রবিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ওনাম ও যুদ্ধপরিস্থিতি ~ অবিন দত্তগুপ্ত


কেরালা-তে এখন ওনাম উৎসবের সময় । ওনম কেরালার সবচেয়ে বড় উৎসব । ওনমের সময় কেরালাবাসি-কে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বি জে পি সভাপতি ,জেনোসাইড-এ পি এইচ ডি অমিত শাহ্‌ টুইট করেছেন - "হ্যাপি বামন জয়ন্তি" । ভাবছেন এ আর এমনকি বিষয় । লোকে গরু খাচ্ছে -গরুর চামড়া ছাড়াচ্ছে বলে খুন হচ্ছে ...আর এ তো পাতি একটা টুইট্‌ । কিন্তু এই টুইট্‌ নিয়েই কেরালা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে , বাছা বাছা বিশেষণে ভুষিত হচ্ছেন অমিত শাহ্‌ । কেন ? সেই উত্তর খুঁজতেই চেষ্টা করা যাক ।

অনেকগুলি ওনাম হয় । মানে একেকটি ওনামের একেকটি গল্প । সবচেয়ে পপুলার মিথোলজি অনুযায়ী , মালায়ালিদের মহাবলী নামে এক রাজা ছিল । পরম পরাক্রমশালী সেই রাজার সবচেয়ে বড় গুন ন্যায় বিচার , আরো ভালো করে বলতে গেলে - সামাজিক ন্যায় বিচার ( Social Justice) । মহাবলীর চোখে সমস্ত মানুষ জাত-ধর্ম নির্বিশেষে এক ছিলেন । তো অনার্য সেই রাজার পপুলারিটি তে, আর্য দেবরাজ ইন্দ্র ভয়ঙ্কর ইনসিকিয়োর্ড হয়ে পড়লেন । একজন রাক্ষস রাজা , বিন্ধ্য পর্বতের ওপারে বাড়ি , কালো - মোটা , সে কিনা আর্য শ্রেষ্ঠ দেবরাজ ইন্দ্রের চেয়েও বেশী জনপ্রিয় !! অতএব ইন্দ্র এসে পৌঁছলেন কূট বুদ্ধিধারী বিষ্ণুর কাছে । বিষ্ণু জানতেন , মহাবলীর কাছে কেউ কিছু প্রার্থনা করলে মহাবলী ফিরিয়ে দ্যান না , এবং মহাবলী তদ্‌কালিন রীতি অনুযায়ী ব্রাহ্মণদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল । অতএব এক বামুনের ছদ্মবেশে বিষ্ণু মহাবলীর কাছে এলেন এবং তিন পা জমি ভিক্ষে করলেন । মহাবলী তিন পা জমি গ্র্যান্ট করতেই , বামন নিজেকে পাম্প দিয়ে গ্যাস বেলুনের মতো ফোলাতে শুরু করলেন । বিকট বড় আকার ধারন করে তিনি এক পায়ে স্বর্গ , এক পায়ে মর্ত মেপে নিয়ে তৃতীয় পা ফেলতে চাইলেন । মহাবলী তৃতীয় পায়ের জন্য নিজের মাথা এগিয়ে দিলেন । বিষ্ণু পায়ের চাপে মহাবলী-কে পাতালে পাঠালেন এবং পাঠানোর আগে মহাবলীর প্রতিবছর একবার দেশে ফেরার ইচ্ছা মঞ্জুর করলেন । এই প্রতিবছর দেশে ফেরার দিনটাই ওনাম ।
মালায়ালি-রা এই দিনটাকে জাত-ধর্ম নির্বিশেষেই উদযাপন করে থাকেন । প্রতিটি বাড়ির সামনে ফুলের কার্পেট পাতা হয় । চার্চের অল্টার যেখানে থাকে ,সেখানেও পাতা হয় এই ফ্লোরাল কার্পেট । সমান তিন ভাগে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান মানুষ থাকেন কেরালায় । কেরালার সামাজিক শাড়ি ,যে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ছুঁচ দিয়ে বোনা , তাতে সুতোর কাজ করে ওনাম । বুঝতেই পারছেন ওনাম কেরালার মানুষের কাছে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ । তা গত বেশ কয়েকবছর ধরে ,আর এস এস কেরালায় বর্ণ হিন্দু সাংস্কৃতি হেজিমনি তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে । তারা বলতে চেষ্টা করছে যে , মহাবলী একটি অসুর, তার নামে আদৌ ওনাম নয় । ওনাম আসলে একটা নীচু জাতের রাক্ষসকে পাতালে পাঠানোর সেলিব্রেশন । ওনাম আসলে বিষ্ণুর বামন অবতারের সেলিব্রেশন । অমিত শাহ্‌ সেই লাইনেই খেলেছেন আর কি । সঙ্গে একটি ছবিও দিয়েছিলেন । মহাবলীর মাথায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে বিষ্ণুর বামন অবতার । ছবিটা আসলে আরও বড় অর্থ বহন করে হয়তো । নীচু জাত মহাবলীর মাথায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন উঁচু জাতের বিষ্ণু । বর্ণবাদের যে রাজনীতি অমিত বাবুরা করেন , তার ন্যাচারালাল কনক্লুশান ।

নিজেদের পছন্দ মতো বর্ণহিন্দু সংস্কৃতি ,সহজিয়া বা লোকসংস্কৃতি বা দলিত-আদিবাসি সংস্কৃতির উপর চাপিয়ে দেওয়ার এই প্রবণতাকেই কাল্‌চারাল ফ্যাসিজিম্‌ বলা হয় । দলিতরা যুগের পর যুগ ধরে চামাড়ের কাজ করেছেন । মৃত গরুর চামড়া ছাড়ানো তাদের জীবিকা । সেটা করতে গিয়ে তাদের খুন হতে হলে ,সেটা কালচারাল্‌ ফ্যাসিবাদ । কমঃ গোবিন্দ পানসারে খুন হলেন কেন ? কমঃ গোবিন্দ পানসারে-কে হিন্দু ফ্যাসিস্টরা খুন করেছে একটি বইয়ের কারণে । বইটির নাম "শিবাজি কৌন হোতা" ( Who was Shivaji ) । কি ছিল এমন বইটাতে ? একটা চটি বই । সরু । ১০০ পাতায় কমঃ পানসারে দেখিয়েছিলেন শিবাজীকে মানুষ ভালোবাসত কারণ শিবাজী গরিব মানুষকে অধিকার দিয়েছিলেন । শিবাজীর জন্য প্রাণ দিয়েছিল যারা, তারা - দলিত , মুসলমান ,হিন্দু । হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের মতো করে ইতিহাস লিখতে চেয়েছেন । তারা দেখাতে চেয়েছেন শিবাজী হলেন আসলে মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু মাসিহাহ্‌ । কমঃ পানসারে দেখিয়েছেন , শিবাজীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত জেনারেলরা ছিলেন মুসলমান , গরিব মুসলমান । দেখিয়েছেন , শিবাজী যে শুধুই মুঘল বাদশাহদের সাথে লড়েছেন তাই নয় , হিন্দু ফড়েদের পেছনে কষিয়ে লাথি মেরেছেন , হিন্দু রাজাদের হারিয়েওছেন । হিন্দু সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ রুখে দেবার অপরাধেই খুন হন গোবিন্দ পানসারে । আপনার নিজের রাজ্যে আপনি দেখবেন , এরা এদের নিজেদের ইতিহাসের ভার্সন সামনে আনছে । এরা আপনাকে মহম্মদ ইসমাইল ভুলিয়ে দিয়ে স্রেফ সুরাওয়ার্দি মনে রাখাতে চাইবে । এরা আপনাকে ফজলুল হক্‌ ভুলিয়ে দেবে । মুসলিম লিগ মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদ ভুলিয়ে দেবে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আর এস এস - হিন্দু মহাসভার নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চাইবে । ইতিহাসে সংস্কৃতিতে এই ভয়ঙ্কর আক্রমণটাই ফ্যাসিবাদ । সহজিয়া সংস্কৃতি , লোকসংস্কৃতি , দলিত-নিম্ন বর্ণের কালচারাল রেজিস্ট্যান্স-ই একমাত্র এদের হারাতে পারে । অতএব আম্বেদকর-কবির-লালন-লেনিন একসাথে লড়লে তবেই যুদ্ধে জয় সম্ভব । এটা যুদ্ধপরিস্থিতি - অন্য কিছু ভাবার কোন অবকাশ নেই ।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন