বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৬

কবি ~ শমীক মুখার্জী

কিশোর রবি জোড়াসাঁকো হইতে নির্গত হইলেন। হাওড়া হইতে এখন ট্রেন যায়, পঁহুছানো অসুবিধা হইবে না। মূলরাস্তার নিকটে আসিতেই একটি তোবড়ানো মিনিবাস "পোস্তা-হাওড়া-হাওড়া-হাওড়া" কহিতে কহিতে আসিয়া দাঁড়াইল। সাবধানে আপনার চোগা-চাপকান সামলাইয়া পাদানিতে অর্ধেক ঝুলিয়া দাঁড়াইলেন কিশোর রবি। মিনিবাস ছুটিল হাওড়া ইস্টিশনের দিকে।

অন্যদিন এই সময়ে কিশোর রবির মনে খেলা করিয়া যায় গানের কথামালা, গুঞ্জরিয়া যায় সুরের ভ্রমর। আজ আর সে সব দিকে রবির ভ্রূক্ষেপমাত্র নাই, নতুন বৌঠান দুটি ক্ষীরকদম্ব খাইয়া যাইতে বলিয়াছিলেন, রবি দৃক্‌পাত করেন নাই, সবেগে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছেন ঘর হইতে। ... বাবামশায়, যে বাবামশায়কে তিনি এত সন্মান করেন, ঈশ্বরতুল্য মনে করেন, সেই বাবামশায় তাঁহার সঙ্গে এমনটি করিলেন?

ব্যান্ডেল লোকালে আনমনে বসিয়া আছেন রবি। ঝালমুড়ি এবং কচি শসা বিক্রেতারা বহুবার তাঁহার কর্ণের নিকটে বহুবিধ স্বরে তাহাদিগের পসরার গুণগান করিয়া গেল, রবির তাহাতে ভাবান্তর ঘটিল না।

বিকেল তিনটার কিছু পূর্ব্বে রবি চুঁচুড়ায় আসিলেন। একটি রিক্সা লইয়া সটান উপস্থিত হইলেন গঙ্গাতীরবর্তী বাগানবাড়িতে। বাবামশায় আজকাল এইখানেই দিন অতিবাহিত করিতেছেন। একটু পরেই তাঁহার উপাসনার সময় হইবে, তাহার পূর্ব্বেই তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ প্রয়োজন।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তখন বারান্দায় বসিয়া একটি সদ্য শোনা সঙ্গীত গুণগুণ করিতেছিলেন। নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে, রয়েছো নয়নে নয়নে। তাঁহার এই পুত্র সত্যই প্রতিভাবান। রবি তাঁহার নাড়ির টান, এইবারে গ্রীষ্মে তাহাকে সঙ্গে লইয়া তিনি কার্শিয়াং যাইবেন।

সহসা ধ্যানভঙ্গ হইল মহর্ষির। দরোজার সামনে দাঁড়াইয়া আছে, ও কে? রবি না? রবি, বাবা, কখন এলে? খবর দিয়া আসো নাই তো?

রবি মনে মনে অনেক রোষকষায়িত বাক্যবাণ প্রস্তুত করিয়া আসিয়াছিলেন, কিন্তু আচম্বিতে বাবামশায়ের সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাঁহার সমস্ত তেজ উবিয়া গেল, পরিণত হইল অভিমানে। চক্ষের কোণে আসিল জলের বিন্দু। পায়ে পায়ে আগাইয়া গেলেন বাবামশায়ের সম্মুখে।

"কেন, বাবামশায়, কেন? ... দেশের রাজা না হয় এ ভাষা বুঝেন না, আপনি তো বুঝেছিলেন, তবে কেন জেনেশুনে আমাকে এই পাঁচশো টাকার নোট দিয়াছিলেন? গত তিন দিন ধরে সারা কলকাতা ঘুরেছি, কেউ নেয় নি, কেউ নিতে চায় নি। বলছে, কালো টাকা। না হয় না-ই দিতেন, আপনার স্নেহই আমার জন্য যথেষ্ট ছিল ..."

গলা বুজিয়া আসিল কিশোর রবির। থরথর হাতে চোগার পকেট থেকে একটি পাঁচশো টাকার নোট তিনি আগাইয়া ধরিলেন মহর্ষির দিকে। মহর্ষি স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। নির্জনে এই বাড়িতে তিনি সাধন ভজন করেন, এনডিটিভি দ্যাখেন না। দেশের রাজা যে এত কিছু করিয়া ফেলিয়াছেন, তিনি জানিবেন কেমন ভাবে?

গঙ্গাবক্ষে শীতল হাওয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া ছুটিয়া গেল নৈহাটির দিকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন