আজ থেকে বেশ কিছুদিন আগে আমার এ লেখা লেখার কথা । যেদিন বাপ্পামামার কাছ থেকে স্রেফ প্রচ্ছদ দেখে মান্টোর এই অনুবাদ খানা এনেছিলাম , তার দুদিনের মধ্যেই লেখা উচিত ছিল । অন্তত ২১শে ফেব্রুয়ারি । নাহ্ । দিনান্তের ক্লেদ সঞ্চয়ে আর প্রতিদিনের সর্বশক্তিমানের সাথে যুদ্ধে , সে সময় পাওয়া যায় নাই । আজ পেলাম তাই লিখি । এই লেখার পুরোটার জন্যই আমি মান্টোর অনুবাদক আতিশ তাজিরের কাছে ঋণী ।
আতিশের মা এবং বাবা যথাক্রমে ভারতিয় এবং পাকিস্থানি পাঞ্জাবি । আতিশ দিল্লীতেই বড় হয়েছে । আতিশের বাবা মা এবং দাদু উর্দুতে কবিতা লিখতেন । দাদুর একটি কবিতার খাতা আতিশ পেয়েছিল উত্তরাধিকারে । কিন্তু আতিশ উর্দু জানে না, অথচ উর্দুতেই লুকিয়ে ইতিহাস । অতএব ডাক্ পড়ল জফর মুরাদাবাদির । মুরাদাবাদি অবশ্যই মুরাদাবাদে থাকতেন বলে , আসল নাম কেউ জানে না । এটা ২০০৪এর কথা ।
জফর মুরাদাবাদে এসছিলেন , যখন তার বয়স ২১ । সালটা ১৯৬১ , এবং তখনো উনি কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন । আর কবি হওয়ার স্বপ্ন দেখেন বলেই না মুরদাবাদে , গালিবের শহরে , উর্দু কবিদের দেশে আসা । জন্ম কোথায় , তাতে কি বা যায় আসে ?? কর্ম মুর্দাবাদে । মির , ঘালিব , মোমিন আর দাঘ-এর মতো কবির জন্মস্থান কেউ না জানুক , কর্মস্থান মুরাদাবাদ সক্কলে জানে । অতএব জফর-ও এসেছিলেন । এসেছিলেন তখন , যখন উর্দুতে কবিতা পাঠ হলে , লোকে হল ভরে শুনতো । এসেছিলেন তখন , যখন উর্দু কবি কোন ডায়নোসারের সমোগত্রিয় শব্দবন্ধ ছিল না । জফর এসেছিলেন । জফর রাজনীতি বুঝতেন না । বুঝলে জানতেন উর্দু , ভারতের ত্যাজ্য ভাষা ।
সেই ৪৭এর পরের থেকেই পাকিস্থান , উর্দুর সাথে ইস্লামিক্ রাস্ট্রকে এক করে দেওয়ার প্রচেষ্টা আরম্ভ করেছিল । অথচ যে সমস্ত ভুখন্ড পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত , তাদের একটিতেও উর্দুর কোন প্রভাব ছিল না । উর্দু ছিল ভারতের নিজস্ব , পুরানি দিল্লী - মুরাদাবাদ তদ্সম-তদভব অঞ্চলের ভাষা । ফায়েজের মতো কবিরা ,উর্দুকে পাঞ্জাবে হাত ধরে নিয়ে এসেছিলেন বললেও ভুল বলা হবে না । কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণ বসত ভারত সরকার , উর্দু ভাষা থেকে দূরে সরতে শুরু করলেন , কাছে এগোতে থাকলো পাকিস্থান । জফররা কেবল ছিলেন বিলুপ্ত প্রজাতি , ভারত বা উর্দু কোনটাই ছাড়তে পারলেন না ।
এরপর ভারতের সরকার আস্তে আস্তে দেবনাগরীর মতো একটি লিপিকে যতো এগোতে থাকলেন , ততো পেছোতে থাকলো জফরের ভাষা । কিন্তু তবুও ভারতের অসামান্য মিলিয়ে দেওয়া , এবং বৈচিত্রের সংস্কৃতি উর্দুকে খুন করতে দিল না । বাঁচিয়ে রাখলো সিনেমা , বাঁচিয়ে রাখলো বোম্বাই। আজ অব্দি , বলিউডি সিনেমায় একজন যাত্রীকে মুসাফির্ বা একটি ষড়যন্ত্রকে সাজিস্ বলা হয় । এবং এটা বলার জন্য বর্ডারের দুপারের মানুষকে কোন আলাদা মনোযোগ দিতে হয় না । ভাষা এমনি-ই বেঁচে থাকে । কিন্তু এটুকু স্রেফ এটুকু দিয়েই কি কবি বাঁচে ?
কবি যদি হন গুলজার বেঁচে যেতেই পারেন , অথবা কাইফি আজমি । তারা অন্যমানের , অন্য ধাতুর মানুষ । উর্দু শব্দের সাথে হিন্দী শব্দ (সিলি হাওয়া ছু গয়ি -সিলা বদন্ ছিল্ গিয়া অথবা সারে জাহান্ সে আচ্ছে হিন্দোস্তা হামারা ।) কজনই বা মিলিয়ে কাঁপুনি ধরিয়েছে । জফর এদের মতো ছিলেন না । অথবা হয়তো ছিলেন , কিন্তু তিনি নিজের লিপি ভয়ঙ্কর ভালোবাস্তেন । আপনাকে যদি বলা হয় - "রোমান অক্ষরে বাংলা লিখুন " - আপনি খুশি হবেন ?? জফর নিজের লিপি ছাড়া কবিতা লিখতেন না । উনি বিশ্বাস করতেন , "মেজাজ লুকিয়ে আছে লিপিতে" । এবং এই একটি বাক্যের জন্যই না চিনে না জেনে ভালোবেসেফেলেছি ।
সে যাই হোক , প্রথমে কবিতা লিখতেন উর্দু স্ক্রিপ্টে , তারপরে গান-ও তাই । চোখের সামনে দিয়ে ওনার ভাষার দুনিয়া শ্মশান হয়ে গেল । উনি কোথাও পালিয়ে যান নি । মনে করতেন উর্দুর গন্ধ লুকিয়ে ভারতের বৈচিত্রের মাটিতে । ভারতেই লড়ে গিয়েছেন ভাষার জন্য । প্রতিক্ষন । সাত-সাতটি পি এইচ ডি থিসিস্ লিখে দিয়েছেন ভাড়ায় , উর্দুতে । নিজেকে বলতেন "ইন্টেলেকচুয়াল মারসিনারি " । আতিশকে পড়াতে এসছিলেন যখন, প্রথম শর্ত ছিল "আগে লিখতে জানতে হবে , তারপর পরতে" । সপ্তাহে পাঁচ দিন, তিন ঘন্টা প্রতিদিন , ভাষা শেখাতেন পাঁচ হাজারে । সালটা ২০০৪ । আতিশ একদিন ওনার বাড়ি গেছিলেন । ঈদ ছিল সেদিন । দেওয়াল ময় পেচ্ছাপ আর রাস্তাময় সদ্য ব্যায় হওয়া রক্তের গন্ধ ঢেকে গিয়েছিল , জফরের উইন্ সিগারেটের গন্ধে । একটা অস্থায়ি সিড়ি টপকে , ৯ফুট বাই ৮ফুটের ঘর । সেখানেই , জফররা চারজনে থাকেন, কাপড় টানা বাথরুম । ঘরের অর্ধেক ভর্তি বই । বড় ছেলে কারাখানায় ঘুমায় রাতে । ঘষ্টানো সব্জেটে দেওয়ালে পিঠ ঠাসিয়ে বসে , নতুন কবিতা পড়ছেন জফর । উইন সিগারেট হাতে , জফরকে ভাষা শহিদের মতোই দেখতে । যেমনটা দেখতে ছিলেন বাংলাদেশের আব্দুস্ সালাম বা আব্দুল জাব্বার ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন