কথা হলো আনোয়ার কাকু একদম আগ মার্কা সি পি আই এম । গত প্রায় বছর খানেক হয়ে গেল , দেখা হয় না । একদিনের কথা মনে পড়ছে ,সেটা জানাতেই এই গৌরচন্দ্রিকা । বছর দুয়েক আগের কথা ,সে দিনও আজকের মতোই ২২শে এপ্রিল । যাদবপুরের ভাঙ্গা লেনিন মূর্তির জায়গায় , নতুন মূর্তি উদ্বোধন হয়েছে , দুপুরে বাড়ি ফিরছি - আনোয়ার কাকুর রিক্সা । বাড়ির সামনে নেবে ১০টাকা ভাড়া দিলাম । আনোয়ার কাকু একটাটাকা ফেরত দিল  সাথে একটা ৫০ পয়সার লজেন্স । "এটা কি ? "  স্বাভাবিক প্রশ্ন । উত্তর এলো - "আজ লেলিন বাবুর জন্মদিন নে । তুমি দলের নোক , খাও ।" একটু মধ্যবিত্তসুলভ সুপিরিয়োরিটি কমপ্লেক্স থেকে জিজ্ঞেস করলাম , " লেনিন কে জানো ?" আরও অবাক করে উত্তর এলো - "ক্যানে আমাদের জমি দেছিলো !!" আনোয়ার কাকুকে দেখে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল ,আমার এরূপ অজ্ঞানতা তাকে অবাক করছে । তবুও খুচালাম , " লেনিন তোমাকে জমি দিয়েছিলো ? লেনিনের দেশ কোনটা জানো ? লেনিন অনেক দিন হল মরে গেছে । " এবার খ্যাক করে হেসে উত্তর দিল - "সে তো জ্যোতি বাবুও মরে গেছে , প্রভাস বাবুও মরে গেছে ।" 
আমার ঈষৎ হতভম্ব ভাব দেখে আনোয়ার বলে চললেন " তুমি জানো না ,জন্মাও নাই কিনা । লেলিনবাবু জ্যোতিবাবুর পার্টির নেতা ,লাল পার্টির নেতা , আমাদের প্রভাস রায়ের নেতা । আমাদের জমি দিয়েছিল লাল পার্টি । সেদিন লেলিনবাবুর কথা বলেছিল বাবু মন্ডল । বাবু মণ্ডল আমার কমরেট্‌, তুমি চিনো না । বাবুদাও মরে গেছে সে বছর তিন হলো । বাবুদা বলেছিল , লেলিনবাবু শিখাইছে জমির লড়াই ,পেটের লড়াই । লেলিন বাবু অনেএএক বড় নেতা । দেখো না ক্যানে , জ্যোতিবাবুর মূর্তি নাই , লেলিনের আছে । কতোখান বড় নেতা হলি ,তবেই না মরে যাওয়ার এদ্দিন পড়েও উরা ওনার মূর্তি ভাঙ্গে । " 

অতঃপর প্যাডেলে চাপ দিয়ে , লেলিনের দলের নোক আনোয়ার মন্ডলের প্রস্থান ।

বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৭

হাজতবাস ~ ফ্যাতারু বজরা ঘোষ

কে য্যানো বলেচিল, বীরের মত ঢুকচি, রাজার মতো বেরুবো, শিবিয়াই কিচ্চুটি কত্তে পাব্বেনা। ... মানে জেলে যাচ্চে খোকারা! উহ, কি তড়পানি শালা। ভাবখান এই য্যানো যতীন দাস কি সুয্যসেন জেলে ঢুকচেন! ও: করেচিস তো চুরিচামারি, য্যানো বিটিশ পিটিয়েছে। শালা, রগড় দেকে ভালই লেগেচিল। তা ভাবলুম, দম যখন আচে, নাহ এ ছেলে ছিঁড়ে দেকাবে! ওমা...

"কপাল আমার বক্ত (মন্দ)
শক্ত দেকে ভাতার নিলাম
হাগে শুদু রক্ত"

তাল ছেঁড়ার খ্যামতা নাই বাল ধরে ঝুলোঝুলি। একন কেঁদেকেটে একশা। আরেক মাল, গাবদা বডি, তিনটে বাঘে খেয়েও শেস কত্তে পারবেনা। বাংলা শিনেমায় নাম ছিল ঢ্যাপোস মতান্তরে আলুসেদ্দ, সেও কাঁদচে। দিদি বাঁচাও, শুকিয়ে যাচ্চি।
জেলের ভাত, লপসী কি জিনিস সে কুনাল বুজে গ্যাচে। গাদাখানিক আই পিল খেয়ে সুইসাইড নাটক কত্তে গেচিল, পেট খালাস করে হেগে মুতে ছড়িয়ে মাট ময়দান। লোকে খিল্লি কচ্চে। একন দেকলাম বই লিকেচে... 'বোন্দিজীবন'। ওই কলেজ ইস্কোয়ারের কোনায় ফ্রিতে মুততে গিয়ে দেকি বোইমেলা হচ্চে, হিসুর লাইন বড় ছিল ভাবলাম এট্টু দেকি একানে কি হচ্চে! লাডূ ফাড্ডু যদি মাগনা মেলে। ওরে সাঁটি এযে বোইমেলা! তকনই দেকলাম তাক আলো করে কালচে মলাটের দুম্বা সাইজের বোই। বোন্দিজিবন। নীচে লেকা কুনাল ঘোস।
বিক্কিরি হতে দেকলুমনা তবে একজন বুদ্দিজিবি পাস থেকে আরেক ঝিংকু শিস্যাকে বললো কুনাল ঘোস অমুককে মনে কোরিয়ে দিচ্চে! আমি সুদোলাম কি নাম বললেন দাদা?
লোকটা অবজ্ঞা নিয়ে বল্লো গ্রামচি, গ্রামচি। নাম সুনেচেন?
হেভি ভেবড়ে গিয়ে বললাম ইয়ে সুনেচি বলে মনে পড়চেনা, পুরো নামটা যদি দাদা বলেন...
আন্তোনিও গ্রামচি।
'আনতো নিয়ে ঘামাচি?'
লোকটা আমায় আকাট চাষা ছাড়া কিচুই ভাবলেনি। হেব্বি দামি পাঞ্জাবি পরেচে অতচ বিড়ি খেতে খেতে চলে গ্যালো
:(
এদের শিগারেট কেনার পয়সা থাকেনা?

আমার জিবে এসব উচ্চারন আসেনা। সেই ভানু বাঁড়ুজ্জ্যে কে তার ভাগ্নে ন্যাপলা বলেচিল না 'মামী হচ্চেন জোয়ান অব আর্ক'
ভানু বললেন জোয়ানের আরক?
ভাগ্নে যত শোধরায়, মামা কন 'আমার কানে দুইটা একই সুনায়'
আম্মো তাই।

হচ্চিল জেলের কতা, কি টেনে ফেল্লুম!
আমিও এট্টা বই লিকবো। সবাই লিকচে, ছাপাচ্চে। নাম ফাটচে।
আমার বই এর নাম হবে হাজতজীবন
মানে জেলে যাইনি কিনা। হাজত অব্দি দৌড়, তাও পাঁচ আইন কেশে। (পাঁচ আইন যারা বুজবেননা তাদের জন্যে পেটি কেস বলচি) রাস্তায় বাংলার পাউচের দর করচিলুম পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। শালা চুল্লুওয়ালা ছিল গাচ হারামি। বলচে ওর মালের দাম বেসি কারন খেয়ে পটকে যাওয়ার চান্সো আচে। আর পটকালেই দু লাক। ক্যাস!
ব্যাস।

ফ্যামিলি দু লাক পাবে এই ভেবে কেউ বেসি দামে চোলাই কেনে? কে বোজাবে?
তবে পুলিশ বাটাম দেয়নি। সুদু বলেচিল ভদ্দোলোক বলে তো মনে হচ্চে ক্যানো খান?
বললাম দু লাক পাওয়ার ধান্দায়। সাব ইনিস্পেক্টার টা খেঁকুরে বুড়ো। সে সালা এমন জবাব পাবে ভাবেনি। ষাঁড়ের বিচির মতো চোকের মনি নিয়ে তাকালো তাপ্পর সোজা হাজতে পাটালো। দেকলাম পলেস্তারা খসা দেওয়ালে কত্ত কি লেকা। 'মালতি আই লাব ইউ' নেতাজি ফিরে এসো, সিবদাস ঘোস জিন্দাবাদ, ওসির মা কে..., হাবিলদার সন্তোষের বোনকে.... ছ্যা ছ্যা। তবে একজন কবিতা লিকেচে। বেস ভাল।

দারোগার ভুরু
চামেলির উরু
দুটোই মোটা,
ভিকিরির পেট
গরাদের গেট
দুটোই ছোটা।

রমনীর মন
আর কালা ধোন
দুইই পাওয়া দায়,
ভুঁইয়া মানোস
মেনে গ্যালো পোষ
অধীর চ্যাঁচায়।

চাম্পি না? টুকে এনেচি তাই।
এসব পড়ে বুজলাম। জেলে গেলেই ক্যানো লেকা পায়। হাগা পাওয়ার মত লেকা পায়। দেশি আমাসার মত হড়হড়িয়ে নামে, কবিতা, গান। এই কদিনের পালদা আর বাঁড়ুজ্যেদা কি কিচু নামালো? বই হয়ে বেরুলে পরবো। তারপর আমিও লিকবো। হাজতজীবন।

জাতপাত ~ সুব্রত ঘোষ

আমরা সদগোপ। হিন্দু মতে শূদ্র। সৎ শূদ্র। গোয়ালা ঘোষ না, চাষা ঘোষ। এসসি ওবিসি নয়, জেনারেল। 'চাষা যে রাস্তায় হাঁটে দশ বছর সে রাস্তায় হনুমান হাঁটে না'- শুনে বড় হয়েছি। তারাশঙ্করের লেখায় পড়েছি, বামুন বাড়ির মেয়েরা বলছে খাবারগুলো ফেলিস না, সকালে সদগোপদের বাড়ির মেয়েদের দিয়ে দিস। ট্র্যাডিশনাল হিন্দু মতে ছোট জাত। গোটা গ্রামটাই সদগোপদের হওয়ায় জাতপাতের ভেদ আম্বেদকরের মত হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এমন নয়। তবে কিছুটা দেখেছি। বাগদী দুলে মুচি মাহাত পরামানিকরা পাশে থেকেও যে আমাদের চেয়ে নিচু জাতের এমন একটা ধারণা অবচেতনেই তৈরি হয়েছিল দেখে দেখে। কেননা ওরা উঠোন থেকে দুয়ারে ওঠে না, ঘর তো দুরস্থান। কাজ করার সময় ঢুকতে পারে ঘর মুছতে। বাসন মাজতে পারে। কিন্তু একাসনে খেতে পারে না। ওদের থালায় বা হাতে কোন জিনিস একটু উঁচু থেকে ছেড়ে দিতে হয়। খেঁদি বাগদীর বাড়ি আমাদের বাড়ির দশ হাত দূরে। সে ভিক্ষা করেই দিন কাটাত। মাঝে মাঝে দুপুরে খেয়েও যেত বাড়িতে। বয়স হয়েছিল। জল নিতে এলে মা কল পাম্প করে দিত। তখন আমাদের বাড়ির কাজের লোক বলতে ছিল জয়ন্তীদি। একদিন মা ঠাকুরঘরে ব্যস্ত, খেঁদিপিসি এল জল নিতে। তখন জয়ন্তীদি কল পাম্প করে দিতে গেলে সে বলল 'আমি জল নেব না দুলের হাতে।' কেননা দুলেরা নাকি বাগদিদের চেয়েও ছোট জাত। আমাকেই সেদিন কল পাম্প করে দিতে হয়েছিল। অনেক ছোটবেলায়, টু থ্রিতে পড়ি, একদিন ঘোষেদের বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে গেছি। একটা সারিতে বসেছি বন্ধুরা। টেনে তোলা হল আমাদের কয়েকজনকে। বাগদী সাঁওতালদের ছেলেরাই তখন আমার সহপাঠী। বামুন, সঞ্জয়, নিতাই, টিপু। ঐ সারিতে নাকি ব্রাহ্মণরা বসেছে কয়েকজন। বাচ্চা ছিলুম। বুঝিনি। দিব্বি অন্য সারিতে সবাইমিলে খেয়ে চলে এসেছি। বাবার ছোটবেলায় নিয়ম ছিল ভোজ বাড়িতে ব্রাহ্মণে রান্না করবে, ব্রাহ্মণে পরিবেশন করবে। ব্রাহ্মণরা খেতে বসে অনুমতি দিলে অন্যরা বসতে পেত। অনুমতি নিতে হত গ্রামের মোড়লের কাছ থেকে। এখন শুধু প্রথাটা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ে টিকে আছে। এক টেবিলে বসে বামুন বাগদী খাওয়াটা পরিচিত দৃশ্য। কেউ কাউকে উঠিয়ে দেয় না। তবে অনেকে লোক দেখেই বসে। মানে জাত দেখে। স্কুলে অঙ্গনয়ারিতে খাবে খাবে না করে অধিকাংশই খাচ্ছে। সময় অনেক বদলে গ্রামের পাশে রিলায়েন্সের ফোর জী টাওয়ার বসেছে মানে এই নয় যে আত্মীয় কুটুম্ব পাতাতে শুরু করেছে বামুনে বাগদীতে। তিন দশক আগে সদগোপ ও ব্রাহ্মণ পরিবারের এমন একটি প্রণয় ঘটিত বিয়ের পর গ্রাম ষোলোআনায় মিটিং ডেকে ভট্টাচার্য মশাইকে অনুরোধ করা হয়েছিল জামাইকে স্বীকার করে নিতে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। জাতের নামে আমরা আলাদা ছিলাম, আলাদাই আছি। সৎ শূদ্রদের মধ্যে কুমার, রায় প্রমুখরা সবচেয়ে উঁচু। কুলিন শূদ্র । এর পরে মিত্তির ঘোষ বোস। শিক্ষিত শূদ্র। কলমে কায়স্ত চিনি/ গোঁফেতে রাজপুত- প্রবাদ ছিল না! তাদের অনেকের পরে আমরা সদগোপরা। তারও পরে 'সানা পানা রাণা/তিন থাকতে মানা।' তারও পরে নাকি বাগদী দুলে ডোম মুচি মেথর ইত্যাদি ইত্যাদি। বামুনদের মধ্যেও ভেদ দেখেছি। পূজারী ব্রাহ্মণরা নাকি নিম্ন শ্রেণীর। অগ্রদানী ব্রাহ্মণরা আরও নিচু। পিণ্ড ভক্ষণ করে কিনা তারা। আরও ভেদ দেখতে চাইলে পাত্র পাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখুন আনন্দবাজারে। অনেককাল আগে একবার এই বিষয়ে এক তর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলুম চতুর্বর্ণ বিভাজন ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার ব্যাপারে হিন্দু হিসেবে গর্বিতরা ঠিক কি ভাবছে!! কোন উত্তর না দিয়ে এড়িয়ে গেছিলেন বিপক্ষের বন্ধু। এই প্রশ্ন আমার আজও। কোটি কোটি হিন্দু যারা প্রতিদিন জানে যে তারা ছোট জাত, তারা কেমন করে গর্বের সাথে বলবে তারা হিন্দু? সামাজিক ভেদ দূর না করে হিন্দু হিসেবে গর্ব বোধ করা এক ধরণের মুর্খামি। একজন ব্রাহ্মণ বলতেই পারেন তিনি হিন্দু হিসেবে গর্বিত। কারণ এই ব্যবস্থায় তিনিই সবচেয়ে বেশী উপকৃত। আমি বলতে পারি না। কারণ আমি এই ব্যবস্থার শিকার। 

মন্দির নিয়ে একটি নিরামিষ গল্প ~ পুরন্দর ভাট

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে পুরীর মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া নিয়ে ক্যাচাল বেধেছিল। সম্ভবত মিটেও গেছে। ইন্দিরা গান্ধীকে অতীতে এর আগে এই নিয়মের (বা বেনিয়ম) সম্মুখীন হতে হয়েছিল কারন তার বৈবাহিক সম্পর্ক পান্ডাদের পছন্দ হয়নি। স্বাভাবিক। খাপ পঞ্চায়েত আর কাজীর ক্যাঙারু কোর্টের দেশে তেনাদের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে হবে। এবসলিউট ক্ষমতার অধিকারিণী ভারতেশ্বরী পর্যন্ত পাত্তা পাননি তো, ছোটখাটো নেতা নেত্রী কোনসা ইয়ে, মানে কোউন ক্ষেত কি মুলি?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বা শ্রীমতী ইন্দিরার রাজনীতির চুড়ান্ত বিরোধী হলেও যেকোনো গণতান্ত্রিক মানুষ এই ধর্মীয় পাকামি ও জগদ্দল নিয়মের নিন্দা করবেন। (অবশ্য এক্ষেত্রে সত্যিই ঢুকতে দেওয়া হয়নি এমনটা নয়, একটু গোলযোগ বেধেছিল, সেটা বিরোধীরা গট আপ বলে সন্দেহও করছেন  ;) ) 
যুগ যুগান্ত ধরে এই নিয়ম চলে আসছে। ঈশ্বর রুষ্ট হবেন কিনা জানা নাই কারণ ঈশ্বর তো ঠুঁটো জগন্নাথ, আক্ষরিক অর্থেই ঠুঁটো। যেমত আল্লাতালাও। তার নিজস্ব ক্ষমতা বলে কিস্যু করবার নাই। পান্ডা মৌলবীদের জন্যে স্বর্গে বসেই তিনি টেন্ডার ডাকেন। এবং বানী দেন এই এই করিতে হইবে। এক পা পিছিয়ে দুই পা আগাইবে, ইত্যাদি। এই মসজিদে কাফের যেতে পারবেনা, সেই চার্চে ঋতুমতী মেয়েরা ঢুকতে পারবেনা, ওই মন্দিরে অন্তজ শুদ্রের প্রবেশ নাই.... ইথার তরঙ্গ বাহিত হয়ে ধর্মগুরুদের কানে বাণী আসে। প্রভু আলো দেখিয়েছেন। প্রয়োজন হলেই তিনি দেন। শুধু টাওয়ার টা আসা চাই। ধর্মগুরুরা দরকার হলেই তাকে টেনে নামান। ডেকে পাঠান। মহম্মদ তো প্রায়ই ডাকতেন। ;)

ঈশ্বর যে ঠুঁঠোই নয় স্রেফ ধ্বজভঙ্গও তা প্রমান করে দিয়েছিলেন কালাপাহাড় স্বয়ং। একধার থেকে পাণ্ডা, পুরোহিতদের কেলিয়েছেন, মন্দির পেলেই হাতুড়ি চালিয়েছেন। হিন্দু মন্দির ভাঙার পেছনে অবশ্য মহান আদর্শ বা লুঠের উদ্দেশ্য ছিলনা (তার সাকরেদরা যথেচ্ছ লুটমার করেছেন)। তিনি এসেছিলেন তীব্র প্রতিশোধস্পৃহায়। কালাপাহাড় যে উচ্চ ব্রাহ্মন ঘরের শিক্ষিত সন্তান ছিলেন ঐতিহাসিক সত্য। সুতরাং ওই বাবর, ঔরংজেবের মতো এক গোত্রে ফেলাও যাচ্ছেনা। :) সেদিন পুরীর পান্ডাদের কি হাল হয়েছিল ইতিহাস সাক্ষী। জগন্নাথের ঠিকাদারেরা মাথায় টুপি পরে, চোগা চাপকান বোরখা পরে, কেউ কেউ হয়ত নুনু কাটিয়ে জান বাঁচিয়েছিল। ধম্মো ফম্মো মাথায় থাক।
বলি, উপাচার, ধুপ, দীপারতি রসাতলে বিসর্জন দিলেও দেবতার ঘুম ভাঙেনি। ভগবান প্রাতঃকৃত্যর টাইমটুকু পাননি। ঝেড়ে দৌড় দিয়েছিলেন।

সকলেই জানেন নিয়ম কানুন কারা বানায়। অলঙ্ঘ নিয়মকেও কলা দেখিয়ে দেন কালাপাহাড়রা। শুধু বুকের পাটা থাকা চাই। ধর্মদ্রোহ মানে গোমাংস বা শুকরমাংস ভক্ষন নয়। আমার কতিপয় বন্ধু অভিযোগ করেন আমি অতীতচারী। কিছু বলতে গেলেই উদাহরণ হিসেবে অতীতে, কবেকার কোন আমলে কি ঘটেছিল টেনে আনি। সেই অভিযোগ ঘাড়ে নিয়ে একটা গল্প বলা যাক। বন্ধুরা একটু ধৈর্য ধরে পড়বেন। মন্দিরে প্রবেশের গল্প। গল্প নয়, বাস্তব ঘটনা।

১৯৪৩ এর শেষার্ধ, আজাদ হিন্দ ফৌজের সদর দপ্তরে বসে নেতাজী কাজ করছেন। দিবারাত্রি পরিশ্রমের ফাঁকে বাইরের কারো সাথে দেখা করার সুযোগ থাকেনা।
এমনি এক দিনে ব্রিজলাল জয়সওয়াল এলেন দেখা করতে তাঁর সাথে। ব্রিজলাল সিঙাপুরের ধনিক ও বনিকশ্রেষ্ঠ। তিনপুরুষ ধরে বর্মা মুলুকে ব্যবসা। আদতে তারা গুজরাটি চেট্টিয়ার ব্রাহ্মণ।
বৃদ্ধ ব্যবসায়ী এসেছেন ফৌজি অর্ডার সাপ্লাইয়ের কথা বলতে। নেতাজী তার কাছে সবিনয়ে একটি আর্জি রাখেন তা হলো অনুদানের। আজাদ হিন্দ ফৌজের ফান্ডে একজন প্রবাসী ভারতীয় হিসেবে এটুকু কি তিনি করবেননা? ব্রিজলাল জানালেন নিশ্চই দান করবেন তিনি। ঠিক তিনি নন, খ্যাতনামা চেট্টিয়ার মন্দির পরিষদই তা দেবে। দেশের স্বাধীনতার জন্যে বুকের রক্ত দিয়ে যারা লড়ছে তাদের এটুকু প্রাপ্য। কিন্তু তিনি চান নেতাজীর জনপ্রিয়তা কে মূলধন করতে। সিংগাপুর প্রবাসী হাজার হাজার ভারতীয়দের চোখে বীর সুভাষচন্দ্র বসু যদি তার মন্দিরে বা ব্যবসাক্ষেত্রে পদধুলি দেন তাহলে.....
নেতাজী বেঁকে বসলেন 'আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক হিসেবে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মন্দিরে যাওয়া তার শোভা পায়না' সুভাষ বোস আর নেতাজি এক ব্যক্তি নন।
ধনকুবের ব্রিজলাল চান তিনি ফৌজি পোষাকেই আসুন, নেতাজীর বেশে, তিনি টাকাটা সর্বসমক্ষে মন্দির চত্বরে দিয়ে দেবেন। আরো চমৎকার হবে নাকি বিষয়টা?
নেতাজী শর্ত রাখলেন তিনি যাবেন তবে সংগে থাকবে শিখ, মুসলিম, খৃষ্টান সহযোদ্ধারা। সবাই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সৈনিক। এই একটা জায়গায় সকলেই এক।
ব্রিজলাল চুড়ান্ত অসম্মতি দিয়ে জানান দুশো বছরের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যময় চেট্টিয়ার মন্দিরে বিধর্মী কেউ পা রাখেনি! এ সম্ভব নয়। হিন্দু ছাড়া ফটকের ভেতরে কেউ যেতে পারেনা, ব্রাহ্মন ছাড়া ভেতরে গিয়ে দেবদর্শন বারণ, আর পুরোহিত ছাড়া কেউ গর্ভগৃহে প্রবেশ করেনি এযাবৎ!
নেতাজী পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, তাহলে মন্দির কমিটির সাথে ভাল করে আলোচনা করে আসুন ব্রিজলালজি। (১৯৪৩ সালে ব্রিজলাল দান করতে এসেছিলেন সাত লক্ষ টাকা! এখনকার হিসেবে কত হতে পারে?)

পরের দিন ফিরে এলেন ব্রিজলাল। সংগে আরো কয়েকজন কর্মকর্তা। তারা রাজী হয়েছেন! নিমন্ত্রণ করতে এসেছেন নেতাজীকে। সাথে বাকি সহযোদ্ধা দেরও।

দুশো বছরের সংস্কারকে ছিন্ন করে সিংগাপুর চেট্টিয়ার মন্দির সেদিন খুলে গেল বিধর্মীদের জন্যে!
সিঁড়ির পাশে সুভাষ চন্দ্র বোস খুলে রাখলেন তার মিলিটারি বুট, পাশাপাশি নিষ্ঠাবান খৃষ্টান আইয়ার, ধার্মিক মুসলিম জামান কিয়ানী আর হাবিবুর রহমান।
সুভাষচন্দ্র বোস একজন কালাপাহাড়। জগদ্দল পাষাণ কে আঙুলের টোকায় ঝেড়ে ফেলে দেওয়ার হিম্মৎ দেখিয়েছিলেন পরাধীন, ধর্মনিগড়ে বাঁধা সংস্কারাছন্ন সমাজে।

(কৃষ্ণমাচারী ভাস্করণ, নেতাজীর স্টেনোগ্রাফারের বয়ানে)

চৈতন্যদেবের লাশ হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে পুরীর মন্দিরের আসেপাশেই।
অসংখ্য দেবদাসীদের কান্না, ঘাম, রক্ত মিশে আছে পাথুরে দেওয়ালে গাঁথনিতে।
এমন মন্দিরে ঢুকে পূণ্য?

বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৭

হারাধনীর সংসার ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী



হারাধনীর তেরোটা ভাই হাতিয়েছিল টাকা 
সবার চিত্র ফুটেজ করে রেখেছে হুল কাকা। 

টাকা দারুণ মুখরোচক, এবং উপাদেয়
কাজে কাজেই…  দেশের জন্য…  দু'হাত মেলে চেয়ো। 

হাপুসহুপুস গিলবি টাকা, ভরিয়ে ফেলে অন্ত্র।   
বদহজমটি ঘটলে রটাস… এ'সব ষড়যন্ত্র। 

দেশের সেবা? সবাই জানে ওইটি উপলক্ষ্য। 
অর্থ উপার্জনেই লেখা রাজনৈতিক মোক্ষ। 

পড়লে ধরা করবি প্রচার…  ভিডিও সব জাল 
যদ্দিন না কাবার্ড থেকে বেরোচ্ছে কঙ্কাল। 

এবং তখন পাল্টাবি সুর… সবাই নাকি জানত 
উৎকোচ নয়, এ'সব টাকাই নিছক অনুদান তো। 

কে নেই সামিল? মন্ত্রী-সান্ত্রী। মহামহিম নেতাও।  
হারাধনীর আদেশ ছিল দলকে ভোটে জেতাও। 

কেউ গিলেছেন টাওয়েল মুড়ে প্রাতরাশের বেলায় 
বন্দরে এক হাঙর খাচ্ছে দারুণ অবহেলায়। 

ফিজিক্স-টিচার গিলছে টাকা।  মুখে কি? লজ্জাই।   
বেজায় কেতার একটি নেতার ও'সব বালাই নাই। 

ভীতুর চিন্তা… বিষবৃক্ষের ফলটি এ'বার ফলবে। 
আশায় থাকে, মিছিল করে দল যা' বলার বলবে। 

তাদের সাফাই দল জানে সব। আমরা নিছক সভ্য। 
অন্যে বলে কোর্ট কাছারি… করব না মন্তব্য। 

অপরূপ এক মিচকে চেঁচায়… ভুল করেছিস অঙ্কে 
ভুললি কেন করিতকর্মা দুই দু'খানা বোনকে? 

একখানি ভাই আমলা-কোটাল, বিশাল নাকি মাইনে, 
হাই তুলে কয়, ঘুষ পেলে আর অন্য কিছুই চাইনে। 

নাচিয়ে ভুরু এক ভাই কয় ব্যাপার ভারি আইনি। 
সেটিং হলেই প্রমাণ হবে, আমরা কিছু খাইনি।  

নারদ নারদ… সামনে গারদ। হারাধনীর চিন্তা … 
সংখ্যাটা ওই তেরোই…  নাকি বাড়বে পরের দিন তা?

সেটিং বাসনা ~ অরুনাচল দত্ত চৌধুরী



আকাশ মেঘলা, মন বিষণ্ণ,
দামাল ভাইরা তোদেরই জন্য।
চির পবিত্র চৌর্যকার্য।
ইথে ক্যামেরাটি ছিল কি ধার্য? 
আমি ক্ষীর খাই নিট পরিপাটি
ভাই তোরা শুধু চেটেছিস বাটি।
কবি কল্পনা দিয়েছি উস্কে
অনুদান বলি সমূহ ঘুষকে।
সেই তোদেরকে এত হেনস্থা
দেশে আইন নেই? এতই সস্তা?

যে যাই বলুক আনিনি গ্রাহ্যে
পুকুরচুরির এ সাম্রাজ্যে
টেটএ ফেটে যাওয়া পেছন-রত্নে
সততার ক্রীম লাগাই যত্নে।
কাটছি পকেট লুটছি ফায়দা
টেরটি পাবে না, এমন কায়দা।
চাল-সাইকেলে নানা বিভঙ্গে
ভোট মস্করা খেলছি রঙ্গে।
চুরির অর্থে ভরেছে ভাণ্ড
রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড  ! 

এরই মাঝে ছায়া। ভারি বিপত্তি।
এফআইআর? দাদা পারিসও সত্যি!
হুকুমটি দিলে দাদা নরেন্দ্র,
নাকে খত, বাদ রাজ্য কেন্দ্র।
মেরুকরণের তুমুল অঙ্কে
কাঁপাবো বাংলা নয়া আতঙ্কে।
অ্যাপেলো কুঠিতে সে কী যে কান্না
প্রাণ কেঁপে গেছে। আর না! আর না!
গোয়াল ভর্তি ভাইএর জন্য
সেটিং করব… হোক জঘন্য।

শেষ সেটিংটি হবে অনন্য…
মেঘবালিকার নিজেরই জন্য।

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৭

চ্যাপলিন ~ আশুতোষ ভট্টাচার্য্য

সেলুলয়েড পর্দা জুড়ে
একটা মানুষ খেলার ছলে
আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে
দিনবদলের গল্প বলে।।

মুখে কিছুই বলছে না সে
নীরবতাই মুখের ভাষা
একাই তিনি যুদ্ধ লড়েন
হাজার মানুষ, রঙিন আশা।।

ভাল মানুষ, মন্দ মানুষ
রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে
পথের মানুষ পথেই থাকে
হাজার হাজার বছর ধরে।।

তবুও তিনিই স্বপ্ন দেখান
চেনা টুপি,গোঁফ আর স্টিকে
পথ দেখাবেন অন্ধকারে
পূবের আকাশ হচ্ছে ফিকে।।

চার্লস চ্যাপলিন ( ১৬ই এপ্রিল ১৮৮৯- ২৫ ডিসেম্বর ১৯৭৭)

বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৭

রামনবমী , মহরম ও সেকুলারিজম ~ শ্যামাপ্রসাদ কুণ্ডু

আমার কিছু বন্ধু অনুযোগের সুরে আমাকে বলেছেন কেন আমি রামনবমীতে অস্ত্রহাতে মিছিলের নিন্দা করে কিছু লিখছি না। তারা সেকুলারিজম নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এ প্রশ্নও তুলেছেন যে মহরমের মিছিলে অস্ত্রহাতে যে উল্লাস দেখা যায় আমি তা সমর্থন করি কিনা। সন্দেহ নেই এসব প্রশ্ন সঙ্গত। আমি এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানি এমন দাবী করি না। জানিনা বলাই সঙ্গত। এইসব প্রশ্নের গভীরে ঢোকার আগে একটা সমীকরণের ব্যাপার বুঝে নেওয়া যাক। এক বন্ধুর বক্তব্যঃ মহরমে যদি অস্ত্র ব্যবহার সঙ্গত হয় তাহলে রামনবমীতে অস্ত্রহাতে মিছিল শোভাযাত্রা সঙ্গত কাজ। আপাত দৃষ্টিতে এই আংকিক যুক্তি অকাট্য। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল। কার কাছে শুনেছিলাম মনে নেই। গল্পটা এইরকমঃ এক ভদ্রলোক রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাজারে যাচ্ছিলেন।স্কুলের কাছাকাছি এসে তিনি একটি চেনা ছেলেকে দেখতে পেলেন। মনে পড়ল সেদিন বার্ষিক ফল বেরোনোর কথা। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন ,’ হ্যাঁরে গনশা, আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে?’ সে কথার উত্তর না দিয়ে গনশা বলল,’ তোমাদের প্যালাও ফেল।‘ বল্বাহুল্য গনশা পরীক্ষায় পাশ করে নি কিন্তু প্যালাও ফেল হওয়াতে তার দুঃখ খানিক কমেছে।‘ এই ধরণের যুক্তি আমি খুব ভয় পাই। সেজন্য এসব বিষয়ে লিখতে সাহস করি না। আমরা খুশি হতাম প্যালা ও গনশা দুজনেই ভাল করে পড়াশোনা করে পাশ করলে।

গনশা ও প্যালাদের সংখ্যাধিক্যের দেশে খোলামনে আলোচনা করার বিপদ পদে পদে। একটা যুতসই নঙর্থক বিশেষণে দেগে দেবে গনশারা। এ বিপদ তো আছেই সারাজীবন মাথার উপর ঝুলে ডেমোক্লিশের তলোয়ারের মত। তবুও কথার ডালপালা গজাক। ভাই নিখিল চক্রবর্তী সেক্যুলারিজমের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছে। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় সেক্যুলার কথাটা সংযোজিত করা আছে। এর প্রকৃত অর্থ কি এবং বাসবে কিভাবে এই নীতি পালিত হয় সে আলোচনায় পরের পর্বে আসব। আপাতত রামনবমী সবিনয়ে দুচারটি কথা বলতে চাই। আমার ভুল হলে সহৃদয় পাঠক/পাঠিকা সংশোধন করে দেবেন। কোনো এক চৈত্রমাসে নবমী তিথিতে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রামচন্দ্র ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন। সে অনেক শতাব্দী আগেকার ধূসর অতীতের কথা। তিনি স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার আর অবতারের জন্মবৃত্তান্ত রহস্যাবৃত হওয়াটাই স্বাভাবিক। মহারাজা দশরথের সন্তান কামনা পূর্ণ হচ্ছিল না। তাই ঋষির নির্দেশে তিনি যজ্ঞ করেন। এর পরের কাহিনী এই রামায়ন-মহাভারতের দেশের সকলেই জানেন।খুব স্বাভাবিক কারণেই সেই সময়ে প্রজারা খুশিতে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলেন। তারপর গঙ্গাযমুনা দিয়ে কত যে জলস্রোত প্রবাহিত হয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নেই কিন্তু প্রজন্মান্তরের মানুষের মনে রামসীতার কাহিনী পল্লবিত ও জীবন্ত রয়ে গেছে। আজও বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশ গড়, ঝারখন্ড এবং খোদ দিল্লীতে রামনবমী পালিত হয় আনন্দ, উল্লাশ ও নৃত্যগীতের সমারোহের মাধ্যমে। বাড়িতে বাড়িতে নানারকমের মিস্টান্ন তৈরি হয়, ভিয়েন বসে, অতিথির সমাগম হয়’ শোভাজাত্রা বার করা হয়, মেলা বসে গ্রামে গ্রামান্তরে। নতুন জামাকাপড় পরে বাচ্চারা আনন্দে মেতে ওঠে। রামের প্রশংসায় গীত রচনা হয়, গাওয়া হয় মহল্লায় মহল্লায়, গ্রামে গ্রামে। রামনবমী আসলে বিশ্বাসীদের কাছে এক অনন্ত খুশির উৎসব। বাঙালী হিন্দু ঐতিহ্যপরম্পরায় মাতৃপূজক। শক্তির উপাসক। চৈতন্য প্রভাবে ভক্তিরসে আপ্লুত হয়েছে কখনো। কিন্তু বাঙালী হিন্দু রামভক্ত নয় সেভাবে কোনোদিন। আমরা শিবের গাজন গাই ধান ভানতে, লাঠি খেলাও হয় কোথাও কোথাও কিন্তু রামভক্ত বলে বাঙ্গালীকে চিহ্নিত করা যাবে না। এ প্রসঙ্গ থাক। বলার কথা এই যে রামনবমী-র সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মিছিল শোভাযাত্রা একেবারেই বে-মানান। ধর্মীয় আস্থা ও বিশ্বাসের ‘রাজনীতিকরণ’ ঘটলে তবেই এমন বিসদৃশ ব্যাপার ঘটতে পারে। এটা রাজনীতি-আরোপিত অস্মিতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া কিছুই নয়। বিপ্রতীপে মহরম একটি অতীব শোকাবহ ঘটনার বেদনার্ত স্মৃতি। শিয়া সম্প্রদায়ের নিষ্ঠাবান বিশ্বাসী মানুষেরা শোক পালন করেন নিজেকে কষ্ট দিয়ে। শোক পালনের সঙ্গেও অস্ত্র প্রদর্শন ও আস্ফালনের কোনো অরগানিক বা আবেগী সম্পর্ক নেই। এখন তো দেখতে পাই অনেকে মহরম পালন করেন ব্যন্ডপার্টী বাজিয়ে তুমুল উল্লাসের সঙ্গে। প্রকৃত ধর্মবিশ্বাসীদের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু আমি বললেই বা কি হবে। কেউ কি শুনবেন বা ভাববেন? আমাদের হয়ে ভাবার ভাবনাটা যখন ধর্ম ব্যবসায়ী ও রাজনীতি ব্যবসায়ীদের হাতে আমরা স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, ভয়ে বা সম্ভ্রমে ছেড়ে দিই তখন এমনি হয়ে থাকে।

মহরম মাসটি শান্তির মাস হিসাবে চিহ্নিত। অনেকগুলি কথা বলার আছে কিন্তু আমি সে তথ্যের মধ্যে যাব না দুটো কারণে।প্রথমত আমি সব তথ্য জানি না। আবেগ তথ্য নির্ভর নয়। মানুষের ধর্মবিশ্বাস এবং আবেগ এমন এক দুর্জ্ঞেয় মানসভূমির উপর স্থিত যে যুক্তি সেখানে আঁচড় কাটতে পারে না। অনেকের সঙ্গে অনেকদুর পর্যন্ত কথা বলার পর এইরকম উত্তর শুনিঃ ‘ আপনি যা বলছেন তা ঠিক কথা কিন্তু আমি বিশ্বাস করি...’। খুব অসহায় লাগে তখন। এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত ও সজ্জন মানুষদেরও এইরকম কথা বলতে শুনি। আংটি পরা , মাদুলি বাবাদুলি বা ঠাকুমাদুলি পরা বা পৈতে প্রথার সমর্থকদের সঙ্গে যুক্তি তর্ক করে দেখেছি শেষ পর্যন্ত তারা বিশ্বাসের নীরেট পাঁচিল তুলে ‘ নো এন্ট্রি ‘ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছেন। খুব অসহায় বোধ করি। কপালে কতবার যে ঠোকা খেয়েছি তার ইয়ত্তা নাই। তরুণ তরুণী থেকে সব বয়সী বিশ্বাসীদের কাছ থেকেই একই রকম সমাদর(!) পেয়েছি। থেমে গেছি বন্ধুত্ব বজায় রাখার খাতিরে। এরা বেশিরভাগই ভাল মনের মানুষ। আমার দ্বিতীয় কারণ হল আমি একটি হিন্দু পরিবারে জন্মেছি। আমি ধর্ম বিশ্বাসী কিনা সে প্রশ্ন কেউ করে না। এটা আমার নির্বাচন নয় কিন্তু আমার এক ধরণের ID. ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কিছু বলতে গেলেই একটা সমস্যা এসে পথ আগলে দাঁড়ায়। আবার সেই NO ENTRY বোর্ড ঝোলানো। ‘বলি, তুমি কে হে আমাদের ধর্ম নিয়ে কথা বলার? কোরান হাদিস পড়েছো?’ যদি বলি পড়েছি প্রশ্ন আসেঃ ‘আরবিতে পড়েছো?’ না। আরবি জানি না। তাহলে চুপ করে থাকো। চুপ করে থাকি। আমি তো সংস্কৃতও জানি না এবং বেদ, গীতা, পুরান, উপনিষদ কিছুই সংস্কৃতে পড়ি নি। যারা রামনবমীতে অস্ত্র নিয়ে মিছিল করার উস্কানিদাতা এবং মহরমে ঢাল তলোয়াল নিয়ে মিছিলের ফতোয়া দেন তারা সব পড়েছেন তো? বুঝেছেন তো? মুস্কিল খুব। এই প্রশ্ন করার অপরাধে আমাকে বিপদে পড়তে হতে পারে। কিন্তু প্যালা এবং গনশাদের কাছে প্রশ্নটাও তো করতে হবে। না হলে ওদের কি হবে? ফেলুদা হয়েই তো থাকতে হবে, তাই না? ঈশ্বর আল্লাহ বা গড-কে ঢাল এবং তলোয়ার হিসাবে ব্যবহার করলে আমার মত নীরেট বুদ্ধির মানুষ খুব মুস্কিলে পড়ে যায়।
 সেকুলারিজমের কথায় আসা যাক। শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ সুন্দর একটা কথা বলেছিলেনঃ যত মত তত পথ। আমি এই কথাটাই এখনকার প্রেক্ষিতে একটু প্যারাফ্রেজ করে ব্যবহার করার অনুমতি চেয়ে নিচ্ছি। এদেশেঃ যত দল তত রকম সেকুলারিজম। অন্যভাবেঃ যত বুদ্ধিমান মানুষ ততরকমের সেক্যুলার। সমস্যাটা একাধারে সেমান্টিক ও পেডাগজিক্যাল। পাঠক/পাঠিকাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি কারণ এই দুটি শব্দের আভিধানিক বাংলা প্রতিশব্দ আরো বেশি খটমট। কেন বলছি এই কথা সেটা বলি। আমাদের সংবিধানে SECULAR শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ধর্ম-নিরপেক্ষ অর্থে। কি অর্থ ধর্ম-নিরপেক্ষতার? রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না অর্থাৎ রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব বা আনুগত্য দেখাবে না। ভাল কথা। সমস্যা এখানেও নয়। রাষ্ট্র তো একটি বিমূর্ত ধারণা। রাষ্ট্রের ইচ্ছা বা WILL ব্যক্ত ও প্রযুক্ত হয় বা প্রতিপালিত হয় সরকারের আইনকানুন ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে। যাকে পরিভাষায় বলা হয় Governance বা State craft. বুঝতেই পারছেন ,সহৃদয় পাঠকপাঠিকা, সেমান্টিক ও পেডাগজিতে জড়িয়ে পড়ছে যুক্তি। কিন্তু এর সহজ ব্যাখ্যা দেবার ভাষা আমার জানা নেই। চেষ্টা করা যাক। এই সাংবিধানিক অর্থে আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি সবাই ‘সেক্যুলার’। আমি কেন্দ্রীয় ও রাজ্যস্তরের সব দলগুলিকেই এই বৃত্তের মধ্যে ধরে নিচ্ছি। টেকনিক্যালি সবকটি দল( ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীগুলি বাদ দিয়ে ) সেক্যুলার বা আমাদের ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষ। বি জে পি দলের সংবিধান খুলে দেখুন। মজাটা এবং সমস্যার জড়ও এইখানে। একটি শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমেই অর্থপ্রাপ্ত হয়। এমনকি অভিধানেও একাধিক অর্থ দেওয়া থাকে। আমার এক ইংরাজী শিক্ষক বন্ধু দেবনাথ মৈত্রের সঙ্গে আজ প্রথম দুপুরে টেলিফোনে কথা হচ্ছিল BECAUSE শব্দটি Conjunction, adverb না preposition. ও কথা থাক। আমাদের প্যালা আর ওদের গনশা-র কাছে ‘সেক্যুলারিজম’ কথা বা অবধারণাটির মানে কি সেটা জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীরের ‘আজাদি’র সমর্থকদের সমর্থন করা সেক্যুলারিজম, তিনতালাকের বিরোধিতা করা ‘সেক্যুলারিজম’ নয় বা সকলের জন্য একই দেওয়ানী ও ব্যক্তিগত আইন প্রবর্তনের দাবী করা ‘সেক্যুলারিজম’ ইমাম ভাতা চালু করলে পুরোহিত ভাতাও দিতে হবে এই দাবী সেক্যুলার দাবী ইত্যাদি নানারকম প্রশ্ন উঠে আসে সামনে। এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে হবে নিরাবেগ সদর্থক যুক্তির মাধ্যমে। আইনের মধ্যে যদি কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের প্রতি পক্ষপাত্মুলক কিছু থাকে সে আইন বদল করতে হবে। গীতা, মনুসমহিতা বা শরীয়তের প্রভাবে যদি রাষ্ট্রীয় আইন ও বিচার ব্যবস্থা পরিচালিত হয় সেই রাষ্ট্রকে প্রকৃত ‘সেক্যুলার’ রাষ্ট্রের আখ্যা দেওয়া যায় না। আমার তাই মনে হয়েছে আমাদের রাষ্ট্র সর্বধর্ম সমণ্বয়কারী রাষ্ট্র –প্রকৃত প্রস্তাবে সেক্যুলার নয়। ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ভাল লাগছে এই জেনে যে কিছু বন্ধু পড়ছেন কষ্ট করে এবং তাদের মতামত ব্যক্ত করছেন। এই বক্তব্যগুলি আমার কাছে খুব মুল্যবান। আমিও শিখছি। এটা অতি বিনয় নয়। এত কিছু জানার বোঝার আছে যে সবসময় তা নজরে পড়ে না। আন্তরিক ধন্যবাদ সকলকে।

আশঙ্কা করেছিলাম শব্দের ডালপালা বেরোবে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রসঙ্গে আসা যাক। আমাদের সংবিধানে secular শব্দটি সংযুক্ত করা হয় সংবিধানের ৪২ তম সংশোধনীর মাধ্যমে। তার মানে এই নয় যে তার আগে আমাদের রাষ্ট্র সেক্যুলার ছিল না।১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ বিভাগ ঘটে।সে রক্তাক্ত ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন বেদনা এখনো আমাদের সামূহিক চেতনায় বহমান। খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় সেই অস্থির টালমাটাল সময়ে ভারত রাষ্ট্রকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা যেত। হয়তো সেই সময়কার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সামূহিক আবেগের কাছে তা গ্রহণযোগ্যতাও লাভ করতো। কিন্তু আমাদের পরম সৌভাগ্য যে আমাদের সেই সময়কার জাতীয় নেতারা আজকের মত ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন না। তাই তারা সংবিধানের প্রস্তাবনায় লিপিবদ্ধ না করেও মৌলিক অধিকার নির্দেশাত্মক নীতিমালার মাধ্যমে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের রাষ্ট্র থিওক্রাটিক নয় সেক্যুলার অর্থাৎ রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের পালন পোষণ করবে নাঃ সকল ধর্মাবলম্বী মানুষকে রাষ্ট্র সমান মর্যাদার সঙ্গে দেখবে। ছাড়াও আমার মতে যে কথাটি সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তা হল এই যে ধর্মবিশ্বাস পালন , অনুসরণ ইত্যাদি ব্যাপার একান্তই নাগরিকদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কেউ যদি এথেয়িস্ট বা নিরীশ্বরবাদী অথবা সংশয়বাদী , একেশ্বরবাদী বা দ্বৈতবাদী , অদ্বৈতবাদী বা বহুত্ববাদী হন সে তার একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাপার। স্বামী বিবেকানন্দ মায়াবতীতে অদ্বৈত আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শেষের দিকে। না, এখানে আমি অন্য কোন ব্যক্তি নাম উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করবো না। বিপদ আছে খুব। ভক্তদের আমি খুব ভয় পাই। 

আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে।হিন্দু ধর্মশব্দ বা শব্দযুগল আমরা সচরাচর ব্যবহার করি বটে কিন্তু এটি কোনো কোডিফাইড ধর্ম হিসাবে গণ্য হয় না। মাঝে মাঝেই কিছু পরিমাণে হলেও হিন্ধু ধর্মকে কোডিফাই করার চেস্টা হয় নি এমন নয়। কিন্তু বৃহত্তর হিন্দু জীবনবোধ দ্বারা প্রভাবিত মানবগোষ্ঠীর কাছে তা গ্রাহ্য হয় নি। বিবেকানন্দ সহ অনেক এটি বর্ণনা করেছেন একটি জীবন দর্শন বা way of life. রূপে। অন্যান্য সেমেটিক অরগানাইজড ধর্মের মত এই হিন্দু ধর্মের একটিমাত্র সর্বজনমান্য ধর্মগ্রন্থ, একজন প্রফেট বা একজন মাত্র ঈশ্বর একটিমাত্র উপাসনালয় স্বীকৃত নয়। সুতরাং হিন্দুধর্ম রাষ্ট্রধর্ম রূপে গৃহীত হলে এদেশের ধর্ম সংকট আরো বেড়ে যেত। হিন্দু জীবন দর্শনের বৃহত্তর পরিধির মধ্যে একটা সামগ্রিক একাত্মকরণের প্রচেষ্টা যুগ পরম্পরায় চলে আসছে। বিরোধ হয়েছে, সংঘর্ষও হয়েছে আবার সমণ্বয়ের সাধনাও পাশাপাশি সমান্তরাল ভাবে চলেছে। মাঝে মাঝে কোডিফিকেশনের চেষ্টাও হয়েছে তবে সেটা গায়ের জোরে বা রাস্ট্রশক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নয়। কেন আমাদের রাস্ট্রনেতারা সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাটিকে বেছে নিয়েছেন সেটা বোঝার জন্যই এই কথাগুলি বলা। হিন্দুধর্মের তাত্বিক বা আধ্যাত্মিক ভিত্তিভূমি ব্যাখ্যা করার মত জ্ঞানবুদ্ধি আমার নেই। এখানে জন্মান্তরবাদ, জাতিভেদপ্রথা ইত্যাদি প্রসঙ্গ আমি তুলব না। এসব বিতর্কিত বিষয়ের অবতারণা এই আলোচনার পরিধির বাইরে। 
 
হিন্ধুধর্ম সেমিটিক রিলিজিওন থেকে চারিত্রে সম্পূর্ণ আলাদা। হিন্দুরা আত্মার পবিত্রতা (divinity of the soul)- বিশ্বাসী। হিন্দুর বিশ্ব দর্শন সেমিটিক রিলিজিওন-এর বিশ্ব দর্শন থেকে একেবারেই পৃথক। একজন প্রকৃত হিন্দুর কাছে কেউ অচ্ছুৎ নয়। বিশ্বের সকলেই তার নিকট আত্মীয় এবং অতিথিকে সে দেবতার মর্যাদা প্রদান করে। এমনকি দেবদেবীরাও হিন্দু জীবন দর্শনে বিশ্বাসীদের কাছে আত্মীয়- একেবারেঘরের মানুষ এতোটাই ঘরের মানুষ যে তাদের নিয়ে দিব্যি ঠাট্টাতামাশাও করা যায়। সেমিটিক রিলিজিওনে এমনটা কল্পনাও করা যায় না। 

প্রসঙ্গত দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথেরভারততীর্থকবিতাটির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।হে মোর চিত্ত পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে এইমহামানবের সাগরতীরেমিলিত হয়েছে পৃথিবীর সকল ধর্ম, জাতি, মত পথের মানুষ। মহাকবির ভাষায় ,’হেথায় আর্য হেথায় অনার্য হেথায় দ্রাবিড় চীন/ শক হুন দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীনহেথায় সবায় হবে মিলিবারে আনত শিরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে
রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের আত্মার স্বরূপ যথার্থ চিনেছিলেন। যেমন চিনেছিলেন ভারত-পথিক রাজা রামমোহন রায়, ভারতীয় নবজাগরণের প্রধান পুরোহিত বলে যাকে আমরা সশ্রদ্ধায় স্মরণ করি। এরা দুজনেই ব্রাহ্ম ছিলেন। কিন্তু ভারতাত্মার স্বরূপ চিনতে ভুল করেন নি এঁরা।ভারততীর্থকবিতায় রবীন্দ্রনাথ উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন এইভাবে-‘মা- অভিষেকে এস এস ত্বরা মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা/ সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থ নীরে/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে। 

দুঃখের বিষয় মঙ্গলঘট এখনো ভরা হয় নি। আর কখনো হবে কিনা আমরা জানি না। ঢাল তলোয়ার আর লাঠি বন্দুক নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেমঙ্গলঘটভরা হবে না। 
যে সমস্যকে কেন্দ্রে রেখে এই আলোচনা শুরু করেছিলাম তাহল রামনবমী, মহরম ও সেকুলারিজম। অস্ত্রহাতে রামনবমীর মিছিল এবং অস্ত্রহাতে মহরমের মিছিল একদিকে চলতে থাকুক আর অন্যদিকে রাষ্ট্র সেকুলারিজম প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট থাকুক তাহলেই একটা সমাধানের পথ আমরা খুঁজে পাব- এটা নেহাতই অতিসরলীক্রিত ধারণা। সেমিনারে সিম্পোসিয়ামে আলোচিত ও হাতালিত হতে পারে কিন্তু বাস্তবোচিত নয়। কেন নয় সেটা বুঝতে গেলে ইসলাম ধর্মের মুল কয়েকটি কথা বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। পবিত্র কোরআন আল্লাহর পবিত্র বাণী ও নির্দেশ। মুসলিম মাত্রেই এই বিশ্বাসে অনড়। হাদিস বা হাদীথ আল্লাহর শেষ নবী হযরত মহম্মদের জীবনাচরণ ও উপদেশাবলীর সংকলন এবং শারিয়া বা শারীয়ত ইসলামিক আইন যা কোরানের নির্দেশ ও শিক্ষা অনুসারে রচিত। একজন বিশ্বাসী মুসলমানের জীবন এই তিনটি মূল আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এখানে সেকুলারিজমের কোনো স্থান নেই। রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুল ইসলাম আবেগী উদারতায় হিন্দু মুসলিম ঐক্যের স্বপ্ন দেখতেই পারেন কিন্তু সেই কাজটা খুব সহজ নয় বাস্তবায়িত করা। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব আইনের শাসনের আওতায় থেকে কিন্তু অরগানিক মিলন সম্ভব নয়। এই বাস্তব কথাটা আমাদের মানতে হবে। পছন্দ করি বা না করি। 
আর একটা কথা। ইদানীং সমাজে যে উগ্রতার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে বিশেষ করে হিন্দুদের একাংশের মধ্যে তার পিছনে একটা পারসেপশানের ব্যাপার আছে। জওহরলাল নেহরুর আমল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এদেশে সেকুলারিজমের নামে সংখ্যালঘু মুসলিম তোষণ করা হয়েছে এরকম একটা পারসেপশান বা বেদন বা কল্পমূর্তি বেশ কিছু মানুষের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছে। এদেশের মুসলিম ধর্মনেতারা এজন্য অনেকখানি দায়ী। তথাকথিত প্রগতিশীল ইন্টেলেকচুয়ালরাও এই ধারণা তৈরি করতে পরোক্ষে সাহায্য করেছেন। শাহবানু মামলা, কাশ্মীর নিয়ে এদের তাত্বিক অবস্থান , ইত্যাদি নানা বিষয়ে এদের অবস্থান ও কেন্দ্রীয় সরকারের দোদুল্যমানতা সবকিছু মিলে তালগোল পাকিয়ে এই পারসেপশান সৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে অনেক সরল ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেও বলতে শুনি,’ না, বাপু এতখানি তোষণ ভাল নয়।‘ এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তিন তালাক ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের আপত্তি। শিক্ষিত ও সচেতন মুসলিমদের গরিষ্ঠ অংশ এসব সমর্থন করেন না কিন্তু প্রকাশ্যে তারা মত প্রকাশ করতে চান না। এক ধরণের ভয় কাজ করে। যুক্তি যেখানে শেষ হয় হিংসার শুরু সেখান থেকেই। এই যে সারা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে নানারকম আতংকবাদী চক্র হিংসাত্মকো ধ্বংসাত্মক কাজ করে চলেছে তার বিরুদ্ধে মুসলিম ইন্টেলেকচ্যুয়াল বা সাধারণ শিক্ষিত মুসলিমদের বড় অংশ মুখ খোলেন না। এই কারণেও এমন একটা পারসেপশান তৈরি হয়েছে যে এরা বুঝি এসব সমর্থন করেন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় দেখবেন যে অধিকাংশ মুসলমান শান্তিপ্রিয় এবং তারা এসব মোটেই সমর্থন করেন না কিন্তু প্রকাশ্যে বলতে ভয় পান। এই ভয় ভাঙ্গাতে পারেন মুসলিম সম্প্রদায়ের চিন্তাশীল মানুষরাই। হিন্দু বা অন্য কোনো ধর্মের লোকেরা এ বিষয়ে যত সমালোচনা করবেন ততই ভয়ের মানসিকতা , অপছন্দ ও হিংসার মানসিকতা আরো তীব্র হবে। আমি রাজনীতির নেতা ও ধর্মব্যবসায়ীদের উপর একেবারেই আস্থাশীল নই। তারা এই ভয়কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। এদেশের ইতিহাসে এর সবথেকে বড় উদাহরণ মহম্মদ আলি জিন্নাহ। আপাদমস্তক সেকুলার এই মানুষটি ক্ষমতার লোভ ও ইতিহাসের হাতছানি উপেক্ষা করতে না পেরে প্রতিষ্ঠা করে গেলেন এমন একটি ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের যার বিষময় ফল আজ পর্যন্ত এই উপমহাদেশের মানুষ ভোগ করে চলেছেন। দুটি গরীব ও উন্নয়শীল দেশ তার জাতীয় সম্পদের একটি মোটা অংশ ব্যয় করছে সেনাবাহিনী পোষার জন্য এবং গোলাবারুদ কেনার জন্য। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ মানুষের মঙ্গলের কাজে লাগানো যেত। 
আমাদের বেশিরভাগ মানুষের সেকুলারিজম skin-deep জানি না এর বাংলা কি কোরব। মীটিং, মিছিল, সেমিনার-সিম্পোসিয়াম, প্রবন্ধ কবিতায় আমরা বেশ অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু যেখানে ‘বাঘের ভয়’ সেখানে কিন্তু আমাদের সেকুলারিজমের ‘সন্ধ্যা’ নেমে আসে। এই দেখুন যারা গরু নিয়ে কথা বলতে বেশ উতসাহী তাদের কাছে শুয়োর ‘হারাম’। উচ্চারণ করতেই চাইবেন না। যারা গো-মাতার ভক্ত তাদের যদি বলেন প্রাচীন কালে আর্যরা গরুর মাংস খেত তেড়ে আসবেন তারা। অষ্টমীর সন্দিক্ষণে মোষ বলি দেবার রেওয়াজ আছে এবং তা হিন্দুরাই পালন করেন। রামায়ণ ও মহাভারতে দিগ্বিজয়ের শেষে বিজয়ী অশ ফিরে এলে তাকে বলি দেওয়া হোত ‘অশ্বমেধ’ যজ্ঞ করে। মেধ মানে তো বলি। সে মাংস কারা খেত?  কিন্তু কেউ শান্তভাবে শুনলে তবেই তো যুক্তির কথা বলা যায়!

আসুন আয়নায় মুখ দেখি নিজেদের। দেখা দরকার কে কোথায় দাঁড়িয়ে।সিংহাবলোকন । 
ইংরাজীতে একটা সুন্দর অর্থবহ শব্দ আছে panacea  যার অর্থ সর্বরোগহর একটি ওষুধ। সেকুলারিজম panacea নয়। রাষ্ট্রীয় আদর্শ আর বাস্তবের মানুষের বিশ্বাস ও আচরণ এক কদাচিত হয়। যেমন ‘মীটিং কা কাপড়া’ আলাদা তোলা থাকে তেমনি সেকুলারিজম ধারণাটি আমরা ব্যবহার করি তোলা জামা কাপড়ের মত। আমাদের জীবন চর্চায় ও চর্যায়, বিশ্বাসে ও আচরণে যতদিন না আমরা প্রকৃত সেকুলার হতে পারছি ততদিন নানা রূপে বিরোধের বীভৎস মুখ বারবার বেরিয়ে পড়বে। ভারতবর্ষ এক প্রাচীন উন্নত সভ্যতার ধারক বাহক ও উত্তরাধিকারী। এ দেশের  Ethos  (ইথোজ) বা মর্মচেতনায় উগ্র ধর্মান্ধতা নেই।ধর্মহীনতাও নেই। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে দলবদ্ধভাবে মানুষ এদেশে  এসেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে নানান সভ্যতা, নানান কৃষ্টি । লুটেরারাও এসেছে। আবার লুটপাঠ করে অনেকে চলেও গেছে। বেশিরভাগই স্থায়ীভাবে এদেশের মাটিতে শিকড় গেড়েছে। বিভিন্ন সভ্যতা ও  ধর্মসংস্কৃতির মধ্যে মাঝে মাঝে লড়াই সংঘর্ষ হয়েছে আবার সমান্তরালভাবে একটা সমণ্বয়ের সাধনাও  নিরবচ্ছিন্নভাবে চলেছে। সব মিলিয়ে প্রায় চারশ বছরের মুসলমান শাসন বা পরবর্তী সময়ে একশো নব্বই বছরের ইংরেজ শাসনে এদেশের আপামর জনসাধারণ নিজেদের ঐতিহ্য ও ধর্ম সংস্কৃতি বজায় রাখতে  সক্ষম হয়েছে তার কারণ সনাতন ধর্মের বা হিন্দু জীবন দর্শনের অন্তর্নিহিত শক্তি ও আধ্যত্মিক সম্পদের বলে। যারা এই মূল ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারেন না তারাই হিন্ধু জীবন দর্শনকে আর একটি সেমিটিক রিলিজিওনের মত কোডিফাই করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। হিন্দু বা সনাতন দর্শনের শক্তি ও সামর্থ্য সম্পর্কে যাদের কোনো ধারণাই নেই তারাই এই জীবন দর্শনকে ‘হিন্দুয়ায়ন’ করার চেষ্টা করছেন। যদি এরা রাজনইতিক  শক্তির সহায়তায় এই মেটামরফসিস (metamorphosis) করে ফেলতে পারেন সেদিন ভারতবর্ষ আর ভারতবর্ষ থাকবে না। যেটুকু ইতিহাস বুঝি তাতে আমি নিশ্চিত এই অপচেষ্টা সফল হবে না। সতত প্রবহমানা নদীতে বাঁধ দেওয়া যায় না। 


এই আলোচনার উপসংহার টানা খুব কঠিন কাজ। আমার মনে হয়েছে কিছু কথা আছে যা আমাদের পীড়িত, ক্ষুব্ধ ও উদ্বেলিত করে কিন্তু সাহস করে বলতে চাই না। নানা ভদ্র শালীন কথার আড়ালে নিজেদের আসল চেহারা ঢেকে রাখি।অথচ বলা দরকার। আসুন নিজেদের প্রশ্ন করি আমাদের কতজনের খুব অন্তরঙ্গ ‘বিধর্মী’ বন্ধু আছে যাদের আনাগোনা আমাদের অন্দরমহল পর্যন্ত। আমাদের পড়শিকে কতটুকু চিনি আমরা? কতটুকুই বা চেনার চেষ্টা করি? 
নিজ নিজ ধর্মকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ধর্ম রূপে ভাবতে আমরা ভালবাসি। এতে আমি দোষ দেখি না কিন্তু অপরের ধর্ম ও জীবনদর্শন সম্পর্কে কিছু না জেনেবুঝে আলগা মন্তব্য করা থেকেই অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
অনেকের মুখেই শুনবেন ‘নেড়ে’,’মোছলমান’,’গরু খায়’,’একমাত্র জুতোয় সোজা’ –এই জাতীয় অবমাননাসুচক নিম্নরুচির মন্তব্য যা মানুষকে আহত করে। বিপ্রতীপে,’ কাফির’,’ হিদেন’,’পুতুল পুজক’,’ ‘মালাউন’ জাতীয় অপমানসূচক মন্তব্য। এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের মুখেও আমি এসব কথা শুনে থাকি। এখনো। বন্ধুত্ব হবে কি করে? বড়দিনের উৎসবে যোগ দিতে আমরা সানন্দে রাজী হই। ‘হ্যাপী ক্রিসমাস’ আনন্দের সঙ্গে বলি। মুসলিম দোকান গুলিতে বড়দিনের এবং নিউ ইয়ার’স এর কেক প্যাস্ট্রি বিক্রী হয় কিন্তু পুজোর ফুল বাতাসা প্রসাদ বিক্রি হয় না। সিমুই বিক্রী হয় হিন্দুর দোকানে, গরুর মাংস নয়। জবাই না বলির পাঁটা তা নিয়ে আমাদের মধ্যে তুলকালাম বেঁধে যায় । আমি একটা NSS Camp-এ যোগ দিতে গিয়ে এ সমস্যা ভোগ করেছি। রাশানালিটি কাজ করে না। অথচ ঐ ক্যাম্পে সকলেই ছিল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র।খুব বিষণ্ণ বোধ করি এসবে। তবুও এটা একটা বাস্তবতা। হিন্দুর পুজোয় যে পুতুলগুলি দেবদেবী রূপে আরাধিত এবং পূজিত হয় সেগুলি ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠা’র আগে এবং উৎসবের দিনক্ষণ পেরিয়ে যাবার পরে আবার পুতুল। কিন্তু ‘প্রাণ প্রতিষ্ঠার’ পরের সময়কালে এবং বিশ্বাসীর মানসভুমিতে তাঁরা দেবতা ও দেবী। এই ব্যাপারটা বুঝতে হবে এবং শ্রদ্ধা করতে হবে। ঠিক তেমনি বুঝতে হবে মহরম , ঈদ এবং হজ করা একজন মুসলমানের কাছে কতখানি মূল্যবান। বিশ্বাস এবং আবেগের সাথে যুক্তিতর্কের বিরোধ চিরন্তন। নানা সমস্যায় জর্জরিত মানুষের জীবন থেকে তাদের বিশ্বাস ও আবেগ জোর করে কেড়ে নেওয়া যাবে না। কত ভালই না হোত আমরা সকলেই যদি এইসব অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের রহস্যময় দুর্জ্ঞেয়তা থেকে মুক্ত হতে পারতাম! তা যখন হয় নি বা যতদিন না হচ্ছে ততদিন একে অপরের বিশ্বাস এবং আস্থাকে তাচ্ছিল্য ও ঘৃণা না করে বন্ধুর মত, সুপ্রতিবেশীর মত বোঝার চেষ্টা করা ভাল! একে অপরের উৎসবে শরীক হয়ে আনন্দ ভাগ করে নিতে পারতাম যদি খানিকটা বন্ধুত্ব বাড়ত! না, আমি রাজনৈতিক ইফতার বা রাজনৈতিক বিজয়া সম্মীলনীর কথা বলছি না। এসব ভন্ডামি তো হচ্ছেই। তাতে মনের দূরত্ব  কমল কই?
মাঠেঘাটে, চায়ের দোকানে, ট্রেনে বাসে নানান আড্ডায় একটা মুখরোচক আলোচনার বিষয় তিন তালাক এবং চারটি বিবাহ। মুসলিম শরীয়ত অনুমোদিত। কোডিফাইড সেমিটিক রিলিজিওনের একটি ইনট্রিনসিক বা মজ্জাগত সমস্যা হোল ধর্ম পুস্তকে যা লেখা আছে তা বদলানো যাবে না। কোরাআনের বাণী বা বাইবেলের বাণী ধ্রুব সত্য। অজর অক্ষয় অমর। অতএব অলঙ্ঘনীয়-sacrosanct
সমস্যার অন্যতম জড় এইখানে। মুস্কিল আরো আছে।বিভিন্ন পন্ডিত বিভিন্ন ব্যাখ্যা এনে হাজির করছেন। কার কথা শুনবেন? একই ধর্মের মধ্যে আবার নানা উপদল সম্পৃক্ত হয়ে আছে। শিয়া ও সুন্নির লড়াইতো একে অপরকে বিনাশ করার চেষ্টায় লিপ্ত। এক গোষ্ঠীর লোক অন্য গোষ্ঠীর মসজিদ ও  উপাসনালয় পর্যন্ত ধংস করে দিতে কুন্ঠিত হচ্ছে না। আলোচনায় এসব কথাও উঠে আসছে সমালোচনা ও হেয় করার মানসিকতা নিয়ে। বিরোধের ও অবিশ্বাসের ক্ষেত্র ক্রমেই বেড়ে চলেছে। 

পৃথিবীর অন্তত একুশটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তিনতালাক বৈধ নয়। পাকিস্তানেও নয়। এক বিশেষ পরিস্থিতিতে চারটি বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ইসলাম ধর্মের জন্মের সূচনাকালে। অনেক অনেকদিন আগে থাকতেই সে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই সব মান্ধাতার আমলের প্রথা যে এখনো টিকে আছে তার কারণ মুসলিম পুরুষদের কায়েমী স্বার্থ।