সোমবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৬

জয়েন্টের পরীক্ষায় কারচুপি? ~ পুরন্দর ভাট

জয়েন্ট পরীক্ষা নিয়ে দুদলের অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছি।

এক দল বলছে আল আমীন থেকে ৪৫০ জন পেয়েছে মানেই কিছু একটা কারচুপি হয়েছে। এদের মানসিকতা হলো যে মুসলমানরা লেখাপড়া করতে পারে না, লেখাপড়া তো শুধুই বর্ণহিন্দুদের জাগিরদারি। যখন রহড়া বা নরেন্দ্রপুর থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ ডাক্তারি অথবা সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পেতো এদের কোনো সন্দেহ হয়নি, যখন সেন্ট জেমস বা সাউথ পয়েন্টের একই ক্লাস থেকে ১৫-১৬ জন আইআইটি পায় এদের কোনো সন্দেহ হয়না, যখন রাজস্থানের কোটার কোচিং সেন্টার গুলো থেকে ৪০-৫০% ছেলেমেয়ে আইআইটিতে পায় তখন এনাদের কোনো সন্দেহ হয় না। এই রাজ্যের কোচিং সেন্টারগুলো থেকেও  গুচ্ছ গুচ্ছ ছেলেমেয়ে ডাক্তারি বা সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পায়, সাকসেস রেট্ খুব ভালো, বিশেষ করে সেইসব ইনস্টিটিউটগুলোর যারা ভর্তি করার সময় পরীক্ষা নিয়ে ভর্তি করে। আল আমীনও তাই করে, ভর্তি করার সময় এন্ট্রান্স পরীক্ষা নেয় এবং সাংঘাতিক পরিশ্রম করায়, তাই সেখান থেকে যে অনেকজন পাবে এতে সন্দেহ কী? তা ছাড়া আল আমীন একটি ইস্কুল না, তাদের ১১ টা সেন্টার থেকে ছাত্র ছাত্রীরা জয়েন্ট দিয়েছিলো।

আবার আরেক দল দেখছি যারা জয়েন্টে কারচুপি হয়েছে বললেই রেগে যাচ্ছে। এদের বক্তব্য হলো আল আমীন ভালো করেছে মানে জয়েন্টে কারচুপি হতে পারে না। এরা আল আমীনকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে জয়েন্টের কারচুপির প্রশ্নটাকেই চেপে দিতে চাইছে! প্রথম দলের সঙ্গে দ্বিতীয় দলের বিশেষ তফাৎ নেই, প্রথম দলের মনে করে আল আমীন থেকে এত জন পেয়েছে মানেই কারচুপি আর দ্বিতীয় দল মনে করে আল আমীন থেকে এত জন পেয়েছে মানেই কারচুপি না।

এবার জয়েন্টের পরীক্ষায় কারচুপি হয়েছে কিনা সেটা তদন্ত না হলে কেউ বলতে পারবে না তবে সন্দেহের যে যথেষ্ট কারণ আছে এটা ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলেই বুঝবেন। রেজাল্ট বেরোনোর সাথে সাথেই বহু মানুষ ফেসবুক এবং অন্যত্র আওয়াজ তুলেছেন, আল আমীন ইত্যাদির কথা তখনও কেউ জানেই না, আমি নিশ্চিত এখনো অধিকাংশ প্রতিবাদকারী পরীক্ষার্থী এবং অভিবাবকরা আল আমীন থেকে কজন পেয়েছে সেটা জানে না, তাই আল আমীন থেকে বেশি জন পেয়েছে বলে তারা প্রতিবাদ করছে এটা ভুল। অনেকগুলো আশ্চর্য্যজনক ঘটনা ঘটেছে যা থেকে বলাই যায় যে এবারের জয়েন্টের রেজাল্ট নজিরবিহীন। যেখানে ২৫০০ আসন সব মিলিয়ে সেখানে এবারে কোয়ালিফাইং নম্বর পেয়েছেন   ১২০০০ এর বেশি  ছাত্র ছাত্রী, আগেরবারের ৩ গুন্। ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে ৩০০ জন, আগেরবার পেয়েছিলো ১৮ জন। এই সমস্ত হয়েছে আগেরবারের চেয়ে ২০ হাজার কম পরীক্ষার্থী থাকার পরেও। বহু পরীক্ষার্থী ওএমআর শিট দেখতে পাচ্ছে না, কোয়ালিফাইং নম্বরের বেশি পেয়েও কোনো রাংক আসেনি অনেকের, বহু ছাত্রের রেজাল্ট ইনভ্যালিড দেখাচ্ছে। তা ছাড়াও দশ নম্বরের ভুল প্রশ্ন নিয়ে একটা কনফিউশন রয়েছে। ওএমআর শিট না দেখতে পাওয়ার জন্যে এই কনফিউশন কাটছে না। জয়েন্ট পরীক্ষা নিয়ে এতো অভিযোগ আমার স্মৃতিতে নেই। তা ছাড়া ছত্তিসগড়, মধ্য প্রদেশ, উড়িষ্যাতে মেডিক্যাল জয়েন্ট নিয়ে কারচুপি হয়েছে, আমাদের রাজ্যেও টেট পরীক্ষা নিয়ে যে প্রহসন হয়েছে আমরা দেখেছি তাই ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখেছে। কাল আদালতে যাচ্ছে শুনলাম, যদি সত্যি কিছু কারচুপি হয়ে থাকে তাহলে এর বিশাল প্রতিবাদ দরকার, সকলে মিলে।

বৃহস্পতিবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৬

জন্মাষ্টমী ~ প্রসেঞ্জিত বোস

আজ রাত্রেই মেয়েটি জন্মায়। গোকুলে ও গোপনে। তার মা তখন প্রসব-পীড়ায় অচেতন। কিছুক্ষণ পর যমুনার ওপার থেকে একটি লোক আসে। নিজের সদ্যোজাত ছেলেটিকে গচ্ছিত রেখে চুপিচুপি মেয়েটিকে তুলে নেয়। মায়ের মুখটি ভাল করে দেখার আগেই জন্মের মতো পরিবার-হারা হয় সেই মেয়ে।

মেয়েটিকে পাচার করা হয় মথুরার এক ঘুপচি কারাগারে। ছেলেটির প্রাণ মূল্যবান। তার প্রক্সি হিসেবে মেয়েটিকে রেখে দেওয়া হয়। মথুরার রাজা ছেলেটিকে মারতে এসে মেয়েটিকে পায় ও তাকেই নিয়ে যায়। মেয়েটি দ্বিতীয় বার হাতবদল হয়।

রাজা যখন পাথরের দেওয়ালে আছাড় মারতে যাচ্ছে কয়েক-ঘণ্টা-আগে-জন্মানো পুঁচকে মেয়েটিকে, হাত পিছলে ছিটকে যায় সে। তারপর কোনও এক অজানা ঘটনা-পরম্পরায় তার ঠাঁই হয় দুর্গম বিন্ধ্য পর্বতে। সেখানেই সে বড় হয়।

মেয়েটির মা-বাবার কাছে ছেলেটিও বড় হয়। একটা সময়ে সেই মা-বাবা সত্যিটা জানতে পারে। ছেলেটি মথুরায় আসল মা-বাবার কাছে ফেরৎ যায়। কিন্তু মেয়েটির মা-বাবা ভুলেও হারানো মেয়ের খোঁজ করে না। কী লাভ খুঁজে ? হারানো, চুরি-যাওয়া, বিক্রি-হয়ে-যাওয়া, পাচার-হয়ে-যাওয়া ছেলেদের ঘরে তোলা যায়। মেয়েদের যায় না।

ছেলেটির এখন দু-জোড়া মা-বাবা। তার জীবনে অনেক প্রেম আসে। অনেক স্ত্রী আসে। অনেক সন্তান আসে। আসে রাজত্ব।

মেয়েটির ? কেউ জানে না। তার এক-জোড়া মা-বাবা, একটি প্রেমিক, একটি স্বামী, একটি সন্তান, একটুও ভূমি জুটেছিল কিনা, কেউ খোঁজ রাখেনি।

একটি ছেলে-বাচ্চাকে বাঁচাতে প্রক্সি হয়েছিল সে, এই তার একমাত্র পরিচয়।

শুভ জন্মাষ্টমী। শুধু কৃষ্ণের নয়, আজ যোগমায়ারও জন্মরাত।

শুক্রবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৬

দলিত রাজনীতি এবং কমিউনিস্ট পার্টি - একটি আলোচনার সূচনা ~ পুরন্দর ভাট

সাম্প্রতিক উনাতে গোরক্ষা বাহিনীর হাতে দলিত নিগ্রহকে কেন্দ্র করে গুজরাটে এক ঐতিহাসিক দলিত - মুসলিম যৌথ আন্দোলনের সূচনা হয়েছে যার ফলস্বরূপ সারা গুজরাট জুড়ে বিশাল এক পদযাত্রার পর উনাতে পঁচিশ হাজার দলিতের সমাবেশ হয়েছে। সেখান থেকে ডাক দেওয়া হয়েছে ব্রাহ্মণবাদ আর তার তাঁবেদারি করা সংগঠনগুলি, বিশেষ করে সংঘ পরিবারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার। একই সঙ্গে সোনি সোরির নেতৃত্বে ছত্তিসগড়ের আদিবাসী সম্প্রদায় বিজেপি সরকার আর তার আদিবাসী বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে পদযাত্রা করেছে। আগামী দিনে এই দুটো আন্দোলন একই বিন্দুতে এসে মিলবে বলেই মনে করি।  আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নিম্নবর্ণ, সংখ্যালঘু এবং আদিবাসীদের ওপর ক্রমাগত শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে যার পুরোভাগে রয়েছে সংঘ পরিবার। এই আন্দোলনগুলোয় বিভিন্ন বামপন্থী দল নিজেদের সীমিত ক্ষমতায় পাসে থাকার চেষ্টা করছে, কোথাও কোথাও নেতৃত্বও দিয়েছে যেমন সিপিএম আম্বেদকর ভবন ভেঙে দেওয়ার বিরুদ্ধে ২০ হাজার দলিতকে নিয়ে মিছিল করেছে মুম্বাই শহরে যার চাপে মহারাষ্ট্র সরকার সেই ভবন পুনর্নির্মাণ করার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু বামপন্থীরা এই দলিত আদিবাসী নবজাগরণকে কি ভাবে নিজেদের তাত্বিক কাঠামোর সঙ্গে মেলাবে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যার বোধয় অভাব আছে। দলিত আদিবাসী আন্দোলনই যে ব্রাহ্মণবাদকে এই দেশ থেকে মুছে দেওয়ার একমাত্র পথ এই নিয়ে আমি নিঃসন্দেহ। কাজটা সোজা নয়, আরএসএস শুধু হিমশৈলীর চূড়া মাত্র, এই আন্দোলন ব্যাপ্ত হলে আরএসএস খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে কিন্তু তাতেই বর্ণবাদ শেষ হয়ে যাবে না, আরও অনেক দূর যেতে হবে তার জন্যে। তাই  বামপন্থীরা কী ভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে আর কী ভাবে এই আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করতে পারে এই নিয়ে স্পষ্ট ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন। 

জেএনইউর "দেশদ্রোহী" উমার খালিদ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি অসামান্য প্রবন্ধ লিখেছেন টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। অমনোযোগী হয়ে লেখাটা পড়লে প্রবন্ধটির গুরুত্ব বোঝা যাবে না, আরো পাঁচটা ভালো প্রবন্ধের মতোই মনে হবে। আসল বক্তব্য প্রবন্ধটির একদম শেষে রয়েছে, হয়তো অনেকের নজরেও বিষয়টা পড়েনি কারণ কোথাও আলোচনা লক্ষ্য করিনি। উমার লিখছেন যে ভারতবর্ষে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হতে চলেছে দলিত এবং আদিবাসীদের কেন্দ্র করেই। দলিত এবং আদিবাসীরা হাজার হাজার বছরের শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে, সামাজিক ন্যায়ের জন্যে  আন্দোলন করবে এবং তাতেই আমাদের পুতিগন্ধময় সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এতে শুধুই দলিতরা মুক্তি পাবে তা নয়, তাদের আন্দোলনের ফলেই এই সমাজ এবং এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শোষিত সমস্ত মানুষই তাদের মুক্তির সন্ধান পাবে। যেটা উনি ব্যাখ্যা করেননি বিস্তারিতভাবে তা হলো যে বর্ণবাদ শুধুই দলিতদের শোষণ করে না। আমাদের সমাজে  নারীদের অবস্থানের পেছনেও সেই বর্ণবাদই দায়ী, শ্রমিক এবং কৃষককে যাঁরা শোষণ করে তাদের অধিকাংশও উচ্চবর্ণই। তাই বর্ণবাদকে মুছে দিলে বাকি শোষণগুলোর ওপরেও তার প্রভাব পড়বে। যাঁরা আমাদের দেশের বিভিন্ন বামপন্থী দলগুলোর প্রোগ্রামের সাথে ওয়াকিবহাল তাঁরা হয়তো অনুধাবন করতে পারছেন উমার যা বলেছে তা কতখানি নতুন এবং ভারতের বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর যে প্রোগ্রাম তার থেকে কতটা আলাদা। বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিচ্ছি। 

আমাদের দেশের সংসদীয় কমিউনিস্ট দলগুলোর মধ্যে প্রধান হলো সিপিএম এবং সিপিআই। এদের প্রোগ্রামে কিছু তফাৎ থাকলেও মূল জায়গায় ফারাক নেই। এই দুই দলই মনে করে যে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম লক্ষ্য হলো  ভারতে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করা। এই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব করবে  শ্রমিক-কৃষক জোট, তারাই হবে বিপ্লবের চালিকাশক্তি। তারা মনে করে যে  জোটটা শ্রমিক-কৃষকের হলেও শ্রমিক শ্রেণীই থাকবে পুরোভাগে কারণ তাদের চেতনার মান সবচেয়ে উন্নত। শ্রমিক-কৃষক জোট বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাবান শ্রেণীকে উৎখাত করবে এবং সমস্ত উৎপাদনশীল সম্পদের  ওপর নিজের হক প্রতিষ্ঠা করবে।  বলা বাহুল্য যে তাদের এই প্রোগ্রাম লেনিনের থিসিস অনুসরণ করে বানানো। এর সঙ্গে  নকশালবাড়ি আন্দোলনের মাধ্যমে সৃষ্টি হওয়া কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর প্রোগ্রামের তফাৎ আছে। নকশালদের প্রোগ্রাম বলতো যে শ্রমিক না কৃষকই হবে বিপ্লবের অক্ষ। তারা মাও ও লিন বাও থিসিস অনুসরণ করে নিজেদের প্রোগ্রাম বানায় যাতে কৃষকদের মধ্যে গেরিলা বাহিনী তৈরী করে ক্ষমতা দখল করা লক্ষ্য হয়, গ্রামে গ্রামে রেজিমেন্ট তৈরী করে তা দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্র শহরগুলোকে ঘিরে ফেলার কর্মসূচি নেয়, স্লোগান ওঠে "গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো।" তাদের প্রোগ্রাম বলতো যে  ভারতবর্ষের মূল উৎপাদন কৃষিজাত, শিল্প এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল সম্পদ নামমাত্র, তাই কৃষিসম্পদ দখল করতে পারলে, তাতে সামাজিক অধিকার স্থাপন করতে পারলে বিপ্লব সফল। পরে নকশালপন্থী বিভিন্ন দলগুলি এই প্রোগ্রাম থেকে সরে আসে। যেমন সিপিআইএমএল লিবারেশনের এখন যে প্রোগ্রাম তা মোটামুটি সিপিআই সিপিএমের কল্পিত জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের থেকে  খুব একটা ভিন্ন না। মাওবাদীরা যদিও এখনও কৃষক এবং আদিবাসীদের মধ্যে গেরিলা বাহিনী সংগঠিত করার প্রোগ্রাম থেকে সরেনি। এবার উমার খালিদ যা বলেছেন তা সিপিআই, সিপিএম অথবা নকশালদের কল্পিত বিপ্লব থেকে কিন্তু  সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি বলছেন দলিত এবং আদিবাসীরাই বিপ্লবের অক্ষ, তারাই চালিকাশক্তি, কৃষক বা শ্রমিক-কৃষকের যৌথ ফ্রন্ট নয়। আমার মনে হয় এ এক অভিনব ভাবনা। কিন্তু  এই নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। 

আসুন দেখি গুজরাটে উনার আন্দোলনের দিকে। উনার আন্দোলন কিন্তু শুধুই সামাজিক সম্মান এবং ন্যায়ের প্রশ্নে থেমে নেই। দলিতরা প্রতিজ্ঞা করছেন যে তারা আর মরা গরু ছোঁবেন না, ময়লা পরিষ্কার করবেন না, যেসব কাজ তাঁরা হাজার হাজার বছর ধরে করতে বাধ্য হয়েছেন সেই কাজ আর তাঁরা করবেন না। কিন্তু এইখানেই প্রশ্ন চলে আসছে যে তাঁরা যদি এই সাবেকি জীবিকাগুলো থেকে সরে যান তাহলে তাঁরা রোজগার করবেন কি করে? মরা  গরু না ছুঁলে যাঁরা চামার তাঁরা কিভাবে উপার্জন করবেন? যিনি জমাদার তিনি জমাদারী ছেড়ে দিলে রোজগার করবেন কি করে? আর এইখানেই উনার দলিত আন্দোলনের উজ্জ্বল নেতা জিগনেশ মেওয়ানি স্লোগান তুলেছেন "লাঠ লেকে জায়েঙ্গে জমিন খালি কারওয়াযেঙ্গে!" অর্থাৎ  লাঠি নিয়ে নিজেদের হকের জমি ছিনিয়ে নেবো। ভারতবর্ষের অধিকাংশ দলিত, সংখ্যালঘু  এবং আদিবাসীদের হাতে খুব স্বল্প পরিমান উর্বর জমি আছে তাই চাষবাস করে তাদের রোজগার করার উপায় সীমিত, আর এই কারণেই তাঁদের সাবেকি পেশার বাঁধন থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল হচ্ছে। জিগনেশরা তাই দাবি তুলছেন ভূমি সংস্কার এবং ভূমি বন্টনের। একদম সঠিক দাবি কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু ভেবে দেখুন যে সামাজিক ন্যায়ের আন্দোলনও কিন্তু সেই উৎপাদনশীল সম্পদ দখল করার মাধ্যমেই নিষ্পত্তির দিশা পাচ্ছে। অর্থাৎ উৎপাদনশীল সম্পদ দখল করা আর তাতে সামাজিক অধিকার স্থাপন করার সাবেক কমিউনিস্ট পার্টির প্রোগ্রামেই আমরা ফিরে যাচ্ছি, দলিতের দলিত পরিচয়ের চেয়ে তাঁর ভূমিহীন হওয়ার পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 

তাহলে কি করণীয়? কমিনিউস্ট পার্টিগুলির প্রোগ্রামই তাহলে ঠিক? কৃষক অথবা শ্রমিক-কৃষক জোটই বিপ্লবের অক্ষ হবে আর দলিত, আদিবাসী সংখ্যালঘুদের শ্রমিক বা কৃষক পরিচয়টাই মুখ্য হবে, তাঁদের সামাজিক পরিচয়গুলো গৌণ থাকবে? তাই যদি হয় তাহলে ৫০-৬০ বছরেও কেন দলিত আদিবাসী আইডেন্টিটি পলিটিক্স মুছে গিয়ে বামপন্থীদের সঙ্গে মিশে যায়নি? কেন সেই আইডেন্টিটি পলিটিক্স দিন কে দিন শক্তিশালীই হয়ে চলেছে ক্রমশ আর বামপন্থীরা জমি হারাচ্ছে? দলিতদের নিগ্রহ না করলে তো দলিতরা রাস্তায় নেমে জমির দাবিতে মিছিল করতো না তাই না? বর্ণবাদী সংঘ পরিবার দ্বারা নিগ্রহের কারণেই তাঁরা আজ রাস্তায় নেমে জমির দাবি তুলছে, ছত্তিসগড়ের রমন সিংহ সরকার সেনাবাহিনী দিয়ে আদিবাসীদের দমন করেছে বলেই আদিবাসীরা একজোট হয়ে জঙ্গলের অধিকারের দাবি তুলছে। 
তাহলে? আমার মনে হয় উমার যা বলেছেন তা আংশিকভাবে ঠিক। কৃষক-শ্রমিক জোটই বিপ্লবের অক্ষ হতে পারে কিন্তু সেই জোট তৈরী হওয়ার উপকরণ হিসেবে দলিত এবং আদিবাসীদের আইডেন্টিটি ভীষণ রকম প্রয়োজন। মার্ক্সবাদ শ্রমিকের চেতনার ওপর ভরসা করে, যেহেতু তারা সর্বহারা তাই তারাই বিপ্লবের সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রহরী। কিন্তু ব্যাপক হারে সেই শ্রমিক চেতনা তৈরী হবে কি করে যেখানে আমাদের দেশের জনসংখ্যার মাত্র ১০-১৫% আজকের দিনে  শিল্পের সাথে জড়িত এবং তা দিন কে দিন হ্রাসমান? বরং আমাদের দেশে দু হাজার বছরের বর্ণবাদী শোষণ যে বিপ্লবী চেতনার উপকরণ রেখে গিয়েছে তাকে বামপন্থীরা উপেক্ষা করেছে এতদিন। সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে, শ্রমিক কৃষকের একটা বড় অংশ বিপ্লবের পথে চালিত হতে পারে, এবং যে হেতু আমাদের দেশে পুঁজিবাদ ও বর্ণবাদ একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত তাই সামাজিক ন্যায়ের পথে চালিত এই অংশটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবেরও সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রহরী হতে পারে। আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি বিষয়টা বিবেচনা করে দেখে কিনা সেটাই এখন দেখবার। 

বুধবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৬

আবহ বার্তা ~ অরুনাচল দত্তচৌধুরী


এ'বার বৃষ্টি এলে আমাদের মাঝখানে জেগে ওঠা চর 
ডুবে যাবে
সে'রকম বৃষ্টি হলে আমাদের ঘর
ডুবে যাবে ফেলে আসা প্রেমে।
আমাদের ধুলোমাখা ছবি,
আবার বাঁধানো হবে বজ্র আর বিদ্যুতের ফ্রেমে

অশ্রুপরিণতিহীন সমস্ত বিলাপ,
নিজেদের ঠকানোর নিরন্তর মধ্যবিত্ত পাপ
দিবানিশি গল্প হয়ে ওঠে
চুমুগুলি থমকে থাকে তৃষ্ণাভরা ঠোঁটে
খাতাভরা কবিতারা
অসমাপ্ত পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
তাদের কুড়িয়ে নিয়ে যথাযোগ্য কথাসুতো দিয়ে
গেঁথে দিক বৃষ্টিকণা এসে।

আয় বৃষ্টি আয়
এই সংসারের চাপে যাওয়া হয়নি মধুচন্দ্রিমায়
আজকে মেঘের দেশে হানা দেবে হারানো সে চাঁদ
একপাশে আলো থাক
অন্যপিঠে কিছুটা বিষাদ।

ভুল করে যাকে গেছি ভুলে
আজ সেই নিম্নচাপ
ঘনীভূত আমাদের ছিন্ন উপকুলে

মঙ্গলবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৬

স্বাধীনতা দিবস ~ যুদ্ধ পরিস্থিতি

আরেকটি ১৫ই আগস্ট, আরেকবার স্বাধীনতা দিবস এলো আর গেলো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে স্বাধীনতার জন্যে যারা লড়েছিলেন, তাদের প্রত্যেকের মাথার মধ্যে হয়তো স্বাধীন ভারতের ধারনা সম্পর্কে আলাদা মতামত ছিলো। ভগত সিং যেই স্বাধীন ভারতের ধারনা মাথায় নিয়ে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েছিলেন, আর গান্ধী যে স্বাধীন ভারতের ধারনা বুকে নিয়ে গডসের গুলি খেয়েছিলেন, তার মধ্যে কিঞ্চিত ফারাক রয়েছে।
চট্টগ্রামের পাহাড়ে সূর্য সেনের নেতৃত্বে যেই সুবোধ রায়, অম্বিকা চক্রবর্তী, গনেশ ঘোষ আর লোকনাথ বল একইসাথে কাধে কাধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের তাক করে রাইফেল ছুড়েছেন, স্বাধীন ভারতে তারাই কংগ্রেস আর কমিউনিস্ট - দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়ে একে অপরের বিরোধী হয়ে রাজনীতি করেছে্ন, ভারত নিয়ে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ধারনা কে বাস্তবায়িত করতে।

আমরা, স্বাধীন ভারতের নাগরিক যারা, প্রত্যেকেই হয়তো আমাদের এই দেশের কাঙ্খিত চরিত্র সমন্ধে ভিন্ন ধারনা পোষণ করি। এবং এই ভিন্ন ধারনা কে বাস্তবায়িত করতে হয়তো আমরা অনেকেই নিজেদের স্বল্প পরিসরে কোনরকম ভূমিকা পালন করবার চেষ্টা করি। একদিক দিয়ে দেখতে গেলে, আমরা যারা ধারনার জগতে একে অপরের বিরোধী, তারাই আবার সহযাত্রীও বটে। কারন স্বাধীনতা তো কোন গন্তব্য নয়, স্বাধীনতা তো যাত্রা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে যারা লড়ে স্বাধীনতা আনলেন, তারা একটা অধ্যায় সমাপ্ত করলেন, এবং স্বাধীনতা যাত্রার পরবর্তী অধ্যায়ের সূচনা করলেন। এই অধ্যায়ের অনেক বৈরিতার মধ্যেও একটা ধারনা অবিচল রয়েছে - বহুত্ববাদ। এই বহুত্ববাদ যতবার আক্রান্ত হয়েছে, এই দেশের মানুষ একজোট হয়ে তাকে রক্ষা করেছে। যাদের ইতিহাসের ভার আমরা বহন করি, তাদের ভারতের ধারনা যে আমাদের মধ্যে প্রবহমান, তাকে আমরা অস্বীকার করি কি করে?
কোন একদিন সুবোধ রায় যখন তেভাগা আন্দোলনের সময় কৃষকদের মিছিলের সামনে হাটছিলেন, তখন কি তার পাশে সূর্য সেন মুচকি হেসে পায়ে পা মেলান নি?
গুরগাঁও তে মারুতি কারখানার যে শ্রমিকরা স্ট্রাইক করে কয়েক বছর জেল খেটে এলেন, তাদের সাথে জেলের ভেতর কি ভগত সিং আর বটুকেশ্বর দত্ত বসে  ১৯২৯ এ ট্রেড ডিসপুট এক্ট পাশ করবার দিন এসেম্বলিতে বোম মারবার গল্প শোনায়েনি?
এই ১৫ই আগস্ট গুজরাটে আহমেদাবাদ থেকে উনা অবধি দলিতদের মহামিছিলের শেষে জিগ্নেশ মেওয়ানি স্টেজে উঠে যখন দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষনা করলেন - 'তুমহারা মাতা তুম রাখো, হামে আপনি জমিন দো', তখন কি আকাশে ছোড়া হাজারটা মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের মধ্যে একটা হাত আম্বেদকরের ছিলো না?
বস্তারে শোনি সোরি যখন কর্পোরেট মাফিয়ার হাতে আদিবাসীদের জল-জমি লুঠের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে কোন এক থানায় পুলিশের হাতে অত্যাচারিত হয়ে এক কোনে পড়েছিলেন, তখন কি ইলা মিত্রর কোলে মাথা রেখে কিছুক্ষন জিরিয়ে নেননি? এই ১৫ই আগস্ট যখন শোনি সোরি বস্তারের গ্রামগুলোর মধ্যে দিয়ে আদিবাসীদের মহামিছিলে হেটে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন, তখন কি তার পাশে হাত ধরে প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার হাটছিলেন না?

স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের বর্তমান অধ্যায়ে এই বলিষ্ঠ চরিত্রগুলো যখন দেশ জুড়ে তাদের ভারতের ধারনা কে বাস্তব করে তুলতে মাঠে নেমেছে, 'আজাদি'র যাত্রায় সহযাত্রী হয়েছে, তখন আমরা সহনাগরিক হিসেবে স্বাধীনতার এই যাত্রা কে মহাড়ম্বরে উদযাপন করবো না কেন? আমরা প্রত্যকেই তো লড়ছি এই আজাদির জন্যে - আমাদের ভারতের ধারনা কে রক্ষা করবার জন্যে। ভুলে গেলে চলবে কি করে, আজ লাল কেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের বক্তৃতা দিয়েছেন যে প্রধানমন্ত্রী, তিনি এমন একটি সংগঠনের সদস্য যারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে শুধু খাতায়-কলমে বিরোধিতাই করে থামেননি, মাঠে নেমে তার বিরুদ্ধে লড়েছেন, যারা এই দেশের পতাকা, সংবিধান কোনটাকেই স্বীকৃতি দেননি।

আজাদির যাত্রা থামবে কেন?

সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৬

স্বাধীনতা ~ পুরন্দর ভাট

দীপা কর্মকার চতুর্থ হলেন। চোখের সামনে ইতিহাস দেখলাম।

ছোটোর থেকে শুনে এসেছি মোহনবাগানের খালি পায়ে বুট পরা সাহেবদের হারানোর গল্প। আমি মাচাদের সহ্য করতে পারিনা কিন্তু তবুও এমন কোনো বাঙালি ফুটবল প্রেমী নেই যে ছোটোবেলায় মোহনবাগানের সেই শিল্ড জেতার গল্প শুনে রোমাঞ্চিত বোধ করেনি। তারপর পড়েছি মিলখা সিংহের সারা জীবনব্যাপী লড়াইয়ের কাহিনী, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রকম সাহায্য  না পেয়েও তিনি কি ভাবে পৌঁছেছিলেন অলিম্পিকে চার নম্বরে। পড়েছি পিটি ঊষার কথা।

আজ চোখের সামনে দেখলাম। মৃত্যুকে তুচ্ছ করে দিয়ে লাফ দিলো ভারতের বিস্মৃত একটি অঙ্গরাজ্যের মেয়ে। হ্যা, প্রদুনোভায় মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, আনন্দবাজারের দৌলতে অনেকেই সেটা জেনে গেছি। যখন দীপা দ্বিতীয় লাফটা দিতে যাচ্ছে, পশে স্কোর বোর্ডে পরিষ্কার দেখাচ্ছে "ডিফিকাল্টি লেভেল -৭" অর্থাৎ সর্বোচ্চ। যিনি গোল্ড জিতলেন সেই মার্কিনি বাইলস কিন্তু দুটো লাফের প্রথমটা ৬.৫ এবং দ্বিতীয়টা  ৬ ডিফিকাল্টির দিয়েছিলেন। কেন দীপাকে এতো কঠিন লাফ দিতে হলো? কারণ পরিকাঠামো এবং ট্রেনিঙের অভাব, যাতে তিনি অন্যান্য সহজ ঝাঁপিগুলি ঠিক মতো অনুশীলন করতে পারেননি। নিজের সমস্তটুকু বাজি রেখে চেষ্টা করেছিলেন, তবুও হলো না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় দেখেছি ছোট্ট শহরেও রোজ বিকেলে শয়ে শয়ে ছোটো ছোটো মেয়েদের জিমন্যাসিয়ামে নিয়ে যেতে  তাঁদের বাপ্ মায়েদের। ভারী ভালো লাগতো ফুলের মতো শিশুদের লাফালাফি করতে দেখে, পাস দিয়ে গেলেই দাঁড়িয়ে দেখতাম। ওই দেশের পরিকাঠামো, ট্রেনিং এবং সকলের উৎসাহের কথা ভাবলে মনে হয় দীপার চতুর্থ হওয়া  মোহনবাগানের খালি পায়ে শিল্ড জেতার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

পার্থক্য একটাই, মোহনবাগান জিতেছিল পরাধীন ভারতে যেখানে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির  স্বদেশী খেলোয়াড়দের অবহেলা করাটাই স্বাভাবিক আর দীপা স্বাধীন ভারতের খেলোয়াড়, পর্যাপ্ত ট্রেনিঙের ব্যবস্থা না থাকলেও দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট বিলোনো দলের  ক্রীড়ামন্ত্রী বিজয় গোয়েল তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ঠিক ব্রাজিল দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, মুকেশ আম্বানি আর তাঁর স্ত্রী সরকারি টাকায় অলিম্পিক দেখছেন এম্বাসেডর হয়ে।

ও, স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।

শুক্রবার, ৫ আগস্ট, ২০১৬

জি এস টি ~ সুশোভন পাত্র

ঐ জোকসটা পড়েছেন? ঐ যে, ম্যাডাম তাঁর ছাত্র কে জিজ্ঞেস করছেন "বল ২ আর ২ যোগ করলে কত হয়?" অমনি ছাত্র নিঃসংকোচে উত্তর দিচ্ছে ৯.৫। উত্তর শুনে ম্যাডাম যখন ছাত্রের জ্ঞানের দীপ্ত বিচ্ছুরণে বিরক্ত হয়ে বেত্রাঘাতে উদ্যত, তখন সেই ছাত্র কাঁচুমাচু হয়ে হিসেব কষছে "২+২=৪ +VAT+সার্ভিস ট্যাক্স+হাইয়ার এডুকেশন সেস+স্বচ্ছ ভারত সেস+কৃষি কল্যাণ সেস+এক্সাইস ডিউটি করলে ওটা রাউন্ড ফিগারে ৯.৫'ই হবে।" ছাত্রের উত্তর শুনে সেই ম্যাডাম, সেই যে অজ্ঞান হয়েছিলেন, গত পরশুই তাঁর জ্ঞান ফিরেছে; মোট চারজন অর্থমন্ত্রী আর দুই সংসদের এক দশকের বায়নাক্কার পর জি.এস.টি সংক্রান্ত (১২২তম) সংবিধান সংশোধনী বিল রাজ্যসভায় পাশ হওয়াতে। মিডিয়ার করতালির লুজ মোশেনে প্রচার হয়েছে, আগের জটিল ও মিশ্র ট্যাক্সেশন পলিসির 'ক্যাসকেডিং এফেক্ট' সরিয়ে জি.এস.টি হবে অপেক্ষাকৃত মসৃণ ও নির্ঝঞ্ঝাট। বাঁকুড়ার চকবাজার থেকে কলকাতার লালবাজার, গৃহস্থের হাটবাজার থেকে বৌ'র শপিং'র পালিকাবাজার -এবার থেকে সব শেয়ালের এক রা, সব বাজারে এক ট্যাক্স। পণ্ডিতরা বলছেন ভীষণ ফেডারেল স্ট্রাকচারে দুর্লভ এই 'ইকোনোমিক ইউনিটি'। যে কোনও বিলে ঐ যে গণ্ডা খানেক হিজিবিজি ট্যাক্সের, সাড়ে বাহান্ন রকম হ-য-ব-র-ল দক্ষিণার সৌজন্যে আপনার মাঝেমাঝেই কালঘাম ছোটে এবার সেটা মুছে ফেলুন। জি.এস.টি তে এবার সবমিলিয়ে একটাই ট্যাক্স।একটাই টাকার অঙ্ক। জি.এস.টি নাকি সো সিম্পল, সো শর্ট অ্যান্ড সো প্রিসাইস।
২০০৬'র জেনারেল বাজেটে পি.চিদাম্বরম যেবার প্রথম জি.এস.টি'র কথা পেড়েছিলেনে, তখনও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুর থেকে দৌড়ে এসে সংবিধান হাতে বিধানসভা ভাঙচুর করেননি, সৌরভ গাঙ্গুলি  কামব্যাক করে গ্রেগ চ্যাপেলের মুখে ঝামা ঘষে দেননি, সাদ্দাম হোসেন তখন জ্যান্ত আছেন, জ্যোতি বসু তখনও দিব্যি আলিমুদ্দিন আসছেন এবং বাইচুং ভুটিয়া তখনও ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন হয়ে নেহেরু কাপ খেলছেন। জি.এস.টি'র সর্বাঙ্গ যদি এত সুন্দর আর সহজ-সরলই হত তাহলে কি আর লাল-সবুজ কার্পেটে মোড়া সংসদে প্রয়োজনীয় সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করতেই জেটলি-চিদম্বরমের একদশক সময় লাগত? অবশ্য দিল্লী এখনও বহুদূর। এবার লোকসভায় তারপর কমপক্ষে ১৫টি রাজ্যের বিধানসভার দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা নিয়ে এই বিল পাশ হয়ে রাষ্ট্রপতির দুয়ার ঘুরলে তবে গঠিত হবে জি.এস.টি পরিষদ। তাঁরাই লিখবেন মূল বিলের খসড়া। সেই বিল কে আবার একে একে পেরোতে হবে লোকসভা ও রাজ্যসভার চৌকাঠ, তবে গিয়ে চালু হবে সাধের জি.এস.টি।
বর্তমান মিশ্র ট্যাক্সেশেন পলিসির ক্যাসকেডিং স্টাইলে যেকোনো পণ্যের ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে শুরু করে হোলসেল ঘুরে রিটেল হয়ে আপনি কেনা পর্যন্ত, প্রতি ধাপে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার বিভিন্ন ট্যাক্স আদায় করে। রাজ্য নিজেদের ঘরের হাঁড়ির অবস্থা দেখে প্রয়োজনীয় ট্যাক্স রেটও ধার্য করতে পারে, নতুন ট্যাক্সও বসাতে পারে। যেমন ধরুন, আমাদের দূরদর্শী মুখ্যমন্ত্রী সারদা কাণ্ডে নিজের নেতা-মন্ত্রী-সাংসদ'র ঘুষ খাওয়া টাকা ফিরিয়ে দিতে সিগারেট উপর সেস বসিয়েছিলেন। আবার ধরুন কেরালার নতুন সরকার, বিক্রি কমাতে ফাস্টফুডের উপর বিশেষ ট্যাক্স বসিয়েছে কিংবা প্রবল বন্যার ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করতে উড়িষ্যা সরকারের লাগু সাময়িক ভ্যাট ইত্যাদি। কিন্তু জি.এস.টি চালু হলে ম্যানুফ্যাকচারিং-হোলসেল-রিটেলে নয় বরং ট্যাক্স বসবে শুধু একবারই, পণ্য কেনার সময়। রাজ্যগুলির হাতেও থাকবে না নিজেদের প্রয়োজন মত ট্যাক্স আদায়ের বা নতুন কোন ট্যাক্স লাগু করার ক্ষমতা। ফলে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু'র মত ম্যানুফ্যাকচারিং রাজ্যগুলি প্রবল রেভেনিউ লসের আশংকায় দীর্ঘদিনই জি.এস.টি লটকে ছিল। এখন অবশ্য গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র'র বিজেপি'র রাজ্য সরকার আর কেন্দ্রের এনডিএ সরকার আমে-দুধে মিশে গেছে। আর আপত্তির আঁটি হাতে নিয়ে তামিলনাড়ু কে আঙুল চুষতে দেখে ফচকে ছোঁড়ারা টুইট কেটেছে "নরেন্দ্র মোদী দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জি.এস.টি'র বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই একই বিল পাশ করিয়েছেন।"
একদিকে ট্যাক্সেশেন পলিসির এই সরলীকরণের ফলে বিভিন্ন রাজ্যগুলির ব্যাপক রেভেনিউ লস আটকাতে চড়া রেভেনিউ নিউট্রাল রেট ধার্য করে ফেডারেল ফিসক্যাল পলিসির মান্যতা রক্ষা অন্যদিকে চিফ ইকনমিক  এডভাইসার অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম সুপারিশ মেনে রেভেনিউ নিউট্রাল রেটকে ১৫%'র মধ্যে রেখে মুদ্রাস্ফীতি রক্তচক্ষুকে সামাল দেওয়া -জি.এস.টি'র ভবিষ্যৎ আপাতত এই শাঁখের করাতেই দোদুল্যমান।  
জি.এস.টি ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স। গরীবের লাইফবয় থেকে বড়লোকিরা হুন্ডা-সিটি, মধ্যবিত্তর এসি থেকে আম্বানি'দের চার্টার্ড ফ্লাইট, জি.এস.টি ওমনিপ্রেসেন্ট, হোমোজিনিয়াস। তাই আর্থিক বৈষম্য কাটাতে ট্যাক্স ব্যবস্থা সত্যি রিফর্ম করে, রাজকোষের শ্রীবৃদ্ধি যদি ঘটাতেই হয় তাহলে ডাইরেক্ট ট্যাক্সের গল্পটাও একটু কড়াই গণ্ডায় বুঝে নেওয়া দরকার। বর্তমানে দেশের জিডিপির মাত্র ১৬.৬% ট্যাক্স। যা উন্নয়নশীল ও ও.ই.সি.ডি'র অন্তর্ভুক্ত দেশগুলির গড় ২৭.৫% থেকে অনেকটাই কম। আবার ঐ ১৬.৬%'র মাত্র ৫১.৫% ডাইরেক্ট ট্যাক্স। আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল সবচেয়ে ১০% মানুষের হাতেই যেখানে দেশের ৬৬% সম্পদ সেখানে ট্যাক্স বাবদ দেশের মোট জি.ডি.পি তে তাঁদের অবদান মাত্র ৫.৪৭%। গতবছরও  যেখানে জেনারেল বাজেটে ইনডাইরেক্ট ট্যাক্স বেড়েছে ২০ হাজার কোটি, সেখানে ডাইরেক্ট ট্যাক্স কমেছে ১ হাজার কোটিরও বেশি। ছাড় দেওয়া হয়েছে ৬৮৭১০ কোটি কর্পোরেট ট্যাক্স। দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ১০টি 'বিগ বিজনেস হাউস'র অনাদায়ী ঋণ ৭.৫ লক্ষ কোটি।
পরশু প্রধানমন্ত্রী টুইট করেছেন, অরুণ জেটলি কেক কেটেছেন। তা বেশ জেটলি স্যার, এবার তাহলে ঋণখেলাপি ললিত মোদি আর বিজয় মালিয়া কেও লন্ডন থেকে ফিরিয়ে আনা হোক, পরের বার বাজেটে ডাইরেক্ট ট্যাক্সের ফাঁকির হিসেবটাও একবার মিলিয়ে দেখা হোক, 'রেভেনিউ ফোরগেনে'র নামে বারবার কর্পোরেট ট্যাক্স ছাড়ের নাটকটারও এবার না হয় যবনিকা টানা হোক, বিগ বিজনেস হাউস'র অনাদায়ী ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও না হয় একবার ৫৬ ইঞ্চির বীরত্ব দেখানো হোক। সেদিন না হয় আমরাও টুইট করব। সেদিন আমরাও কেক কাটবো..

সোমবার, ১ আগস্ট, ২০১৬

আবেশ কেন মারা গেলো? ~ উৎসব গুহ ঠাকুরতা

আবেশ কেন মারা গেলো? - এই জ্বলন্ত প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে গোটা বঙ্গসমাজ। আবেশের মৃত্যুতে সামগ্রিক বাঙ্গালী জাতির চেতনা জাগ্রত হয়েছে - সামাজিক কাঠামোর প্রতিটি ইঞ্চি বিশ্লেষণ করে নাগরিক সমাজ একের পর এক বৈপ্লবিক দলিল পেশ করছে। আমরা নিজেদের চিনছি, জানছি - আবেশ কেন মারা গেলো, আর কি কি করলে আবেশ মারা যেতো না। আসুন, বিভিন্ন প্রান্ত থেকে জড়ো হওয়া সমস্ত দলিল কে এক করে আমরা একটা কারনের লিস্ট বানাই।

আবেশ মারা গেছে কারন সে আইনত প্রাপ্তবয়স্কের তকমা পাওয়ার আগেই নেশা করতো। দু মিনিট নীরবতা সেই সমস্ত পাষন্ড অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে যারা গত ৪০ বছর ধরে স্কুলে পড়াকালীন লুকিয়ে সিগারেট টেনেছে, পুজোয় বাড়ির থেকে পাওয়া পয়সা জড়ো করে মদ খেয়ে মাতাল হয়েছে, গাঁজা টেনে রাস্তায় পড়ে থেকেছে। কলেজের হোস্টেলে, বাড়ির ছাদে, বন্ধুরা এক হয়ে যারা 'নেশাভাঙ' করেছে, খুন হওয়াই যে তাদের ভবিতব্য, তা আবেশ চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে গেলো।

আবেশ মারা গেছে কারন সে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়তো, টিউশন কামাই করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারতো, এবং তার কাছে মোবাইল ফোন ছিলো। দুমিনিট নীরবতা গোটা রাজ্যের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়া সেই সমস্ত অভাগাদের জন্যে, যারা টিউশন কামাই করেছে, টিউশনের স্যারের টাকা মেরে তাই দিয়ে 'নষ্টামো' করেছে। দু মিনিট নীরবতা সেই সমস্ত বাবা-মায়ের জন্যে, যারা প্রযুক্তির বিস্তার কে অস্বীকার করবার সাহস দেখাতে পারেনি, যারা বাচ্চাদের হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছে (বাড়িতে কেবেল টিভি লাগাচ্ছে, পার্সোনাল কম্পিউটার কিনে দিচ্ছে, আমাদের সময় এসব ছিলো নাকি!?) , যারা সন্তানের সঠিক বিকাশের জন্যে প্রাক-ডিজিটাল বিপ্লব পরিবেশ তৈরি করতে পারেননি।

আবেশ মারা গেছে কারন তার বান্ধবীদের সাথে 'খোলামেলা' মেলামেশা ছিলো, তাদের সাথে রাতে অন্তর্জালে চ্যাট করতো, আড্ডা মারতো, সামাজিক নজরদারির অভাবের কারনে তাকে এই কর্মকান্ডের থেকে বিরত রাখা যায়েনি। দু মিনিট নীরবতা বাংলার নাগরিক সমাজের জন্যে, যারা নারী-পুরুষের খোলামেলা মেলামেশায় কোনরকম বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি, যারা বাংলার পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে, উত্তর ভারতের মতন খাপের কাঠামো গড়ে তুলতে পারেনি। দু মিনিট নীরবতা সেই সমস্ত আধুনিকতার পাঠ পড়া নাগরিকদের জন্যে যারা এই ক্ষেত্রে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছে - পাড়ার রাস্তা দিয়ে হাতে হাত ধরে যখন স্কুল ইউনিফর্ম পড়া ছেলে আর মেয়েটা হেঁটে গেছে, তখন সমাজের যে মাথারা সেই নিয়ে প্রতিবাদ করেছে, তাদের খেঁকুড়ে বুড়ো এবং কালচার কাকু -কাকিমা বলে সন্মোধন করেছে।

আবেশ মারা গেছে কারন তার জগতে ঠাকুমার ঝুলি ছিলো না, ছিলো কানে হেডফোন আর হাতে টাকা। দু মিনিট নীরবতা সেই সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক এবং তাদের সন্তানদের জন্যে যারা মনে করেছে যে সাহিত্যগুনহীন ঠাকুমার ঝুলি না পড়লেও বড় হয়ে ওঠা যায়, যারা বাছবিচার না করে নিজেদের পছন্দমতন গানবাজনা শুনতে অভ্যস্ত।

একটি বিষয় এখনও ঐক্যমত পাওয়া যায়েনি - পাড়ার সাম্যবাদী কাকু বলছেন যে আবেশ মারা গেছে কারন সমাজ এখন ভোগবাদ আর পণ্যায়নে আক্রান্ত, আর টিভিতে সনাতনী দাদু বলছেন যে আবেশ মারা গেছে কারন আমরা পরিচ্ছন সনাতনী ভারতীয় সংস্কৃতি ভুলে পাশ্চাত্যের চাকচিক্যে মেতে উঠেছি। দুজনেই অবশ্য জানিয়েছেন যে সময়ের চাকা কে ৩০ বছর পেছনে ঘোরালেই সেই আদর্শ সমাজব্যাবস্থায় পৌছানো যাবে।

আগামী দিনে আমরা আরও বেশি করে সমাজসংস্কারমূলক ভাবনাচিন্তা আশা করছি বাংলার নাগরিকদের পক্ষ থেকে। সত্য এবং পূন্যের সন্ধানে আমাদের যাত্রা চলবে। সামাজিক আন্দোলনের এই সন্ধিক্ষনের চরম মূহুর্তের  মাঝেই কিছু খুচরো মাতাল এবং পাগল যদিও বেসুরো গাইছে। ব্যাটারা বলছে চা শ্রমিকদের মৃত্যুর কারন খুজবে না? চাষী কেন আত্মহত্যা করছে তার কারন খুজবে না? আম চুরির অপরাধে গ্রামের ওই কিশোরটিকে পিটিয়ে মেরে ফেললো কেন তার কারন খুজবে না? হাজার হাজার বছর ধরে আমরা একে অপরকে হত্যা করছি, ধর্ষন করছি, ১ মাসের শিশুকে রেহাই দিচ্ছি না, আস্ত জনজাতি কে হাপিস করে দিচ্ছি, তার কারন খুজবে না? আরেকজন বলছে হিটলার সিগারেট, মদ, মাংস কিছু না খেয়েই ৬০ লাখ ইহুদিকে সাফা করে দিলো, মোদী তো ছোটবেলা থেকে শাখায় আদর্শ ভারতীয় সংস্কৃতি শিখে বড় হয়েছে, না খায় মদ, না করে নেশা, না করে পার্টি, না দেয় বান্ধবীদের সাথে আড্ডা, হেডফোন লাগিয়ে রক, হিপ-হপ এসব তো নৈব নৈব চ, তার তত্ত্বাবধানে শিশুর গলায় পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হলো, ব্যাপারটা কিরকম গোলমেলে ঠেকছে না?

কিন্তু এসব প্রলাপে আমরা কান দিচ্ছি না। আবেশ মারা গেছে, আপাতত এই ওয়াটারশেড ইভেন্ট কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে চলেছে বাঙ্গালীর দ্বিতীয় নবজাগরন।
এই ঐতিহাসিক স্রোতের বিপক্ষে যারা চলবার চেষ্টা করবে, তারা উড়ে যাবে।

ফরোওয়ার্ড মার্চ!