বুধবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

“সন্ত” টেরিসা ও কিছু না-ওঠা কথা ~ নগর যাযাবর

মহা সমারোহে মাদার টেরিসাকে "সন্ত" উপাধি দেওয়া হলো, ক্যাথলিকদের সর্বোচ্চ ও শ্রেষ্ঠদর্শন প্রতিষ্ঠান ভ্যাটিকান সিটিতে | এমনিতে তা নিয়ে আমাদের খুব কিছু বলার ছিলোনা, পৃথিবীতে সম্ভবত রোজই কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠান তার কোনো না কোনো সদস্যকে কিছু একটা উপাধি দিচ্ছে, সে দিক | কিন্তু কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার ও প্রচারমাধ্যম ব্যাপারটাকে একটা জাতীয় গৌরব ও আনন্দের ঘটনা হিসাবে প্রচার করছে দেখা যাচ্ছে, সুতরাং রাষ্ট্র ও প্রচারমাধ্যমের যৎকিঞ্চিৎ প্রজা হিসাবে দু চারটি কথা আমাদের বলতেই হয়, পছন্দ না হলে কথাগুলো আপনারা "রামায়ণের মধ্যে ভূতের ক্যাচকেচি" হিসাবে ধরতে পারেন |

 

শুরুতেই আমরা সম্মান জানাবো মাদার টেরিসার প্রতি, ইউরোপ থেকে এসে একটা জীবন কলকাতার নোংরাতম রাস্তায় পড়ে থাকা সমাজের বঞ্চিততম মানুষদের তুলে নিয়ে গিয়ে দু-দণ্ড একটু শান্তি দেওয়ার জন্য, অনেক সময় চিকিৎসা, অনেক সময় অন্তত একটু সম্মানজনক মৃত্যুর সুযোগ  দেওয়ার জন্য | মনে রাখা দরকার যে যিনি শুধু দরিদ্রদের সেবা করেছেন, এ-কথা বললে সবটা বলা হয়না | তিনি রাস্তায় পরে থাকা অন্ধ, পঙ্গু, কুষ্ঠরোগীদের, যারা সমাজ-বিতাড়িত, সামান্যতম সম্মান ও ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত সমাজের অসহায়তম মানুষ, তাদের রাস্তা থেকে, আবর্জনা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে সেবা করেছেন | সেই দুর্দশার পরিমান এই লেখার লেখক ও পাঠকের পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয় | অনুপ্রেরণা যাই হোক, এই কাজে গোটা জীবন নিবেদন করাটা সহজ নয়, সুতরাং সে জন্য মাদার টেরিসাকে আমাদের শ্রদ্ধা |

 

ব্যাপারটা এরমধ্যে, অর্থাৎ মাদার টেরিসার কাজ, তার থেকে পাওয়া তাঁর ব্যক্তিগত আনন্দ ও সমাজের একটা মানানসই স্বীকৃতি, তাঁর তৈরি ধর্মীয় গোষ্ঠী "মিশনারিজ অফ চ্যারিটি"র প্রসার, অনেক প্রশংসা ও কিছু নিন্দামন্দ, ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে আমাদের খুব একটা কিছু বলার থাকতো না | আমরা তাঁর কাজের অনুপ্রেরণা, তাঁর আদর্শগত ও রাজনৈতিক অবস্থান, তাঁর কাজের ব্যাপ্তি ও স্থায়িত্ত্ব, তিনি কাদের থেকে অনুদান নিয়েছেন ও সমর্থন করেছেন, তাঁর হোমগুলির অবস্থা ও চিকিৎসার মান, ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাতাম না, একজন মানুষের চিন্তা বা প্রচেষ্টার সবদিক গ্রহণযোগ্য নাই হতে পারে | কিন্তু ব্যাপারটা নোবেল পুরস্কার, ভারতরত্ন, সীমাহীন (অর্থাৎ ভারসাম্যহীন) খ্যাতি এবং অধুনা "সন্ত" উপাধি প্রদান ও তাই নিয়ে আবার ভারসাম্যহীন উৎসবের স্তর পর্যন্ত গড়ালো বলে তাকে আর একজন ব্যক্তির ঘটনা বলে ভাবা যায়না, বরং একটা সময়ের সমাজের কিছু চরিত্র এর থেকে প্রকট হয় | আর তাই বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর প্রয়োজনও তৈরি হয়, কিছু না বললে সময়ের সাক্ষী হিসাবে আমাদের কাজ করা হয় না |

 

মাদার টেরিসা ও তাঁর সংস্থা সারাজীবন বঞ্চিত, অসহায় ও সমাজের দ্বারা প্রবলভাবে অসম্মানিত ও প্রায়-বিতাড়িত মানুষের সেবা করেছেন, এ-কথা প্রথমেই সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করেছি | তারপর এ-কথা বলতে হয় যে এইসব মানুষের এই অবস্থার কারণ তথা সমাজের এই অবস্থার কারণ নিয়ে  তাঁর কোনো সুচিন্তিত মতামত ছিল বলে আমাদের জানা নেই (এই অবস্থা ঈশ্বরের দান এবং তাই দারিদ্র সুন্দর, এই কথা ছাড়া) | অতয়েব মানুষের এই দুর্দশা যাতে না হয় তার কোনো রাস্তা তিনি দেখাননি, তাঁর কথা থেকে মনে হয় দেখতে চানওনি, তিনি দারিদ্রকে-দুর্দশাকে সুন্দর মনে করতেন এবং ঈশ্বরের কাছের জিনিস মনে করতেন | আর এটাকে সমস্যা না মনে করলে তার সমাধানের প্রশ্ন নেই | সুতরাং মাদার টেরিসার কাজ অনেক অসহায় মানুষকে সাহায্য করলেও তাঁর আদর্শগত অবস্থান সংখ্যায় আরো বহু বহুগুন বেশি অসহায় নিপীড়িত মানুষের (যাদের কাছে তাঁর বা অন্য কোনো সংস্থা পৌঁছতে পারছেনা) এই অবস্থা থেকে মুক্তির পথে অন্তরায়, যেমন অন্তরায় ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ এই অবস্থার মধ্যে না পরে সেরকম ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে | তিনি শুনেছি বলতেন যে কারুর দুঃখদুর্দশার জন্য কেউ দায়ী হলে তাকে ক্ষমা করে দিতে হবে,  যেমন ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার জন্য বহুলাংশে দায়ী ইউনিয়ন কারবাইডকে | কথাটা বাণী হিসাবে ভালো, তবে এরমধ্যে মূল সমস্যা এবং তাঁর সমাধানের মধ্যে না ঢোকার স্পষ্ট প্রবণতা আছে, যা ধর্মের কাজের জন্য ভালো হতে পারে কিন্তু মানুষের উন্নতি ও মুক্তির পথে অন্তরায় | বিশেষ করে যদি কেউ তাঁর সংস্থার জন্য হাইতির ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী শাসক ডুভিলিয়ার বা কুখ্যাত মার্কিন ঠগ চার্লস কিটিং-এর কাছ থেকে অনুদান নেন (যেমন মাদার টেরিসা নিয়েছিলেন), তাহলে সেই প্রবণতাকে ক্ষমার চোখে দেখলে অতি-সারল্য এবং যুক্তির চোখে দেখলে ধান্দাবাজি বলে মনে হয় | দেখেশুনে মনে হয় সমাজে ক্ষুধা, দারিদ্র, বৈষম্যের অবসান ঘটুক এই অবস্থার থেকে মাদার টেরিসার এই অবস্থাই বেশি পছন্দ ছিল যে মানুষ দারিদ্র, অসহায়তার সম্মুখীন হোক আর যুগ যুগ ধরে কোনো নিবেদিতপ্রাণ "সন্ত" তাদের কাউকে কাউকে কোলে তুলে তাদের মৃত্যুকে কিঞ্চিৎ আরামদায়ক করুন ও সেই সূত্রে ঈশ্বরের সাধনা করুন | মাদার টেরিসার খ্যাতি একটা অঞ্চল ও সময়ের মধ্যে সীমিত থাকলে একথা বলার প্রয়োজন হতোনা, কিন্তু আজ এ-কথা আলোচনা করা দরকার, কারণ তাঁর খ্যাতি বিশ্বজোড়া আর তাই এটা বোঝা দরকার যে তিনি ঠিক কীরকম ব্যবস্থা বা সমাজ চাইতেন?

 

স্বাধারণভাবে তুলনা করার প্রয়োজন ছিলোনা, তাও এক্ষেত্রে করতেই হয় কারণ বর্তমানে মাদার-স্তুতিতে কান পাতা দায় | তাঁর খ্যাতির পরিমানের সঙ্গে মানানসই আরো কয়েকজন মানুষের-জন্য- কাজ-করা লোকের কথা আমাদের মনে পরে | মনে পরে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের কথা, যিনি মহাত্মা গান্ধীর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন ও শান্তির রাস্তার পথিক ছিলেন | কিন্তু যেখানে প্রতিবাদের প্রয়োজন সেখানে তার কোনো শর্টকাট বিকল্প তিনি খোঁজেননি | প্রতিবাদ করেছেন, মিছিল করেছেন, কালজয়ী বক্তৃতা করেছেন এবং শেষ বিচারে, একদম সরলভাবে ধরলেও, তাঁর আদর্শ এবং কাজের দ্বারা উপকৃত মানুষের সংখ্যা মাদারের থেকে বহুগুন বেশি | আমাদের মনে পরে চে গুয়েভারার কথা | তিনি শোষিত নিপীড়িত মানুষের যোদ্ধা ছিলেন, এবং তাদের মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছেন | একবার বিপ্লব সফল হওয়ার পর, কোনোক্রমে বেঁচে যাওয়ার পর, তিনি কিউবায় আরামে বাকি জীবন কাটাতে পারতেন | কিন্তু তিনি তা করেননি, জীবনকে বাজি রেখে আবার ফিরে গেছেন মানুষের জন্য যুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে, অপরাধের বিরুদ্ধে যুদ্ধে | সেই যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন, কিন্তু আজও বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একজন প্রতীক হিসাবে চে'র নাম উজ্জ্বল | আমাদের মনে পড়ে মহাত্মা গান্ধী, ভ্লাদিমির লেনিন, নেলসন ম্যান্ডেলা, হো চি মিন, ম্যালকম এক্স, মালালা ইউসুফজাই ইত্যাদি আরো বহু নাম | এঁরা কেউ ধর্মবিশ্বাসী, কেউ অবিশ্বাসী, কেউ কমিউনিস্ট, কেউ ব্যাপটিস্ট, কিন্তু এঁরা কেউ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে, সামাজিক বৈষম্যের মূল কারণগুলির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে দ্বিধা করেননি | আর তাই এঁদের আদর্শ ও কাজের দ্বারা উপকৃত মানুষের সংখ্যা মাদার টেরিসার থেকে অনেক অনেক বেশি, মানুষের কল্যাণে তাঁদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী | নিপাট সমাজসেবার কথা ভাবতে গেলেও, ক্রাই-এর মতো এনজিও সম্ভবত মাদারের সমান বা বেশি এবং আরো সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কাজ করছে, কারণ তারা শিশুদের অধিকার নিয়ে লড়াই করছে, দারিদ্রের জয়গাথা গাওয়া ও তার বহমানতাকে নিশ্চিত করতে ব্যস্ত নয় |

 

ব্যাক্তিপুজো এদেশের একটা ব্যাধি | তার প্রচুর প্রমাণ প্রতিনিয়ত পাওয়া যায়, যার একটা উদাহরণ "মনীষীদের" নামে বিভিন্ন কিছুর নাম দেওয়া | এই ব্যাধির চরিত্র ও ক্ষতি নিয়ে আলোচনা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, পরে কখনো সময় পেলে হবে, তবে মাদার টেরিসাকে নিয়ে হৈচৈ-টা এই ব্যাধিরই আরেকটি উপসর্গ বলে মনে হয় | এই ঢক্কানিনাদের  মধ্যেও কিছু সাহসী লোক তাঁর কাজের যুক্তিপূর্ণ বিশ্লেষণ করেছেন এবং ভক্তির ঠুলি সরিয়ে রেখে তাঁর হোমগুলি ঘুরে দেখে রিপোর্ট করেছেন | সেইসব রিপোর্ট থেকে উঠে আসা চিত্র সবসময় খুব আশাব্যঞ্জক নয়, কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভয়ের, যেমন এই ব্যাপারটা যে তাঁর হোমে একই সিরিঞ্জ ঠান্ডা জলে ধুয়ে বারবার বিভিন্ন লোকের শরীরে ফুঁটিয়ে ইনজেকশন দেওয়া হতো | সেসবের মধ্যে এখানে ঢুকছিনা, তবে এই লেখকের একবার অবকাশ হয়েছিল আশির দশকে কালীঘাটে তাঁর হোম "নির্মল হৃদয়ে" যাওয়ার | যদিও খুব ছোট ছিলাম, তবু অন্ধকার জেলখানা ধরণের পরিবেশটাকে মোটেও ভালো লাগেনি মনে আছে | একজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়েছিল - তিনি বিষাদের সঙ্গে বলেছিলেন যে তাঁর সংসারে কেউ নেই | আমার অভিভাবক ও সঙ্গী তাঁকে বলেন যে কেন, মাদার আছেন তো | এর উত্তরে তিনি কিছু বলেননি, তবে তাঁর মুখ থেকে এটা পরিষ্কার ছিল যে সেটাকে তিনি বিশেষ কোনো সৌভাগ্য হিসাবে মনে করেননি | এইটুকু অভিজ্ঞতা থেকে কোনো স্বাধারণ মতামতে পৌঁছনো যায়না, তবু সৎভাবে তাঁর কাজের মূল্যায়ন করতে গেলে এই-সমস্ত রিপোর্ট ও লেখাও পড়ে দেখা দরকার | তবে, আমরা এখানে সেকাজ করছিনা এবং তাঁর ভালো কাজকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিচ্ছি | আমাদের এই লেখার যাবতীয় বক্তব্য সেটুকু মেনে নেওয়ার পরেও |

 

ক্যাথলিক চার্চ খ্রীষ্ঠান ধর্মের প্রতি আনুগত্য ও তার প্রচারের জন্য "সন্ত" উপাধি দেয় | এর সঙ্গে ভালোমন্দের সম্পর্ক কম, যেমন দেখা যায় অনেক মানবতার শত্রু আগে "সন্ত" উপাধি পেয়েছে | এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই, কারণ যেকোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মতোই ক্যাথলিক চার্চ যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি-রহিত অন্ধ বিশ্বাসের ভিত্তিতে তৈরি হওয়া ও বেড়ে ওঠা একটি সংস্থা যা যুগ যুগ ধরে মানুষের বিরুদ্ধে নানাবিধ অত্যাচার করেছে | আমাদের মনে পড়ে যে এই ক্যাথলিক চার্চই গ্যালিলিওর বই বেআইনি ঘোষণা করেছিল ও তাঁকে গৃহবন্দী করে রেখেছিলো কারণ তিনি দূরবীনের সাহায্যে পর্যবেক্ষণের দ্বারা কোপার্নিকাসের তত্ত্বকে সমৰ্থন করেছিলেন যে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ও অন্য গ্রহরা ঘুরছে, সবার মধ্যমণি পৃথিবী নয় যেমন চার্চ বিশ্বাস করতো | চার্চের সঙ্গে জুড়ে আছে আরো বহু অত্যাচারের কাহিনী | সব আখ্যানে যাওয়ার দরকার নেই, তাও উদাহরণ-স্বরূপ আলেক্সান্ড্রিয়ার "সন্ত" সিরিলের কাহিনীটা বেমানান হবেনা |

 

323 খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আলেক্সান্ডারের মৃত্যুর পর তাঁর সেনাপতি প্রথম টলেমি মিশরের দখল নেন; শুরু হয় টলেমীয় যুগ, যা চলে প্রায় তিনশো বছর | এরমধ্যে অনেকটা সময়ই ছিল সমৃদ্ধির | গড়ে ওঠে, সমৃদ্ধ হয় আলেক্সান্ড্রিয়া ও তার মহান গ্রন্থাগার, যা ছিল প্রাচীনকালের জ্ঞানচর্চার এক শ্রেষ্ঠ পিঠস্থান | ভূমধ্যসাগরে অবস্থিত আলেক্সান্ড্রিয়ার বন্দর মিশরকে দেয় বাণিজ্যে সমৃদ্ধি | গল্প আছে যে আলেক্সান্ড্রিয়ার বন্দরে নোঙ্গর করা সব জাহাজকে একটা তোলা দিতে হতো | তবে সেটা আজকের অঞ্চলের মস্তান বা রাজনৈতিক নেতাদের নেওয়া তোলার থেকে আলাদা | বন্দরে নোঙ্গর করা সব জাহাজকে জাহাজে থাকা সমস্ত বই আলেক্সান্ড্রিয়ার লাইব্রেরিকে দিতে হতো কপি করার জন্য | কপি করার পর বই ফেরত পাওয়া যেত, হয় আসলটি নয় প্রতিলিপিটি | এছাড়াও বই জোগাড় করার আর যত রকম আইনি বেআইনি ফিকির হতে পারে, সে সবই ব্যবহার করে এক অত্যাশ্চর্য জ্ঞানমন্দির হয়ে ওঠে এই গ্রন্থাগার | প্রায় সব বইই ছিল প্যাপিরাস | কত বই ছিল সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়না, বিভিন্ন হিসাবে চল্লিশ হাজার থেকে চার লক্ষ বই ছিল আলেক্সান্ড্রিয়ার লাইব্রেরিতে |

 

কাহিনী অনুযায়ী, এই লাইব্রেরির শেষ অধ্যক্ষা ছিলেন সেই সময়ের একজন প্রধান গণিতজ্ঞ ও দার্শনিক, হাইপেশিয়া (355 থেকে 412 খ্রিষ্টাব্দ) | খ্রিষ্টধর্মের উত্থানের সেই সময়ে যুক্তি ও জ্ঞানচর্চাকে ভালো চোখে দেখা হতো না, যে দুটো জিনিস চলতো আলেক্সান্ড্রিয়ার লাইব্রেরিতে ও যার সবল ও প্রাণবন্ত নেতৃত্ত্ব দিতেন অধ্যক্ষা হাইপেশিয়া | শেষপর্যন্ত তার দাম তাঁকে দিতে হয় | আলেক্সান্ড্রিয়ার রাস্তায় একদিন যখন তিনি তাঁর রথে চড়ে কাজে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে বিশপের লেলিয়ে দেওয়া ধর্মোন্মত্ত জনতা তাঁর রথ থেকে টেনে নামিয়ে আনে এবং জীবন্ত পুড়িয়ে মারে | পুড়িয়ে দেওয়া হয় পৃথিবী-বিখ্যাত গ্রন্থাগারটিকেও | সেই বিশপ সিরিল পরে "সন্ত" উপাধি পান! বলাই বাহুল্য সিরিলের সঙ্গে মাদার টেরিসার তুলনা হয় না, কিন্তু এখানে এইটুকুই শুধু বোঝার যে "সন্ত" উপাধি পাওয়ার সঙ্গে ব্যক্তির মহত্ত্বের সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক আছে ক্যাথলিক ধর্মের প্রতি আনুগত্যের |

 

তবু "সন্ত" উপাধি দেওয়াটা চার্চের ব্যাপার, তা নিয়ে আমাদের কিছু বলার থাকতো না যদি না আমাদের সরকার ও প্রচারমাধ্যম তাই নিয়ে উচ্চগ্রামের আদিখ্যেতা শুরু করতো | করেছে যখন তখন আরো দু-একটা কথা তুলতেই হয় | মাদার টেরিসা তো তাঁর কাজের জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি আগেই পেয়েছেন, ভ্যাটিকানের এই "সন্ত" উপাধি-প্রদান আর অতিরিক্ত কীসের স্বীকৃতি? এটা হচ্ছে প্রথমতো এটার স্বীকৃতি যে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি ঈশ্বরের অতি কাছের লোক, এবং তার প্রমাণ হিসাবে দেখাতে হয় যে তিনি দুটি অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়েছেন | মাদার টেরিসার ক্ষেত্রে প্রথম অলৌকিক কাণ্ড হচ্ছে যে জনৈক মনিকা বেসরার পেটের টিউমার নাকি মাদারের ছবি থেকে "নির্গত জ্যোতি" আর তাঁর ছবিওলা একটা চাকতি রোগিণীর পেটের ওপর রাখায় সেরে গেছে | এসব শুনলে মনে যে ভাব আর মুখে যে ভাষা আসে সেটা লেখায় প্রকাশ না করাই ভালো, কিন্তু একথা বোঝা দরকার যে যেসব আজগুবি ভূতের গল্প চপ-মুড়ি সহযোগে বর্ষার সন্ধ্যের আড্ডায় ভালো জমে, সেগুলোকেই সত্য বলে স্বীকৃতি দেওয়া হলো লক্ষ লোকের সামনে, ভ্যাটিকানের চাতালে | যারা দেখে হাততালি দিলো তাদের আর যাই হোক, যুক্তি-বুদ্ধি-মনুষ্যত্বের সমঝদার বলা যায় না | এটুকুই শুধু আশার কথা যে এই বাংলারই বহু লোক এই ছেলে-ভোলানো মিথ্যাটাকে মিথ্যা হিসাবে রায় দিয়েছেন যার মধ্যে আছেন ওই রোগিণীর স্বামী (যদিও পরে তিনি বয়ান পাল্টান), ওনার ডাক্তার এবং বিতর্কে জড়াতে ভয়-না-পেয়ে সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্র |



Illustration by Mark Alan Stamaty

 

আমাদের বুঝে নিতে ইচ্ছা করে যে ঠিক কারা বছরের পর বছর ধরে আমাদের এই বেলাগাম মাদার-স্তুতিতে ডোবানোর চেষ্টা করছে | প্রথমত দেখা গেছে দেশ বিদেশের  রাজনৈতিক  নেতা-কর্পোরেট মিডিয়া (উদাহরণ মাদারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু চরম দক্ষিণপন্থী মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান) | মানুষের মুক্তির সংগ্রাম, যা বহু ক্ষেত্রেই সংগঠিত হয় দুঃখ দুর্দশা বৈষম্য বয়ে আনা নির্মম মুনাফামুখী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, এরা সেই সংগ্রামের বিরোধী | এরা এই ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় কারণ এরা এর সুবিধাভোগী | এই ব্যবস্থায় মাদার টেরিসার আদর্শ চমৎকারভাবে খাপ খায় - সমস্যার মূলে ঢুকোনা, ক্ষমা করে দাও, অহেতুক ঝুট ঝামেলায় যেওনা | পাশাপাশি আছে সেবা - চ্যারিটি - যা এই অত্যাচারী ব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে রেখেও কিঞ্চিৎ বিবেকদংশনের উপশম ঘটায় | আদর্শ ব্যবস্থা, সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না, শোষণ অত্যাচারও চললো, বিবেকও খোঁচা খেলনা | এই-জন্যই যা সাধারণ শ্রদ্ধার বিষয় ছিল তা গিয়ে দাঁড়ালো বিশ্বজোড়া খ্যাতি, ভারতরত্ন, নোবেল শান্তি পুরস্কার এবং "সন্ত" উপাধিতে | এই মাদার-স্তাবকতার নেতাদের অনেকেই ন্যূনতম মজুরির দাবিতে হওয়া শ্রমিক ধর্মঘটের বিরোধিতা করে, এরাই ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষাগুলিকেও বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করে, কৃষক আত্মহত্যাকে অশ্লীলভাবে অস্বীকার করে | এই মাদার স্তাবকদের মিছিলে দেখলাম আমাদের বর্তমান রাজ্য সরকারের একটি দলও যোগ দিয়েছে, নেতৃত্ত্বে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী | তা তো দেবেই, যাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা-মন্ত্রীরা হরদম মানুষের বিরুদ্ধে নানাবিধ অত্যাচার করছে, তোলা তুলছে, সম্পূর্ণ হেলদোলহীন হয়ে ঘুষ খাচ্ছে এবং তারপরও একইরকম দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই দল তথা সরকারের লোকজন এতো সস্তায় "পুণ্য" করার সুযোগ পেলে যে ছাড়বেনা সেটা সহজেই বোঝা যায়, সঙ্গে আবার রোম বেড়ানোর সুযোগ | অতিভক্তিটা চিরকালই চোরাকারবারিদের লক্ষণ | আর যাঁরা সরল মনে মাদার-স্তুতিতে ব্যস্ত, তাঁরা নেতৃত্ত্ব ও সংবাদমাধ্যমের দীর্ঘদিনের প্রচার থেকে এটা শিখেছেন যে এই বেশ ভালো চলছে, এই স্থিতাবস্থাকে ঘাঁটিওনা, শুধু মাঝে মাঝে একটু চ্যারিটি করো, যার সাক্ষাৎ প্রতিভূ মাদার টেরিসা, যদিও তিনি সম্ভবত চ্যারিটি করেছিলেন "ঈশ্বরের কাছে" পৌঁছনোর জন্য |

 

মাদার টেরিসাকে এখন থেকে নাকি "সেইন্ট টেরিসা অফ ক্যালকাটা" বলে অভিহিত করা হবে | আগে থেকেই নিরন্তর প্রচারের চাপে বহু সৎ বিদেশী পর্যটকের কাছে (অনেক ভারতীয়র কাছেও) কলকাতার সবচেয়ে বড় ঘটনা মাদার টেরিসা, কলকাতায় এলে আর কিছু না হোক মাদার হাউসটি একবার দেখতে যান, যদিও তাঁরা বেশিরভাগই জোড়াসাঁকোয় রবীন্দ্রনাথের বাড়িটির অস্তিত্ত্ব সম্পর্কেই অবহিত নন | বিশ্বজুড়ে লাগামহীন মাদার-স্তুতিকে হাওয়া দিয়ে এই দেশের এবং শহরেরই বহু মানুষ, রাজনৈতিক নেতা ও প্রচারযন্ত্র এই অজ্ঞানতাকে সমৰ্থন ও লালন পালন করেছে, "সন্ত"-উপাধি প্রদান নামক ভাঁড়ামোটি তার সাম্প্রতিকতম সংযোজন | সুতরাং এই ধূলিধূসরিত শহরে জন্মানো, বড় হওয়া যৎসামান্য নাগরিক হিসাবে আমাদের কিছু বলাটা জরুরি | কিছুটা এই শহরে বড় হওয়ার সূত্রেই বিশ্ব-নাগরিকত্ত্বের কিছু বোধ আমাদের আছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ-জাতি-সংস্কৃতিকে আমরা সম্মান করি, নিজেদের ভালো প্রমাণ করার জন্য কাউকে খাটো করার কোনো অভিপ্রায় আমাদের নেই, নিজেদের হাজারো দোষ-ত্রুটি স্বীকার করতেও কোনো অসুবিধা নেই, আর তাই স্বাধারণভাবে কলকাতা শহর সম্পর্কে আত্মপ্রচার করার প্রশ্ন উঠতো না | কিন্তু যখন শহরের পরিচয়েই একটা ভ্রম থেকে যাচ্ছে, তখন কিছু বলাটা আমাদের বিনীত কর্তব্য |

 

ইউরোপীয় এবং অন্যান্য বহু ভারতীয় শহরের তুলনায় কলকাতা নেহাত নবীন শহর (যদিও এর নগর পরিকল্পনার অভাব দেখে সে-কথা মনে হয়না) | তবু এর তিনশো পঁচিশ বছরের ইতিহাসে ঘটনা নেহাত কম ঘটেনি | সময়ের চরিত্র অনুযায়ী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনা ও ভাবনাচিন্তার প্রসার ঘটলেও (যার মধ্যে অনেকগুলি যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল ও দুর্ভাগ্যজনক), এই শহরের একটা মূল চরিত্র বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনের ভূমি হিসাবে - ধর্মীয় সংস্কারের আন্দোলন, মুক্তচিন্তা ও যুক্তির পক্ষের আন্দোলন, প্রতিবাদী রাজনীতির আন্দোলন | পাশাপাশি জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও কলকাতার ইতিহাস উজ্জ্বল | এই শহর ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের একটা মূল কেন্দ্র ছিল, কিন্তু তাই বলে ব্রিটিশ তথা ইউরোপীয় মনীষীদের কাছে টেনে নিতে এই শহর পিছপা হয়নি | তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ নিখাদ মানবতাবাদী অভিপ্রায়ে কাজ করে কলকাতার ইতিহাসে হীরকখণ্ডের মতো উজ্জ্বল | আমি ডিরোজিও, ডেভিড হেয়ার প্রমুখের কথা বলছি, কলকাতায় যাঁদের অবদানের সঙ্গে মাদার টেরিসার অবদানের কোনো তুলনা হয়না | এঁদের পাশাপাশি কাজ করেছেন এই শহরের ভূমিপুত্ররা | পুরস্কার পাওয়া-না পাওয়া দিয়ে ভালোমন্দের বিচার করাটা নিপাট বোকামো, তবু নিছক আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কথা ধরলেও, বহু প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে এই শহরে জন্মে, বড় হয়ে বা কাজ করে মাদার টেরিসা ছাড়াও চারজন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন - রবীন্দ্রনাথ, সি ভি রমন, রোনাল্ড রস এবং অমর্ত্য সেন | নোবেল পুরস্কার পাননি কিন্তু জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে বহু নোবেলজয়ীর থেকে বেশি অবদান রেখে গেছেন এই শহরেরই কেউ কেউ, যাঁদের মধ্যে সর্বাগ্রে মনে পরে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম, যিনি ব্রহ্মাণ্ডের অতিসুক্ষ রহস্য নিয়ে কাজ করেছিলেন, যাঁর নামেই ব্রহ্মাণ্ডের অর্ধেক কণার নাম - বোসন | শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত-চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও কলকাতা বিশ্বের মানচিত্রে নেহাত ফেলনা নয় | শোষণ নিপীড়ণের বিরুদ্ধে, শ্রমের সম্মান ও অধিকারের দাবিতে আন্দোলনের ব্যাপারেও কলকাতা একটা সামনের সারির নাম, যা মানুষকে প্রকৃত অর্থে মুক্তি দিতে পারে | এঁদের বেশিরভাগেরই প্রতিভা ও মানুষের উন্নতির ক্ষেত্রে অবদানের পাশে মাদার টেরিসা ফিকে হয়ে যান |

 

এসবের জন্য আমাদের "সেইন্ট টেরিসার" প্রয়োজন হয়নি | বস্তুত কলকাতার মাদার টেরিসাকে যতটা প্রয়োজন ছিল, মাদার টেরিসার কলকাতাকে প্রয়োজন ছিল তার থেকে অনেক বেশি | অহেতুক কলকাতার গৌরবগাথা গাওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়; ভারতের স্বাধারণ অবস্থার ভাগিদার হিসাবে দারিদ্র, বৈষম্য, নোংরাও এই শহরের নিত্যসঙ্গী | বিশেষ করে বর্তমানে সমাজ ও রাজনীতিতে আমরা একটা তলানিতে আছি মনে হয় | তবে উত্থান পতন যেকোনো শহরের ইতিহাসে আছে এবং এই অবস্থা থেকে উত্তরণও অবশ্যম্ভাবী আর তার জন্য আর কোনো "সেইন্ট টেরিসা"-কে আমাদের প্রয়োজন নেই | তাঁর ভালোটুকু - মুমূর্ষু, সমাজ পরিত্যক্ত, অসহায়তম মানুষের সেবা করা - অতীত ও শ্রদ্ধার, আর আপত্তিজনক অংশটাও - স্বাধারণভাবে মানুষের দুর্দশার মূল কারণ খোঁজা-কে এড়িয়ে যাওয়া, ভালোমন্দের বিচার না করে মানবতাবিরোধীদের কাছ থেকে অনুদান নেওয়া, ধর্মের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস, অলৌকিক ঘটনা ইত্যাদির প্রতি বিশ্বাস প্রচার করা  - নেহাত কম নয় | তবু আমরা তাঁর ভালোটুকু নিয়েই থাকতে পারতাম, কিন্তু তাঁকে চূড়ান্ত গৌরবান্বিত করার যে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা বছরের পর বছর ধরে চলেছে, তাঁর কাজ ও আদর্শকে একটা প্রশ্নহীন বেমানান উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা চলেছে, তাঁকে কলকাতার প্রায় শ্রেষ্ঠ আইকন হিসাবে তুলে ধরার যে চেষ্টা চলেছে এবং শেষপর্যন্ত "মিরাকেল"-কে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হচ্ছে, তা সমগ্র মানবজাতির পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর | মানুষ ও কলকাতা শহর এসবের থেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্ত হতে পারে, ততই ভালো |

 

রবিবার, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ওনাম ও যুদ্ধপরিস্থিতি ~ অবিন দত্তগুপ্ত


কেরালা-তে এখন ওনাম উৎসবের সময় । ওনম কেরালার সবচেয়ে বড় উৎসব । ওনমের সময় কেরালাবাসি-কে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে বি জে পি সভাপতি ,জেনোসাইড-এ পি এইচ ডি অমিত শাহ্‌ টুইট করেছেন - "হ্যাপি বামন জয়ন্তি" । ভাবছেন এ আর এমনকি বিষয় । লোকে গরু খাচ্ছে -গরুর চামড়া ছাড়াচ্ছে বলে খুন হচ্ছে ...আর এ তো পাতি একটা টুইট্‌ । কিন্তু এই টুইট্‌ নিয়েই কেরালা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে , বাছা বাছা বিশেষণে ভুষিত হচ্ছেন অমিত শাহ্‌ । কেন ? সেই উত্তর খুঁজতেই চেষ্টা করা যাক ।

অনেকগুলি ওনাম হয় । মানে একেকটি ওনামের একেকটি গল্প । সবচেয়ে পপুলার মিথোলজি অনুযায়ী , মালায়ালিদের মহাবলী নামে এক রাজা ছিল । পরম পরাক্রমশালী সেই রাজার সবচেয়ে বড় গুন ন্যায় বিচার , আরো ভালো করে বলতে গেলে - সামাজিক ন্যায় বিচার ( Social Justice) । মহাবলীর চোখে সমস্ত মানুষ জাত-ধর্ম নির্বিশেষে এক ছিলেন । তো অনার্য সেই রাজার পপুলারিটি তে, আর্য দেবরাজ ইন্দ্র ভয়ঙ্কর ইনসিকিয়োর্ড হয়ে পড়লেন । একজন রাক্ষস রাজা , বিন্ধ্য পর্বতের ওপারে বাড়ি , কালো - মোটা , সে কিনা আর্য শ্রেষ্ঠ দেবরাজ ইন্দ্রের চেয়েও বেশী জনপ্রিয় !! অতএব ইন্দ্র এসে পৌঁছলেন কূট বুদ্ধিধারী বিষ্ণুর কাছে । বিষ্ণু জানতেন , মহাবলীর কাছে কেউ কিছু প্রার্থনা করলে মহাবলী ফিরিয়ে দ্যান না , এবং মহাবলী তদ্‌কালিন রীতি অনুযায়ী ব্রাহ্মণদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল । অতএব এক বামুনের ছদ্মবেশে বিষ্ণু মহাবলীর কাছে এলেন এবং তিন পা জমি ভিক্ষে করলেন । মহাবলী তিন পা জমি গ্র্যান্ট করতেই , বামন নিজেকে পাম্প দিয়ে গ্যাস বেলুনের মতো ফোলাতে শুরু করলেন । বিকট বড় আকার ধারন করে তিনি এক পায়ে স্বর্গ , এক পায়ে মর্ত মেপে নিয়ে তৃতীয় পা ফেলতে চাইলেন । মহাবলী তৃতীয় পায়ের জন্য নিজের মাথা এগিয়ে দিলেন । বিষ্ণু পায়ের চাপে মহাবলী-কে পাতালে পাঠালেন এবং পাঠানোর আগে মহাবলীর প্রতিবছর একবার দেশে ফেরার ইচ্ছা মঞ্জুর করলেন । এই প্রতিবছর দেশে ফেরার দিনটাই ওনাম ।
মালায়ালি-রা এই দিনটাকে জাত-ধর্ম নির্বিশেষেই উদযাপন করে থাকেন । প্রতিটি বাড়ির সামনে ফুলের কার্পেট পাতা হয় । চার্চের অল্টার যেখানে থাকে ,সেখানেও পাতা হয় এই ফ্লোরাল কার্পেট । সমান তিন ভাগে হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান মানুষ থাকেন কেরালায় । কেরালার সামাজিক শাড়ি ,যে সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের ছুঁচ দিয়ে বোনা , তাতে সুতোর কাজ করে ওনাম । বুঝতেই পারছেন ওনাম কেরালার মানুষের কাছে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ । তা গত বেশ কয়েকবছর ধরে ,আর এস এস কেরালায় বর্ণ হিন্দু সাংস্কৃতি হেজিমনি তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে । তারা বলতে চেষ্টা করছে যে , মহাবলী একটি অসুর, তার নামে আদৌ ওনাম নয় । ওনাম আসলে একটা নীচু জাতের রাক্ষসকে পাতালে পাঠানোর সেলিব্রেশন । ওনাম আসলে বিষ্ণুর বামন অবতারের সেলিব্রেশন । অমিত শাহ্‌ সেই লাইনেই খেলেছেন আর কি । সঙ্গে একটি ছবিও দিয়েছিলেন । মহাবলীর মাথায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে বিষ্ণুর বামন অবতার । ছবিটা আসলে আরও বড় অর্থ বহন করে হয়তো । নীচু জাত মহাবলীর মাথায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন উঁচু জাতের বিষ্ণু । বর্ণবাদের যে রাজনীতি অমিত বাবুরা করেন , তার ন্যাচারালাল কনক্লুশান ।

নিজেদের পছন্দ মতো বর্ণহিন্দু সংস্কৃতি ,সহজিয়া বা লোকসংস্কৃতি বা দলিত-আদিবাসি সংস্কৃতির উপর চাপিয়ে দেওয়ার এই প্রবণতাকেই কাল্‌চারাল ফ্যাসিজিম্‌ বলা হয় । দলিতরা যুগের পর যুগ ধরে চামাড়ের কাজ করেছেন । মৃত গরুর চামড়া ছাড়ানো তাদের জীবিকা । সেটা করতে গিয়ে তাদের খুন হতে হলে ,সেটা কালচারাল্‌ ফ্যাসিবাদ । কমঃ গোবিন্দ পানসারে খুন হলেন কেন ? কমঃ গোবিন্দ পানসারে-কে হিন্দু ফ্যাসিস্টরা খুন করেছে একটি বইয়ের কারণে । বইটির নাম "শিবাজি কৌন হোতা" ( Who was Shivaji ) । কি ছিল এমন বইটাতে ? একটা চটি বই । সরু । ১০০ পাতায় কমঃ পানসারে দেখিয়েছিলেন শিবাজীকে মানুষ ভালোবাসত কারণ শিবাজী গরিব মানুষকে অধিকার দিয়েছিলেন । শিবাজীর জন্য প্রাণ দিয়েছিল যারা, তারা - দলিত , মুসলমান ,হিন্দু । হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের মতো করে ইতিহাস লিখতে চেয়েছেন । তারা দেখাতে চেয়েছেন শিবাজী হলেন আসলে মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দু মাসিহাহ্‌ । কমঃ পানসারে দেখিয়েছেন , শিবাজীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত জেনারেলরা ছিলেন মুসলমান , গরিব মুসলমান । দেখিয়েছেন , শিবাজী যে শুধুই মুঘল বাদশাহদের সাথে লড়েছেন তাই নয় , হিন্দু ফড়েদের পেছনে কষিয়ে লাথি মেরেছেন , হিন্দু রাজাদের হারিয়েওছেন । হিন্দু সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ রুখে দেবার অপরাধেই খুন হন গোবিন্দ পানসারে । আপনার নিজের রাজ্যে আপনি দেখবেন , এরা এদের নিজেদের ইতিহাসের ভার্সন সামনে আনছে । এরা আপনাকে মহম্মদ ইসমাইল ভুলিয়ে দিয়ে স্রেফ সুরাওয়ার্দি মনে রাখাতে চাইবে । এরা আপনাকে ফজলুল হক্‌ ভুলিয়ে দেবে । মুসলিম লিগ মন্ত্রীসভায় শ্যামাপ্রসাদ ভুলিয়ে দেবে । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আর এস এস - হিন্দু মহাসভার নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চাইবে । ইতিহাসে সংস্কৃতিতে এই ভয়ঙ্কর আক্রমণটাই ফ্যাসিবাদ । সহজিয়া সংস্কৃতি , লোকসংস্কৃতি , দলিত-নিম্ন বর্ণের কালচারাল রেজিস্ট্যান্স-ই একমাত্র এদের হারাতে পারে । অতএব আম্বেদকর-কবির-লালন-লেনিন একসাথে লড়লে তবেই যুদ্ধে জয় সম্ভব । এটা যুদ্ধপরিস্থিতি - অন্য কিছু ভাবার কোন অবকাশ নেই ।


শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

যুদ্ধ ~ সুশোভন পাত্র

ঐ তো অগ্নিদগ্ধ হয়ে শুয়ে আছেন জম্মুর হাবিলদার রভি পাল, ঠিক তাঁর পাশে, ঝাড়খণ্ডের সেপাই জাভ্রা মুন্ডা। কালাশনিকভের বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিশ্বজিৎ গরাই আর মহারাষ্ট্রের নায়েক শঙ্করের বুকটা। হ্যালোজেনের আলসেমি ভেজা রবিবারে কাকভোরে তখনও অবশ্য ঘুমই ভাঙেনি সেভেন রেস কোর্স রোড কিম্বা রাইসিনা হিলের নিশ্চিন্ত বাসিন্দা'দের।

স্বাভাবিক কারণেই,স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে,গর্জে উঠেছে ডাল মাখনি থেকে ইডলি-ধোসা হয়ে ইলিশ ভাপা। স্টার জলসার বিজ্ঞাপন বিরতি তে দীর্ঘশ্বাসের ফাঁকে ঘরে ঘরে প্রতিধ্বনিত হয়েছে -'খুন কে বদলা খুনের' অঙ্গীকার। সময়ের পাতনে, গত এক সপ্তাহে অবশ্য সেই বাক্যবাণের অনুরণন, ক্রমশ থিতু হতে হতে ব্র্যাঞ্জেলিনার ডিভোর্সের ঘণ্টাখানেক আলোচনায় বোতলবন্দী। আসলে সীমান্তের চড়াই উতরাইয়ে লাশ কুড়ানোর অভ্যাস আছে আমাদের। ২০০২'র কালুচক ক্যান্টনমেন্টে ৩১, ২০১৩'র শ্রীনগরে সি.আর.পি.এফ ক্যাম্পে ৫, ২০১৫'র গুরুদাসপুরের রাস্তায় ৭, গত জানুয়ারির পাঠানকোটে সেনা ছাউনি তে ৮। এবার সীমান্ত লাগোয়া উরির কাঁটাতার ঘেঁষে সারিবদ্ধ ১৮টা রাষ্ট্রায়ত্ত লাশ। অ্যান্ড দা লিস্ট গোস অন। অ্যান্ড অন...
ক্রোধোন্মত্ত দেশবাসীর ঘৃণার বারুদে অগ্নি সংযোগে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায় অবিশ্বাস্য তৎপরতায় হাজির ভারত-পাকিস্তানের সমরসজ্জার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিসংখ্যান। পরমাণু অস্ত্র, ক্ষেপণাস্ত্র, সামরিক বরাদ্দ, সাবমেরিন, ডেস্ট্রয়ার, ট্যাঙ্কারের ধারে-ভারে কয়েকশ যোজন এগিয়ে 'হিন্দুস্থান'। বিজেপি প্রেসিডেন্ট রাম মাধবের টুইট 'দরকারে একটা দাঁতের জন্য গোটা চোয়াল উপড়ে নিতে হবে'। তর্কপ্রিয় অর্ণব গোস্বামীর শিশুসুলভ নিষ্পাপ প্রশ্ন "নেশন ওয়ান্টস টু নো, হোয়াই নট কোভার্ট অপারেশন?" রিটায়ার্ড আর্মি চিফ জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরী বলছেন 'ফিদায়ীন' বানিয়েই বদলা নিতে হবে।

আরবি শব্দ ফিদায়ীন' অর্থে 'সুইসাইড বোম্বার।' ৭১'র বদলা নিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর দ্বৈত সামরিক 'মাস্টার প্ল্যানের' একটা ছিল এই 'ফিদায়ীন' গ্ৰুপ তৈরি। পরে নয়ের দশকে বেনজির ভুট্টোর ক্যাবিনেটের 'কিং মেকার' নাসিরুল্লা বাবরের সতর্ক নজরদারি তে এই ফিদায়ীন সংশ্লেষিত 'আফগান সেলের' কড়া তত্ত্বাবধানেই ভূমিষ্ঠ হয় সর্বজন নিন্দিত 'তালিবান'। তাহলে কি 'ফিদায়ীন' থেকে 'ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন' তৈরির ঐ বিপজ্জনক পথেরই পথিক হব আমরা? শহীদ জওয়ান'দের বলিদানের মূল্য চোকাতে, আরও কিছু নাগরিক'দের হাড়িকাঠে চড়াব আমরা? কাদের সঙ্গে যুদ্ধ আমাদের? ১৬ আনা উচ্ছন্নে যাওয়া ইসলাম মৌলবাদী আর উগ্র দেশপ্রেমের বিষবৃক্ষ বুকে বয়ে বেড়ানো পাকিস্তানের সাথে? না নিজেদের সাথে? পরমাণু বিধ্বস্ত লাহোরের রক্ত ৩০ কিলোমিটার দূরে অমৃতসরের রাস্তায় বইবে না? বন্দর শহর করাচির বারুদের গন্ধ কচ্ছের রণের বাতাসে মিশবে না? বর্তমানে যুদ্ধের আনুমানিক খরচ ৫ হাজার কোটি/দিন এক পাক্ষিক কালের যুদ্ধে দেশের রাজকোষ ঘাটতি এক লাফে বেড়ে হতে পারে ৮ লক্ষ কোটি। ২০০ টাকা/কেজি ডালের দেশে যুদ্ধের এই বিপুল খরচ বইবে কোন গৌরী সেন?
এন.এই.এ'র তদন্তে আশঙ্কা সেনা ছাউনির ভৌগলিক নকশার সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল জঙ্গি'দের কাছে। খবর ছিল, ১০ডোগরা রেজিমেন্টের কাছ থেকে বিহার রেজিমেন্টের রুটিন দায়িত্ব হস্তান্তরেরও। হাই সিকিউরিটি জোনের কাঁটাতার দু-জায়গায় কেটে, ১৫০ মিটারের উন্মুক্ত অঞ্চল আর সেনা পাহারার নিশ্ছিদ্র বলয় পেরিয়ে, ৪ জঙ্গি নিশ্চিন্তে পৌঁছে গেলেন  একেবারে অলিন্দে। যে জওয়ানরা সিয়াচেনের বরফে জমে দেশ আগলায়, যে জওয়ানরা ঘরের খেয়ে সারাজীবন বনের মোষ তাড়ানোর হিম্মত দেখায়, যে জওয়ানরা রাষ্ট্রসংঘ বোঝে না, সার্কের গোল টেবিলে বৈঠক করে না, তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে এতো অবহেলা? যুদ্ধ যদি করতেই হয় তাহলে যে গঠনতন্ত্রের আমলারা কূটনীতির জটিল অঙ্ক কষতে গিয়ে শহীদের নিরাপত্তা দেবার সরল পাটীগণিতের গুন-ভাগে ভুল করেন সেই গঠনতন্ত্রের বিরুদ্ধেই করুন। যুদ্ধ যদি করতেই হয় তাহলে, যে নেতা-মন্ত্রীরা অশ্রুস্নাত জওয়ান'দের কফিন নিয়ে কেলেঙ্কারি করেন তাঁদের বিরুদ্ধেই করুন।    
গত আড়াই মাসে কাশ্মীরে লাগাতার কারফিউ আর জঙ্গি আন্দোলনের শাঁখের করাত সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় শ্রীনগরের 'সন্ত্রাস দমনে'র তথ্য পরিবেশনকারী মাল্টি এজেন্সি সেন্টার। গত দু-মাসে এল.ও.সি বরাবর অনুপ্রবেশর নির্দিষ্ট তথ্যই নেই গোয়েন্দা বিভাগের কাছে। গত কয়েক সপ্তাহে কাশ্মীরে আত্মগোপন করেছে কয়েকশ যুবক। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দয়া করে, পরিসংখ্যানের কচকচানিটা বুঝুন। চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়া নিতান্তই নাবালোকচিত। কাশ্মীর আমাদের পর নয়। পেলেট বিদ্ধ ১১ বছরের কাশ্মীরের আপেল রাঙা ছেলেটাও সন্ত্রাসবাদী নয়। রক্তে ভেজা কাশ্মীরের ইতিহাস সে কথা বলে না।

১৯৪৭-৪৮'এ কাশ্মীরের দখলদারি নিতে আসা পাকিস্তানের হানাদারের ভাগিয়ে দিয়েছিলো কাশ্মীরের সাধারণ মানুষরাই। ১৯৬৫ তে আয়ুব খানের 'অপারেশন জিব্রালটার' ৪০ হাজার অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল আজকের পেলেট বিদ্ধ কাশ্মীরিদের পূর্বসূরিরাই।    

সুব্রহ্মণ্যম স্বামী ১০ কোটি ভারতীয় কে পাকিস্তানের সাথে পরমাণু যুদ্ধে আত্মত্যাগের জন্য তৈরি থাকতে বলেছেন। তা ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী জী, ১০ কোটির একজন হতে, আপনার ক্যাবিনেটের গবু মন্ত্রীরা তৈরি তো? আপনার সঙ্ঘ পরিবারের মোড়লরা তৈরি তো? আপনি নিজে তৈরি তো? এই তো সেদিনও আপনি জওয়ান মরলেই 'দুর্বল দিল্লী' সরকার বিরুদ্ধে টুইটারে ঝড় তুলতেন, মিতভাষী মনমোহন সিং কে ব্যাঙ্গ করে পাড়ার রকের মস্তানের মত রংচটা বিবৃতি দিতেন। মৃত সৈনিকের লাশের সওয়ার হয়ে দিল্লীর মসনদ দখলের স্বপ্ন দেখতেন। অথচ দেখুন, সেই আপনিই আজ বাজপেয়ী-মনমোহন পথে হেঁটে 'কূটনৈতিক মোকাবিলার' কথা বলছেন। আজ আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তান কে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন। জিও-পলিটিকাল স্ট্র্যাটেজির অজুহাতে শ্যাম আঙ্কল'দের বাধ্য ছেলের মত, ওয়াশিংটনের 'ধরি মাছ না ছুঁই পানির বিবৃতি' মুখ বুঝেই সহ্য করছেন। তা বেশ! তাই না হয় করুন। আজ না হয়, পেলেট আর পাল্টা ইট বৃষ্টির মৃত্যু মিছিলে লাগাম টানুন, আজ না হয়, কাশ্মীরী'দের আস্থা অর্জন করে পাকিস্তানের মুখে জব্বর একটা ঝামাই ঘষুন, আজ না হয় কাশ্মীরে সকলের সাথে কথা বলে শান্তি ফিরিয়ে আনুন, আজ না হয় আপনার ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে সীমান্তের জওয়ান'দের আগলে রাখুন। দোহাই আপনাকে, আজ না হয় একবার, প্রথমবার, কথাটা কম, আর কাজটা একটু বেশীই করুন।

বৃহস্পতিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

কাশ্মীর ~ অবীন দত্তগুপ্ত

​কুনান পোশপারা কাশ্মীরের একটি জায়গার নাম । কুনান পোশপারা ভারতের একটি জায়গার নাম । কুনান পোশপারা এমন একটি জায়গার নাম , যার প্রতিটি বাড়িতে ১৮ থেকে ৫৮ অব্দি প্রত্যেকটি মেয়ে ধর্ষিতা ।

পলিটিকাল কারেক্টনেস্‌ অনেক কিছুই লিখতে দেয় না । কাশ্মীর ভারতের অংশ হয়েছিল অটোনমির আশ্বাস পেয়ে । কথা ছিল , কাশ্মীরের জাতিয় সঙ্গিতটাও নিজস্ব হবে । সেই অনুযায়ী রচিত ভারতের সংবিধানের আরটিকাল নম্বর ৩৭০ । এলাস্‌, প্রতিটি সরকার এসেছে , কাশ্মীর একটু একটু করে নিজের স্বাধীনতা হারিয়েছে । যা যা কথা দেওয়া হয়েছিল ,একটি কথাও রাখা হয়নি । এর বিরুদ্ধে যখন বিদ্রোহ তৈরি হয়েছে , তখন আফস্পা নামের একটা ভয়ঙ্কর আইন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে । চারদিকে বন্দুক । গুম-খুন-ধর্ষণ । ভাবুন তো কোন টানে , স্ত্রীয়ের শরীরের উষ্ণতা ছেড়ে এক মধ্য বয়সী যুবক , ঠান্ডা বন্দুকে উষ্ণতা খুঁজে পায় ?? কখন পায় ?? আপনি বলবেন "জিহাদ।" মনে রাখবেন , জম্মুতে যখন রক্তের হোলি খেলা হচ্ছে ৪৭-এ , বিশাল একতরফা দাঙ্গায় খুন হচ্ছেন ওখানকার মুসলমান মানুষ - তখন কাশ্মীর ছিল সম্পূর্ণ শান্ত । মুসলমান মৌলবাদিরা এরজন্য কাশ্মীরকে গালি দিতেন - প্যান মুসলমান ঐক্যে কাশ্মীরিরা বেমানান । তাই জিহাদ্‌ কথাটা ঠিক খাটবে না । একটা নির্যাতিত জনজাতি , যখন যার উপর ভরসা করেছে সেই তখন পিঠে ছুড়ি বসিয়ে দিয়েছে । অতএব বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে । এর সুযোগ নিয়েছে সিমান্তের ওপারের শকুনেরা ।

গরিব বাড়ির ছেলেদের ,যাদের চাষে দিন চলে না (অতএব আর্মি) , হাতে বন্দুক ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন আগ্নেয়গিরির সামনে । ১৭ জন খুন হলেন । আপনি ৫৬ ইঞ্চির তান্ত্রিক ১৭টা মৃতদেহ পেলেন । সামনেই উত্তরপ্রদেশ - গুজরাটের নির্বাচন । লাগাও যুদ্ধ । ঘুরাও চাকতি ।

আচ্ছা , আপনি আপনি আপনি , আপনারা সকলেই মনে করেন কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্দ অংশ । তা এই এক মাসে , যে ৮০ জন খুন হয়ে গেল , আজকে যে বাচ্চাটা (১১ বছরের) মাথার চুল উপড়ে নিয়ে , ৪০০টা পেলেট গায়ে গেথে মরে গেল , তারা ভারতীয় নন ? কুনান পোশপারায় প্রতিটি বাড়িতে থাকা ,প্রতিটি নারী ভারতীয় নারী নন ? কাশ্মীরের কেউ নিজেদের কথা আপনাদের বলতে পারছেন না । কাশ্মীরে গুগুল -ইউটিউব- ফেসবুক ব্যানড্‌ । আপনার দেশের অবিচ্ছেদ্দ অংশের মানুষ কেন আপনার থেকে কম সুবিধে পাবে ? কেন তার সংবিধান প্রদত্ত মিনিমাম রাইট টূ ইনফোরমেশন থাকবে না ?

আচ্ছা আরেকটু সহজ করে দি । হিন্দি সিনেমার মতো সহজ । কানেক্ট করতে সুবিধে হবে ।হায়দার সিনেমাটা দেখেছেন তো । টাবুকে দেখেছেন । টাবুর সারা মুখে ছড়িয়ে থাকা যন্ত্রণা ? দেখেছেন ? সবাই টাবুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল । ছেলেটা পর্যন্ত ,অতো সাধের ছেলেটা পর্যন্ত আগন্তুক হয়ে গেল । কেউ কথা রাখে নি । বিশ্বাসঘাতক আপনজনের ছোড়ায় ক্ষতবিক্ষত , সারাটা জীবন বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়া ,শেষে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া 'টাব্বু' কাশ্মীরের পারসনিফিকেশন - ধরে নিন, টাব্বুই কাশ্মীর ।​

বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আইফোন ~ আশিস দাস

আইফোন ৭ লঞ্চ হল কদিন আগে। নতুন ফিচারস আদৌ কিছু এল কিনা সেটা তর্ক সাপেক্ষ। উপরন্তু একটু মোবাইল নিয়ে নাড়াঘাটা করা লোকজন মাত্রেই মানবেন আইফোনের অর্ধেকেরও কম দামে অ্যান্ড্রয়েডের অনেক ফোন রয়েছে একই বা আরো ভাল স্পেসিফিকেশনে। আসলে কোল্ডপ্লে কনসার্ট, আকাশ ছোঁয়া দাম আর চতুর ব্র‍্যান্ডিং দ্বারা এই ফোনকে ঘিরে বহুবছর ধরেই একটা এক্সক্লুসিভিটির মোহজাল তৈরী করা হয়েছে। কোম্পানির ক্যাচলাইন সেই জন্যই "ইফ ইউ ডোন্ট হ্যাভ অ্যান আইফোন, ইউ ডোন্ট হ্যাভ অ্যান আইফোন"! আমি সিওর আইফোনের ওই জ্বলজ্বলে আপেলের লোগো বাদ দিয়ে কাল যদি একই স্পেসিফিকেশনের একটা ফোন আনে অ্যাপল, বেশিরভাগ গ্রাহক সেটা কিনবেন না, দাম আদ্ধেক করে দিলেও না। তবুও হুজুগে ক্রেতার আদেখলামো শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই গোটা বিশ্বজুড়ে, বিশেষত আমেরিকায়।

যাইহোক আইফোন কতটা ওভাররেটেড বা এর প্রযুক্তিগত দিক নিয়ে আলোচনা করার জন্য এই পোস্টের অবতারণা করিনি। বরং এক একট ঝকঝকে স্লিম আইফোনের পিছনে কতটা কালো দাগ লেগে থাকে সেই ব্যাপারেই দুকথা বলার ছিল। আশা করি অনেকেই জানেন যে আইফোনের ডিজাইন আমেরিকান হলেও ফোন বানানো অর্থাৎ অ্যাসেম্বলিং এর কাজ হয় চিনেই। সেটা অস্বাভাবিক না, কারণ বেশিরভাগ বড় কোম্পানির ফোনই আজকান মেড ইন চায়না। কিন্তু কেন? সেটা ভেবে দেখেছেন? আসুন সেটাই নাহয় একটু বিশদে দেখা যাক।

চিনে আইফোন অ্যাসেম্বল করার মোটামুটি তিনটে বড় কোম্পানি আছে যারা ঠিকাচুক্তি ভিত্তিতে অ্যাপলের সাথে কাজ করে। ফক্সকন, পেগাট্রন এবং উইসট্রন। এর মধ্যে সবথেকে বড় এবং বিখ্যাত (নাকি কুখ্যাত?) কোম্পানি হল ফক্সকন। ফক্সকন আন্তর্জাতিক মহলে সাড়া ফেলে দেয় ২০১০ সালে যখন কারখানার ১৮ জন শ্রমিক আত্মহত্যার চেষ্টা করে। হ্যাঁ তাদের মধ্যে ১৪ জন সফলও হয়। যাইহোক এরপর অবশ্যই ফক্সকন দ্রুত ব্যবস্থা নেয় এরকম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি আটকাতে। কি ব্যবস্থা? উমম.. কারখানার চারদিকে বড়বড় জাল লাগানো হয় যাতে আর কেউ ঝাঁপ না দিতে পারে..!! ও হ্যাঁ, সেইবছরই ফক্সকনের লোংঘুয়া ফ্যাক্টরিতে দিনে গড়ে ১৩৭০০০ আইফোন বানানো হয়। মানে মিনিটে ৯০টা! সেই ১৮জন শ্রমিকের মধ্যে ছিল ১৭ বছরের কিশোরী টি-আন ইউ, যে ৪ তলার ডর্মিটরি থেকে ঝাঁপ দিয়েও (দুর্ভাগ্যক্রমে?) বেঁচে যায় এবং কোমরের নীচ থেকে প্যারালাইজড হয়ে পড়ে। তার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতি শ্রমিককে সপ্তাহে ৬ দিন নামমাত্র মজুরীতে দিনে ১২ ঘন্টা খাটতে হত। দিন এবং রাত্রি উভয় শিফটেই। আর সাথে বরাদ্দ ছিল একটি ঘুপচি ডর্মিটরি ঘর ৮জন গাদাগাদি করে থাকার জন্য! এসব ঘটনা প্রকাশে আসার পর অবশ্য অ্যাপল একটু নড়েচড়ে বসে। চাইনিজ শ্রমিকদের ভাল থাকার প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি প্রভৃতি সমেত ঝলমলে পুস্তিকা ছাপানো হয়। অ্যাপলের বিভিন্ন ইভেন্টে বিলিও করা হয়। ব্যাস। এই অবদিই। কারণ আগের বছরই চায়না লেবার ওয়াচ নামের আমেরিকান এনজিও-এর করা রিসার্চে দেখা যায় কিভাবে শ্রমিকদের উপর অমানুষিক শোষণ এখনো অব্যাহত রয়েছে। আইফোনের আরেক অ্যাসেম্বলার পেগাট্রনের উপর করা গোপন রিসার্চে উঠে এসেছে অকল্পনীয় সব তথ্য। পেগাট্রনে একজন চাইনিজ শ্রমিক সপ্তাহে ৬দিন, দিনে ১২ ঘন্টা কাজ করেন - যার মধ্যে দৈনিক ১.৫ ঘন্টা আবার আনপেইড লেবার! প্রতি শ্রমিক দিনের পুরো সময় দাঁড়িয়ে কাজ করেন! এবং প্রতি ৩.৭৫ সেকেন্ডে একটা আইফোনে মাদার বোর্ডের কাজ শেষ করতে হয়! গত বছর সাংঘাইতে নূন্যতম শ্রমিক মজুরি বাড়ানো হয়েছিল। তাই পেগাট্রন কতৃপক্ষ শ্রমিকের চিকিৎসা বিমার টাকা ছেঁটে ব্যাপারটা ব্যালান্স করে দেন। নিখুঁত কি বলেন? উইসট্রন নামের অন্য কন্ট্রাকটরের উপর ড্যানিশ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ড্যানওয়াচের রিপোর্টে জানা যায় তারা ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহার করে কম খরচে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য। স্থানীয় স্কুল এবং কলেজের ছাত্রছাত্রীদের বাধ্যতামূলক ভাবে মাসের পর মাস কারখানায় একজন সাধারণ শ্রমিকের মতই হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়, কিন্তু অনেক কম পারিশ্রমিকে। ড্যানওয়াচকে এক ১৯ বছরের ছাত্রী জানান, এই কারখানায় কাজে স্বেচ্ছায় রাজী নাহলে কলেজ থেকে ডিগ্রী না দেবার হুমকিও দেওয়া হয়!

তাহলে ব্যাপারটা যা দাঁড়াল শ্রমিকদের ঘন্টা প্রতি মাত্র ১.৬ ডলার দিয়ে আমাদের ৭০০০০ টাকায় ফোন বেচে অ্যাপল মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলছে। শুধু গতবছরেই তাদের লাভ ছিল ৪৭ বিলিয়ন ডলার। মোট সম্পদের দিক থেকে (২৩১ বিলিয়ন ডলার) অ্যাপল আমেরিকার সরকারের থেকেও ধনী! তবুও তারা শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরিটুকু দিতে নারাজ। শ্রমিকদের শোষণ করা আর ক্রেতাদের টুপি পরানো - এই মোটামুটি অ্যাপলের বিজনেস মডেল! এবার আপনি ভেবে দেখুন। পরেরবার সদ্য কেনা আইফোনে সেল্ফি তোলার সময় ১৭ বছরের কিশোরীর ছাদ থেকে ঝাঁপ দেওয়া স্ক্রিনে ভেসে উঠবে না তো? কিংবা আইপ্যাড বা আইপডে গান শোনার সময় কানে ১২ ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ শ্রমিকের হাঁপানির শব্দ কানে আসবে না তো? টাকা আপনার। আপনি সেটা অ্যাপলের গগনচুম্বী মুনাফার পাহাড়ে যোগ করে সেই পাহাড়ের তলায় লাখ লাখ শ্রমিককে পিষে মারবেন কিনা সেই সিদ্ধান্তও আপনার। একেবারেই আপনার।

ঋণস্বীকার : দ্যা গার্ডিয়ানে প্রকাশিত আদিত্য চক্রবর্তীর প্রবন্ধ।

শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মোক্যাম্বো ~ উৎসব গুহ ঠাকুরতা

মোক্যাম্বোতে মনীশ ভাইয়ার অপমানের ঘটনার পর সারা শহর রাগে ফুসেছে, ফেসবুকে গালাগালি করে গায়ের ঝাল মিটিয়েছে, বয়কট মোক্যাম্বো নামে বেশ কয়েকটা ফেসবুক গ্রুপ শুরু হয়ে গেছে, মোক্যাম্বোর সামনে ইতিমধ্যেই একটা ধর্না হয়ে গেছে, আগামী শনিবার আরেকটা হবে, শহরের এক সাংবাদিক একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারকে নিয়ে মোক্যাম্বোতে খেয়ে এসে তার প্রতিবাদ নথিভুক্ত করেছে। এবার আসুন তো বস, একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবি, এই রাগটা আসলে কি নিয়ে?

মোক্যাম্বো যেটা করেছে তাকে আমরা বলি 'এক্সক্লুসিভিটি'। অর্থাৎ তারা এমন একটা অভিজ্ঞতাকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করছে যা 'এক্সক্লুসিভ', সবার জন্যে নয়। মনীশ ভাইয়া মোক্যাম্বোতে খেতে গেছিলো, ইয়ে মানে, মনীশ ভাইয়া মোক্যাম্বোতে খেতে যাবে কি করে? অত ট্যাকের জোর তো তার নেই। তাকে নিয়ে গেছিলেন তার গাড়ির প্যাসেঞ্জার একজন উচ্চমধ্যবিত্ত মহিলা। তিনি না নিয়ে গেলে, মনীশ ভাইয়া বাপের জন্মে মোক্যাম্বোতে খাওয়ার কথা ভাবতো না। এটা তো শুধু মোক্যাম্বোর গল্প না বস। চারিদিকে তো সবকিছুই এরকম 'এক্সক্লুসিভ'। বাজারে মাছ আর সব্জির দাম এক্সক্লুসিভ, সবার জন্যে নয়। উচ্চশিক্ষা এক্সক্লুসিভ, সবার জন্যে নয়। ক্যাফে কফি ডে তে কফির পেয়ালা এক্সক্লুসিভ, সরকারের হিসেব অনুযায়ী একটি পরিবারের এক সপ্তাহের খাওয়ার খরচ উঠে আসবে তার থেকে। সাউথ সিটি মলের বাইরে জয় ইঞ্জিনিয়ারিং এর শ্রমিক দাঁড়িয়ে থাকলে তার জন্যে কতৃপক্ষ কে ব্রিটিশদের মতন গোদা ভাবে 'কুকুর আর ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ' জাতীয় বোর্ড লাগাতে হয় না। মলের দোকানে দ্রব্যমূল্যের প্রাইস ট্যাগ সেই বোর্ডের কাজ করে। স্কুলে ভর্তির সময় কতৃপক্ষ যখন বাচ্চার বাবা মায়ের স্যালারি স্লিপ চায় এপ্লিকেশন ফর্মের সাথে তখন আপনারা রেগে যান না কেন বস? শহরের নামী ক্লাবে মেম্বার হতে গেলে এপ্লিকেশনের সাথে যখন গত ৫ বছরের ইনকাম হিস্টরি দেখাতে হয় তখন রাগ থাকে কোথায়? আমাদের প্রতিদিনের জীবনের প্রতিটা মুহুর্তই তো 'এক্সক্লুসিভ'। শহরের ধনী পাড়া,বস্তি, খেলার মাঠ, কমপ্লেক্স, মল, রেস্তোরাঁ, এমনকি সংস্কৃতিও তো এক্সক্লুসিভ। শ্রেনী, বস, শ্রেনী। শ্রেনীকে অস্বীকার করবে কে? শ্রেনী সত্য, শ্রেনীসত্যই সত্য, এবং তাই এক্সক্লুসিভিটিও সত্য। এই যে দেশে চারিদিকে ধর্ম এবং জাতপাতের ডিসক্রিমিনেশন কে শেষ করতে সমস্ত সচেতন নাগরিক উঠেপড়ে লেগেছে, সবচেয়ে বড় ডিসক্রিমিনেশন তো শ্রেনীবিভক্ত সমাজ। তা সেসব নিয়ে কিছু করবার কথা ভাবছেন নাকি বস? ধুর, জানি তো, ওসব পুরনো বস্তাপচা মাথা আলুর চপ করা ভাবনা ঠিক ফ্যাসনবেল না। খাটুনিও প্রচুর। তারওপরে টিআরপি নেই। মানে জাতপাত কে অস্বীকার করে এগিয়ে চলো বলে স্লোগান দিন, ধর্ম মানি না বলে স্লোগান দিন, সচেতন নাগরিক এবং মিডিয়া বাহবা বলে এগিয়ে আসবে। এবার বলুন শ্রেনীবিভক্ত সমাজ মানি না, উৎপাদন প্রক্রিয়ার মালিকানার সামাজিকরন করো, মিডিয়া পেছনে ঝ্যাটা নিয়ে তাড়া করবে, নাগরিক সমাজ পাভলভে ভর্তি করবার জন্যে চাদা তুলতে মিছিল করবে।

(জিগনেশ মেওয়ানি নামক এক দলিত নেতা বলেছে - দলিতদের সামাজিক স্বীকৃতি দিতে হলে আগে জমি দাও, ব্যাস, আপাতত পুলিশ লকাপে তুলে নিয়ে রেখে দিয়েছে।)

তাহলে আপনি হঠাত মোক্যাম্বোর কেসে এত রেগে গেলেন কেন? আসলে আপনি রেগেছেন অন্য কারনে। মুক্ত বাজার আর পুঁজিবাদ আপনাকে প্রমিস করেছিলো যে ট্যাকে পয়সা থাকলে সব কেনা যায়। আর আমরা তো জানি, ঠিকঠাক মেধা, বুদ্ধি এবং অধ্যবসায় থাকলে আমরা যে কেউ আম্বানি হতে পারতাম। পুঁজিবাদ আমাদের শিখিয়েছে, অসংখ্য র‍্যাগস টু রিচেস স্টোরির মাধ্যমে, তা ধীরুভাই আম্বানির বাস্তব ইতিহাস হোক, বা 'দ্য পারসুইট অফ হ্যাপিনেস' নামক সিনেমা হোক, শিখিয়েছে যে খাটো, খাটো, খাটো, এবং পৃথিবী তোমার মুঠোর মধ্যে। আমরা কেউই আসলে গরীব না, নিম্নমধ্যবিত্ত না, সবাই ধনী হওয়ার পথে বিভিন্ন দুরত্ব অতিক্রম করেছি মাত্র। মানি স্পিক্স - ফ্রী মার্কেটের মূলমন্ত্র, যা আমরা অমোঘ সত্য বলে মানি (হ্যা সবাই মানি, ওই যে মালগুলো লাল ঝান্ডা নিয়ে ডাউন ডাউন ক্যাপিটালিজম বলে, তারাও জানে না তারা কখন এটা মেনে নিয়েছে), সেই সত্যকে এক নিমেষে ঢপের চপ প্রতিপন্ন করে দিয়েছে মোক্যাম্বো, এবং এখানেই আমাদের রাগ। অবিশ্বাস, হতাশা, অক্ষোমের ক্রোধ। পুরো বিলা কেস তো বস। তাহলে ব্যাপারটা কি? আরে ওই যে আরও কয়েকটা গাঁঁড়ল কিসব বলে - আধা সামন্ততান্ত্রিক-আধা পুঁজিবাদী - কিসব ভাট, কে জানে, ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না।

তাই ভেবে দেখলাম, মোক্যাম্বো 'রাইট অফ এডমিশন রিজার্ভড' বোর্ড লটকে বেশ সৎ কাজ করেছে, কারন আপাতত পৃথিবীজুড়ে যে নৈশভোজ চলছে, তাতে ৯০% মানুষের ক্ষেত্রে 'রাইট অফ এডমিশন রিজার্ভড' - খালি বোর্ডটা লটকানো নেই।

শুক্রবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

বং ~ সুশোভন পাত্র

- হু ওয়াজ নজরুল মামমাম?
- সাচ অ্যা শেম তাতাই! ইউ ডোন্ট ইভেন নো নজরুল তাতাই? হি ওয়াজে গ্রেট বেঙ্গলি পোয়েট, রাইটার অ্যান্ড মিউজিসিয়ান। উই অল রেড হিস পোয়েম ইন আওয়ার চাইল্ডহুড।
দিল্লী মেট্রো তে আড়ি পেতে শোনা এই কথোপকথনের মত, গত পাঁচ বছরে আরও গণ্ডা খানেক উদাহরণে ঋদ্ধ হয়ে নিশ্চিত হয়েছি যে, দিল্লীর কনটেম্পোরারি বাঙালি বাপ-মা'রা কদাচিৎ ব্যতিক্রম ছাড়া আর ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন না। আজকাল তো শুনছি কলকাতাতেও বলেন না।
গ্লোবালাইজেশনের দুনিয়ায় ক্লাস টু'র বাচ্চা'দের ইংরেজিতে ঢেকুর তোলাটাও নাকি আবশ্যিক। আমরা নেহাতই ওল্ড ফ্যাশানড তাই ক্লাস এইটে প্যাসিভ ভয়েস কে অ্যাক্টিভ করলে ইংরেজি মাস্টার ভালোবেসে একটা চুইনগাম চিবোতে দিতেন। আবেশের বন্ধুদের ইন্টার্ভিউ দেখতে গিয়ে খেয়াল করলাম, কি ঝরঝরে ইংরেজি। কি কেতাদুরস্ত উচ্চারণভঙ্গি। মুখ ফসকেও একটা বাংলা বেরল না। এরা আমার-আপনার মত সাদামাটা বাঙালি নয়, এরা 'বং'। কলোনিয়াল কালচারের সম্পৃক্ততায় মাতৃভাষা কে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার প্রবল চেষ্টা এই 'বং জেনারেশনে'র ট্রেন্ডিং ফ্যাশন। আর অযথা আমেরিকান এসেন্টে ইংরেজি বলাটা এলিটিজম।

যে ধরনের এলিটিজম আপনি ধরবো ধরবো করবেন কিন্তু ধরতে পারবেন না সেটা 'সোশ্যাল স্ট্যাটাস'। যেমন ধরুন, আইফোন সেভেন। কিম্বা ধরুন, মহারাষ্ট্রের বিজেপি বিধায়কের বৌ'কে জন্মদিনে গিফট করা ৩.৫ কোটির ল্যাম্বোরগিনির গাড়ি। আবার যে ধরনের এলিটিজম আপনার কষ্টকল্পনা'তেও বিলাসিতা সেটা হল 'গ্ল্যামার'। যেমন ধরুন, ফিতুর সিনেমায় চিনার পাতার রঙে ক্যাটরিনা কাইফের চুল রাঙিয়ে দিতে ৫৫ লাখের বাজেট। কিম্বা বিরাট কোহলির প্রতিদিনের ১০ লক্ষ টাকার প্যাকেজ। এই 'সোশ্যাল স্ট্যাটাস' আর 'গ্ল্যামার'র ককটেল যদি সময় মত বগল দাবা করতে পারেন তাহলে আপনি 'সেলিব্রেটি'। আর এদেশের সেলিব্রেটি সত্ত্বা হল দায়িত্ব-কর্তব্য, আইন-প্রশাসন -সবকিছু ফাঁকি দেবার এলিটিজম।   

সংসদের দু-কক্ষ মিলিয়ে সাংসদ'দের উপস্থিতির গড় ৮০.৫%। আর সেলিব্রেটি সাংসদ'দের কিরণ খের ছাড়া বাকি সবার উপস্থিত ৭৫%'র কম। গত চার বছরে অভিনেত্রী রেখার রাজ্যসভায় উপস্থিতি ৫%। বিতর্কে অংশগ্রহণ শূন্য। প্রশ্ন উত্থাপনও শূন্য। এম.এল.এ ফাটাকেষ্টর রুপালি পর্দায় ডায়লগ বাজি করে সততার রুশ বিপ্লব নামিয়ে ফেলা মিঠুন চক্রবর্তীর উপস্থিতি ১০%। কেন্ট আরও'র বিজ্ঞাপনে গোটা দেশের মানুষকে বিশুদ্ধ জল সরবরাহকারী হেমা মালিনীর উপস্থিতি ৩৭%।

'ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান' নিয়ে দেব লোকসভাতে বাংলায় মুখ খুলেছেন ঐ একবারই। আর তাতেই ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি রোমন্থনের সাব-অলট্রানিসমের আবেগে ধুয়ে গেছে তাঁর মুখে লেগে থাকা লোকসভায় মাত্র ৯% উপস্থিতি'র চুনকালি। সংসদে এনারা সাবডিসাইজড ক্যান্টিনে খাবার খেতে আর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে হাই তুলতে মোট দুবার মুখ খুললেও, আমাদের ট্যাক্সের টাকা চটকে, মাসের শেষে সাংসদ হবার সমস্ত সুযোগ সুবিধা উদরস্থ করতে কোন কসুরই করেন না। আসলে এদেশে সেলিব্রেটি'দের সাংসদ হওয়া তে কোন দায়বদ্ধতা নেই। আছে একধরনের এলিটিজম। সংসদীয় এলিটিজম। 

'ভারতরত্ন' লতা মঙ্গেশকার ২০০১'এ মুম্বাইয়ের পেদ্দার রোডে তাঁর বিলাসবহুল বাড়ির উল্টো দিকে একটি ফ্লাইওভারের নির্মাণ পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে প্রয়োজনে দেশ ছেড়ে পাকাপাকি দুবাইয়ের বাসিন্দা হবার হুমকি দেন। তড়িঘড়ি ফ্লাইওভার নির্মাণ পরিকল্পনার স্থগিতাদেশ ঘোষণা করে মুম্বাই মিউনিসিপালিটি কর্পোরেশন। আজ অবধি আর শুরু হয়নি সে নির্মাণ। আরেক 'ভারতরত্ন'শচীন তেন্ডুলকার ২০০৩'এ ডন ব্র্যাডম্যানের ২৯'টি সেঞ্চুরির রেকর্ড টপকে মাইকেল শুম্যাখার উপহার ইটালিয়ান ফেরারী স্পোর্টস কারের ১.১৩ কোটি টাকা আমদানি শুল্ক ছাড় দেবার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করেন। ২০১১'তে বান্দ্রার ৮০ কোটির অট্টালিকায় আইন বহিৰ্ভূত নির্মাণের অভিযোগ ওঠে লিটিল-মাস্টারের বিরুদ্ধে। কিছুদিন আগেও মুসৌরি তে DRDO'র নো-কন্সট্রাকশন জোনে বিজনেস পার্টনার সঞ্জয় নারঙ্গর বিরুদ্ধে যে বে-আইনি নির্মাণের অভিযোগ উঠেছিলো, শচীন নিজে মনোহর পারিকরের সাথে দেখা করে তার মধ্যস্থতা করেন। আসলে এদেশের ম্যাচো ম্যানরা থাম্পস আপের বোতলে তুফানি চুমুক দিয়ে হরিণ মেরে, ফুটপাতে গাড়ি চালান। রাতের অন্ধকারে, মানুষ মেরে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে নিঃসংকোচে ঘুড়ি ওড়ান। আর এদেশের মুন্নাভাই'রা ঘরে বে-আইনি অস্ত্র রাখার গুরুতর অপরাধ অভিযুক্ত হয়েও বরাদ্দ মেয়াদের আগেই জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। এলিটিজম কি আর শুধু মোকাম্বো'র রেস্টুরেন্টে? এলিটিজম তো এদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। 

মোকাম্বো'র ঘটনার প্রায় সমান্তরালেই পালিত হল 'ওনাম'। পৌরাণিক বিশ্বাসে মালায়ালি দলিত রাজা মহাবলীর রাজত্বে নাকি সবার ছিল সমানাধিকার, সব প্রজারা ছিলেন বেজায় খুশি। মহাবলীর প্রতিপত্তিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে, ছলে বলে কৌশলে তাঁকে পরাস্ত করে, তাঁকে নরকে পাঠিয়ে দেন বামনা অবতারে মর্ত্যে অবতীর্ণ বিষ্ণু। গোটা কেরালা যখন ওনাম উপলক্ষে এই মহাবলীর পুনরাবির্ভাব উদযাপনে ব্যস্ত, তখন বামনা অবতারের কল্পিত চিত্র টুইটারে পোস্ট করে 'বামনা জয়ন্তী' পালন করলেন বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ।  রাজনীতি ও ধর্মের সংমিশ্রণে শ্যামলা বর্ণের দলিত রাজার উপর গোরা ব্রাহ্মণ্যবাদের এলিটিজম।

আসলে এলিটিজম আমাদের রক্তে। সোশ্যাল মিডিয়া ঝড় তুলে আমার ভেতরের এলিটিজমের ভিসুভিয়াস'টাকে যদি চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া যেত, তো বেশ হত। জোমেটো তে রেটিং দিয়ে যদি দেশের সব এলিটিজম এক লহমায় ঝেড়ে ফেলা যেত, তো বেশ হত। কিন্তু কি করবেন বলুন, দিনের শেষে আমরাও তো 'ভদ্রলোক'। আমরা সকালবেলা আনন্দবাজার পড়ি। সন্ধ্যে বেলা অফিস ফেরত মায়ের বাতের ব্যথার ওষুধ কিনি। ফোর্ড আইকনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পরের দিনের ভাতের থালাতে পালং শাকের অপেক্ষা করি। তাই প্রাণহীন মোকাম্বো'ও এলিটিজম প্র্যাকটিস করে। তাই প্রাণহীন মোকাম্বোর স্টাফ হাউসের এলিটিজম নিশ্চিত করে। কারণ আমরাই এলিটিজম কে ধাওয়া করি। আমরাই এলিটিজম আগলে রাখি। আমরাই মনের মণিকোঠায় এলিটিজমের আকাঙ্ক্ষা কে সযত্নে লালন পালন করি ...

মঙ্গলবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

মোক্যাম্বো ~ সৌমিক দাশগুপ্ত

সে এক দিন ছেল। ট্রেনে করে দুর্গাপুর যেতুম। লোক্যালে লোক্যালে। হাওড়া বর্ধমান কর্ড লাইন ধরে দুনিয়ার আলবাল স্টেশন পেরিয়ে বর্ধমান। মেন লাইন হলে আধ ঘন্টা টাইম বেশী লাগত। সেখান থেকে পুরুলিয়া প্যাসেঞ্জার বা অমন কিছু একটা ধরে দুর্গাপুর। এর বেশী বিশেষ যাতায়াত হত না। পুরো রাস্তা জুড়ে আলট্রা প্রোলেতারিয়েত টাইপ কিছু পাবলিক, কিছু ডেইলি প্যাসেঞ্জার, কিছু হকার এর সাথে সহবাস করতে করতে। ভর দুপুরের ট্রেন আপন মনে ঘুচ ঘুচ করে চলত। দরজার কাছে কোন এক ক্ষ্যাপাচোদা টাইপ পাবলিক বসে ময়লা একটা লুঙ্গী বিপদসীমার উপরে তুলে ঘচর ঘচর করে বিচি ফিচি চুলকাতো। আর আমিও বেশ, দেখি দাদা, একটু সাইডে চেপে বসুন, গাঁড়টা ঠেকাই বলে টলে তিনটে সীটের চতুর্থ পাবলিক হয়ে পৌঁছে যেতাম।

ঝামেলাটা হল চাকরী পাবার পর। বেশ বুঝতে পারলাম, ন্যাহ বাঁড়া, পোষাচ্ছে না। বেশ কয়েকশো টাকা বেশী দিলে ঠান্ডা ঠান্ডা একটা কামরা পাওয়া যায়। তাতে হাই ব্লাড প্রেসারে ভোগা কিছু মাল চড়ে। হেব্বি চাম্পি টাইপ কিছু মামণি, উফফ, কি পেটি পাগলা। আর ট্রেনে উঠেই ল্যাপটপ খুলে একটা এক্সেল শীট নিয়ে চোয়াল শক্ত করে বসে থাকা বেশ কয়েকটা লোক। হেব্বি বিজি। এদের সাথে যাওয়াটা বেশ ভালো। বেশ কমফোর্টেবল ও। এখানে ভিখিরি নেই, হকার নেই, বাথরুমে হিসির গন্ধ নেই। বড়লোকদের হিসিতে গন্ধ থাকে না।

তা দেড় দশক কেটে গেল, নন এসি কামরা দেখলে কেমন যেন লাগে। লোক্যাল ট্রেনে চড়তে হবে ভাবলে ট্যাক্সিতে করে যাওয়া যায় কিনা চিন্তা আসে।

খলনায়ক দেখতে গেছিলাম, ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো, অশোকাতে। র‍্যান্ডাম ক্যালাকেলি করেছিলাম ডায়মন্ড হারবার রোডের উপর। হল এর গেট খুলতে দেরী হলে, কি রে খানকীর ছেলে, কতক্ষণ দাঁড়াবো বাঁড়া আর বলে চেল্লানো। এ ছাড়া প্রদীপ বা ভবানীতে গিয়ে মাঝে মধ্যে প্যায়াসী চুড়েইল বা জওয়ানি কি চুলকানি টাইপ ব্যাপার স্যাপার দেখে, হলের আলো আঁধারিতে প্যান্টের চেনটা আলতো করে নামিয়ে.....মানে যা যা হয় আর কি।

তারপর হটাত করেই উপলব্ধি, কিছু টাকা বেশী নেয় বটে, কিন্তু কেমন যেন মায়াবী জগত। ছোট্ট ছোট্ট হল, হেলানো সীট। সিটি ফিটি দেয় না তেমন কেউ। কুড়ি টাকার ভুট্টার খই দুশো টাকায় বেচে বটে, কিন্তু কি সুন্দর ইংরাজি বলে। ইয়োর অর্ডার স্যার, চিজি পপকর্ণ উইদ এক্সট্রা স্পাইস, টু হান্ড্রেড থার্টি, থ্যানক ইউ স্যার। শুনে কান জুড়িয়ে যায়। ও হ্যাঁ, ছোট প্লাস্টিকের গ্লাসে জল ও পাওয়া যায়। একদম ফ্রী। কোন শালা যায় ওই হলে, যেখানে পাশের সীটের লোকটার গা থেকে কেমন ছারপোকার মত গন্ধ ছাড়ছে।

ফাইন ডাইন দু হাজারেও হয় না আর। সেই নিভু নিভু রেস্তোরাঁ তে ওয়েটারকে যখন শ কিংবা দুশো টিপস দি, অথবা পঁচাশি টাকার বীয়র দুশো টাকায় কিনে আলতো চুমুক মারি, অথবা আড়াই তিন হাজারী পেমেন্ট স্লিপে খচাখচ সাইন মারি, মাইরী বলছি, সেই এস এন ব্যানার্জী রোডের ভাতের হোটেল আর আনোয়ার দার কথা মনে পড়ে না। অবিশ্বাস্য লাগবে, যদি আমার পাশের সোফাতে আনোয়ার দা কে গ্রীলড স্যামন এ ছুরি চালাতে দেখি। অবচেতন মন মানতে চাইবে না। সিসিডি তে প্রেমিকার সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে থাকার সময় আমি চাইবো না, আমার পাশে গুড়কের দোকানে ধারে চা বিড়ি খাওয়া রঞ্জু এসে বসুক। মানতেই পারবো না।

পয়সা দেকাচ্চো বাঁড়া? এলিটিজম? গাঁড়ে মোক্যাম্বো গুঁজে দেবো বাল।

রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

কানহাইয়া ও কারাত ~ পুরন্দর ভাট

জেএনইউর ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার প্রকাশ কারাটকে খোঁচা মেরেছেন কারণ কারাট বলেছেন যে বিজেপি ফ্যাসিস্ট শক্তি নয় এবং বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই কংগ্রেসের মতো দলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে করা যাবে না। কানহাইয়া তাতে বলেছেন যে লড়াই করার ইচ্ছে যদি না থাকে কারাট বাবু অবসর নিয়ে বিদেশে গিয়ে পড়ান। এরপর দেখছি কিছু সিপিএম কর্মী সমর্থক কানহাইয়াকে গালমন্দ করছেন। তা ভালো, ২৫ দিন জেল খেটে এসে বিজেপিকে ফ্যাসিস্ট বলা অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। কিন্তু প্রশ্নটা  কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলানোর নয়, প্রশ্নটা অনেক গভীর।

কানহাইয়া এবং সাবেকি কমিউনিস্টদের চিন্তাধারার মধ্যে একটা মূল তফাৎ আছে। কানহাইয়া যতখানি মার্ক্সবাদী ততখানিই আম্বেদকারবাদী, এটা সে বক্তৃতায়, লেখায়, বার বার বুঝিয়ে দিয়েছে। আর কানহাইয়া একা নন, উত্তর ভারতে বামপন্থী আন্দোলনের সাথে যুক্ত অধিকাংশ নেতা কর্মীর কাছে  সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ। কানহাইয়া তাই মনে করে যে আরএসএস বিজেপির বিরুদ্ধে সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে এক বৃহত্তর ঐক্য তৈরী করতে হবে, তাতে অবামপন্থীরাও থাকবে। আরএসএস যে উচ্চবর্ণের স্বার্থসিদ্ধি করার একটা সংগঠন এই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই কারণ বর্ণবাদ ব্যাতি রেখে হিন্দুত্ববাদ সম্ভব না, ওটা বাদ দিলে যা দাঁড়ায় তাকে বৌদ্ধ ধর্ম বলা যেতে পারে, চৈতন্যের বৈষ্ণব ধর্ম বলা যেতে পারে, বাউল অথবা সহজিয়া অথবা চার্বাক ধর্ম বলা যেতে পারে কিন্তু সনাতনী হিন্দু ধর্ম বলা যায় না। আরএসএস হিন্দুত্ব বলতে চৈতন্য বা বাউল বা চার্বাক বোঝে না, বোঝে সনাতন ধর্ম। তাই কানহাইয়া মনে করেন যে আরএসএস এর সিঁড়দাঁড়ার গাঁটগুলো একে একে খুলে ফেলতে হলে সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন গড়ে তোলাই সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র আর সেই আন্দোলনে হিন্দুত্ববাদ বিরোধী সমস্ত শক্তিকে একত্রিত করা দরকার।

এর উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে কারাটের মতো সাবেকি কমিউনিস্টরা মনে করেন যে আরএসএস কে হারাতে হলে শ্রমিক শ্রেণীর বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন, নব উদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীর একতা তৈরী করতে হবে এবং এই একতা ধর্ম, জাত পাতের উর্ধে উঠে গড়তে হবে। এই একতা তৈরী হলেই বড় পুঁজি আর পশ্চিমী  সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ বিজেপি-আরএসএস কে প্রতিরোধ করা সম্ভব। অর্থাৎ আরএসএস-এর হিন্দু ঐক্যর বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য। তাই কারাট বলছেন যে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনো বোঝাপড়া করে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়া যাবে না কারণ কংগ্রেস একই অর্থনৈতিক নীতির পক্ষে।

এই নিয়ে সন্দেহ নেই যে নব উদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে না লড়লে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব নয় কারণ ভারতে যে ধরণের পুঁজিবাদ আজকে বিরাজমান তা বর্ণবাদী শোষণ কমানো তো দূরে থাক বরং বাড়িয়েই চলেছে। তাই নব উদারবাদী নীতি সমর্থন করে যে সব রাজনৈতিক শক্তি তাদের সঙ্গে জোট করে সামাজিক ন্যায়ের লড়াই কোনোদিন ফলপ্রসূ হবে না।  আমার মনে হয় যে কানহাইয়াও তা অস্বীকার করেন না। কিন্তু প্রশ্নটা হলো যে গুরুত্ব কোনটিকে দেওয়া হবে? সামাজিক ন্যায়ের লড়াইকে না কি নব উদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে শ্রেণী আন্দোলনকে? এই প্রশ্নটা কিন্তু প্রাসঙ্গিক, এই জন্যে যে দ্বিতীয়টাকে যখনই মূল লক্ষ্য বলে স্থির করবো তখনই স্বাভাবিকভাবে এই প্রশ্নটা আসবে যে নব উদারবাদী নীতিকে আটকে দিলেই কি বর্ণবাদী শোষণ কমে যাবে? সম্পূর্ণ নির্মূল না হলেও অন্তত কিছু মাত্রায় কি সুরাহা হবে? আমার মনে হয় এর উত্তর হলো না। তাই যদি হতো তাহলে ৫০-৬০ এর দশকে নেহরুবাদি সমাজতন্ত্রের সময় বর্ণবাদী শোষণ কম থাকতো এখনকার তুলনায়। সেটা যে নয় তা সকলেই জানে। বর্ণবাদী শোষণ শুধু বেসরকারি পুঁজিই লালন পালন করে না, সরকারি পুঁজিও তা করে। সরকারি অফিসার, পুলিশ, সেনা সবেতেই বর্ণবাদ বহাল তবিয়তে রয়েছে এবং বেসরকারি পুঁজির জায়গায় সরকারি পুঁজি থাকলেও সেই অফিসার, পুলিশ, সেনারাই বর্ণবাদী শোষণকে ধারণ করতে সাহায্য করতো। তাই আম্বেদকারবাদীদের যদি গিয়ে বলি যে ভাই তোমরা সব ছেড়ে আপাতত নব উদারবাদ বিরোধী আন্দোলনকেই পাখির চোখ করো তাহলে তারা শুনবে কেন? সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলন নব উদারবাদ বিরোধী আন্দোলন ছাড়া অসম্পূর্ণ সেটা মানলেও গুরুত্ব দিতে হবে সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলনের ওপরেই।

ইদানিংকালে বামপন্থীদের মধ্যে  "জয় ভীম" স্লোগান জনপ্রিয় হলেও মাত্র ৩-৪ বছর আগেও সামাজিক ন্যায়ের লড়াইকে "আইডেন্টিটি পলিটিক্স" বলে খাটো করতেন তারা। প্রকাশ কারাট কয়েক বছর আগেই লিখেছিলেন "The ruling classes in India are not disturbed by the diversity of identity politics and the limited movements that they spawn. They seek to engage and give concessions to such identity politics. The obverse side of this is that identity politics disrupts the unity of the working class by preventing the broader mobilisation against the system; by diverting the attention of the people from the rampant inequalities and exploitation under the neo-liberal regime." বলাই বাহুল্য যে এইরকম মানসিকতা নিয়ে দলিত অধিকারের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হওয়া সম্ভব না। যদিও গত তিন চার বছরে সিপিএম নিজেদের কর্মসূচি এবং ভাবনাচিন্তার অনেক বদল ঘটিয়েছে।     

আম্বেদকর বলতেন যে ভারতে শ্রমিক শ্রেণী বলে কোনো শ্রেণী নেই, শ্রমিক শ্রেণী গোষ্ঠী বলে একাধিক শ্রেণী আছে। উনি বামপন্থীদের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিলেন যে "আপনারা শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র তৈরী করতে চান কিন্তু সেই একনায়কতন্ত্রে কোন শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব সবচেয়ে বেশি থাকবে? আপনারা কি নিশ্চিত যে উচ্চবর্ণের শ্রমিকরা সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিয়ে দলিত শ্রমিকদের চেপে দেবে না?" ১৯২৮-এ যখন বোম্বের কাপড় কলের শ্রমিকরা এক ব্যাপক ধর্মঘট করে কমিউনিস্ট পার্টির কিংবদন্তি নেতা ডাঙ্গের নেতৃত্বে তখন আম্বেদকর শ্রমিকদের দাবিসমূহ সব সমর্থন করেন কিন্তু তার সাথে  ডাঙ্গের কাছে আরও একটি বিশেষ দাবি করেন। বোম্বের কাপড় কলের শ্রমিকদের মধ্যে দুটো প্রধান ভাগ ছিল কাজের ভিত্তিতে। যার মধ্যে একটি কাজে সুতোতে মুখের থুতু দিতে হতো। যেহেতু সেই সুতো নিয়ে তারপর অন্য শ্রমিকদের কাজ করতে হতো তাই ওই থুথু দেওয়া কাজে কোনো দলিত শ্রমিককে নিয়োগ করা যেত না, দলিতের থুথু দেওয়া সুতো  উচ্চবর্ণের শ্রমিকরা ছোঁবে না বলে। কিন্তু সেই থুথু দেওয়ার কাজের মজুরি ছিল বেশি। তাই আম্বেদকর ডাঙ্গেকে চিঠিতে লেখেন যে বাকি সব দাবির সাথে এই বর্ণ ভিত্তিক নিয়োগের দাবি তোলাকেও রাখা হোক। ডাঙ্গে তাতে অসম্মত হন কারণ তিনি বলেন যে এতে শ্রমিক শ্রেণীর ঐক্য ব্যাহত হবে। তাই শ্রেণী বনাম বর্ণ এই বিবাদ বামপন্থী আম্বেদকারপন্থীদের মধ্যে নতুন না, ভারতে বামপন্থার শুরু থেকে এটা চলছে। প্রকাশ কারাট আর কানহাইয়ার মধ্যে বিভেদেও এই কোনটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার তার প্রশ্ন রয়েছে।

শনিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

পেট্রোল ডিজেল গ্যাস এর দাম ~ সুশোভন পাত্র

কে.সি নাগের অঙ্ক তো নয় যেন গব্বর সিং'র জুলুম। অনুশীলনীর তিরিশ, একত্রিশের অঙ্কগুলো তো কষার জন্য নয় বরং অঙ্কের টিউশনে যৌবনের প্রেস্টিজ কে ছড়িয়ে ছাপ্পান্ন করার জন্যই লেখা। বাজার থেকে একটু চা-পাতা কিনতে যাবেন অর্ধেক আসাম চা-পাতার সাথে দার্জিলিং চা-পাতা, ভেজাল চা-পাতা মিশিয়ে কে.সি নাগ আপনাকে লাভ-ক্ষতির হিসেব করতে বসিয়ে দেবেন। স্নান করতে যাবেন দেখবেন কে.সি নাগ চৌবাচ্চা তে একটা বড় আর একটা ছোট ফুটো করে দিয়ে চলে গেছেন। এবার পাটীগণিতের মাথা খেয়ে স্নান করবেন না, জল ধরবেন-জল ভরবেন? দুনিয়ায় একমাত্র কে.সি নাগের বইয়েই কোনও বাঁদর তৈলাক্ত বাঁশে উঠতে চেষ্টা করে। একবার ৫ ফুট উপরে ওঠে আবার তার পরের মিনিটেই ৪ ফুট নিচে নামে। ঠিক যেন পেট্রোল-ডিজেলের দাম। পরশু ২ টাকা ২৭ পয়সা কমল। কাল আবার ৩.৩৮ বেড়ে গেলো। বাঁদরও যেমন এতদিনেও আর বাঁশের মাথায় উঠলো না, পেট্রোল-ডিজেলের দামও তেমন আজও সাধারণ, মধ্যবিত্তর নাগালে এলো না।   

২০০৫'র রঙ্গরাজন এবং ২০০৯'র কিরীট পারিখ কমিটির সুপারিশ মেনে, সরকার যখন পেট্রোল এবং ডিজেলের দাম বিনিয়ন্ত্রণ করছে, তখন দুর্বার বাজার অর্থনীতির অভিমুখে দেশের অর্থনীতির আরও একধাপ উত্তরণের করতালিতে মুখরিত হয়েছিল দেশের তাবড় সংবাদমাধ্যম। পেট্রোল-ডিজেলের ভর্তুকির গলদঘর্ম ত্যাগে রাজকোষের শ্রীবৃদ্ধি এবং সমানুপাতিক হারে 'পরিকাঠামো উন্নয়নের' স্বপ্নের মায়াজাল বেঁধেছিলেন কেতাদুরস্ত অর্থনীতিবিদরা। আকাশছোঁয়া পেট্রোল-ডিজেলের দামে নাজেহাল সাধারণ মানুষ কে শান্ত করতে তখন বিশ্ব-বাজারে অপরিশোধিত তেলের অগ্নিমূল্যের কেতাবি অজুহাত। বিভিন্ন 'জিও-পলিটিক্যাল' কারণে গত ১৬ মাসে বিশ্ব-বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ৭৫% কমে এখন জলের থেকেও কম। এক লিটার মাত্র ১২.৫৮ টাকা। 'তরল সোনার' এই ইন্দ্রপতনে যখন সর্বস্বান্ত হওয়ার জোগাড় ভেনিজুয়েলার মত একাধিক তেলের রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতি তখন ৮০% তেল বিশ্ব-বাজার থেকে আমদানি করা ভারতের মত দেশের অর্থনীতির রমরমা। তাহলে কেন আপনি এখনও পেট্রোল-ডিজেলর অগ্নিমূল্যে  প্রতিদিন জ্বলে পুড়ে মরছেন?
বিনিয়ন্ত্রণের  নিয়ম অনুযায়ী যদি বিশ্ব-বাজারে অপরিশোধিত তেলের দামের উপরেই যদি পেট্রোল-ডিজেলের দাম নির্ভর করে তাহলে তো গত ১৬ মাসে পেট্রোল-ডিজেলের ক্রয়মূল্যও ৭৫% কমে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হয়েছে কি?

দেশে যে সমস্ত সংস্থা অপরিশোধিত তেল উত্তোলন করে কিম্বা বিদেশ থেকে আমদানি করে তারা 'আপস্ট্রিম সেক্টর'। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ ONGC কিম্বা বেসরকারি রিলায়েন্স, HOSE, প্রিমিয়ার ওয়েলের মত 'আপস্ট্রিম সেক্টর' যে দামে অপরিশোধিত তেল আমদানি করে অর্থনীতির পোশাকি ভাষায় বলা হয় 'প্রাইস অফ ক্রুড ওয়েল'। বর্তমানে এক লিটার পেট্রোলের ক্ষেত্রে যা ১৯.৮০ টাকা।
এবার সরকারী IOCL, HPCL এবং বেসরকারি রিলায়েন্স, এসার, শেলের মত 'ডাউনস্ট্রিম সেক্টর' এই অপরিশোধিত তেল রিফাইনিংর পর যে মূল্যে ব্যবহার যোগ্য পেট্রোলিয়াম পণ্য হিসেবে বিক্রি করে সেটা 'রিফাইনারি গেট প্রাইস'। এক লিটার পেট্রোল পিছু রিফাইনিং খরচা যদি ৩.৭৩ টাকা হয় তাহলে এই অবস্থায় 'রিফাইনারি গেট প্রাইস' ২৩.৫৩ টাকা। পরিশোধিত এই তেল  আবার বিভিন্ন পরিবহনকারী সংস্থার গাড়ি বয়ে আপনার নিকটবর্তী পেট্রোল পাম্প রিটেলারের দুয়ারে এসে পৌঁছায়। ট্রান্সপোর্টেশেন খরচা সহ  তখন তেলের এই 'প্রি-ট্যাক্স প্রাইস' মেরেকেটে ২৬.২১ টাকা। এরপরই শুরু আসল গল্প। ২৬.২১ টাকার এক লিটার পেট্রোলের উপর এবার বসে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ২১.৪৮ টাকার 'এক্সাইস ডিউটি' আর রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পলিউশেন সেস ও সারচার্জ মিলিয়ে ১৩.৪৯ টাকার ভ্যাট। ব্যাস কেল্লা ফতে!  বুকে পাথর রেখে এক লিটার পেট্রোল ভরতে যেই আপনি পাম্পে দাঁড়িয়ে ইলেক্ট্রনিক্স মিটারে চোখ রাখবেন অমনি ২৬.২১ টাকার পেট্রোল আর ৩৪.৯৭ টাকার মোট ট্যাক্স মিলিয়ে, ঘ্যাঁচাৎ করে কাটা যাবে ৬৩.৪৭ টাকা। মানে,  আগে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দামের আকাশছোঁয়া দামের খেসারৎ দিয়ে আপনার পকেট কাটা হত। আর এখন বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমে যাবার সুযোগে নিয়ে গত দু-বছরে বিজেপি সরকারের ডিজেলে ৪০০% আর পেট্রোলের ১৩৩% 'এক্সাইস ডিউটি' বৃদ্ধির বদান্যতায় আপনার পকেট কাটা হয়।
অতএব মুক্তবাজারের অর্থনীতির অঙ্কে, সরকারের লাভ হোক বা ক্ষতি, পকেট কিন্তু কাটা হবে এক্সক্লুসিভলি আপনার।  
তখন একদিকে রিলায়েন্সের বিরুদ্ধে ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রাকৃতিক গ্যাস চুরির অভিযোগে, অন্যদিকে কেজি অববাহিকার একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ইচ্ছাকৃত কম উৎপাদন করে গ্যাসের বাজার দর ইচ্ছাকৃত ভাবে বাড়িয়ে রাখার ষড়যন্ত্রের অভিযুক্ত রিলায়েন্স একটি জনস্বার্থ মামলা সুপ্রিম কোর্টে রীতিমত কোণঠাসা। ঠিক সেই সময়ে দিল্লীর শাস্ত্রী ভবনের কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস মন্ত্রকের দরজার ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে সরকারী ফাইল থেকে চুরি হয়ে গেলো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। চুরি হওয়া কাগজের মধ্যে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা ইনপুট  হিসেবে তেল-মন্ত্রকের দেওয়া দু-পাতার নোট এবং তেল-মন্ত্রকের বিদেশ নীতির খসড়া। ধৃত সাংবাদিক শান্তনু সাইকিয়া বলেছিলেন তেল-মন্ত্রকের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের এই গুপ্তচরবৃত্তি আসলে একটা '১০০০০ কোটি টাকার দুর্নীতির টিপ অফ দি আইসবার্গ।'

কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই 'আইসবার্গের' আর হদিশ পায়নি সরকার। খুঁজে বের করতে পারেনি কাদের পরামর্শে এই তথ্য চুরি করার কাজ করেছিল সরকারী দপ্তরের সাধারণ ছা-পোষা ঐ কেরানী গুলো। তদন্তে উঠে আসেনি কোথায় গিয়েছিলো আর কাদেরই বা বাড়া ভাতে ছাই দিতে কাজে লেগেছিল ঐ তথ্যগুলো? ৫৬ ইঞ্চির সরকার জিজ্ঞাসাবাদ করার সাহস করেনি একজনও রিলায়েন্সের কর্মকর্তা'দের। আসলে দিনের শেষে সরকার কে তো পেট্রোল-ডিজেলে 'এক্সাইস ডিউটি' বাড়িয়ে, আমার আপনার পকেট কেটে, কর্পোরেট ট্যাক্সেই প্রতিবছর হাজার কোটি টাকার ছাড় দিয়ে হয়। দিনের শেষে এই সরকার কে তো আম-আদমির নয় আম্বানি-আদানিরাই স্বার্থসিদ্ধি করতে হয়।
দিনের শেষে তো আদানিদের চার্টার্ড ফ্লাইটেই লোকসভার প্রচার সারতে হয়। দিনের শেষে তো প্রধানমন্ত্রী'কেও সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায় রিলায়েন্স জিও'র বিজ্ঞাপনে দন্ত বিকশিত করে ভোডাফনের কুকুরের মার্কেট ভ্যালু কে টেক্কা দিতে হয়...