শুক্রবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১৬

বৃষ্টির পূর্বাভাষ ~ দীপাঞ্জন গুহ

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তাঁর অননুকরণীয় বাচনভঙ্গিতে কারুর সম্পর্কে বলেছিলেন যে সে কী করে বলবে, তার তো কোলে ছেলে? প্রসঙ্গ ছিল কোনো একটা বিষয়ে প্রতিবাদ করা যে ব্যাপারে উদ্দিষ্ট ব্যক্তি অপারগ কারণ তার কোনো একটা নাছোড় পিছুটান বা ভালনারেবিলিটি আছে |  "কোলে ছেলে" ছিল চূড়ান্ত ব্যক্তিগত পিছুটানের প্রতীক |

বাংলার চলতি বিধানসভা ভোট এই সাধারণভাবে সত্যি অসাধারণ অবলোকনটিকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে |

সেদিন হালিশহরে একটি সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা মেয়েকে লাঠি দিয়ে পেটায় শাসক দলের গুণ্ডারা! কারণ বাচ্চাটির পরিবারে বিরোধী সমর্থক আছে! অবাক হবেননা না বন্ধুগণ, কারণ গতকালই ভাঙরে একটি দশ বছরের বাচ্চাকে বেধড়ক পিটিয়ে ক্ষেতের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছিল কারণ সেই নাকি শাসক দলের "পোস্টার ছিঁড়েছে" |

অবাক হন এর পরের খবরটিতে  | হালিশহরের ওই বাচ্চাটির মা গুণ্ডাদের হুমকি উপেক্ষা করে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে গিয়ে ভোট দিয়ে এসেছেন!

বাংলায় এখন রাজনৈতিক তর্কের কোনো পরিসর নেই, যেটা আমাদের এই কদিন আগেও ছিল | যেমন ধরুন কৃষিজমিতে শিল্প হওয়া উচিত কিনা; হলে জীবিকা-হারাদের কী হবে, না হলে জমি আসবে কোথা থেকে, সেজ হওয়া কাম্য কিনা, হলে কী শর্তে, ভর্তুকি দেওয়া ঠিক কী না, ইত্যাদি | এই ধরনের প্রশ্নের এখন কোনো পরিসর নেই কারণ রাজনীতির মঞ্চ দখল করেছে গুন্ডা আর চোরাকারবারীরা, যে চোরাকারবার শুরু হয়েছিল ভুয়ো ডকটরেট ডিগ্রি দিয়ে আর সারদা নারদ পেরিয়ে প্রতিদিনের ব্যবসার সর্বশেষ নিদর্শন জাল ছবি দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন, কৃতিত্বে শাসক দলের সাংসদ ! বালি মাফিয়া, কয়লা মাফিয়া, সিন্ডিকেট মাফিয়া, ওয়াগন-ব্রেকার তো ছেড়েই দিলাম | এদের হাত থেকে মুক্তি এবং ন্যুনতম গণতন্ত্রের আশাই (যাতে কার্টুন ফরওয়ার্ড করে আর সারের দাম বাড়ছে কেন জিজ্ঞেস করে অন্তত জেলে যেতে না হয়) এখন মূল ইস্যু, তাই রাজনৈতিক প্রশ্ন আপাতত তোলা আছে | এমনকি একদম হালের প্রশ্নও হালে খুব একটা পানি পাচ্ছেনা, যথা বহু কষ্টে প্রতিষ্ঠিত কমিশনগুলোকে, স্কুল সার্ভিস কলেজ সার্ভিস পাবলিক সার্ভিস, প্রায় তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হলো কার স্বার্থে, পঞ্চায়েতের অধিকার প্রশাসন দিয়ে খর্ব করা হচ্ছে কেন, শিল্পের ব্যাপারে রাজ্যের জমি নীতিটা ঠিক কী, চা-বাগানের জীবন-মরণ পরিস্থিতির স্থায়ী সমাধান কী, চাষীরা দাম পাচ্ছেন না কেন, ডোল-পলিটিক্সকে আদৌ কোনো উন্নয়ন বলা যায় কিনা, ইত্যাদি |

এই খরতাপ, লু-বওয়া বৈশাখের বাংলায় আপাতত এই প্রশ্নগুলো তোলা আছে | কারণ চোখের সামনে দেখা যাচ্ছে ঘুষ খাওয়া, প্রধান শিক্ষিকাকে যোগ ছোঁড়া, পুলিশকে চর মারা, ক্রমাগত প্রকাশ্য সভায় বিবিধ হুমকি দিয়ে চলা নেতারা কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে | দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র বিরোধী পোলিং এজেন্ট হওয়ার "অপরাধে" খুন হলেন তিনজন, ক্রমাগত হামলা অব্যাহত | আর শেষ অবধি দেখা গেল যে দুটি শিশুকে আক্রমণ করলো ঠ্যাঙ্গারেরা |

গল্পটা এখানেই শেষ করার ইচ্ছা ছিল শাসকের | কিন্তু হলো কই! 

সাড়ে তিন বছরের মেয়ে মার খাওয়ার পর তাকে কোলে নিয়ে ভোট দিলেন হালিশহরের দেবশ্রী ঘোষ, শুধুমাত্র ভোট দিতে যাওয়ার "অপরাধে" দুর্বৃত্তরা দুটো হাত লাঠি দিয়ে মেরে ভেঙে দেওয়ার পর আরো জেদ নিয়ে ভোট দিলেন গয়েশপুরের পলিটেকনিক শিক্ষক শিবু দাস ও তাঁর স্ত্রী টুলটুল দাস, ছমাস আগের অজস্র দুর্বৃত্তের রক্তচোখকে জবাব দিতে ভোর থেকে লাইন দিয়ে ভোট দিলেন বিধাননগরের বাসিন্দারা, কাল তিরিশ তারিখ ওই ভাঙরের মার খাওয়া দশ বছরের শিশুটির পরিবারও হয়ত ভোট দেবে |

অসংখ্য বুথ দখল, ভয় দেখানো, ছাপ্পা চলছে | কিন্তু প্রতিরোধও চলছে | এই নির্বাচনের এটাই প্রধান পাওনা, ফল যাই হোক |

গ্রীষ্ম প্রচন্ড | কিন্তু বৃষ্টির পূর্বাভাষ আছে!

রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৬

মা মাটির উন্নয়ন ~ মাহফুজ আলম

মাননীয় অভিরূপ সরকার সমীপেষু,

আপনি গত তেইশ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকাতে ক্যানো মা-মাটি'র সরকার সরকারী কর্মচারীদের ডিএ দিচ্ছেনা সেইটে বোঝাতে গিয়ে কিছু যুক্তি দিয়েছেন আর লাস্টে কয়েছেন যে আগের সরকার নাকি প্রছন্নভাবে মধ্যবিত্তের পক্ষে ছিল এবং আপনারা খোলাখুলিভাবে গরিবের পক্ষে। গোটাটা পড়ে সেই গরিবের ভাষাতে আপনাকে কটা মন ভালো করা রেজ্জাকীয় সাব-অল্টার্ন ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেসনের নমুনা দিতে যারপরনাই ইচ্ছে করছিল। দিচ্ছিনা, কারণ আপনি একে 'সুশীল', তার উপরে 'বুদ্ধিজীবি' এবং সর্বোপরি পে কমিশনের চেয়ারম্যান (যদিও লেখাটা পড়ে বোঝা গেছে যে সরকারে এলে আপনি ডিএ দেওয়ার নামে কাঁচকলা দেখাবেন)।

আপনি অর্থনীতি'র পন্ডিত লোক, আপনার ডিগ্রি ইস্ট জর্জিয়া থেকে আসেন নি, আপনার পিএইচডি টাও যাদবপুরের কি নর্থবেঙ্গলের কেউ টুকে দেন নি- এতদূর নিয়ে আমাদের কারুরই কোনো দ্বিমত নেই।

এখন রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, সুতরাং কেন্দ্রীয় হারে ডিএ দেওয়া সম্ভব নয়, অ্যাদ্দূর সব্বাই জানি। এইটে বকার জন্য আপনার জ্ঞান দেওয়াটা জরুরী নয়। এট্টু সমস্যা থেকে যাচ্ছে পরের অংশটা নিয়ে, যেখানে আপনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে ডিএ না দিয়ে আপনারা সেই টাকায় গরিবের উন্নয়নে খরচ করেছেন।

আপনার ধরে নেওয়া হিসেবে সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাবের সংখ্যা সাড়ে-পাঁচ হাজারের বেশি হবেনা। এইটে ডাহা মিথ্যে কথা সার। ২০১৫ তেই সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাবের সংখ্যা ৭০০০। ২০১২ সালে অনুদান দেওয়া শুরু হয়েছিল ১৫.৫ কোটি টাকা দিয়ে, ২০১৫-১৬ তে সেটা দাঁড়িয়েছে ১৫০ কোটি টাকায়। এই হিসেবে গত তিন বছরে ৩০০ কোটির বেশি টাকা ক্লাবগুলোকে অনুদান দেওয়া হয়েছে। আর ইয়ে, ২০১৫-১৬ বাজেট বক্তব্যে অমিত মিত্র সগর্বে জানাচ্ছেন যে সাহায্যপ্রাপ্ত ক্লাবের সংখ্যা ১৪০০০। আপনার জন্য প্রামাণ্য লিঙ্কগুলোও থাকছে (http://indianexpress.com/article/cities/kolkata/didi-doles-out-rs-105-cr-for-clubs/, http://indiatoday.intoday.in/story/west-bengal-polls-mamata-banerjee-tmc-left-cpm/1/622050.html )

এখন যদি বুঝিয়ে দ্যান যে এই ক্লাবগুলোকে টাকা দিয়ে কোন গরিবের কিভাবে উপকার হয়েছে তাহলে উপকৃত হই।
অথবা, অনুষ্ঠান বাড়ি করে ভাড়া দিয়ে টাকা রোজগার আর বাৎসরিক পূজোটা ভালো করে করা ছাড়া এই টাকায় বাংলার কোন খেলার উন্নতি হয়েছে সেইটে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে বোঝালেও হবে। এবং হ্যাঁ, ক্লাবগুলো সবই কিন্তু তৃণমূলের নেতা-চামচাদের বাছা। সত্যিকারের যে কটা ক্লাব খেলোয়াড় তৈরী করে তাদের পাত্তাই দেওয়া হয়নি।

ক্লাবের ছেলে আর কর্তাদের দিয়ে ভোটের সময় বিরোধী ভোটারদের চমকানোটা কি গরিবের উন্নয়নের মধ্যে ধরেছেন? তাহলে অবশ্যি, আপনি দিদিমণির দুষ্টু ভাই। কিস্যু বলার নেই।

আপনি লিখেছেন যে উৎসব বাবদ খরচ হয় বছরে আরো চল্লিশ কোটি টাকা। সিরিয়াসলি সার, আপনার অ্যাত্তো জ্ঞান, রাতে ঘুম হয় তো?

শুধু কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেই কত খরচ হয় আপনার ধারণা আছে? ২০১৪তেই সেরা সিনেমা'র জন্য প্রাইজ মানি ছিল ৫১ লাখ টাকা। অফিসিয়ালদের মতে খরচ ছাড়িয়েছিল ২০ কোটি টাকার বেশি (নিউজ লিঙ্ক http://www.telegraphindia.com/1141107/jsp/frontpage/story_19008855.jsp )। 

অবশ্যি নিন্দুকেরা বলে যে সেবার টাকা যুগিয়েছিলেন সুদীপ্ত সেন যার অনিদ্রার রোগ সারাতে দিদিমণি'র লেখা কবিতার বইগুলো থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করা হত।

মুখ্যমন্ত্রী তার 'মিনি-মহাকরণ' এর নামে জেলায় জেলায় যে বিশাল এসি প্যান্ডেলে রাজসভা চালান, গোটা জেলার কর্তাব্যক্তিরা এসে হাজির হয়, ঢালাও খাওয়া-দাওয়া হয়।তার খরচ জানেন? গড়ে ৭০-৭৫ লাখ টাকা। এও শোনা যায় যে সে প্যান্ডেলের বরাত নাকি এক নির্দিষ্ট ঘেসোকেই দেওয়া হয়।

কটা মেলা হয় বছরে তা জানেন আপনি?  আপনার অর্থমন্ত্রীও গুণতে পারেন নি। তিনিও বাজেট বক্তব্যে 'Dance Drama Festival, Mati Utsav, Natya Mela, Bangla Sangeet Mela,Children's Film Festival, Tele Award, Paschimbanga Charukala Utsav' এইগুলোর নাম লিখে তাপ্পর শেষে 'etc' বসিয়েছেন (সোর্স- ওয়েস্ট বেঙ্গল বাজেট স্পিচ, ২০১৫-১৬, পেজ-৫০)।

যাকগে, মেলাগুলোর আয়োজন করে মূলতঃ বিভিন্ন সরকারী দপ্তর। এর মধ্যে তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর প্রধান, এইটা নিশ্চয়ই জানেন। তাদের বাজেট-বরাদ্দ দেখলেই মেলার খরচের হিসেব পাওয়া সম্ভব। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র তার বাজেট বক্তব্যে জানিয়েছেন যে ২০১৪-১৫ সালে তথ্য সংস্কৃতি দপ্তরের জন্য বরাদ্দ ছিল ১৬৫ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ সালে সেইটে বাড়িয়ে করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ২০০ কোটি টাকা। ক্রীড়া আর যুবকল্যাণ দপ্তরের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৫২ কোটি টাকা, সেইটে বাড়িয়ে ৩৪০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

এরমধ্যে সবটা নিশ্চয়ই মেলার জন্যে খরচ হয়না। কিন্তু বড় অংশটা নিশ্চয়ই হয়। তাহলে এই খরচগুলো মিলিয়ে আপনার গপ্পে দেওয়া মাত্তর চল্লিশ কোটির হিসেব তো জাপানী তেল দিয়েও দাঁড়াচ্ছেনা সার।

বাজেটের লিঙ্কটা দিলাম না। আপনি সরকারী লোক। নিশ্চয়ই নেটে সার্চ মারলেই পেয়ে যাবেন। যেটা জানার সেটা হল এই গুচ্ছের টাকা উড়িয়ে সঠিকভাবে ঘেসো-ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের কন্ট্রাক্ট পাইয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিভাবে গরিবের উন্নতি হয়েছে সেইটা বোঝাবেন প্লিজ।

আপনি লিখেছেন যে বিস্তর উন্নয়ন হয়েছে। বলছেন যখন তখন নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও হয়েছে। MNREGA বা সোজা বাংলায় একশো দিনের কাজের হিসেব দেখছিলাম যাতে প্রায়শই রাজ্যসরকার নিজেদের এক নম্বর বলে দাবী করে থাকেন। স্টেট ওয়াইজ রিলেটিভ পারফরম্যান্স অনুসারে পশ্চিমবঙ্গ এইমুহুর্তে ১০ নম্বরে। মিজোরাম,অরুণাচল, জম্মু-কাশ্মীর, নাগাল্যান্ড, আসাম, পাঞ্জাব,বিহার, ছত্তিশগড় আর সিকিমের পিছনে। লিস্ট অনুযায়ী, নথিভুক্ত তফশিলীদের ৪১% কে এখনও কাজ দেওয়া যায় নি। এবং ১৫ দিনের মধ্যে টাকা মেটানো হয়েছে মাত্র ২৫.৬১% কে। দারুণ গরিব প্রেম, তাই না?
(রেগার লিঙ্ক- http://164.100.129.6/netnrega/st_weightage_drill.aspx?lflag=eng&fin_year=2015-2016&source=national&labels=labels&Digest=+WYLWwx19OhhVOg6q39p/g
)

বড়বাজারের উড়ালপুলটার কথা ভুলবেন না সার। বাম আমলে টেন্ডার হয়েছিল, তাই আপনাদের যুক্তিতে আপনাদের সরকারের আমলেও বামেরাই সেতুটা বানিয়ে যাচ্ছিল আর কি। ২৭ জনের  প্রাণ গিয়েছে। পরে বেরিয়েছে যে সেতুর মালমশলা সরবরাহ করতেন এক ঘেসো নেতার ভাইপো। দেখার দায়িত্বে কমিটিতে ছিলেন একাধিক ঘেসো নেতা। এক নেতা টিভিতে বলেওছেন যে তিনি জানতেন নকশায় গলদ আছে কিন্তু রাজ্যসরকারের খরচ বাড়বে বলে চেপে গেছিলেন।

মাত্র ২৭টা প্রাণ...উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে তার কিইবা দাম বলুন? আফটার অল, ওরা সিপিএমের আমলে জন্মেছিল নিশ্চিত।

গুচ্ছের রাস্তা আর বাড়িঘর অকারণে নীল-সাদা রঙ হয়েছে। নিন্দুকদের মতে সে রঙও নাকি এক ঘেসোর দোকান থেকেই কেনা হয় বিনা টেন্ডারে। এতে ঠিক কি উন্নয়ন হয়েছে বলবেন?

গত আর্থিক বছরে কুড়ি জন মত চাষী দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেছেন। চা বাগানে অনাহারে মৃত্যুমিছিল বেড়েই চলেছে।

এই খেলা-মেলার টাকা, নীল সাদা রঙ করার টাকা- এসবের একটা অংশ দিয়ে এই দেনার দায়ে বিকিয়ে যাওয়া চাষী, অনাহারে ধুঁকতে থাকা চা বাগানের শ্রমিক-এদের একটু সাহায্য করা যেত না সার?
আপনার গরিব দরদী সরকারের ফিরিস্তি'র তাড়া কাগজ তৈরী আছে জানি কিন্তু কাজের কাজ কি হয়েছে?

আপনি লিখেছেন যে বেতন খাতে রাজ্য সরকারের খরচ কমেছে। ২০১৪-১৫ আর্থিক বছরে বাজেটের বরাদ্দের ৩১.৭% খরচ হয়েছে বেতন বাবদ। আমি অর্থনীতির ছাত্র নই, তবু এটুকু বোঝা যাচ্ছে বেতন খাতে খরচ কমা মানে রাজ্য সরকারের কর্মী সংখ্যাও কমেছে। অবসরপ্রাপ্তদের জায়গাতে আর স্থায়ী নিয়োগ হয়নি।

এদিকে আপনার মুখ্যমন্ত্রী ভোটের বাজারে বকে বেড়াচ্ছেন যে তিনি নাকি ৬৮ লাখ বেকারকে চাকরি দিয়েছেন। এবার ৬৮ লাখ চাকরি দিলে বেতন খাতে খরচ বাড়া উচিত। কিন্তু আপনার হিসেবে তো খরচ কমেছে।

তাহলে? মিথ্যে কথাটা কে বলছেন বলুন তো? আপনি না আপনার মুখ্যমন্ত্রী?

আপনি লিখেছেন যে ডিএ না দিয়ে সেই টাকায় আপনার সরকার সার্বজনীন উন্নতিতে হাত দিয়েছে। এখন সার্বজনীন উন্নতি বলতে আপনি কি বোঝেন সেইটে জানতে ইচ্ছে করছে। ভোটের হিসেবে দেখা যাচ্ছে ঘেসো পার্টির নেতাদের সম্পত্তি অনেকের ক্ষেত্রেই কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে, এটাই কি সার্বজনীন উন্নতি?

চাষীরা ধানের সহায়ক মূল্য পাচ্ছেনা।কিষান মান্ডিগুলো গড়া হয়েছে লোকালয়ের মূল বাজারের বাইরে। সেখানে কেউই যায়না। দেনার দায়ে আলু চাষীরা আত্মহত্যা করছেন, এইটাই কি সার্বজনীন উন্নতি?

পাঁচ বছরে কাগজে কলমে ছাড়া কোনো বড় ও ভারি শিল্প গড়ে ওঠেনি যাতে বিকল্প কর্ম-সংস্থান হতে পারে। এটাই কি সার্বজনীন উন্নতি?

সারদা কেলেঙ্কারিতে এটা জলের মতন স্পষ্ট যে গরিব দরদী সরকারের নেতারা গরিবের টাকা লুটের সাথে যুক্ত ছিলেন। কদিন আগেও এক চিটফান্ডের মালিককে দিদিমণির ভাইপো'র পাশ থেকে ধরা হয়েছিল।সত্তরের উপর মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। সর্বস্বান্ত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। এটাই কি আপনার সার্বজনীন উন্নতি?

সরকারী স্কুল শিক্ষা আপনার মতে অদক্ষতার নজির। সেই স্কুলের চাকরিকে সামনে রেখে গরিব দরদী সরকারের নেতারা প্রাইমারি আর টেট নিয়ে লাখ লাখ বেকারের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। আপনাদের শিক্ষামন্ত্রী অব্দি বলতে বাধ্য হয়েছেন যে যারা যারা চাকরি দেবার নাম করে টাকা নিয়েছেন তারা যেন টাকা ফেরত দেন। এটাই কি আপনার সরকারের সার্বজনীন উন্নতি?

আপনার গাঁজাখুরি'র আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছি। সরকারী স্কুলে বেসরকারী স্কুলের থেকে কুড়িগুণ ছেলে মেয়ে পড়ে। এইটেতে আপনার ভারি দুঃখ হয়েছে নির্ঘাৎ। কারণ, স্কুলশিক্ষাটাকে বেসরকারি করণ করা গেলোনা। আপনি লিখেছেন, 'কিন্তু সমস্যা হল, সরকার বিপুল টাকা স্কুল শিক্ষায় খরচ করা সত্ত্বেও পড়াশোনার পিছনে স্কুল পড়ুয়াদের ব্যক্তিগত খরচ কমছে না। দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের স্কুল পড়ুয়াদের গড় ব্যক্তিগত খরচ সারা ভারত গড়ের খুব কাছাকাছি, এবং পশ্চিমবঙ্গের পড়ুয়ারা যে টাকাটা  স্কুল-বেতনের খাতে বাঁচাচ্ছে তার থেকে বেশি তাদের খরচ হয়ে যাচ্ছে প্রাইভেট কোচিং-এ। এর মানে, সরকার শিক্ষায় এত বেশি খরচ করা সত্ত্বেও ছাত্ররা স্কুল থেকে ঠিকমত শিখতে পারছে না। এত খরচ করেও কিন্তু শিক্ষাপ্রাপ্তির নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের স্থান সারা ভারত গড়ের কাছাকাছি। অর্থাৎ একই জায়গায় পৌঁছনোর জন্য সারা ভারতের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গকে সরকারি ও ব্যক্তিগত খরচ মিলিয়ে অনেক বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। এটা অদক্ষতা।'

এবার আপনার এই ফালতু কথাগুলোর জবাব দিই। ভারতে Right of Children to Free and Compulsory Education Act বলে একটা আইন হয়েছিল ২০০৯ সালে যাতে স্পষ্ট করা বলা হয়েছে ১৪ বছর বয়স অব্দি এলিমেন্টারি এডুকেশন হবে অবৈতনিক। অর্থাৎ, স্কুলে কোনো বেতন নেওয়া হবেনা।খরচটা বহন করবে কেন্দ্র এবং রাজ্য (শতাংশ অনুপাতে প্রাথমিকভাবে কেন্দ্রই ৬৫% খরচ দেয়) ।কিন্তু পড়াশুনোর তো কিছু আনুসঙ্গিক খরচ থাকেই এবং সেটা গোটা দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। রাজস্থানের ক্লাস সেভেনের ছেলেটাকেও খাতা পেন কিনতে হয় এ রাজ্যের আমডাঙ্গার ছেলেটার মতন। তাহলে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল পড়ুয়াদের গড় ব্যক্তিগত খরচ সারা ভারত গড়ের খুব কাছাকাছি হবে এতে আশ্চর্য হবার মতন কিছু আছে কি?

নাকি, আপনারও ধারণা এরাজ্যে স্কুলের গোটা টাকাটাই মন্ত্রীসভার কারুর পৈতৃক সম্পত্তি থেকে আসে?

প্রাইভেট টিউশনের উপর নির্ভরতা বাড়ছে। তার কারণ হল প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে বাচ্চাদের নামিয়ে দেওয়া। সব্বাইকে সব কিছুতে ফার্স্ট হতে হবে।এইটে এক ধরণের সামাজিক অসুস্থতা। আপনি তার দায় দিচ্ছেন স্কুলের উপর। আমি বলছিনা যে সরকারী স্কুলে খুব পড়াশুনো ভালো হয়। একটা পার্সেন্টেজ শিক্ষক নিশ্চয়ই ফাঁকিবাজ। কিন্তু বেশিরভাগ খারাপ হলে তো সরকারী স্কুলের প্রতি এত নির্ভরতাই থাকতো না।

একটা হাইস্কুলে একজন মাস্টারমশাইকে দিনে কটা ক্লাস নিতে হয় সেটা আপনার জানা আছে? একটা হাইস্কুলে একজন মাস্টারমশাইকে কম করেও সপ্তাহে ২২-২৫ টা ক্লাস নিতে হয়। এর বাইরে প্রভিসনাল ক্লাস থাকে।দিনে কম করেও পাঁচটা, মোট দুশো মিনিট। প্রতি ক্লাসে গড়ে কম করেও পঞ্চাশের উপর ছেলে-মেয়ে। চল্লিশ মিনিটের ক্লাসে সবাইকে ঠিকঠাক দেখানো সম্ভব?

উত্তর হচ্ছে না। তাহলে আরো সেকশন বাড়াতে হবে। আরও শিক্ষক লাগবে।
কিন্তু শিক্ষক তো আপনারা নিয়োগ করবেন না। কারণ আপনার মতে 'অদক্ষতার একটা উদাহরণ স্কুলশিক্ষা।'

কিন্তু একইসাথে ঢালাও বেসরকারী বিএড আর ডিএড কলেজের পারমিশন দিয়ে যাবেন। মাঝে মধ্যেই স্কুলে শিক্ষক নেবো বলে বিজ্ঞাপন দেবেন। হাজার হাজার গরিব ছেলে মেয়ে জমি বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা দিয়ে এসব কলেজ থেকে বিএড ডিএড পাশ করে বেরিয়ে এসে দেখবে যে আপনি বক্তিমে ফলাচ্ছেন যে 'অদক্ষতার একটা উদাহরণ স্কুলশিক্ষা' তাই এখানে আর শিক্ষক নিয়োগের দরকার নেই, বরং সেই টাকা দিয়ে সার্বজনীন উন্নয়নের নামে দিদিমণি'র আরও কটা ঢাউস ফ্লেক্স টাঙানো হোক।

পারলে নিজের মুখটা একবার আয়নায় দেখুন। ভালো থাকুন।

শনিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৬

আনন্দমার্গী ~ সুশোভন পাত্র

ইমাম আলি কে চেনেন? আজকের এই তৌহিদুল ইসলাম, ফজলে হক, দুখিঃরাম ডালের মতই ইমাম আলি কেও সেদিন মোড়া হয়েছিলো ঐ কাস্তে হাতুড়ির লাল শালুতেই। তখন বিহারের কলিয়ারির শ্রমিক বস্তি গুলোতে লাল ঝাণ্ডার দাপট বাড়ছে ক্রমশ। ঝরিয়া, কেশারিয়া, পিপড়ার অলিগলিতে তখন 'কমরেড' ডাক কানে বাজছে। সকাল আটটার ট্রেনে জ্যোতি বসু কে স্বাগত জানাতে সেদিন পাটনা প্লাটফর্মেই হাজারো মানুষ। পোস্টার-ফেস্টুন আর 'ই-কি-লা-ব'র তুমুল শ্লোগানে ছয়লাপ ষ্টেশন চত্বর। হঠাৎ চলল গুলি। লক্ষ্যভ্রষ্ট বুলেট গিয়ে বিঁধল ইমাম আলির বুকে। আততায়ী মিলিয়ে গেলো জনস্রোতে। হাসপাতাল যাবার আগেই শহীদ হলেন ইমাম আলি। 'কমরেড' ইমাম আলি। পরে গোয়েন্দা দপ্তর জানালো, আততায়ী ছিলেন 'আনন্দমার্গী'। কদিন পর পাঞ্জাব সীমান্তে পাকিস্তান থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করতে গিতে বিএসএফের হাতে ধৃত দুই মার্গী যুবকের স্বীকারোক্তি, তাঁদের সংগঠনই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত। আসলে গেঁয়ো যোগী যেমন ভিখ পায় না, লাল শালুতে মোড়া লাশেরও তেমন, 'সিপিএম'র গণহত্যার' মত, প্রথম পাতায় ৬০ পয়েন্টের হেডিং হয় না।          
১৯৫৫'র ৯'ই জানুয়ারি বিহারের জামালপুর অঞ্চলে প্রভাত রঞ্জন সরকার ওরফে 'আনন্দমূর্তি' ওরফে 'বাবা'র হাত ধরে জন্ম এই 'আনন্দমার্গ'র। স্বঘোষিত ধর্মগুরু প্রমাণের তাগিদে শুরু হল বাবার নিত্য বচন। বাবার শিব দর্শন, শৈশবে বাঘের পিঠে জঙ্গল ভ্রমণের অলৌকিক সব কাহিনী। আনন্দমার্গ'র সর্বক্ষণের কর্মী হতে তখন দীক্ষা লাগে। পোশাকি নাম পড়ল 'অবধূত'। মার্গের রাজনৈতিক কর্মসূচী পরিচালনার জন্য তৈরি হল, 'প্রাউটিস্ট ব্লক অফ ইন্ডিয়া'। তাদের মুখপত্র 'প্রাউট' ঘেঁটে জানা যায় বাবা'র  অনন্য বিচারধারা। "অহিংসা উপর ভিত্তি করে আধ্যাত্মিকতা মানবতার কোন উপকারেই আসবে না", "ভারতবর্ষের গণতন্ত্রে নিরক্ষর ও অশিক্ষিতদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া উচিত", "কমিউনিজম মানুষ কে জন্তুতে পরিণত করে" ইত্যাদি।  স্বৈরতান্ত্রিক এবং ধর্মগোঁড়া এই বাবার লালিত পালিত গুপ্ত আধ্যাত্মিক সংগঠন যে পরবর্তী সময় জ্যোতি বসু ছাড়াও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী আব্দুল গফুর, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন এন রায় কে হত্যার ব্যর্থ ষড়যন্ত্রের করবে , এমনকি রেলমন্ত্রী ললিতনারায়ন মিশ্র হত্যাও করবে এতে আর  আশ্চর্য কি? বলদ দিয়ে তো আর হাল চাষ হয় না ।
ক্রমশ ভক্ত এবং মার্গের অভ্যন্তরেও বাবা'র বিরুদ্ধে ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়। ১৯৭১'এ কলকাতার 'ধর্ম মহাচক্র'র পর 'আনন্দমূর্তি'র স্ত্রী উমা সরকার ও প্রাক্তন অবধূত, 'প্রাউটের' অর্থসচিব নওল কিশোর আনন্দমার্গের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেন। নওল কিশোর তাঁর 'আনন্দমার্গঃ সয়েলিং  দি সাফরন রব' বইয়ে লেখেন 'গুরুর বিরুদ্ধে জেহাদের অপরাধে ৩৬ জন আনন্দমার্গী কে ছোটনাগপুরের জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে পেট চিরে, চোখ উপড়ে হত্যা করা হয়।' পরে ঐ মামলায় অভিযুক্ত অন্য এক অবধূত মাধবানন্দ'ও আদালতে জানান 'গুরুর নির্দেশে তিনি নিজেই ১৮ জন অবধূত কে হত্যা করেছেন।' আবার ১৯৭৩'র ৯'ই এপ্রিল মার্গের পক্ষে থেকে প্রচার করা হল যে বিহারের বিধানসভার সামনে দিভিয়ানন্দ অবধূত 'স্বেচ্ছা আহুতি' দিয়েছেন। ২৪শে এপ্রিল দিল্লিতেও আবার 'স্বেচ্ছা আহুতি'। পরে পুলিশি তদন্তে অবশ্য প্রমাণ হয় তাঁদের আসলে জ্যান্ত জ্বালিয়ে মারা হয়েছিল।
পুরুলিয়া ও বিহার সীমান্তে জয়পুর ও ঝালদা ২ নং ব্লকের আদিবাসী, সরকারী ও রায়তি জমি মিলিয়ে হাজার একর জমি বেআইনি ভাবে দখল করতে উদ্ধ্যত হয় এই মার্গীরা। ১৯৯০'র ১৮ই এপ্রিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুফতি মহম্মদ সঈদ লোকসভা তে এক বিবৃতিতে মার্গীদের বিরুদ্ধে জমি হাতিয়ে নেওয়ার এই সত্যতা স্বীকার তো করেনই সাথে পুরুলিয়ার বাঁশগড়ের জঙ্গলে বিদেশ থেকে আমদানি করা বে-আইনি অস্ত্র মজুতের অভিযোগও করেন। ১৯৯৫'র ডিসেম্বরর বিমান থেকে পুরুলিয়া অস্ত্র-বর্ষণ কাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত কিম ডেভি তাঁর সাক্ষ্যতেও আনন্দমার্গীর বিরুদ্ধে বিদেশ থেকে আমদানি করা বিপুল বে-আইনি অস্ত্রের কথা উল্লেখ করেন এবং জানান ঐ বিমানেই ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক আনন্দমার্গী দয়ানন্দ অবধূত।      
এতো কিছু পরও ১৯৮২'র ৩০শে এপ্রিল বিজন সেতুতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ১৭ জন মার্গী মারা যাওয়ার ঘটনা  ন্যক্কারজনক। 'ছোট্ট' , 'সাজানো ঘটনা' বা 'বিরোধীদের চক্রান্ত'  নয় বরং  ৪ঠা মে, সিপিএম রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত জানান "আনন্দমার্গীর ঘটনাতে আমরা গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি। প্রকৃত ঘটনার সঠিক তদন্ত ও দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক।"  সিপিএম বিধায়ক শচিন সেন, কান্তি গাঙ্গুলি প্রমুখের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়, বিচারও শুরু হয়। কিন্তু ঠিক কি কারণে আনন্দমার্গীরা সেদিন ঢাল তরোয়াল মড়ার খুলি নিয়ে মিছিলের অনুমতি চেয়েছিল? অনুমতি না থাকলেও তাহলে কেন সেদিন ঐ মিছিল  হয়েছিলো? কেন পরবর্তী সময় আনন্দমার্গীরা আদালতে সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে অস্বীকার করলেন? তাঁদের ধারাবাহিক অনুপস্থিতির কারণে যে মামলা বাতিল হল তাঁর দায় কার? 'সিপিএমের গণহত্যা' প্রমাণের এমন সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারালেন কেন? না এটাও ছিল ছোটনাগপুরের জঙ্গলের মতই অন্তর্দলীয় হত্যালীলা?  কিম্বা  দিল্লী-পাটনার অবধূত'দের মত 'স্বেচ্ছা আহুতি'?
২০১১'র আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলার শিরা ফুলিয়ে প্রতিশ্রুতি দিতেন "৩৪ বছরের সমস্ত গণহত্যার তদন্ত করবেন। কমিশন বসাবো"। তাহলে কেন "বিজনসেতুর সিপিএম'র গণহত্যার" প্রায়শ্চিত্ত হল না? কেন  ১৭ জন মার্গীর 'অতৃপ্ত আত্মা' বিচার পেল না? কেন সিপিএম'র কেউ জেলে গেলো না? হোক না একটা গণহত্যার সাচ্চা হিসেব নিকেশ। তৌহিদুল ইসলাম থেকে ইমাম আলি। অজিত লোহার থেকে শালকু সরেন। ঝর্না মান্ডি থেকে রোহিত ভামুলা। হোক সেটা, ইতিহাসের পাতা থেকেই। যে ইতিহাস আত্মবলিদানের। যে ইতিহাসের পাতা বামপন্থীদেরই রক্তে ভেজা। যেখানে জমাট রক্তের রং লাল। শুধুই লাল...

শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৬

হাজার লেনিন ~ অনামিকা মিত্র


একটা লেনিন কাগজ কুড়োয়, ঝরতি এবং পরতি
একটা লেনিন ...রক্ত বমি ,হাসপাতাল -এ ভর্তি,
একটা লেনিন ইস্কুল -ছুট ,অনেক রাস্তা হেঁটে
একটা লেনিন বাদাম জোগায়, ট্রেন -যাত্রীর পেটে ,
একটা লেনিন ভর-সন্ধ্যায় ,গলির মুখে ছিনতাই
একটা লেনিন ধুঁকছে নেশায় ,ঝিমোয় সারা দিন টাই ,
একটা লেনিন ,প্রমোটরের বাধ্য কেয়ার টেকার
একটা লেনিন শিক্ষা শেষে ,বিষন্ন -মুখ বেকার ,
একটা লেনিন গলায় দড়ি .."আলু -র তত দাম নেই "
একটা লেনিন চায়ের দোকান, বন্ধ মিলের সামনেই,
আমরা হাজার - লক্ষ্ লেনিন ,আমরা কবে ভাববো -
লেনিন মানে সত্যি বাঁচা ,বেঁচে থাকার কাব্য !

মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৬

যো ডর গ্যায়া সমঝো মর গ্যায়া ~ সুশোভন পাত্র

কিংসমিড,ডারবান, ২০০৭। স্টুয়ার্ট ব্রডের ওভারের প্রথম বলটা, ওয়াইড লং অন বাউন্ডারির উপর দিয়ে উড়ে গেছে গ্যালারির পিছনে। দ্বিতীয় বলে, কব্জি মোচড়ানো ফ্লিকটা আছড়ে পড়ল ডিপ স্কয়ার লেগের গা ঘেঁষা বিল্ডিং'র কার্নিশে। ক্যামেরার লেন্স তখন জুম করেছে অনুতপ্ত ফ্লিনটফের মুখ। তৃতীয় বলের পর সাইড চেঞ্জ। এবার রাউন্ড দা উইকেট। আর এবার, ডিপ এক্সট্রা কভার। চতুর্থ বলের পর শর্ট মিড উইকেট থেকে দৌড়ে এসে বোলার কে পরামর্শ দিয়ে গেলেন ক্যাপ্টেন কলিংউড। অতঃপর ফিল্ডিং চেঞ্জ। পঞ্চম ও ষষ্ঠ বলের আগে একে একে বলার কে সাহস দিয়ে গেলেন লিউক রাইট, পিটারসেনরা। কিন্তু কোন কিছুই সেদিন রাজসিক যুবরাজ কে ক্রিকেটের ক্যানভাসে ধ্রুপদী রূপকথার ছবি আঁকা থেকে আটকাতে পারেনি। এক মহাপুরুষ বলেছিলেন, "তুমি যাহা চিন্তা করিবে, তাহাই হইয়া যাইবে। যদি তুমি নিজেকে দুর্বল ভাবো, তবে দুর্বল হইবে; তেজস্বী ভাবিলে তেজস্বী হইবে।" ভারতবর্ষের বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে এই 'ভাববাদের প্রাসঙ্গিকতা প্রশ্নাতীত না হলেও অনেক সময়ই ক্রিকেট কেবলই 'মনস্তাত্ত্বিক'। আপনি যেখানে চাইবেন বোলার ঠিক সে-খা-নে-ই বল করবে। নাহলে ইংলিশ বা হাতি ওপেনিং ব্যাটসম্যান, ক্রিস ব্রডের, এই ছেলে, যে এখন ইংল্যান্ড ক্রিকেটের মেরুদণ্ড, টি২০ ক্যাপ্টেন, সে কিনা  ছ-খানা বলই নিয়ম করে হয় হাফভলি না হয় ফুলটসে সাজিয়ে দিলেন। আরে টি-২০ ক্রিকেটের স্লগ ওভারে বল করতে যাওয়ার আগে, আমাদের পাড়ার গাবলু অবধি আপনাকে পই পই করে বলবে "আর যাই কর বাছা, ফুলটস আর হাফভলিটা দিস না"। আসলে নার্ভাসনেস দাদা, নার্ভাসনেস। এটাই হল অন ফিল্ড নার্ভাসনেস। গব্বর সিং বেঁচে থাকলে বলতেন "যো ডর গ্যায়া সমঝো মর গ্যায়া।" তখন আপনি যতই ভাবুন ইয়র্কার দেবেন ঠিক দেখবেন ফুলটস পড়ে গেছে। যতই ভাবুন বাউন্সার দেবেন দেখবেন হাফভলি পড়ে গেছে। আর যতই ভাবুন সিপিএম কে বাঁশ দেবেন দেখবেন, মুকুল উল্টো গাইছে, ম্যাডাম ক্ষমা চাইছেন, বৌ-বাজারের মোড়ে স্লিপ ও টাং'এ ভাইদের পথে বসিয়ে বলছেন "আগে জানলে টিকিটই দিতাম না"
তা ম্যাডাম, লজ্জার মাথা খেয়ে, না হয় ধরেই নিলাম যে আপনি আগে কিছুই জানতেন না। কিচ্ছুটি না। আপনি একেবারে শিশুর মত নিষ্পাপ। ফুলের মত কোমল। তা এবার তো জানেন? না হয় প্রার্থী তালিকা ঘোষণাই হয়ে গেছে, কিন্তু ডিয়ার 'অগ্নিকন্যা' ওরফে 'সততার প্রতীক' ওরফে 'মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়', আপনি যদি সত্যি কাউকে প্রার্থী হিসাবে নাই চান, তাঁদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে খড়গহস্তই হন, তা হলে তো শুভেন্দু বাবুর মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের এখনও তো সময় আছে। হোক প্রত্যাহার। গোটা রাজ্য বয়ে বেড়িয়ে, হেলিকপ্টার হাঁকিয়ে, আপনিই তো বলে বেড়াচ্ছেন, ২২০'র বেশি আসন সহ জয় নাকি নিশ্চিত। তা আপনার তো দয়ার শরীর ম্যাডাম, দিন না ছেড়ে ঐ গোটা পাঁচ-সাতটা সিট। সমুদ্র থেকে দু-বালতি জল তুলে নিলে আর কিই বা যায় আসে বলুন। আপনার সম্মানও বাঁচবে। সততা পারদও চড়চড় করে ঊর্ধ্বগামী হবে। আর একান্তই যদি এসব কিছুই করা না যায়, তাহলে তোয়ালা খ্যাত শ্রী শোভন বাবু কে দিন তো মেয়র পদ থেকে সরিয়ে। করুন স্থাপন একটা জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। আরে বাবা কলকাতা পৌরসভা নির্বাচনের তো নিশ্চয় আর প্রার্থী ঘোষণা হয়নি। তাই না?
ইংল্যান্ড তখন ঘরোয়া ক্রিকেটে টি-২০'র আঁতুড় ঘর পেরিয়ে এসেছে। সে ম্যাচে কিছু টি-২০ স্পেশালিষ্ট নামিয়েছিল। কি হাবভাব তাঁদের। কি সব ভয়ঙ্কর নাম। ড্যারেন ম্যাডি, দিমিত্রি ম্যাসকেরেনাস। বলছে, কেউ নাকি ছয় মারার স্পেশালিষ্ট তো কেউ  ইনসুইং'র। ঠিক যেন অনুব্রত আর আরাবুল। কেউ গুড় বাতাসা, কেউ চড়াম-চড়াম। কিন্তু দুঃখ হল, এতো কিছুর পর দিদি এখন আমাদের নার্ভাস স্টুয়ার্ট ব্রড। প্রথম তিন দফার পরই লুস বল দিতে শুরু করেছেন। বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচন কমিশনে দৌড়ে গিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। ক্যাপ্টেন এসে পিঠ চাপড়ে সাহস দিচ্ছেন। দিদি সাইড চেঞ্জ করছেন। রিষ্ট ব্যান্ড ঘাম মুছছেন। নতুন করে ফিল্ডিং সাজাচ্ছেন। আজ বর্ধমান তো কাল এন্টালি দৌড়চ্ছেন। কিন্তু যেই রান আপ শেষে বল করছেন, সেই হয় হাফভলি না হয় ফুল্টস। ছ দফা ওভারে এবার একটা নো বল'ও হবে। আর নো বলে তো আবার ফ্রি হিট। দিন ফ্রি হিটে স্টেপ আউট করে ।বাপি এবার বাড়ি যা...

রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৬

চিক্কুস ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য্য

লাল মোরাম বিছানো রাস্তা। গাড়ি গেলে খরখর করে শব্দ হয়।
অবশ্য গাড়ি আর ক'টা! স্কুল ট্রিপ বা মার্কেটিং ট্রিপের ভ্যান, নয়তো বাবার অফিসের এম ডি মাঝেসাঝে এলে।
রাস্তার দু'ধারে কৃষ্ণচূড়া দেবদারু আর নাগকেশর গাছ। তার তলায় রঙ্গন, সিনোয়ারি, বাবলা, লজ্জাবতীর ঝোপ। ওইখানে বহুরূপীগুলো লুকিয়ে থাকে আর মাঝে মাঝে ঘাড় তুলে দেখে কে এলো। মাঝে মাঝে টকটকে লাল রঙ, ভেলভেটের মতো গা, ছোট্ট মাকড়সা দেখা যায়। তুড়ুক তুড়ুক করে কাঠবিড়ালি লাফায়। ফড়িং ওড়ে। একটু ভিজে জায়গায় শামুক থাকে।
  রাস্তা দিয়ে এগোলে কলোনীর গেট। পাশে বুগনভিলিয়া। তার ছায়াতে ফোল্ডিং চেয়ারে বসে থাকে সিকিউরিটি কাকু। আমি ছিপটি হাতে রাস্তায় দাগ টানতে টানতে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাই। কাকু আমাকে চেনে, হাসে। এখন গরমের ছুটি। সকালেই আমার পড়াশোনা শেষ করে বেড়াতে বেরোই। হাতে থাকে ছিপটিটা। নতুন কোনো ফুল, নতুন কোনো পাতা পেলে কুড়িয়ে আনি। দুপুরে বাবা ভাত খেতে আসলে দেখাই। গোল নুড়ি পেলে মা-কে এনে দিই। মা সাজিয়ে রাখে।
এইরকমই একদিন হাঁটতে হাঁটতে কলোনীর বাইরে দেখি একটা জটলা। কয়েকজন লোক একটা বাচ্চা বাঁদরকে ঘিরে বসে আছে। মায়ের কোল থেকে নাকি পড়ে গেছে, ভয়ে জুলজুল করে তাকাচ্ছে। আমাকে দেখেই আমার কোলে উঠে পড়লো। সবাই বলল, তাহলে ওটা আমার কাছেই থাক। আমিও নিয়ে চলে এলুম বাড়ি। মা খুব খুশী, বাবাও এসে খুশী হল। ছোট প্লাস্টিকের ডিশে একটু দুধ দিতে চুকচুক করে খেল। জল খেল। আর আমার কোলে উঠে বসে রইল। আমি নাম দিলুম জুলজুল। বাবা নাম দিল মাঙ্কিম্যান। মা নাম দিল চিক্কুস। মায়ের দেওয়া নামটাই রয়ে গেল। 
এইভাবে চিক্কুস আমাদের বাড়ি এল। আমার একটা সারাদিনের সঙ্গী হল। বিস্কুট দিলে অনেকটা মুখে পুরে গালের একপাশে রেখে দিত। রাত্তিরে আমাদের বাইরের চৌবাচ্চার পাশে একটা বস্তা নিয়ে মাথায় ঘোমটার মতো টেনে ঘুমোতো। তখন ওকে দেখতে লাগতো ঠিক একটা বুড়ো দাদুর মতো। সেই সময় ওকে জাগিয়ে দিলে রেগে দাঁত খিঁচোত খুব! চান করতে চাইত না। আমি ওকে ধরে বাগানে জলের পাইপ দিয়ে চান করাতুম। নখ কেটে দিতুম। আমার কাছে খুব শান্ত হয়ে থাকতো। মা একটা প্যান্ট সেলাই করে দিয়েছিল, ল্যাজের জায়গায় ফুটো। সেটা পরে ঘুরতো।
তারপর আমার স্কুল খুলে গেল। সারাদিন আর দেখতে পেতুম না চিক্কুসকে। বিকেলে আমি ফিরলেই লাফিয়ে এসে জড়িয়ে ধরতো। মা বলতে শুরু করতো ওর সারাদিনের গল্প। বদমায়েশীর নালিশ করলে চিক্কুস চুপ করে বসে থাকতো, মাথা নীচু। যেন কতো অনুতাপ। অনুতাপ কথাটা বাবা শিখিয়েছিল আমাকে।
আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো, বদমায়েশিও বাড়তে লাগল। রাস্তায় কুকুরগুলোর সঙ্গে খেলতো, কাঠবিড়ালি দেখলে তাড়া করে জামগাছে, পেয়ারাগাছে উঠে যেত। একদিন দরজা রঙ করবার জন্যে সবুজ রঙের কৌটোটা উল্টে সারা গায়ে মাখলো, ঘরময় করলো। সেদিন ওকে কেরোসিন তেল দিয়ে চান করাতে হলো। টেবিলে পেয়ারা বা কলা রাখলেই এসে খেয়ে নিত। বকলে মাথা নীচু করে থাকতো, আবার যে কে সেই। বাথরুম পেলে টয়লেটে যেত, শিখিয়ে দিয়েছিলুম। মাঝে মাঝে দেখতুম উদাস হয়ে বসে আছে, হয়তো ওর মায়ের জন্যে মন কেমন করতো...
তারপর কলোনীর অন্য কাকুরা নালিশ করতে আরম্ভ করলো। চিক্কুস নাকি ওদের বাড়ি গিয়ে সব নষ্ট করছে! লোকের চাপে ওকে বেঁধে রাখা হোত। করুন স্বরে কাঁদতো, আমার মায়া হোত। খুলে দিতুম। আবার বদমায়েশি করতো, আবার নালিশ আসতো।
  এর মধ্যে আমাকে একটা বড় ইস্কুলে ভর্তির পরীক্ষা দিতে হোল। সেখানে নাকি হস্টেলে থাকতে হবে! চিক্কুসকে একদিন বললুম, যে আমাকেও ওর মতো মা বাবাকে ছেড়ে থাকতে হবে। ও কী বুঝল কে জানে, আমাকে জড়িয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। ওকে ভদ্র করবার যতোই চেষ্টা করতুম, ও আরও বাঁদর তৈরি হছিল। সেই সময়েই ঘটলো দুর্ঘটনাটা। বাবার অফিসের ডিরেক্টরের ছোট্ট নাতি এসেছিল বেড়াতে। আমাদের কোয়ার্টার্সের সামনে দিয়ে হাঁটছিল। নতুন ছেলে দেখে চিক্কুস তেড়ে গেছিল, ভয় পেয়ে ছেলেটা দৌড়ে পালাতে গিয়ে পড়ে গেল। হাঁটু ছড়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গিয়ে সে বানিয়ে বললো চিক্কুস নাকি ওকে আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে! বাবাকে ডেকে ডিরেক্টর বললেন, বাঁদরটাকে এখনই বিদায় করতে। বাকিরাও সায় দিল। যারা চিক্কুসের খেলা দেখে মজা পেত এতদিন, তারাও একে একে নালিশ করতে লাগলো। আমরা অবাক হয়ে দেখলুম।
সেই ডিরেক্টরই এক রবিবার ফোন করে ব্লু ক্রসের গাড়ি ডেকে পাঠালো। সেদিন আমরা সকাল থেকে কেউ কিচ্ছু খাইনি। চিক্কুসও খায়নি। ভ্যান থেকে দুজন কাকু নামতেই চিক্কুস পালিয়ে গাছের ওপর উঠে পড়লো। কিছুতেই নামছিল না। শেষে আমি গিয়ে ডাকলুম, তখন নেমে এল। আমার কোলে উঠে আমায় শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। একজন কাকু ওকে কী একটা ইঞ্জেকশন দিল, ঘুমের ওষুধ নাকি। চিক্কুস একটু কেঁপে উঠে আমাকে আরো জড়িয়ে ধরলো। আমি দাকলুম, "চিক্কুস! চিকাই!" জুলজুল করে তাকালো, সেই একদম প্রথম দিনের মতো। কী যেন একটা বলতে চাইল। তারপর আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল আমার কোলে। আমি ওর পিঠে, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলুম।
ব্লু ক্রসের কাকুটা বাবাকে বলল, আমরা ওকে যখন খুশী গিয়ে দেখে আসতে পারব। কিন্তু তাতেও বাবা খুব কষ্ট পাচ্ছিল। মা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই বসেছিল। কাকুটা আমার কোল থেলে যত্ন করে চিক্কুসকে নিলেন, একটা নরম তোয়ালে জড়িয়ে ভ্যানে তুললেন। দরজা বন্ধ হল, তারপর চিক্কুসের জামগাছের তলা দিয়ে, পেয়ারা গাছের পাশ দিয়ে, সেই লাল রাস্তা দিয়ে খরখর শব্দ করে ভ্যানটা...
...আর লিখতে পারছি না...

বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৬

সাঁইবাড়ি ~ সুশোভন পাত্র

ঐ ২০১২। রাস্তার কোল ঘেঁষে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে লেনিন। কার্ল মার্ক্স আর এঙ্গেলস খাবি খাচ্ছে পিছনের নর্দমার হাঁটু ভর্তি জলে। ফোট ফ্রেম সহ স্তালিন হামাগুড়ি দিচ্ছে রাস্তায়। জ্যোতি বসুর মুখে লেপা আলকাতরা। সাদা-কালো কাকাবাবুর ছবিতে পেচ্ছাবের বিশ্রী গন্ধ। সাবল দিয়ে ভাঙ্গা গেটের তালাটা ছুঁড়েই ভাঙ্গা হয়েছে টিভিটা। মেঝে ভর্তি ভাঙ্গা চেয়ার-টেবিল। উপরের তাকটা থেকে মাঝে মাঝে গায়ে এসে পড়ছে মেম্বারশিপ ফর্মের টুকরো গুলো। গোটা ঘর তছনছ। আর বাইরে, এককোণে, তখনও, আগুনে পুড়ছে কিছু জরুরী কাগজপত্র আর গোটাকতক লাল পতাকা। হার্মাদ সিপিএমে'র ৩৪ বছরের বা তারও আগের 'গণহত্যা'র বদলা নিয়ে, জোনাল পার্টি অফিসে, 'গণতন্ত্রে'র নিদর্শন রেখে গেছেন, একালের 'সততা'র পূজারীরা। পাড়ার মোড়, রাস্তা-ঘাট, চায়ের ঠেক স্পিকটি নট। লোকাল পুলিশ আরও স্পিকটি নট। অ্যাপলিটিক্যাল, নিরপেক্ষ, মধ্যপন্থী, সুশীল, বুদ্ধিজীবী,কবি, টেক্সাসের বাঙালি টেকনোক্র্যাট, ম্যানচেস্টারের প্রবাসী চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, আরও আরও স্পিকটি নট। আসলে নন্দীগ্রাম থেকে মরিচঝাঁপি, আনন্দমার্গী থেকে নেতাই'র 'গণহত্যার' কাণ্ডারি সিপিএম'র প্রতি নিখাদ জনরোষ দাদা। 'গণহত্যা' বলে 'গণহত্যা'? সেই সাঁইবাড়ি দিয়ে শুরু। ভয়ানয়-ভয়ঙ্কর। সে কি মশাই আপনার সাঁইবাড়ি মনে নেই? সাঁ-ই-বা-ড়ি? 

৭০'র উত্তাল বাংলা।একদিকে কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার বাংলা। 'লাঙ্গল যার জমি তার' আর 'বেনামি জমি দখল রাখো, দখল রেখে চাষ কর' শ্লোগানে মুখরিত বাংলা। আর অন্যদিকে, যুক্তফ্রন্ট সরকার, রাষ্ট্রপতি শাসন, মুক্তিযুদ্ধের তাপে তেতে ওঠা বাংলা। বিকল্প জোটের সুশীল ধাড়া কে সঙ্গে নিয়ে, ১৬'ই মার্চ পদত্যাগ করলেন অজয় মুখার্জি। সিপিএম'র নেতৃত্বাধীন সংখ্যাগরিষ্ঠ যুক্তফ্রন্ট কে সমর্থন করতে অস্বীকার করল ফরওয়ার্ড ব্লক, এসইউসিও। ১৩ মাসের মধ্যেই আবারও মুখ থুবড়ে পড়ল দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। বাংলা কংগ্রেসের বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিবাদে, বিপিটিউসি সহ অন্যান্য গণ সংগঠনের ডাকে, পরেরদিন রাজ্য জুড়ে ধর্মঘট পালিত হবে। 

ধর্মঘটের সমর্থনে, ১৭'ই মার্চ সকালে বর্ধমানে তখন আদিবাসী ও কৃষকদের লাল ঝাণ্ডার লম্বা মিছিলে হঠাৎ আক্রমণ। শুরু হল ব্যাপক বোমাবাজি। ছত্রভঙ্গ জনতা প্রতিরোধের রুদ্ররূপ দেখে গুণ্ডারা তখন ঐ সাঁইবাড়ি'র আশ্রিত। জনতার সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে নিহত হলেন মলয় সাঁই, প্রণব সাঁই এবং জিতেন রায়। অবশ্যই নিন্দনীয় এবং অনভিপ্রেত। কিন্তু কারা এই মলয় সাঁই, প্রণব সাঁই? রবীন্দ্র-নজরুল-বিবেকানন্দ নাকি? না ধোয়া তুলসী পাতা? না, বরং, কংগ্রেস জমানাতেই পিডি অ্যাক্টে অভিযুক্ত জেল ফেরত দাগী আসামী। তাঁদের জামিনের প্রাক শর্তই তো ছিল বর্ধমান শহরে প্রবেশ নিষিদ্ধতা? তাহলে কেন এবং কার মদতে তাঁরা সেদিন এসেছিলেন বর্ধমান শহরে? কোন পুণ্য কাজটা করতে এসেছিলেন? 

তৎকালীন রাজ্যপাল ধরমবীর অবশ্য সেদিন সন্ধ্যেতেই ছুটে গিয়েছিলেন সাঁইবাড়ি তে। সিপিএম'র 'গণহত্যা'। জব্বর ব্যাপার। তা বেশ, সাঁইবাড়ি, না হয় 'গণহত্যা'। আর ঐ দিনই হুগলির ত্রিবেণীর কেশোরাম রেয়নে শ্রমিক নেতা ননী দেবনাথ সহ পাঁচজনের এনকাউন্টার? টুকরো টুকরো করে ফার্নেসে ছুঁড়ে ফেলা লাশ? রাজ্য জুড়ে আরও ১৫ জন বাম কর্মীদের খুনের জমাট রক্ত? হবে নাকি 'গণহত্যা' নিয়ে একটা ঘণ্টা খানেক স্যার? ২২'শে এপ্রিল, মঙ্গলকোটের গরিব খেতমজুর মীরপাড়াতে গর্ভবতী পুস্পরানি মাঝির উপর সিআরপিএফ'র নির্মম অত্যাচার, তুলসী মাঝির কোল থেকে ছুঁড়ে ফেলা শিশুর আর্তনাদ, ডাব বাগদী থেকে শুরু করে ৮০ বছরের ইন্দুমতী মাঝির শ্লীলতা হানি, কুয়োয় ফেলা শ্যাম দাসীর চার বছরের সন্তানের নিথর মৃতদেহ। তখনও আঁতুড় ঘরের চৌকাঠ না ডিঙানো কিম্বা দুগ্ধপোষ্য, আজকের 'সততা'র পূজারী ভাইরা, হোক না 'গণহত্যার' একটা হিসেব-নিকেশ। 

সাঁইবাড়ি কাণ্ডে, ঐ দিনই, দুপুর সাড়ে বারোটায়, দিলীপ কুমার ভট্টাচার্যর অভিযোগের ভিত্তিতে, বর্ধমান থানায় প্রায় ১৫০০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ রুজু হয়। ঐ অভিযোগে নাম না থাকলেও, ডিডিআই আসানসোল পরে বিনয় কোঙার নাম যুক্ত করে, মোট ১১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। ৭৩'এ রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বর্ধমান আদালত মামলাটি আলিপুরের সাব ডিভিশনাল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে স্থানান্তরিত হয়। ৭৭'এ সরকার ফৌজদারি কার্যবিধির ৩২১ ধারা মতে আবেদন করলেও বিচারপতি গীতেশরঞ্জন ভট্টাচার্য মাত্র চারজন অভিযুক্তর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের অনুমতি দেন। পরে পাবলিক প্রসিকিউটার একটি চিঠি এনেক্সচার রূপে জমা দেন তাতে দিলীপ কুমার ভট্টাচার্য পরিষ্কার লেখেন যে- তিনি প্রত্যক্ষদর্শী নন। তৎকালীন কংগ্রেসের জেলা সম্পাদক নুরুল ইসলামের অভিযোগ পত্রে সাক্ষর করেছেন মাত্র। চার্জশিটের অপর সাক্ষী ইতিকা দত্ত আদালত কে জানান তিনি ঐ সময় শহরেই ছিলেন না। মৃত মলয় সাঁই ও প্রণব সাঁই'র জীবিত ভাই বিজয় সাঁই, ভগ্নী স্বর্ণলতা যশ ও ভগ্নীপতি অমলকান্ত যশও বিচারপতি কে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করলে, বিচারপতি আবেদন মঞ্জুর করে সমস্ত অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস করেন।

প্রতীকী তে কিম্বা পৌত্তলিকতায় আমার কোন বিশ্বাস নেই। তাই স্তালিনের হামাগুড়ি, লেনিনের ডিগবাজি, মার্ক্সের খাবি খাওয়াতেও আমার কিছুই যায় আসে না। ছবি টাঙ্গালেই যেমন পার্টি অফিসে যেমন জ্যোতি বসুর আত্মা ভর করে না, দাঁড়ি রাখলেই যেমন রবীন্দ্রসঙ্গীত আসে না, চে'র টি শার্ট পরলেই যেমন বলিভিয়ার জঙ্গলে বিপ্লব হয় না, হাওয়াই চটি পরে ঘুরলেই যেমন কেউ 'সততার প্রতীক' হয়ে যায় না, ২১শে জুলাই'র মঞ্চে পাগলু নাচিয়ে যেমন 'শহীদ দিবস' পালন হয় না, চোখ বন্ধ করে ট্রাফিক লাইটের নিচে নাচতে শুরু করলে যেমন সেটা ডিস্কো লাইট হয়ে যায় না, ঠিক তেমনই গলার জোরে 'সাঁইবাড়িও 'গণহত্যা' হয় না। গণহত্যার হিসেব-নিকেশ যদি করতেই হয়, তাহলে হোক সেটা, ইতিহাসের পাতা থেকে। যে ইতিহাস আত্মবলিদানের। যে ইতিহাসের পাতা বামপন্থীদেরই রক্তে ভেজা। যেখানে জমাট রক্তের রং লাল। শুধুই লাল...

শনিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৬

সখী, খিস্তি কাহারে কয় ~ মনিপর্ণা সেনগুপ্ত মজুমদার

"খিস্তি" শব্দটির ভিতরেই কিরকম একটি অনেক না-বলা ব্যঞ্জনা রহিয়াছে। খানিক নিষিদ্ধতা, খানিক ভীতি এবং যৎপরোনাস্তি ঘৃণা- এইসব মিলিত হইয়াই বোধহয় একেকটি বিশেষ শব্দ অসাধারণ অর্থবহ হইয়া উঠে এবং যেকোন মানুষের কর্ণপটাহে তথা মানসসাগরে নিদারুণ যাতনা সৃষ্টি করিতে সমর্থ হয়। কিন্তু সত্যই কি তাই? নাকি সময়, অবস্থান, মানসিকতা এবং ব্যক্তিবিশেষে কোন একটি শব্দের অর্থের তারতম্য ঘটে?
সর্বাগ্রে এই আমার কথাই ধরি। শিশুকাল হইতেই "বইপোকা " হইবার সুবাদে তথাকথিত বড়দের, অতি-বড়দের বই-ও পড়িয়া ফেলিয়াছিলাম। পীতাভ, শুভ্র বা নীলাভ, বই পড়িবার ক্ষেত্রে কোনরূপ বর্ণবৈষম্য না থাকার ফলে আমি জাগতিক প্রায় সমস্ত রকম চলতি অশ্রাব্য গালিগালাজ সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করিয়া ফেলিয়াছিলাম অল্প বয়সেই। তথাপি মুশকিল ছিল যে, কিছুতেই একটি অশালীন শব্দও আমার মুখ গহ্বর হইতে নির্গত হইতে চাহিতনা। মনে মনে ভাবিতাম, বলিব, এই বার ঠিক বলিব, তথাপি কার্যকাল উপস্থিত হইলে কোন্‌ বারাঙ্গনার সন্তান যে আমার কণ্ঠরোধ করিয়া ফেলিত তাহা ভাবিয়া পাইতামনা। শুধু যে বলিবার সমস্যা ছিল তাহা নহে, কেহ কুবাক্য উচ্চারণ করিলেও রীতিমতন  শিহরিয়া উঠিতাম।   এমতবস্থায়, এক সুন্দর স্বর্নালী সন্ধ্যায় এক বালক-বন্ধু ইতিহাসে পঁচিশে পাঁচ পাইল এবং সমস্ত সম্পর্কের মাতা-ভগিনী করিয়া শিক্ষিকাকে শ্যালিকা সম্বোধন করিয়া বসিল। আমি যথারীতি চমকাইয়া উঠিয়া তাহাকে নিরস্ত করিবার চেষ্টা করিতেই বিকট মুখব্যাদান করিয়া আমাকে ভ্যাংচাইয়া আমার প্রাপ্ত পূর্ণমানের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপনপূর্বক সে আমাকে জানাইল যে এরূপ সম্বোধনই শিক্ষিকার প্রাপ্য, এবং যেহেতু ইহাতে আমার একটিও যৌনকেশ উৎপাটিত হইতেছে না সেহেতু নীরবতা পালনই আমার পক্ষে শ্রেয়!
অদ্যপি সকলেই জ্ঞাত আছেন যে বাঙালী  নারী কদাচ এরূপ বাচালতা সহ্য করেনা। সুতরাং আমিও ক্রোধে অন্ধ হইয়া, সমস্তরকম শিষ্টতা বিসর্জন দিয়া 'মূর্খ -সঙ্গমকারী'  বলিয়া তাহার হাত মোচড়াইয়া দিয়া দ্রুতপদে সেই স্থান ত্যাগ করিলাম। বালক-বন্ধুটি বিস্ময়াহত হইয়া স্থাণুবৎ হইয়া রহিল। "আমি তখন নবম শ্রেণী"।
সেই শুরু।
তাহার পর কলিকাতার রাজপথ দিয়া বহু জল প্রবাহিত হইয়াছে। আমিও বেশ অনেকগুলি বসন্ত পার হইয়া আসিয়াছি। মাতা ঠাকুরানী যাহা ছিলেন এবং মাতা ঠাকুরানী যাহা হইয়াছেন- তাহার মধ্যে সহস্র যোজন ব্যবধান। অদ্য নানাবিধ কুবাক্য অনায়াসে উচ্চারণ করিতে পারি এবং কী আশ্চর্যের ব্যাপার, এতটুকু পাপবোধ হয়না। শুধুমাত্র তাহাই নহে, উপরোক্ত শব্দাবলী আর তদ্রূপ অশালীন বলিয়াও বোধ হয়না। অবশ্য বহু ব্যবহারে তরবারির শাণিত ফলা-র তীক্ষ্ণতাও হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, আর ইহা তো নিতান্তই আমার নিজস্ব শালীনতা বোধ!
যাহা হউক, এক্ষণে গৌরচন্দ্রিকা যথেষ্ট হইয়াছে, পূর্বোক্ত আলোচনায় ফিরি। "খিস্তি", এক অর্থে প্রকৃত সাম্যবাদের প্রবক্তা। যে খিস্তিসকল নগণ্য  রিক্‌শাওয়ালা  দিয়া থাকেন, সেই একই ভাষা আপনি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রকোষ্ঠে বসিয়া আপনার ঊর্ধতন কর্মচারীর প্রতি প্রয়োগ করেন। বলাই বাহুল্য, যে catharsis-ও অভিন্ন দুই ক্ষেত্রেই। আবার, সামান্য দুইটাকা খুচরা না দিতে পারার হেতু অটো ওয়ালা  যে মুহূর্তে আপনার চৌদ্দ গুষ্টির গুহ্যদ্বারের  একশত আট করিতে থাকেন, তখন যেরূপ মনোবেদনা বোধ করেন, সেই একই বাক্য যখন কোন বন্ধুবর প্রয়োগ করে তখন সেরূপ প্রবল প্রসববেদনা হয়না। ইহার কারণ প্রথমেই উল্লেখ করিয়াছি, ব্যক্তি ও স্থানবিশেষে একই খিস্তির বিভিন্ন অর্থ হইয়া থাকে এবং মনোজগতে তার প্রভাবও ভিন্ন।
একটি উদাহরণ রাখিতেছি; আমার পরম পূজনীয় পতিদেবের এক অভিন্ন হৃদয় বন্ধু, যিনি উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজে অতীব সম্মানিত, তাঁহার একটি মহৎ দোষ হইল যে হলাহল-সম আসব সামান্য অধিক পরিমাণে পান করিবার পর তিনি কিঞ্চিৎ অস্থির হইয়া পড়েন এবং তখন তাঁহার বাক্যাবলীর মধ্যে পুরুষের প্রধান অঙ্গটির (অধিকাংশ পুরুষের মতানু্যায়ী উহাই তাহাদের প্রধান অঙ্গ, মস্তিষ্ক নহে) একটি চলিত রূপের প্রয়োগ বিশেষভাবে বৃদ্ধি পাইয়া থাকে।
অপর এক বন্ধুর নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে কয়েক বৎসর পূর্বে আমার পতিদেব, এবং উল্লিখিত বন্ধুটি তাঁহার গৃহে গমন করেন। উষ্ণ পানীয় সমাপনান্তে যেক্ষণে সকলেই আহারাদিতে ব্যস্ত এবং বন্ধুর মাতৃদেবী স্বয়ং তদারকিতে, সেক্ষণে ইনি হঠাৎ বিগলিত হইয়া গদ্গদ কন্ঠে বলিয়া উঠিয়াছিলেন, (পাঠকের বোধের সুবিধার্থে হুবহু প্রতিলিপি দেওয়া হইল), "মাসিমা, বাঁআ, মাংসটা যা বানিয়েছেন বাঁআ, ওঃ, বহুদিন পরে বাঁআ এমন মাংস খেলাম"।
ইহা শ্রবণ করিয়াও 'মাসিমা' র হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া যে সহসা স্তব্ধ হইয়া যায় নাই, ইহাতেই প্রমাণ হয় যে এই কলিকালেও ভগবান আধা-জাগ্রত অবস্থায় বিরাজমান। ইহাতে আরো প্রমাণ হয় যে কথার মাত্রা হিসেবে, শুধুমাত্র নিজ অভিব্যক্তি প্রকাশের নিমিত্তও কোন কোন সময় খিস্তি ব্যবহৃত হইয়া থাকে। যাঁহারা এরূপ করিয়া থাকেন, কাহাকেও মানসিক আঘাত দিবার জন্য নহে, শুধুমাত্র অভ্যাসের বশেই বলিয়া ফেলেন।
যাহা হউক, আরো একটি ব্যাপার হইল যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হওয়ার কারণে নারীজাতির অবমাননা করা হয় খিস্তির মাধ্যমে। উহা লইয়া পৃথক একটি আলোচনা করিবার অভিপ্রায় রাখিলাম।ইয়ে, তেমন গুরুপাক কিছু নহে। 

ক্ষমা? ~ সুশোভন পাত্র

নিভিয়া'র বডিলোশেন নিয়মিত মাখলে নাকি আপনার স্ত্রী'র ত্বক এমন একটা বিশেষ মাত্রায় 'সফট' হবে যে ঘর ছেড়ে আপনার আর অফিস যাওয়াই দায়। ডাভ সাবানের যত্নশীল ব্যবহারে আপনার গালে আবার ফিরে আসতে পারে শৈশবের নরমতা। জনসন অ্যান্ড জনসনের ম্যাসাজ ওয়েলের দ্বি-প্রাহরিক মর্দনে আপনার শিশু পুত্রের পশ্চাদদেশের নমনীয়তা টেক্কা দেবে কাপার্সের কোমলত্ব কে। লোরিয়েলের লাস্যময়ী শ্যাম্পু আপনার মাথার চুল কে করবে গোড়া থেকে শক্ত এবং বাইরে থেকে নরম। আজকাল তো, ক্লোস আপের দয়ায় ৩২ পাটি দাঁত, সিন্ডিকেটের ক্যারিশমায় উড়ালপুলের স্ল্যাব, আর ভোটের বালাইয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সুরও নরম হচ্ছে। কিছুদিন আগেও যিনি সবাইকে "ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে মেপে" নিচ্ছিলেন, "কত ধানে, কত চাল" কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নিচ্ছিলেন, পুলিশ কে "চাবকে লাল" করে দিচ্ছিলেন, নিজেকে "রাফ এন্ড টাফ" দাবি করছিলেন, নিজের মার্কশিটে নিজেই ১০০/১০০ বসিয়ে ফেলছিলেন আর গলার শিরা ফুলিয়ে "আমাকে ধমকালে আমি চমকাই, আমাকে বর্ষালে আমি গরজাই", "তুমি বুনো ওল হলে আমি বাঘা তেঁতুল" -- ডায়লগে বাজার গরম করছিলেন, তিনি কিনা শেষে  করজোড়ে ক্ষমা চাইছেন? ভুল স্বীকার করে মানুষের করুণা আর সহানুভূতি ভিক্ষা করছেন?
তা কে আপনাকে ক্ষমা করবে ম্যাডাম? গলায় ছ-খানা টাঙ্গির কোপ খেয়ে মধ্যমকুমারির জঙ্গলে পড়ে থাকা সালকু সরেনের লাশটা? না মাওবাদীদের ফতোয়ায়, বৃদ্ধা বিধবা মা'র শত অনুরোধেও, সালকুর মৃতদেহ সৎকার করতে  সাহস না করা গ্রামবাসীরা? কার সহানুভূতি আপনি চাইছেন? ভালুকবাসা জঙ্গলঘেরা পাথরপাড়া গ্রামের বাদল আহিরের? জ্যান্ত অবস্থায় যার গোটা দেহে গুনগুনে একশ আটটা পেরেক পুঁতেছিল মাওবাদীরা? না, অজিত লোহার, পূর্ণিমা ঘড়ুই, জিতেন নন্দী, প্রদীপ তা, কমল গায়েন, সুদীপ্ত-সৈউফুদ্দিন হয়ে স্বপন মালিকের ১৭৫'র লম্বা তালিকাটা? কে আশীর্বাদ করবে আপনাকে দিদিমণি? সিঙ্গুরের  অনিচ্ছুক কৃষকরা? শালবনী আর নন্দীগ্রামের জমিদাতারা? ৬৮ লক্ষের গল্প শোনা টেট আর এসএসসি'র জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা বেকাররা? ৫০% বকেয়া ডিএ'র ভুক্তভোগী সরকারী কর্মচারীরা? ফসলের দাম না পাওয়া কৃষকরা? অনাহারে মরা চা-বাগানের শ্রমিকরা? এ রাজ্যের মানুষ আর আপনাকে আশীর্বাদ করে না ম্যাডাম।  বরং গত চার বছরের আপনার স্বেচ্ছাচারিতা কে আর দশ হাজার ক্লাব কে ৩৮৪ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা অনুদান দিয়ে পোষা, আপনার তা-বেদরা-তোলাব-লুম্পেনদের-গুণ্ডা-চোর'দের ঘেন্না করে, ধিক্কার দেয়, জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি হয়।
ঐ যেদিন আপনার হেলিকপ্টারটা গাঁয়ের মাঝ বরাবর, মাথার উপর দিয়ে পতপত করে উড়ে গেল, সেদিনই সন্ধ্যে বেলায় বসেছিলাম পার্টি অফিসে। সদ্য বন্ধ হয়েছে শিলাবৃষ্টি। চারিদিক অন্ধকার।পার্টি অফিসে যিনি এসে ঢুকলেন, বয়োজ্যেষ্ঠ'দের সম্বোধনে জানলাম তিনি সবার 'দীনু দা'। অবশ্য বার্ধক্যের ছাপে, মলিন পাঞ্জাবির অবয়বে, হাঁটু অবধি ভাঁজ করা কোমরের ধুতির বাঁধনে, পুরু কাঁচের চশমার চাউনিতে, আর হাতে ধরা শেষ সম্বলের লাঠির ভারে, তিনি বোধহয় 'দিনু জ্যাঠু' হিসেবেই  বেশি মানানসই।চারিদিকের ভ্রু-কুঞ্চিত ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন দেখে বুঝলাম তিনি কনটেম্পোরারি অ্যান্ড্রয়েড কমরেড'দের কাছে বেশ অপরিচিতই। ঘরে ঢুকেই একঘর ভর্তি লোকের সামনে 'দিনু দা' তাঁর গভীর উদ্বেগ নিঃসংকোচে উগরে দিলেন
-মেশিনে না হয় আমি ভোটটা কেস্তায় দিলম, কিন্তু বুঝব কি করে যে আমার ভোটটা কেস্তাতেই পড়ল? অন্য কুথাও চলে যায় যদি?
ভালবাসার আশংকা থেকে নিঃসৃত এই অনর্থক উদ্বেগ কে বাকি সবাই মিলে প্রশমিত করেই তাঁকে একটা মডেল ব্যালটে ভোট দিতে বলা হয়। বোধহয় তাঁর দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতার কথা ভেবেই  এই  অমূলক পরীক্ষা। একঘর লোকের সামনে প্রথম চেষ্টাতেই 'কাস্তেটা' চিনে ফেলে, গর্বের হাসি হেসে, পুরু চশমার ভেতর দিয়ে সবার দিকে ঘুরে, ঘুরে তাকিয়ে 'দিনু দা' বললেন
-৫২ বছর ধরে ভোট দিচ্ছি ব। আর কেস্তা চিনতে লারবো? ইবার তো চিনতেই হবেক। গাঁয়ে হেলিকপ্টারও উড়বেক আর আমাদের ধান গুলাও পচে মরবেক, এইটা তো চলবেক নাই।
আশ্বস্ত 'দিনু দা'র নিশ্চিন্ত প্রস্থানের পরে শুনলাম, আগে নাকি তিনি নিয়মিতই এখানে আসতেন।বসতেন। কাজও করতেন।ভবঘুরে মানুষ। হঠাৎ কি যে হল, আসা বন্ধ করে দিলেন। গত ৮-৯ বছর আর এ পথ মাড়াননি একবারও। আজ এলেন। আবার এলেন। নিজেই এলেন। কে জানে কেন এলেন... 
ম্যাডাম, আপনার তো অপরিসীম ক্ষমতা। এতো শত মন্ত্রী-সন্ত্রী,আমলা,পুলিশ পাইক, বরকন্দাজ, পেয়াদা। আর সামান্য 'দিনু দা'রা কিনা আপনাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করছে? চিড় ধরিয়ে দিল আপনার অহংকারে? হিমালয়সম আত্মবিশ্বাসে? আচ্ছা, আপনি কি ভয় পেয়েছেন ম্যাডাম? তা বেশ করেছেন। ভয় আপনার পাওয়াই উচিত, 'দিনু দা'রা ফিরে আসছে যে, প্রতিদিন ফিরে আসছে, নিজের ঘরে ফিরে আসছে, জোটে বেঁধেই ফিরে আসছে, আপনাকে হারাতেই ফিরে আসছে...

বৃহস্পতিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৬

অমিত মিত্র ~ সাক্যজিত ভট্টাচার্য্য

কুমি কাপুরের লেখা ইমার্জেন্সির ইতিহাসের ওপর বইটা পড়ছিলাম। লেখিকা সাংবাদিক হয়েও তৎকালীন জনসংঘের প্রতি নিজের অনুরাগ গোপন করেন নি। তাতে সমস্যা নেই। তবে একটা ইন্টারেস্টিং অ্যানেকডোট শেয়ার করি।

ইমার্জেন্সির সময়ে সুব্রম্ম্যণিয়াম স্বামী পালিয়ে বেড়িয়েছেন অনেকদিন। স্বামী তখন জনসংঘের টিকিটে এমপি। নানাজী দেশমুখ, মানে তখন জনসংঘের প্রধান, স্বামীর স্ত্রী রোক্সনাকে বলেছিলেন বিদেশে গিয়ে জনসংঘ এবং আর এস এস-এর কর্মীদের ওপর যা যা অত্যাচার হচ্ছে সেগুলো নিয়ে প্রচার করতে। বিশেষত বিদেশের আরএসএস কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করতে যারা টাকাপয়সা এবং অন্যান্য সাহায্য দিতে পারেন। রোক্সনা বিদেশে গিয়ে দেখেছিলেন লন্ডনে বসবাসকারী আরএসএস-রা বেশ ভয় পেয়েছেন। সাহায্য করতে রাজী নন। কিন্তু আমেরিকায় আরএসএস কর্মী যারা আছেন তারা প্রচুর হেল্প করেছিলেন। রোক্সনা বিশেষত উল্লেখ করেছিলেন পেনসিলভানিয়ার ফ্র্যাংকলিন মার্শাল কলেজের অধ্যাপক দম্পতির কথা যারা আরএসএস কানেকশন কাজে লাগিয়ে রোক্সনাকে সাহায্য করেছিলেন।

দম্পতির নাম মীরা এবং অমিত মিত্র। দ্বিতীয়জন পরবর্তীকালে পশ্চিমবংগের অর্থমন্ত্রী হন।

(Page 135, The Emergency: A Personal History-Coomi Kapoor, Penguin Viking, 2015)