বৃহস্পতিবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৬

রাতভোর ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

- আপনি গাঁজা খান স্যার?
-
কেন তোর আপত্তি আছে?
- না স্যার, আমার আর আপত্তি থাকার কি আছে? তবে বড় বিচ্ছিরি গন্ধ
- তুই আমার ছাত্রী, তোর বলার একটা রাইট তো আছেই তবে সে সময় এখন নয়
- বকলেন?
- মোটেই না রাত ১২ টার পর ছাত্রীদের বকতে নেই
- খিক খিক …… আপনার নেশা হয়েছে
- হয়েছে, তবে গাঁজার নয় ঝিম ধরা মধ্যরাতের নেশা গাঁজার থেকে অনেক স্ট্রং
- আপনাকে অদ্ভুত লাগে স্যার মাঝে মাঝে আপনার কথা কিছু বুঝতে পারিনা 
- তাহলে রাত তিনটের সময় না ঘুমিয়ে বাংলার প্রোফেসরের পাশে বালির ওপর বসে আছিস কেন?
- ভাল লাগছে স্যার কি সুন্দর ! শহরের ভিড়ভাট্টা নেই, আওয়াজ নেই, হুড়োহুড়ি নেই
- হুঁ সবাই সেটাই বলে বটে
- আপনি কতজনের সঙ্গে এরকম বসে থেকেছেন স্যার মাঝ রাতে , সমুদ্রের ধারে?
- বেশী না, তবে হাঁটুর বয়সি কারুর সঙ্গে এই প্রথম
- আপনার হাঁটুর বয়স কত ?
- ডেঁপোমি করিসনা
- এতই যদি ইয়ে আমি , তো কেন বসে আছেন আমার সঙ্গে? আমি যাই ঘুমোতে এখনো কেউ কেন নোটিশ করেনি আমি বাইরে, সেটাই বুঝতে পারছিনা
- বোস
- কেন?
- আমি বলেছি বলে
- আপনি বলেছেন তাই বসব?
- তোদের ম্যাডাম নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে এখন ঢুকতে গেলে উঠে পড়ে ঝামেলা করবে
- ম্যাডাম ঝামেলা করবে বলে বসতে বললেন?
- এত বক বক করিস কেন বল তো?
- আমি যাচ্ছি
- বোস
- কেন?
- তুই থাকলে ভাল লাগে
- কেমন ভাল? আমি কে?
- তুই আমার ছাত্রী তোর সঙ্গ আমার ভাল লাগে
- হেঁয়ালী ছাড়ুন
- মন দিয়ে শোন মেয়েদের একটা সহজাত বোধ থাকে, যেটা দিয়ে তারা পুরুষকে বুঝে নিতে পারেআর
- আর?
- জেন্টলম্যানরা জানে তাদের কোথায় থামা উচিত
- আপনি জেন্টলম্যান?
- অন্ততঃ হবার ইচ্ছেটা রাখি
- যদি না হতে পারেন? না হতে চান?
- নষ্ট হয়ে যাবে রে, সব নষ্ট হয়ে যাবে
- কি নষ্ট হবে স্যার?
- ওই দেখ, দিকে দেখছিস? আকাশ ফর্সা হচ্ছে একটু একটু করেরঙ ধরছে?
-   মাকি সুন্দর স্যার? রঙটা দেখছেন? কি অপূর্ব !! উফ আমি কখনো দেখিনি স্যার!! দারুন

- নিজের লিমিট না জানলে, এইদারুনএর স্মৃতিটাই তেতো হয়ে যাবে বুঝলি পাগলি? সব সুন্দরকে ধরতে যেতে নেই… 

মঙ্গলবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৬

দুই বাবা ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

- বাবা…
- উঁ ?
- ওই পাঁচিলের ওপাশে কি আছে বাবা? ওই যে দূরে, বিরাট উঁচু, মেঘ ছোঁয়া পাঁচিল...
- কিচ্ছুটি নেই।
- কিচ্ছু নেই? কেউ নেই?
- নাঃ , সব খালি।
- তার পর? খালির পর?
- খালি … খালি … খালি ... তার অনেক পর, প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার দূরে আবার একটা আমাদের এই কলকাতার মত ঝাঁ চকচকে শহর। দিল্লি। তাতে আমাদের মতই মানুষ থাকে। বড় বড় বাড়ি ৩০০ তলা, আকাশে গাড়ি চলছে, বড় বড় শপিং মল, তাতে কিনতে পাওয়া যায় সব কিছু। ঠিক আমাদের মত। আরো আছে, মুম্বাই, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর, বেজিং, নিউ ইয়র্ক...
- আর মাঝের খালি জায়গায়? মানুষ নেই?
- নাঃ নেই।
- তবে যে টুবাই বলছিল ওখানেও কারা সব থাকে, ৩ বছর আগে ওর বাবা নাকি গিয়েছিল একবার পাঁচিলের ওপাশে, ৩০৫২ সালে।
- কিছু জংলী হয়ত আছে, জীবজন্তু টাইপের। তাদের না আছে বিজ্ঞান, না আছে উন্নতী, না আছে লাইফস্টাইল ... নাথিং... ওদের নিয়ে আলোচনা করতে নেই
- কেন বাবা?
- জানিনা রে, আমাকে সেই মতই প্রোগ্রাম করা হয়েছে, যেন আমি তোর সঙ্গে এই নিয়ে কথা না বলি।
- রোবট-বাবারা কেন এমন হয়?
- কারন তোর মানুষ-বাবার যে সময় নেই বাবু। কাজে ভারি ব্যস্ত। তাই তো আমি।
- তুমি আর মা, মানে আমার রোবট বাবা মায়ের জায়গায় এক দিনের জন্য মানুষ বাবা মা কে পেতে পারি?
- জানিনা রে বাবু। এ উত্তরের জন্যে আমার ব্রেন তৈরি নয়। চলো তোমাকে ক্লাস ওয়ানের ভর্তির জন্যে বেসিক ক্যালকুলাসটা একটু প্র্যাকটিস করিয়ে দিই।
***********
- বাবা...
- উঁ?
- ওই পাঁচিলের ওপাশে কি আছে বাবা? ওই যে দূরে, বিরাট উঁচু, মেঘ ছোঁয়া পাঁচিল...
- জানিনা রে বাবু। শুনেছি এক মস্ত বড় শহর আছে। কলকাতা।
- সেখানে কি আছে বাবা? শহর কি?
- আমিও কি জানি রে বাবু? শুনেছি মস্ত মস্ত সব বাড়ি, কলকব্জা, আকাশে নাকি গাড়ি চলে।
- ওখানে কারা থাকে?
- থাকে...... মানুষেই থাকে
- আমাদের মত মানুষ বাবা?
- আমাদেরই মত তবে আবার আমাদের মত নয় ও
- মানে কি বাবা?
- এই ধর, আমাদের টালির চালা বাড়ি, লাউ মাচা, পাতকুয়ো, বাগান, পুকুর, গোয়াল, ক্ষেত খামার, গাঁয়ের পাঠশালা, সবাই মিলেমিশে ভাগাভাগি করে নেওয়া এসব ওখানে নেই
- তাহলে ? কি আছে?
- উচ্চাশা আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, যা নেই তাকে পেতে চাওয়া আছে, সমৃদ্ধি আছে, একাকিত্ব আছে ...
- আর এখানে? ওখানে এত কিছু আছে তো আমরা কেন ওখানে নেই বাবা?
- এখানে ? এখানে যে তুই আছিস বাবু... তুই, আমি তোর মা... তোর বন্ধু টুবাই, ঠাকুর্দা, ঠাকুমা... ভূলো কুকুর... ধবলী গাই... এই যে আমাদের উঠোনের টগর আর শিউলির গাছ...
- তোমাকে খুব ভালোবাসি বাবা। তোমাকে আর মা কে। আর টুবাইকে, দাদুকে, ঠাকুমা কে...সবাইকে
- এখানে সুখ আছে বাবু, আর শান্তি। চল তোকে আজ সিন্ধুবাদ নাবিকের গল্প শোনাই।

শুক্রবার, ২১ অক্টোবর, ২০১৬

আহারে বাংলা ~ সুশোভন পাত্র

- হ্যাভ ইউ এভার বিন টু ইউরোপ? এলে বুঝতিস, প্রফেশেনালিজম কি জিনিস। কি ডিসিপ্লিন, কি ডেকোরাম। ঐ 'শ্রমিক ঐক্য' দিয়ে কিস্যু হবে না। 'দুনিয়ায় মজদুর' আর কবে এক হবে? অষ্টমীর সকালে চেতলা অগ্রণীর সর্বজনীন মণ্ডপে? না দশমীর সকালে বারোয়ারি ম্যাডক্স স্কয়ারে? মিছিল, মিটিং, ধর্মঘট... যত্তসব ডিসগাসটিং এলিমেন্ট। ডেভলাপমেন্ট করতে একটা 'ওয়ার্ক কালচার' লাগে রে। আই মিন.. 'কর্ম সংস্কৃতি'। যেটা ঐ ৩৪ বছরের বাংলায় ছিল না। কনটেম্পোরারি কিছু ভাব ভাই, না হলে কিন্তু...  
স্কাইপি তে, বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময়টা প্রায় হুমকি দিয়েই শেষ করলো আমার প্রবাসী 'নিরপেক্ষ' ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু। আমি অবশ্য তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেছি, সি.পি.এম'র চিতা জ্বলা শশ্মানের সোনার বাংলায়, সঞ্জীবনী 'কর্ম সংস্কৃতি'র পুনর্জন্ম হয়েছে। এখন হারাধন বাবুর মাসতুতো বোনের ননদের ছেলের বৌ কিম্বা পাশের বাড়ীর শ্যামল কাকুর নাতজামাই'র পিসতুতো ভাইয়ের খুড়শ্বশুরের মত কিছু লুপ্তপ্রায় প্রাণী ছাড়া আপামর 'নিরপেক্ষ' বাঙালি 'কর্ম সংস্কৃতি'টা গুলে খেয়েছে। আনন্দবাজার তাঁদের শিখিয়েছে, শ্রমিকদের নুন্যতম মজুরি আদায়ের ২৪ ঘণ্টার ধর্মঘটে কর্ম সংস্কৃতি ধ্বংসের যে পাপ লাগে, দুর্গা স্তুতির এক্সট্রা ছুটিতে সে পাপ ধুয়ে যায়। কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম চাওয়া রাজপথের মিছিলে 'সাধারণ মানুষ' যে হেনস্তার দীর্ঘশ্বাস ফেলে, রাস্তা জোড়া দুর্গা মণ্ডপ ফাঁদলে সেই হেনস্তা'ই ভক্তি রসে ডুবে যায়। মহালয়া থেকেই দুর্গাপূজার শুভারম্ভের মুখ্যমন্ত্রীর মুখনিঃসৃত খোয়াবনামায় -বাংলার 'উন্নয়নে' আর ভাঁটা পড়ে না, পার ক্যাপিটা ইনকামের মহাভারত আর অশুদ্ধ হয় না, হাওড়া থেকে হনুলুলুর সিঁড়ি চড়তে গিয়ে সেনসেক্সের সূচকেরও পা হড়কে যায় না। 
সন্ধ্যালোকে ইডেন প্রান্ত থেকে বীরদর্পে মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে অবতীর্ণ হতেই রেড রোডের ব্যস্ত রাস্তা বন্ধ করে শুরু হল ওয়ার্ল্ডের 'বিগেস্ট কার্নিভ্যাল' -'পূজার শেষে ঠাকুর দেখা'। ফোর্ট উইলিয়াম প্রান্ত থেকে একে একে ৩৯টি পূজা কমিটির বর্ণাঢ্য র‍্যাম্প শো। মঞ্চের সামনে উদ্যোক্তা'দের উলুধ্বনি তে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে উজাড় করা নিরঙ্কুশ আনুগত্য। কারও গলায় 'থ্রি চিয়ার্স ফর আমাদের দিদি', কেউ বললেন 'হি পি পুরে', কোনও সুসজ্জিত ট্যাবলোর ব্যানারে আবার রবীন্দ্র-নজরুল-টেরেসার সাথে মাখামাখি হয়ে সুশোভিত হলেন 'আজকের দুর্গা...' স্বয়ং সততাময়ী মমতা। মুখ্য-সচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, রাজ্য পুলিশের ডি.জি, কলকাতা পুলিশের কমিশনার পরিবেষ্টিত, লাস্যময়ী নীল নিয়নে ভেজা মুখ্যমন্ত্রীর মুখে তখন আত্মমুগ্ধতার একগাল হাসি, সরকারি পয়সায় মা দুর্গার খাতিরের কর্ম সংস্কৃতি বাস্তবায়নের একবুক তৃপ্তি। 
আচ্ছা, নবমীতে মুর্শিদাবাদের সালিশি সভায় 'স্বামী কে ছেড়ে যাওয়ার অপরাধে' ১০৮ বার কঞ্চির বাড়ি মেরে যে গৃহবধূর মাথার চুল কেটে নেওয়া হল কিম্বা প্রেম প্রত্যাখ্যানের অপরাধে হাঁসখালির যে মা-মেয়েটার মুখে অ্যাসিড ছোঁড়া হল –মঞ্চ থেকে তাঁদের সমবেদনা জানালে কি 'বিগেস্ট কার্নিভ্যাল'র মাহাত্ম্যে কিঞ্চিৎ ব্যাঘাত ঘটত? আগুনে পোড়া তিলজলার নাজিয়া ফাইজা কিংবা অনাদায়ী পনের দায়ে উলুবেড়িয়ার মিতা মণ্ডলের নিথর দেহের বিচার চাইলে কি নবান্ন'র দুর্গার মোচ্ছবের বাড়া ভাতে ছাই পড়ত? 'পূজার শেষে ঠাকুর দেখা'র আয়োজনী খরচা, দেবীপক্ষে রাজ্য জুড়ে নারী নির্যাতনে বলি ছ'জন গৃহবধূর পরিবারে বিলিয়ে দিলে কি মা দুর্গার আপ্যায়নে একটু খামতি থাকতো?
আপনার 'নিরপেক্ষতা' যখন সীমান্তের যুদ্ধ জিগির আর হাজীনগরের দাঙ্গা উস্কানির মাঝে পেন্ডুলামের মত দুলছে, আপনার ফেস্টিভ মুড যখন টলিউডের নায়িকার কোজাগরী আরাধনার গ্ল্যামারাস বাইটে আটকে, নার্কোটিক কন্ট্রোল ব্যুরোর রিপোর্ট অনুসারে বাংলা তখন বে-আইনি আফিম চাষে দেশের মধ্যে ফার্স্ট হয়েছে। বুলডোজারে গুড়িয়ে দেওয়া সিঙ্গুরের ৯৯৬ একর কে 'চাষযোগ্য' করে কৃষকদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ায় দেখে আজ যে সংবাদ মাধ্যম্যের লুস মোশেন হয়েছে, সেই সংবাদমাধ্যমই আবার মালদা'র ৭০০০ একর জমিতে বে-আইনি আফিম চাষের খবর, চুপচাপ চেপে দেওয়ার কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছে। আপনি জানতেই পারবেন না যে, নিয়মিত ক্লাবে আর দুর্গাপূজা কমিটিতে অনুদান দেওয়া আপনার সাধের এই রাজ্য সরকার, অভাবের সংসারের হাঁড়ির হাল ফেরাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ট্রাম ডিপো গুলো লিজ দিয়ে ২৫৮ কোটি টাকা কোষাগারে তুলেছে। আপনি যখন ব্যস্ত ছিলেন পূজা প্যান্ডেলের হপিং'এ কিম্বা অর্ধাঙ্গিনীর সাথে ম্যান ল্যান্ড চাইনার টেবিলে, রাজ্য সরকার তখন বাজার থেকে ধার করেছে আরও ১৫০০ কোটি। গত পাঁচ বছরে মোট ১ লক্ষ ২২ হাজার কোটি। পূজার বোনাস নেই, বকেয়া মহার্ঘ্য ভাতা নেই, রেশনে বরাদ্দ নেই, চাকরিতে নিয়োগ নেই, শিল্পে বিনিয়োগ নেই, কিন্তু তবুও সরকারের ধার করাতে খামতি নেই। আসলে ধার করাও তো একটা 'কাজ'। আর মোচ্ছবের খরচ চালাতে নিয়মিত ধার করাটা 'কর্ম সংস্কৃতি'।
জঙ্গলমহলের যে বেতাজ বাদশা লেনিনিষ্ট কনজাংচারের গ্রহ-তারা-নক্ষত্র বিচার করে তৎকালীন বিরোধী নেত্রীর রাজনৈতিক চরিত্রে নিজেদের 'শ্রেণী বন্ধু' খুঁজে পেয়েছিলেন, তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী বানাতে চেয়ে সাপের পাঁচ পা দেখেছিলেন, তিনি আজ বেঁচে থাকলে দেখতেন; হেমন্তের অলস দুপুরে, মাননীয়ার সরকার এখন পাঁচদিন ব্যাপী 'আহারে বাংলা'র খাদ্য উৎসব করছে। দেশী-বিদেশী তাক লাগানো সব মেনুর সম্ভারে মিলন মেলা প্রাঙ্গণে পেট-পূজার রাজসিক আহ্লাদীপনার আয়োজন হচ্ছে। চাকদহর বারো হাতের দুর্গার আশীর্বাদে যখন হিন্দ মোটর্স, ডানলপ, জেশপের বন্ধ কারখানার তালা খোলেনি, চটকলের শ্রমিক মহল্লায় উৎসবের দিনেও আলো জ্বলেনি, 'মাননীয়ার অনুপ্রেরণায়' যখন উত্তরবঙ্গের চা-বাগানে রেশন আর স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া যায়নি, অনাহারে আর অপুষ্টিতে গত চার বছরে যখন সেখানে ৬০০ জনের লাশ হয়ে যাওয়া আটকানো যায়নি তখন সরকারের এই মোচ্ছব মুখরতার বিরোধিতা করলে কি নীল-সাদা উন্নয়নের রং একটু ফ্যাকাসে হয়ে যাবে? বেকারদের চাকরি চেয়ে মিছিল-মিটিং করলে কি রাজ্যের 'কর্ম সংস্কৃতি'র মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? চা-বাগানের শ্রমিকদের পক্ষ নিলে কি কনটেম্পোরারি ফ্যাশনের 'নিরপেক্ষ' ইমেজে অল্প এট্টু চুনকালি লেগে যাবে? লোকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে ছিঃ ছিঃ করবে? করলে করবে। তবুও আমি পক্ষপাতদুষ্ট। কায়মনোবাক্যেই পক্ষপাতদুষ্ট। আমি গর্বিত আমি পক্ষপাতদুষ্ট...

বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১৬

স্টেশনের নাম ~ কৌশিক মজুমদার

​স্টেশনের নাম নিয়ে নানা মজার মজার গপ্পো আছে। প্রথম এই ধরণের গল্পের সন্ধান পাই ছোটবেলায়। শীর্ষেন্দুর পাতালঘরে আছে বর্ধমান লাইনে বেলমুড়ি স্টেশনের নামটি নাকি ভারি অপয়া। সকাল সকাল ওই নাম করেছ কি মরেছ। টিকিটবাবুরাও নাকি ওই নাম করলে টিকিট দিতে চান না। অগত্যা যাত্রীগন "আপনে সুবিধা কে লিয়ে" ওই স্টেশনের নাম দিয়েছে মাঝের গ্রাম। অনেকে আবার নাকি একে শ্রীফল চালভাজা ও বলে থাকেন। বেলকে বেল বললে অপয়া আর শ্রীফলে কি নতুন ফল ফলবে কে জানে বাপু!আমি তো এই সেদিন শান্তিনিকেতন যাবার পথে বেশ কবার বেলমুড়ি বেলমুড়ি বললুম। কিছু ডেলি পাষন্ডের মত তাকাল বটে কিন্তু অনর্থ তো কিছু হল না।
উল্টোডাঙ্গা এখন নেহাত বিধাননগর হয়েছে। কিন্তু ১৭৪২ এর সেই ভয়ানক ঝড়ে এখানে এক সাথে সাতটা ডিঙ্গি নৌকা উলটেছিল সেটা বোধহয় অনেকেই ভুলে মেরে দিয়েছি। যেমন ভুলেছি সাহেবের কাছে গরীব মানুষের কাতর ভিক্ষার আবেদন "Sir I am poor" বদলাতে বদলাতে শ্রীরামপুর নাম নিয়েছে। রামচন্দ্র!!
সেদিন ট্রেনে যেতে যেতে আর একটা দারুন গল্প শুনলাম। সাহেবগঞ্জ লুপ লাইনে একটা স্টেশন আছে নোয়াদার ঢাল নামে।ক্রসিং স্টেশন। তার নাম নিয়েই গল্প। এর আশেপাশে আরও দুই ঢাল আছে। ঝাপটের ঢাল আর পিচকুড়ির ঢাল। সাহেবী আমল। কেরাণীবাবু সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন "সাহেব কি নাম রাখি এ ইস্টিশানের?" সাহেব এত ঢালে বিরক্ত। বললেন"Anything but no other dhal".কেরাণী কি বুঝল কে জানে। নাম হইয়া গেল।
তবে স্টেশনের নাম নিয়ে ঝামেলা কম নেই। বিশরপাড়া কোদালিয়া কিংবা নারায়ণ পাকুরিয়া মুরাইল নামকে নাম গ্রামকে গ্রাম। কেউ নিজের অধিকার ছাড়েনি। শেষটা তো আবার এই বাংলার সবচেয়ে বড় নামের স্টেশন।কি মজা!সেটাও আজকাল আমার যাত্রাপথে পড়ে।
তবে উত্তরবঙ্গে থাকাকালীন বড় মায়াবী নামের একটা ছোট্ট স্টেশন পড়ত। নাম নিজ বাড়ি। কতবার ভেবেছি নেমে যাই। চা বাগান ঘেরা,টালি ছাওয়া এই ঘরগুলোর মধ্যেই কোথাও হয়ত আমার জন্ম জন্মের বাড়িটা লুকিয়ে আছে। নামতে পারিনি। আমার নাগরিক ঔদাসিন্য বাধা দিত। এখন প্রায়ই মনে হয়। কি হত নেমে গেলে?আমারই বাড়ি তো!পরের বার ঠিক নেমে যাব টুক করে…
যাবই…

শনিবার, ১ অক্টোবর, ২০১৬

গান্ধী না গডসে ~ সুশোভন পাত্র

সেদিন একটু দেরিই হয়েছিল গান্ধীজীর। গোধূলির রাঙা আলো তখন ঝরে পড়ছে আগত অসংখ্য ভক্ত, অনুরাগী'দের গা বেয়ে। খালি পায়ে, ঘাসের চাদর বিছানো লনে গান্ধীজী কে আসতে দেখেই, তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে উদ্যত হন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। শীর্ণকায় গান্ধীজী'র সহকারী আভা চট্টোপাধ্যায় কে ধাক্কা দিয়ে, হঠাৎ সেই শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বদলে যায় ইটালিয়ান বেরেত্তা M1934, সেমি অটোমেটিক পিস্তলের তিনটে ৯MM বুলেটে। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ ফায়ার। সরাসরি বুকে। স্থান, বিরলা হাউস, দিল্লী। কাল, ৩০শে জানুয়ারি, ১৯৪৮, বিকেল ৫:১৭। পাত্র, নাথুরাম গডসে।
রেডিও বার্তায় দেশবাসী কে গান্ধীজী'র মৃত্যু সংবাদ জানাতে গিয়ে নেহেরু যখন বলছেন "লাইট হ্যাস গন আউট অফ আওয়ার লাইভস",দেশের অগণিত মানুষ যখন ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল, গোটা বিশ্বের আপামর জনতা যখন ঘটনার বর্বরতায় শোকস্তব্ধ, তাবড় রাষ্ট্রনায়ক'দের সমবেদনার বেতার বার্তায় যখন ভেসে যাচ্ছে দিল্লী, তখন খুশির মিষ্টি বিতরণ হয়েছিলো আর.এস.এস আর হিন্দু মহাসভার দপ্তরে দপ্তরে। আগের পাঁচবার হত্যার চেষ্টার ব্যর্থতা ধুয়ে মুছে 'হিন্দুরাষ্ট্র' তৈরির পথের কাঁটা সরিয়ে ফেলার সাফল্য উদযাপিত হয়েছিলো রীতিমত জান্তব উল্লাসে।
হিন্দু মহাসভার মারাঠি মুখপত্র হিন্দুরাষ্ট্র'র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক পুনের চিতপাভন ব্রাহ্মণ নাথুরাম গডসে। ১৯৪৮'র ৮'ই নভেম্বর, গান্ধী হত্যার বিচারে, লালকেল্লার স্পেশাল কোর্টের ট্রায়ালে তিনি বলেছিলেন "সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে গান্ধীর ভণ্ড মুসলিম তোষণ ও হিন্দু'দের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ আমাকে এই কাজে বাধ্য করেছে।" কাশ্মীরে, পাকিস্তান হানাদার আক্রমণের পরেও, ভারত সরকার কে পাকিস্তানের ৫৫ কোটি টাকার ঋণ শোধে বাধ্য করে গান্ধীর আমরণ উপবাস এবং মুসলিম'দের আলাদা দেশ হিসেবে পাকিস্তান গঠনে গান্ধীর ভূমিকাই নাকি নাথুরামের সেই ঘৃণার বারুদের অগ্নিসংযোগে অনুঘটক হয়েছিলো। কিন্তু বাস্তবে, ইতিহাসের প্রামাণ্য সব নথিই নাথুরামের অভিযোগের ভিত্তিহীনতা'কেই প্রতিষ্ঠা করে।    
ধর্মীয় হানাহানিতে তখন রক্তাক্ত গোটা দেশ। 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংসে'র পরও জ্বলছে বাংলা। পাঞ্জাব সীমান্তে পাকিস্তান ফেরত উদ্বাস্তু হিন্দু'দের রক্ত ঝরছে প্রতিদিন। খবর আসছে হানাহানির, ধর্ষণের। দিল্লীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় হিন্দুরা সেই হিসেব বুঝে নিচ্ছেন স্থানীয় মুসলমান'দের উপর। সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য ও সামাজিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে গান্ধীজী আমরণ অনশন শুরু করেন দিল্লীতে। ১৯৪৮'র ১২'ই জানুয়ারি সান্ধ্য প্রার্থনায় গান্ধীজী নিজে আমরণ অনশনের যেসব নির্দিষ্ট কারণ ব্যাখা করেছিলেন কিম্বা ১৭'ই জানুয়ারি গান্ধীজীর পক্ষ থেকে যে প্রেস বিবৃতি দেওয়া হয়েছিলো, কিম্বা সরকারের পক্ষ থেকেও ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ কমিটি গান্ধীজী কে আমরণ অনশন ত্যাগ করতে অনুরোধ করে যে সমস্ত শর্ত মেনে নেবার কথা বলেছিলেন –সেখানে কোথাও, নাথুরামের অভিযোগ মত, ভারত সরকার কে পাকিস্তানের ৫৫ কোটি টাকার ঋণ শোধের কথা উল্লেখ ছিল না। নাথুরামের কবিকল্পনা যাই হোক না কেন, দেশভাগে অত্যুৎসাহীও গান্ধীজী ছিলেন না। বরং ছিল হিন্দু মহাসভা আর মুসলিম লিগের মত উগ্র মৌলবাদী দলগুলি। ছিলেন নাথুরামের ধর্মগুরু, ব্রিটিশ'দের আনুগত্য স্বীকার করে মুচলেকা দেওয়া বীর সাভারকার আর জিন্না মত নেতারা। ১৯৩৭'র হিন্দু মহাসভার আহমেদাবাদে প্রকাশ্য অধিবেশনে সাভারকার বলেছিলেন "ইন্ডিয়া আর ঐক্যবদ্ধ ও সমজাতিক দেশ থাকতে পারে না। হিন্দু-মুসলমান আসলে তো দুটো আলাদা দেশই।" ১৯৪৫'এ এই সাভারকারই বলেছিলেন "টু-নেশন থিওরি তে জিন্নার সাথে আমার কোন দ্বিমতই নেই। হিন্দুরা নিজেরাই তো একটা দেশ।" কই নাথুরাম গডসে তো দেশভাগের সমর্থনকারী সাভারকারের বিরুদ্ধে বন্দুক ধরেননি? মুসলিম'দের আলাদা দেশ হিসেবে পাকিস্তান গঠনে নৈতিক সমর্থনের জন্য সাভারকারের বুকে বুলেট ভরে দেননি? বরং গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রের আপাদমস্তক অংশীদার ছিলেন সাভারকার। অভিযুক্ত'দেরই একজন দিগম্বর বাদগে ট্রায়াল কোর্টে তাঁর সাক্ষ্যতে বলেছিলেন "গান্ধী হত্যার তিনদিন আগে তিনি, নাথুরাম গডসে এবং নারায়ণ আপ্তে সাভারকারের সাথে দেখা করতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখানে দীর্ঘ মিটিং'র পর  তাঁদের বিদায় দেত্তয়ার সময় সাভারকার বলেছিলেন, যাও সফল হয়ে ফিরে এসো।" সাভারকারের মৃত্যুর পর তাঁর দেহরক্ষী আপ্তে রামচন্দ্র কেশর এবং সাভারকারের সেক্রেটারি গজানন বিষ্ণু দামলের স্বীকারোক্তি রেকর্ড করে কানপুর কমিশন রিপোর্টে উল্লেখ করে "অভিযুক্ত'দের প্রত্যেকেরই সাভারকারের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ঘনিষ্ঠতাও ছিল।"
গান্ধী হত্যার দায়ে ক্রোধোন্মত্ত দেশবাসীর ঘৃণার রোষানল এড়াতে লালকৃষ্ণ আদবানি  বলেছিলেন "আর.এস.এস'র সাথে নাথুরাম গডসের কোন সম্পর্কই নেই।" আদবানির মন্তব্য শুনে, ব্যঙ্গের হাসি হেসেছিলনে নাথুরাম গডসের ভাই গোপাল গডসে। বলেছিলেন "আদবানি কাপুরুষ। আমরা তিন ভাই'ই সঙ্ঘে ছিলাম। নাথুরাম ছিল 'বৌধিক কার্যবাহক'। পুলিশি বয়ানে নাথুরাম সঙ্ঘের কথা অস্বীকার করেন যাতে দ্বিতীয় সরসঙ্ঘচালক গোলওয়ালকার কোন আইনি বিপদে না পড়তে হয়। আমৃত্যু নাথুরাম সঙ্ঘেই ছিলেন।" এমনকি বর্তমান বিজেপি সরকার যে সর্দার প্যাটেলের ৫৯৭ ফুটের মূর্তি বসাচ্ছে, সেই সর্দার প্যাটেলও বিজেপির আদর্শগত অভিভাবক আর.এস.এস সম্পর্কে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি কে লিখেছিলেন "সরকার নিশ্চিত যে আর.এস.এস ও হিন্দু মহাসভার প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন মদতেই গান্ধীজীর হত্যার বীভৎসতা সম্ভব হয়েছে।"
এই চাপানউতোরেই  আজ বেঁচে আছেন গান্ধীজী। কখনও ২রা অক্টোবরের ড্রাইডে তে কখনও সর্দার প্যাটেলের চিঠিতে কখনও আবার রক্তভেজা ইতিহাসের পাতায়। গান্ধীজী আছেন, মানিব্যাগের নোটে, বাম-কংগ্রেস 'ধর্মনিরপেক্ষ' জোটে, স্বচ্ছ ভারতের বিজ্ঞাপনে, কিম্বা রাহুল গান্ধীর পদবির লেজুড়ে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী ভাষণে ভোটের অঙ্ক কষে গান্ধীজী কে 'মহাত্মা' বানাচ্ছেন, আর অন্যদিকে পার্লামেন্টে সাড়ম্বরে সাভারকারের মূর্তি স্থাপিত হচ্ছে। একদিকে সীমান্ত পেরিয়ে 'সার্জিক্যাল অপারেশনে' 'জঙ্গি এবং জঙ্গিদের সহায়তাকারী'দের' শায়েস্তা করে দেশোদ্ধার হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের ভেতরের 'জঙ্গি এবং জঙ্গিদের সহায়তাকারী'রা নাথুরাম গডস কে বীর শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। মিরাটে মন্দির বানিয়ে নিত্য পূজার আয়োজন করছেন। এই গান্ধী জয়ন্তী তে তাই আপনি ঠিক করুন এদেশে গান্ধী বাঁচবেন কিভাবে? গডসে'দের হাত ধরে না অহিংসা আর শান্তিতে? সেমি অটোমেটিক পিস্তলের বুলেটে না সত্যাগ্রহের অভ্যাসে? অসহযোগের প্রতিরোধে না ঘৃণার বারুদে? আপনি ঠিক করুন এদেশে বাঁচবে কে? গান্ধী না গডসে...