শুক্রবার, ১৮ মার্চ, ২০১৬

অভ্যেস ~ মধুবনী ঘোষ

সক্কালে দাঁত মাজা, কফি এক কাপ
কার পুলে কথা কম, আপিসের চাপ
ছানাদের টুইশন, রাতে ছোটা পেগ
অভ্যেস হয়ে গেছে নো মোর আবেগ
থোর বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোর
অভ্যেস হয়ে গেছে নেতা ঘুষখোর
হাতি পোষা ভোট এলো খরচের ধুম
পাঁচ সাত লাখ নেব কা বোলেগা তুম ?
ভিডিও তুলেছ নাকি বিদেশী টাকায় ?
যতসব ফটোশপ গপ্প পাকায় !
গামছা চাদর আর কাগজ রঙিন
চাপিয়ে অর্থ নেবে সিক্স এলগিন
কে আছিস? ভাল করে গুনে নিস ভাই
ইমপেক্স ব্যাটাদের লবির দোহাই
অভ্যেস হয়ে যাওয়া লোভ চকচকে
অভ্যেসে হাত পাতা চোখের পলকে
নালিশ করবে কাকে? সকলেই চোর
তাদের মায়ের আজ গলার কি জোর !!
দাঁত মাজো কফি খাও সিরিয়াল দেখো
ঘুষ টুশ নিয়ে বাপু বেশি ভেবো নাকো
এগিয়ে বাংলা বেবি হেবি কপচাবে
একদিন খুনটাও অভ্যেস হবে |


বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ, ২০১৬

সোমরা মারান্ডী সরকার হোসেইন ~ দেবযানী ভট্টাচার্য্য

​বাবার নাম - দেলওয়ার হোসেইন।
মায়ের নাম - রুপা সরকার
ছেলের নাম - সোমরা মারান্ডী সরকার হোসেইন
চমকে গেলেন? আমিও গিয়েছিলাম। ছেলেটি এসেছিল মায়ের সাথে। আমার কাছে ইংরাজী পড়বে। আমার বাবা যে ইশকুলে চাকুরী করতেন সেই ইশকুলে পড়ে, ক্লাস নাইন। ওখানকার একজন স্যর পাঠিয়েছেন। ভালো কথা। মায়ের চেহারার সাথে ছেলের চেহারার ভীষন তফাত। ভাবলাম হয়তবা বাপের চেহারা পেয়েছে। নাম জানতে চাইলাম। এবং বিষম খেলাম শুনে। একে অমন নাম তার উপর মায়ের কপালে সিন্দুর হাতে নোয়া, কি কান্ড! ভদ্রমহিলা আমার হতভম্ব চেহারা দেখে বুঝে নিলেন যে আমায় বিষয়টা বোঝানো প্রয়োজন। ছেলে কে কলম কেনার ছুতোয় দোকানে পাঠিয়ে বললেন সব। নিজেরা ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। অনেক ঝড় সামলে নিজের নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস অক্ষুন্ন রেখেই আজ সংসার করছেন বাইশ বছর। ছেলেটি কুড়িয়ে পাওয়া। ইঁট ভাটার পাশেই ঘর। এক শিবরাত্রির সন্ধ্যেবেলায় মন্দির থেকে বাবার মাথায় জল ঢেলে ফিরে ছেঁচতলায় পড়ে থাকতে দেখেন সদ্যোজাত শিশুটিকে। পিপড়ে ছেঁকে ধরেছে। ছুটে গিয়ে কোলে নেন। আজ অবধি কোল জুড়ে। খোঁজ নিয়ে জেনেছিলেন ভাটায় কাজ করতে আসা আদিবাসী এক মেয়ের উপর ঠিকাদারের সেই বিশেষ মহতী অনুভুতির ফলাফল এই অবাঞ্ছিত প্রাণ। একে নিয়ে দেশে ফেরার উপায় নেই মেয়েটির। তার মরদ জানলে মা বাচ্চা দুজন কেই জ্যান্ত কবর দেবে। সবটা বুঝে ছেলেটিকে নিজেদের কাছেই রাখার সিদ্ধান্ত নেন তারা। শুধু জেনে নিয়েছিলেন নিজের বুকে রাখতে পারলে মেয়েটি কি নাম দিত তার সন্তানের। সেই নামই রেখেছেন। সাথে জুড়ে গেছে নিজেদের পরিচয়। পুরো গল্প বলে এক চোখ পরিতৃপ্তি নিয়ে ভদ্রমহিলা কি বলে উঠলেন জানেন? "দিদিমনি, ও আমার ভোলানাথ। শিবরাত্তিরে আমার ঘরে এসেছে ও। ওকে বুকে করে রাখব চিরকাল। ওর বাবাও ওকে চোখে হারায় জানেন। ভ্যান টেনে সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফিরে ছেলে পাশে নিয়ে পড়তে বসায়, নিজে নামাজ পড়ে। ছেলেও বাপের দেখাদেখি নামাজে বসতে চায়। উনি দেননা। বলেন , তুই তো তোর জন্ম কথা সব জানিস বাপ আমার, আদিবাসী দের ধর্ম টাই তো আসলে তোর সেই মায়ের ধর্ম কিন্তু আমরা সেটা তত জানিনে, তাই তোর ধর্ম এখন কেবল পড়াশোনা বাপ, বড় হয়ে নে তারপর পুজো নামাজ যেটা ভালো লাগে করবি, চাইলে দুটোই করবিখন। আবার কিছু না ইচ্ছে করে করবিনা। আমি রা কাড়ব না। কিন্তু লেখাপড়া না করলে পিঠে চ্যালাকাঠ ভাংগব। বলেই ছেলে জড়িয়ে সোহাগ করেন। উনি নাকি মারবেন! তালেই হয়েছে আর কি! দিদিমনি, আপনিই মেরে বকে পড়া আদায় করে নেবেনখন। আপনাকেই ভরসা করে দিয়ে গেলাম।" চলে গেলেন উনি। আসলে আমিই ভরসা পেলাম। বিরাট এক ভরসা। মানুষ জাতটা এখন পুরোপুরি পচে নি। মালাউন মা আর মোস্লা বাপের ঘরে একান্ত আদরে মানুষ তৈরী হচ্ছে এই ভুমিখন্ডের আদিপুত্রের বংশজ। আলি সাহেব, এটাই আপনার ভারতবর্ষ।

বুধবার, ১৬ মার্চ, ২০১৬

আলিমুদ্দিন ~ সুশোভন পাত্র

৩০'শে অগাস্ট আলিমুদ্দিন গিয়েছিলাম। ঐ প্রথমবার। খবরের কাগজে, টিভিতে তো প্রায়ই দেখি-শুনি, 'আলিমুদ্দিন চক্রান্ত করেছে', 'আলিমুদ্দিন ভয় পেয়েছে', 'আলিমুদ্দিন হিমশিম খাচ্ছে', 'আলিমুদ্দিনের কপালে ভাঁজ', 'আলিমুদ্দিন অমুক', 'আলিমুদ্দিন তমুক।' তাই অনেকদিনের সখ ছিল এই 'আলিমুদ্দিন' নামক 'নরকের দ্বার'টাকে একবার দেখবোই। বড্ড ম্যাড়ম্যাড়ে আলিমুদ্দিন, বুঝলেন। কোনও আড়ম্বর নেই। জৌলুস নেই। ঢোকার মুখটায় আলো নেই। ১৫ ফুট লম্বা ৫ হাত পুরু বিশাল প্রাচীর নেই। ব্ল্যাকক্যাট আর জেড ক্যাটাগরির সিকিউরিটি নেই। প্রায় নিশ্চিন্তেই, আপনি পৌঁছে যেতে পারেন একেবারে আলিমুদ্দিনের 'অলিন্দে'। সেই অলিন্দে, যেখানে সর্বদা আড়ি পেতে, নাড়ির খবর জোগাড় করেন আনন্দবাজার-বর্তমান এবং আরও অনেক শ্রী-মান। এমনকি আলিমুদ্দিনের উপরে যে লাল পতাকাটা, যেটাকে স্টার আনন্দের ফুটেজে ২৪X৭ পতপত করে উড়তে দেখেন, সেটাও হাওয়া না দিলে একবারে নেতিয়েই থাকে।
একটা বই'র জন্য অপেক্ষা করছি, টেবিলের অপর দিকে এসে বসলেন সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত এক ভদ্রলোক। লোকে বলে, বিমান বসু। একহাতে লাল চা'র গ্লাসে চা পাতা গুলো তখনও পাতনের নিয়মে থিতিয়ে পড়ছে, আর অন্য হাতে একটা ওষুধ। সৌজন্যের খাতিরেই জিজ্ঞাসা করলাম
-কিসের ওষুধ সুগারের? ভাবলাম বুড়োর বয়স তো হয়েছে সুগারের ঢিলটা নিশ্চয় লেগেই যাবে। ভদ্রলোক হেসে উত্তর দিলেন,
-৭০ থেকে দুধ-চিনি ছাড়াই চা খাচ্ছি। সুগার, প্রেশার আর কোলেস্টরেল কোনটাই আমার নেই। ঐ যে নবান্ন অভিযানের দিন মাথায় মারলো পুলিশ। ওষুধটা নেহাত সেই জন্যই।
ঠিকই তো। যে উচ্চবিত্ত ব্যবসায়ী পরিবারের ছেলে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে রাজনীতিতে এসেছেন, একসময় আদিবাসীদের সাথে ঘরে-দাওয়ায় চাটাই পেতে একপাতে ইঁদুর-পোড়া, ব্যাঙ-ভাজা খেয়েছেন, বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন, ছিয়াত্তরে যে বুড়ো গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে তিনদিন অনশন করেন, ২১ কিলোমিটার হেটে কেশপুরের পার্টি অফিসে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েন, তিনি যে চায়ে দুধ-চিনি কবেই ছেড়ে দেবেন, এতে আর আশ্চর্য কি। ভাবনাটা শেষ হবার আগেই উনি পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে ধরালেন। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান, সিপিআইএম'র পলিট ব্যুরো মেম্বার, এত বড় 'হার্মাদ' শেষে কিনা বিড়ি টানছেন? আমি তো টোটাল ট্যান। ভাবলাম, আচ্ছা পায়ে হাওয়াই চটি যদি 'সততার প্রতীক' হয় তাহলে, ঐ একই ত্রৈরাশিকে, হাতে বিড়ি ঠিক কিসের প্রতীক হওয়া উচিত?  ঘড়ি ধরে ১৫ মিনিটের আলিমুদ্দিন অভিযান শেষে ফিরে আসার পথে ১০ সেকেন্ডের জন্য থমকে দাঁড়ালাম এক জায়গায়। 'ফিরে দেখা'র ডিকটেশন দিচ্ছেন এক ভদ্রলোক। গাল ভর্তি সাদা দাঁড়ি। আমি লেখালিখি করার চেষ্টা করি শুনে বললেন "লেখ। আমাদের যে ভুলের কথা গুলো কেউ লিখতে না, সেগুলোই সাহস করে লেখ।" আচ্ছা এই লোকটার "আমরা ২৩৬ ওরা ৩৬" মন্তব্যে মিডিয়া ঔদ্ধত্য'র মহাভারত লিখেছিল না? তাহলে বর্তমানে অন ক্যামেরা যিনি পুলিশ কে চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেবার হুমকি দেন? সেটা কি তাঁর 'ঔদ্ধত্য' না জননেত্রীর মমতা?
পূর্বস্মৃতির বিলম্বিত অবতারণা নিতান্তই উদ্দেশ্য প্রণোদিত। গ্রেট কোলকাতা কিলিংস,  তেভাগা, খাদ্য আন্দোলন, জরুরি অবস্থা, অপারেশন বর্গা আজ না হয় ওল্ড ফ্যাশানড। কনটেম্পোরারি বং' জেনারেশন না হয় সেসব হানি সিং ঢেলে আর সানি লিওনে গুলে খেয়েছেন। কিন্তু ঐ ভয়ঙ্কর ৩৪। কিম্বা এই স্বপ্নের পাঁচ। সেটা তো মডার্ন? তা এই ৩৯ বছরে, স্যামুয়েল ম্যাথুরা আলিমুদ্দিনের ভেতরে কিম্বা বুদ্ধ-বিমান বা ছোট-মাঝারি হার্মাদ গুলোর উপরে স্টিং অপারেশনের জন্য মাত্র ২৩ মিনিট খুঁজে পেলেন না? হোক না একটা স্টিং এঁদের উপরেও। ২৩ মিনিটের। যেকোনো ২৩ মিনিটের।
বছর সাত আগে, একটা স্টিং অপারেশনে, নন্দীগ্রামের সিপিআই'র প্রাক্তন বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াসের হাতে প্রায় জোর করেই গুঁজে দেওয়া হয় ১০,০০০ টাকা। বিধানসভায় জমা পড়ে সেই সিডি। স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিশ আনেন আজকের এই 'পাঁচ লাখি' সৌগত রায়। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের স্বার্থে পদত্যাগ করেন ইলিয়াস। আজ ইলিয়াস গুরুতর অসুস্থ। দু-বিঘা জমি বেঁচে তার চিকিৎসা চলছে। সংসার চলে বিধায়কের পেনশনে। আর সেই স্টিং অপারেশনর সাংবাদিক শঙ্কুদেব পণ্ডা ও তার পরামর্শ দাতা শুভেন্দু অধিকারী একবার 'সারদা' আর একবার 'নারদা'। ইলিয়াসের ছেলে আজ জানতে চায় সৌগত বাবু,   আপনি কি স্বাধিকার ভঙ্গের নোটিশ আনবেন? করবেন ইলিয়াসের মত পদত্যাগ?
রথে চেপে দেশ ঘুরে 'মরেঙ্গে মর জায়েঙ্গে/ মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে'র' চ্যাংড়ামি ও রাজনৈতিক আদর্শের জন্য আমি আডবানী কে অপছন্দ করি এবং বিশ্বাস করি হাওলা কাণ্ডে সিবিআই তদন্তও নিরপেক্ষ ছিল না। কিন্তু তবুও তদন্তের স্বার্থে লৌহপুরুষের অগ্রিম পদত্যাগের সিদ্ধান্ত শ্রদ্ধাযোগ্য। এরকম প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই কিছু বিবেকবান, সৎ মানুষ আছেন। যারা আডবাণী-ইলিয়াসের সৎ সাহস ধরেন। বিমানের আত্মত্যাগ ধরেন। যারা পেটে গামছা বেঁধে নিঃস্বার্থে রাজনীতি করেন। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে পার্টির  ডাইরেক্টিভস অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন। যাদের কোনদিন কোন স্টিং হয়নি। একটা ঘন্টাখানেক হয়নি। মিডিয়া ফুটেজ দেয়নি। সোশ্যাল মিডিয়া দেওয়ালে ঘুঁটে লেপেনি। এনারাই স্বচ্ছ রাজনীতির  মুখ। এনারাই আমাদের আদর্শ। আমার ভরসা। আর যে রাজনীতি, যে রাজনৈতিক দল এদের অবজ্ঞা করে অবহেলা করে, ঐ ঘুষখোর ক্ষমতা লোভীদের দল চালানোর দায়িত্ব দেয়, নেতা-মন্ত্রী বানিয়ে মাথা তুলে নাচে, ফাঁদে পড়লে আঁচল দিয়ে আগলে রাখেন তাঁদের আমি ঘেন্না করি। আমার গর্ব, আমার অতিক্ষুদ্র সামর্থ্যে, আমি সেই রাজনীতির বিরুদ্ধেই লড়াই করি...

শনিবার, ১২ মার্চ, ২০১৬

চল বাংলায় ~ অমিতাভ প্রামাণিক

চল বাংলায়, লিখি পোস্টার, মাটি মানুষের ম্যানিফেস্টো –
আহা দিনকাল কত নির্মম, রাধা নাচলেও দোষ কেষ্টর।।

চল বাংলায় ...

হাসে জঙ্গল হাসে পর্বত, বাছুরের দল আঁকে স্বস্তিক –
স্বামী ভুলে যায় কে যে তার বৌ, আর কীসে তার জাগে মস্তি।।

চল বাংলায় ...

'জিও পাগলা' বলে ভাগলাম, দেখি ক্ষীর খায় বসে পাগলি;
হাতে কলম চলে বা জলরং, যা বেরোয় সব পাতি, আগলি।
পায়ে নীল স্ট্র্যাপ সাদা ফ্লিপফ্লপ, ধুয়ে জল খায় গোদা পাব্লিক –
আমি ছুটে যাই ভেঙে ব্যাকবোন, খেতে নুন-ঝাল আলুকাবলি।।

চল বাংলায় ...

খোসা ছাড়ানোর মত বললাম – যারা চলমান ফোঁড়া-অর্শ,
তারা রগটা ফুলিয়ে চিল্লায়, ঘরে ঢোকাবে চামচা ধর্ষক।
দ্বারে করাঘাত ক'রে বাড়া ভাত কেড়ে – ভোট চাই, ওহ, লাভলি!
আমি ফেলে দিই স্পাইনাল কর্ড, খেতে নুন-ঝাল আলুকাবলি।

চল বাংলায় ...

সোমবার, ৭ মার্চ, ২০১৬

নারী দিবস ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য

সেই মেয়েটা ট্রেন পেতে রোজ ঘন্টাখানেক
হাঁটে।
রাস্তাতে সব লোলুপ নজর শরীরটা তার
চাটে।
ভীড় ট্রেনে ফের ছোঁকছোঁকানি, যেমন বাজার
হাটে।
কলেজ হোক বা চাকরি, মেয়ের এইভাবে দিন
কাটে।
বিয়ের আগে হাজার বারণ মনেতে খিল
আঁটে।
বিয়ের পরে সুখের নামে ঘেন্না আসে
খাটে।
বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি, তার স্থান চৌ-
কাঠে।
শখ-আহ্লাদ? সবকিছু বাদ। মন উঠেছে
লাটে।
মুখ বুজে স্রেফ হুকুম তামিল, লেখাই যে ল-
লাটে!
ছেলে বিয়োলে পাড়া জুড়োল, হাজারো ঝন-
ঝাটে
'মা' ডাকটুকুন শুনবে, যতোই কষ্টেতে বুক
ফাটে।
সেই ছেলে আজ লায়েক হয়েই আলাদা তল-
লাটে।
বছর বছর নারীর দিবস, সুজ্যি নামে
পাটে।
বন্ধু ক'জন হারিয়ে যায় তেপান্তরের
মাঠে,
সারাজীবন মেয়েটা সেই একলা পথেই
হাঁটে।

দেশপ্রেম পায় ~ সুশোভন পাত্র

​"সবচেয়ে বেশি জোরে কেঁদেছিলেন হারুর ঠাকুরমা। তিনি আবার কানে শোনেন কিছু কম।তাঁকে সবাই জিজ্ঞেস করল, "আপনি এত কাঁদছিলেন কেন?" তিনি বললেন, "আমি কি অত জানি? দেখলুম ঝিয়েরা কাঁদছে, বৌমা কাঁদছে, তাই আমিও কাঁদতে লাগলুম—ভাবলুম একটা কিছু হয়ে থাকবে।"
অতএব হারুর ঠাকুরমার দেশপ্রেম পেলো। এবার জেএনইউ তে পেলো। দেশপ্রেম বড়ই অমূল্য। রেখে ঢেকে খরচা করতে হয়। তাও সবসময় আবার দেশপ্রেম পায় না। মহারাষ্ট্রে কৃষক মরলে পায় না। কন্যাভ্রূণ হত্যা হলে পায় না। লেবার ল রিফর্ম হলে পায় না। ৪৪২ জন কোটিপতি সাংসদ মিলে দৈনিক ২৫ টাকায় 'বিলো প্রভাটির' লক্ষণরেখা টেনে দিলে পায় না। রেভিনিউ ফোরগোন'র নামে কর্পোরেটদের ৬৮,৭১০ কোটি টাকার ট্যাক্স ছাড় দিলে পায় না। কৃষি 'সেস' বসলে পায় না। 'ক্লিন এনভায়ারোমেন্ট সেস' দ্বিগুণ হলে পায় না। প্রত্যক্ষ করে সরকার ১০৬০ কোটি টাকা আয় কমিয়ে পরোক্ষ করে ২০ হাজার বেশী আয়ের কোপ জনসাধারণের উপর চাপালেও পায় না। কিন্তু সিয়াচেনে সৈনিক মরলে পায়। ক্রিকেট মাঠে জাতীয় সঙ্গীত বাজলে পায়। ১৫'ই অগাস্ট দুপুরে টিভি'তে রোজা সিনেমা দেখলে পায়। পি-এফ'এ ট্যাক্স বসলে পায়। মাঝে মাঝে গোবর আর ঘুঁটেতেও পায়।
কিন্তু আম ছাড়া আবার আমাশা হয় না। একটি সংবাদ সংস্থার 'মুড অফ দ্য নেশন' সমীক্ষায় বলছে ২০১৪'য় নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পছন্দ করতেন ৫৭% মানুষ, ২০১৬ সালে তা ৪০%৷ ৫১% জানিয়েছেন মোদীর আমলে অর্থনৈতিক অবস্থা একই থেকে গেছে কিংবা আরও খারাপ হয়েছে৷ ৫৮%'র মতে মোদী সরকার মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ৷মূল্যবৃদ্ধি এখন ৫ .৬৯ শতাংশ। এই সরকার যেদিন শপথ নেয়, সেদিন সেনসেক্সের সূচক ছিল ২৪৫৫০৷ এই মুহূর্তে ২৩০০০। বিহার-দিল্লী ছাড়ুন। গুজরাট ও ছত্তিসগড়ে তো খাঁটি দেশপ্রেমের চাষ হয়। সেখানেও পৌরনির্বাচনে দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট বণ্টনকারীদের শক্তি কমেছে৷ উত্তরপ্রদেশে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্রে বিজেপি ৫৮টির মধ্যে ৫০টিতেই হেরেছে৷ এবং গৃহমন্ত্রী রাজনাথ সিং'র কেন্দ্রে ২৮টি আসনের মধ্যে ২৪টিতে৷
লাজুক মধুচন্দ্রিমা কাটলে আগে দাঙ্গা পেত। কনটেম্পোরারি সময়ের লেটেস্ট ফ্যাশন -এখন দেশপ্রেম পায়।
আরএসএস'র প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের 'ফ্রেন্ড ফিলজফার অ্যান্ড গাইড', বালকৃষ্ণ শিবরাম মুঞ্জে ১৯৩১'এ মুসলিনির সাথে সাক্ষাৎ করতে ইতালি যান। সেখানে তিনি ফ্যাসিস্ট অ্যাকাডেমি পরিদর্শন করে লেখেন, "আমি অভিভূত। প্রতিটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী বিকাশমান জাতির এই রকম ফ্যাসিস্ট সংগঠনই প্রয়োজন।" অতএব সঙ্ঘে প্রবর্তন হয় ৬-১৮ বছরের বালকদের প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী উগ্র দেশপ্রেমে মগজধোলাই। পরে গোলওয়ালকার হিটলারের ইহুদি নিধন যজ্ঞের ভূয়সী প্রশংসা করে লিখেছিলেন "জাতিগোষ্ঠীর শুদ্ধতা রক্ষা করতে জার্মানি দেশটাকে সেমেটিক জাতিভুক্ত ইহুদিদের ক্লেদ মুক্ত করেছিলো।" এখন অবশ্য প্রকাশ্যে এই দেশপ্রেমী'দের আর হিটলার-মুসলিনি পায় না। স্তালিন-ক্রুশচেভ পায়। গান্ধী পায়। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল পায়। সেই গান্ধী, সেই সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, যিনি ১৯৪৮'র ১১ই সেপ্টেম্বর চিঠি তে লিখেছিলেন "সঙ্ঘের নেতাদের বিষাক্ত ভাষণের জন্য গান্ধী কে হত্যা করা হয়েছে। আর সঙ্ঘের অনুগামীরা তা উৎযাপন করতে মিষ্টি বিতরণ করছে।"
জেএনইউ'র মত সেটাও ছিল ফেব্রুয়ারি। ২৭'এ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৩। জার্মানির বিলাসবহুল হেরেন ক্লাবে ভাইস চ্যান্সেলর ফন পাপেন তখন প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবুর্গের হাতে তুলে দিচ্ছেন দুর্লভ বিদেশী মাদকের স্বর্ণাভ সুরাপাত্র। অন্যদিকে গোয়েবলসের প্রাসাদে, গ্রামাফোনের মৃদুমন্দ আবহসঙ্গীতের সিম্ফনি তে মোহিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কর্পোরাল হিটলার, তাঁর গুণমুগ্ধ স্তাবকদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব পুনরুদ্ধারে সম্মোহনী পরিকল্পনার রূপরেখা বর্ণনা করছেন। রাত তখন ১১, ক্রমশ লাস্যময়ী, প্রথম ফোনটা এলো হানফস্টাঙ্গেলের কাছ থেকে। 'রাইখস্ট্যাগে আগুন লেগেছে'। ফুয়েরার কে নিয়ে ঝড়ের গতিতে রাইখস্ট্যাগে পৌঁছে গেলেন গোয়েবলস। নিমেষে সবাই নিশ্চিত হয়ে গেলেন। ফুয়েরার গোটা বিশ্ব কে জানিয়ে দিলেন 'এই কাজ অবশ্যই কমিউনিস্টদের'। গেস্টাপো-চিফ রুডলফের উদ্দেশ্যে গোয়েরিং'র চিৎকার করে 'অ্যাডমিনিসট্রেটিভ ডায়রেক্টিভস', "আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা নয়। কোন ক্ষমা নয়। প্রতিটি কমিউনিস্ট কে এক্ষুনি গুলি করে মারতে হবে।"
রাইখস্ট্যাগের আগুনে কমিউনিস্টদের ভূমিকা অবশ্য আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু গুলি সেদিন চলেছিল। ঝাঁঝরা হয়ে কমিউনিস্টরা মরেও ছিল। তবুও, তবুও, আজও, কানহাইয়ারা জন্মাচ্ছে, কানহাইয়ারা জন্মেছে, কানহাইয়ারা জন্মাবে...

বুধবার, ২ মার্চ, ২০১৬

আমার স্যার ~ অরুণাচল দত্ত চৌধুরী

আমার স্যার চলে গেলেন। আজ শুধু তাঁর কথা। ডাঃ দেবব্রত সেন। প্রফেসর ডি সেন। দেবু সেন। এমবিবিএস, ডিটিসিডি, ডাবল এমআরসিপি। মেডিকেল কলেজের উজ্জ্বল ছাত্রদের একজন। কিন্তু এ'সব তো তাঁর পোশাকি পরিচয়। আর্তজন (আর ছাত্ররাও) জানত, উনি দেবতা সেন। হ্যাঁ, মমতায় ভালবাসায় মেধায় ও জ্ঞানে স্যার তেমনই ছিলেন। আমরা মানে মুর্খ ভক্তরা আড়ালে বলতাম শনিঠাকুর। মুখ দিয়ে যদি কোনও ডায়াগনোসিস, ভালোমন্দ যা হোক, বেরিয়ে গেল, অন্যথা হবার জো নেই। প্রায় সংস্কারের মত দাঁড়িয়ে গেছিল আমাদের মনে। আমার সহপাঠী ঘনিষ্ঠ বন্ধু অমিতাভর বাবার শরীর খারাপ হল। তেমন মারাত্মক কিছু না। স্যারকে দেখাতে বললেন, ভাল লাগছে না। বেরিয়াম মিল করানো হল। নর্মাল ছবি। স্যার কিন্তু ছবি দেখে আরও গম্ভীর। তখন কলকাতায় এন্ডোস্কোপি সবে শুরু হয়েছে। ডাঃ জালান। রায় বেরোল স্টমাকের ক্যান্সার। ছ'মাসের মধ্যে আমার কলকাতার আশ্রয়, সেই প্রিয় মানুষ, শ্রী বিজয় ভট্টাচার্য চলে গেলেন। এই রকম অসংখ্যবার তাঁর ডায়াগনোসিস আমাদের চমকে দিত। রোগীর জন্য, মানুষের জন্য এমন মমতা সারা জীবনে দ্বিতীয় কারুর মধ্যে দেখিনি।
মেদিনীপুর, বহরমপুর, জলপাইগুড়ি, চাকরি সূত্রে যে'খানে পোস্টিং হয়েছে, সে'খানেই মানুষের চোখে দেবতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন এই মমতা ভালোবাসা বিছিয়ে। প্রত্যেক জায়গাতেই চেম্বারে চাপ হত খুব। সাহিত্যিক দেবেশ রায় একবার অধুনা লুপ্ত "শারদীয় অমৃত''তে স্যারকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন। তা'তে জলপাইগুড়ির প্রেক্ষাপটে স্যারের চেম্বারে রোগীদের ভিড়ের খুব ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন । জলপাইগুড়ির সম্পন্ন মানুষেরা সেই কালে কলকাতায় আসতেন বড় রোগব্যাধি হলে। কলকাতায় থাকা তাঁদের পরিচিত কাউকে দিয়ে বা অন্য কোনও ভাবে তথাকথিত বড় ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হত। বলাই বাহুল্য, সাথে সাথে পাওয়া যেত না সেই সব মহার্ঘ অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এই যে দেরি হত এটাই ছিল সেই সম্পন্ন মানুষদের স্ট্যাটাস সিম্বল। এদিকে স্যার ছিলেন হাসপাতাল অন্ত প্রাণ। সকাল সন্ধ্যার রাউন্ডতো আছেই, তার সাথে আরও বহুবার যেতেন রোগীর পাশে অশেষ উৎকণ্ঠায়, রোগ বুঝবার আর সারাবার জন্য। হাসপাতালের বেড থেকে পেশেন্ট ভাগিয়ে চেম্বারে নিয়ে যাওয়া দুরস্থান, চেম্বারে তাঁকে পাওয়াই ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। নাম লিখিয়ে ডেট নিতে হত কাজেই। সেই সম্পন্ন মানুষরাও বেশ ভালো সুযোগ হিসেবে নিলেন এই ঘটনাটাকে। তাঁদের স্ট্যাটাসের জন্য প্রয়োজন ছিল লাইন দিয়ে ডেট নিয়ে দেখাতে হয় এমন ডাক্তারের। সেই জন্যেই তো কলকাতা যাওয়া। জলপাইগুড়িতেই যদি সেই লাইন দিয়ে ডেট নিয়ে দেখানোর সুব্যবস্থা পাওয়া যায়, তবে সেই সুবিধা না নেবার কোনও মানে হয় না। শুনেছিলাম জলাতঙ্ক আক্রান্তকে নিজে স্ট্রেচারে তুলতে গিয়ে তাঁকে সেই সময়ে চালু চোদ্দোটা প্রাণান্তকর ইনজেকশন নিতে হয়েছিল একদা। এই স্যারই আবার টিচিংএ পিজিতে এসে, যে হেতু নন-প্র্যাকটিসিং পোস্ট, কোনও প্রাইভেট প্র্যাকটিস করলেন না। সেই প্র্যাকটিস আবার শুরু হবে রিটায়ার করার পর। নতুন করে শুরু করা সেই প্রাইভেট প্র্যাকটিসের গল্পও বর্ণময়। ফিজ, শেষ অবধিও তাঁর কৃতি ছাত্রদের অনেকের চাইতে কম। অন্যরা অর্জুন হলেও আমি ছিলাম একলব্য। স্যারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখার চেষ্টাও করিনি। তিনি কিন্তু মনে রেখেছিলেন। মনে রাখার ধরণটাও অদ্ভুত। বললেই বোঝা যাবে। একবার আমার পাঠানো এক পেশেন্টকে কিছুতেই দেখবেন না। কী ব্যাপার? না, 'অতদিন ধরে অরুণাচলকে কী শেখালাম, যে সেই এত সহজ কেসও আমার কাছে রেফার করে?'
অবুঝ স্যারকে বোঝাই কী করে, যে মফসসলের এই অধম চিকিৎসক রোগীর চাহিদাতেই রেফার করতে বাধ্য হয়েছে।
স্যারের সল্ট লেকের বাসায়, রোগীদের কাছ থেকেই শুনেছি, দেখানোর পদ্ধতিটা ছিল কিছুটা অন্যরকম। সকালে আটটা নাগাদ ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হত। পেশেন্ট পিছু একঘণ্টার স্লট। আমার এক রোগী বিকেল চারটেতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। পৌঁছেছেন একটু দেরিতে, মানে চারটে বেজে দশ নাগাদ। স্যার নাকি তাঁকে বলেছিলেন বেজায় হা হুতাশ করে, 'ইস, এত দেরি করে এলেন, আমি দশ দশটা মিনিট কম দেখতে বাধ্য হলাম।' দিনে চেম্বারে দেড়শ'টা করে পেশেন্ট দেখা আমার সহকর্মীরা ভাবতেও পারবে না, এ হেন আপশোষের কথা। খুঁটিয়ে হিস্ট্রি নিয়ে, ক্লিনিক্যাল একজামিনেশন করে, পুরনো কাগজপত্র থাকলে তা' দেখে, প্রেসক্রিপশনে সব কিছু লিপিবদ্ধ করেও শান্তি পেতেন না। এক জাবদা খাতায় নাম তারিখ দিয়ে তুলে রাখতেন সব। বলা তো যায় না, রোগী যদি কোনও কারণে কাগজ হারিয়ে ফেলে!
স্যারের বন্ধু আর ভাইএর মত ছিলেন আমার আর এক শিক্ষক, ডাঃ প্রণব চৌধুরী। তিনি মারা গেছেন বেশ কয়েকবছর আগে। তাঁর কাছে শোনা, তাঁদের ছাত্রাবস্থায় দেবব্রত আর প্রণব কলকাতার চার মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন ওয়ার্ডে কোন বেডে কোন ইন্টারেস্টিং কেস রয়েছে দেখে বেড়াতেন অক্লান্ত। আরজিকর থেকে পার্ক সার্কাসের ন্যাশনাল অবধি অবলীলায় হেঁটে চলে যেতেন মুড়ি বাদাম চিবোতে চিবোতে। কেস দেখবার আর শেখবার লোভে। সেই সব বেড নাম্বার লেখা থাকত তাঁদের পকেট ডায়রিতে।
'মোটর নিউরন ডিজিজ খুঁজছ?'
পকেট ঘেঁটে ডায়রি বার করে হদিশ দিতেন সমসাময়িক উৎসাহী কাউকে,
'উম্‌ম্‌... চলে যাও মেডিকাল কলেজে মতিলাল শীল ওয়ার্ডে ছেচল্লিশ তা না হলে এনআরএস মেডিসিনের পাঁচ নম্বর ফিমেল নইলে ন্যাশনালের একশ সতের নম্বর বেডে। আমি আর প্রণব গত দুদিনে দেখে এসেছি সব ক'জনকে। তবে ন্যাশনালের কেসটার ফাইন্ডিং বেশি। যাবার আগে ভালো করে পড়ে নিয়ো। আর মেডিক্যালের পেশেন্ট হয় তো ছুটি হয়ে যাবে আজকালের মধ্যে।'
এখনকার এমসিকিউ মুখস্তর যুগে এই কাণ্ড কেউ ভাবতে পারে?
মেধার সাথে পরিশ্রম আর অনুসন্ধিৎসা যোগ করলে কী দাঁড়ায় তার উদাহরণ ছিলেন এঁরা।
টুকরো টুকরো কত ঘটনাই যে খেয়াল পড়ছে। একদিন রেফার্ড কেসের ডাক এসেছে অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ড থেকে। আর্জেন্ট লেখা। স্যার আউটডোরে। সাথে আমি। রওনা হলেন আমাকে নিয়ে। গিয়ে দেখা গেল তেমন জরুরি কিছু না। কুড়ি বছর আগে টিবি হয়েছিল। বুকের এক্স-রে তে তার পুরনো দাগ এসেছে সামান্য। এক্ষুনি করণীয় কিছু নেই। তবু রেফার। ডাক্তারি কথ্য ভাষায় যাকে বলে 'ছুঁইয়ে রাখা'। বেড হেড টিকিটে দেখা গেল একজন হাউসস্টাফ এই রেফারটি লিখেছে। স্যার যখন তাকে ডেকে বললেন, 'আর্জেন্ট লিখেছ বলে ব্যস্ত আউটডোর ছেড়ে আমাকে আসতে হল', সে তো হতভম্ব। নিজের ঘাড় থেকে দায়িত্বের বোঝা নামাতে এই আর্জেন্ট লেখাটাই দস্তুর। তাকে সে'রকমই শেখানো হয়েছে।
হাসপাতালে ঢুকতেন সকাল সাড়ে আটটায়। ঘড়ি মেলানো যেত। এরপর রাউন্ড, আউটডোর, রেফার্ড কেস দেখা, আমাদের পড়ানো, এই সব নানান কাজ সেরে বিকেল চারটেতে স্যারের সেকেন্ড রাউন্ড। দিদির ক্যান্টিনে খেতাম আমরা। সেখানের দিদিরা জানতেন চেস্টের চারটে ছেলে দেরি করে আসবে। খাবার রেখে দিতে হবে।
ছাত্রদের মধ্যে জ্যোতিষ্ক যেমন ছিল অনেক, তেমনই আমার মত অলস নিরুদ্যমি মেধাহীন দু'চারজনও জুটেছিলাম। স্যারের কিন্তু আমাদের নিয়ে উদ্যমের কোনও ঘাটতি ছিল না। রোজ দুপুরে ম্যারাথন আউটডোরের পর আমাদের নিয়ে বসতেন স্যার। হয় তো হ্যারিসন অথবা অন্য কোনও টেক্সট বই, নইলে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল যাতে ওয়ার্ডে ভর্তি কোনও রোগীর যে রোগ তার বিবরণ। স্যার প্রায়শই ডাক্তারদের সেই আপ্ত বাক্য মনে করিয়ে দিতেন, 'হোয়াট ইয়োর মাইন্ড ডাসন্‌ট নো ইয়োর আইজ ক্যানট সি'। তার মধ্যেই 'অ্যাই অরুণাচল চোখ ছোট হয়ে আসছে। ঘুমিয়ে পোড়ো না।' তাঁকে তো আর বলা যায় না, অনেকক্ষণ ধরেই আমি বসে বসে ঘুমোচ্ছি। স্যার ভাবতেই পারেন না আউটডোর চলাকালীনও আজ একবার ঘুমের ঢেউ এসেছিল। আমি টয়লেটে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে পাঁচ মিনিট ঘুমিয়ে এসেছি।
চেনা শোনা তথাকথিত ক্যাচ কেস, স্টাফের মেসোমশাই, রাজনৈতিক নেতার চিরকুট আউটডোরে এলে আগে দেখে দেওয়া স্যারের ধাতে ছিল না। কতবার দেখেছি, খুব ডাকাবুকো অন্য ডিপার্টমেন্টের কোনও মাস্টারমশাইএর হাত থেকে সাথে আনা রোগীর টিকিট একদম শেষে রেখে জিজ্ঞেস করেছেন স্মিত মুখে, 'দেরি হবে বেশ, আপনি কি ততক্ষণ শুধু শুধু অপেক্ষা করবেন? কোনও দরকার নেই।' মহম্মদ ইসমাইল সিপিআইএমের ডাকসাইটে নেতা, তখন এমএলএ না এমপি, বাইরের বেঞ্চে বসে আছেন টিকিট জমা দিয়ে। স্যারের ওপর অচলা ভক্তি। যত দেরিই হোক, দেখিয়ে ফিরবেন। আজকের মেরুদণ্ডহীন সুপার বা ভিজিটিং যাঁরা ক্ষমতাবান কারওর চিরকুট দেখলে ভয়ে আইসক্রিমের মত গলে যান, তাঁরা ভাবতেও পারেন না সত্যিকারের সততার দাপট কাকে বলে।
বাড়াবাড়ি রকমের কথা বলতেন কিছু কিছু। 'একটা ওষুধ যদি দিয়েছ তবে তুমি রোগ ধরতে পেরেছ। দু'টো দিলে, ইউ আর ইন এ ডায়লেমা। আর তিনটে ওষুধ মানে তুমি কিছুই ধরতে পারোনি।' আমার এক সহকর্মী, বারাসতের বিরাট প্র্যাকটিশনার, ওষুধ লেখেন দশটা থেকে বাইশ তেইশটা। এই সব প্রেসক্রিপশন দেখলে স্যার কী বলতেন কে জানে। স্যার শেখাতেন, রোগীর ইতিহাস ঠিকমত জানতে পারলে পরিভাষায় যাকে বলে 'হিস্ট্রি টেকিং' অধিকাংশ রোগের ডায়াগনোসিস হয়ে যায়। আর বাকিটুকুর জন্য লাগে ক্লিনিক্যাল একজামিনেশন। মানে ইন্সপেকশন, প্যালপেশন, পারকাশন আর অসকালটেশনে বাকিটুকু। খুব সামান্য অংশ পড়ে থাকে যাদের ইনভেস্টিগেশন করে রোগ ধরতে হবে। সিনিয়র শিবদা' বলত ' নিজে প্রত্যেকটা কেস নিজে হাজার দু'হাজারটা করে দেখেছেন। তাই রোগীর মুখের ভাঁজ দেখলে রোগ ধরে ফেলেন।' সত্যিই তাই। মাঝে মাঝে অলৌকিক মনে হত তাঁর সে সব ডায়াগনোসিস।
সেই অলৌকিক এক গল্প বলে শেষ করি।
উনিশশ' সাতাশি সালের ঘটনা। তখন হাসপাতালে হাউসস্টাফ আন্দোলনে স্বাভাবিক কাজকর্ম মোটামুটি স্তব্ধ। বেলা দেড়টা নাগাদ এমারজেন্সিতে এক রোগী ঢুকল। বয়েস বছর বারো।অজ্ঞান। সাথে নাক ডাকার মত শব্দ… আমাদের ভাষায় স্ট্রাইডর। সহজ ডায়াগনোসিস, আপার এয়ার ওয়েতে ফরেন বডি অবস্ট্রাকশন। ই এন টির আরএমও কে কল বুক দেওয়া হল। যদি ফরেন বডি বার করে আনা যায়।
স্ট্রাইকের বাজারে কোথায় কে! এ দিকে রোগীর অবস্থা যখন তখন। কী করা? এমারজেন্সীর ডাক্তার বুদ্ধি বার করলেন। চেস্টে ভর্তি করে দেওয়া যাক। ওরা ডিপার্টমেন্টে অনেকক্ষণ থাকে।
সেদিন ছিল আমাদের আর এক স্যার ডাঃ ডি এন সিনহার অ্যাডমিশন ডে। বেলা তিনটে নাগাদ ডাঃ সিনহা রাউন্ডে এসে রোগীর বিবরণ শুনে, হতাশ ভাবে বললেন, 'কি আর করা। আগামী কাল সকাল সকাল রেফার লিখে ই এন টি সার্জন এনে দেখিয়ো, মানে ততক্ষণ যদি বাঁচে'।
স্যার এলেন বেলা চারটে নাগাদ। উনি খালি নিজের রোগীই নয়, সব রোগীকেই দেখতেন। এই বাচ্চাটার কাছে এসে, সব শুনে, নাকটা কুকুরের(স্যারের কাছে ক্ষমা চাইছি) মত তুলে কী যেন শুঁকলেন বার কতক। তারপর আমার একদা সিনিয়ার হাউসস্টাফ, আলোচ্য সময়ে আরএমও আলোকদা'কে বললেন, 'আলোক, এর প্যান্টটা খোলো তো'। প্যান্ট খোলা হল। ফাইমোসিস। পেচ্ছাপের জায়গাটা… ডাক্তারির ভাষায় যাকে বলে পিনহোল মিয়েটাস। স্যার ব্যাখ্যা করলেন, 'পেচ্ছাপ আটকে ইউরিমিয়া হয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ওর নিঃশ্বাসের থেকে অ্যাসিডোটিক স্মেল পেলাম এই জন্যেই। চট করে ওপরের তলায় ডায়ালিসিস ইউনিটে পাঠাও। এখুনি ডায়ালিসিস করতে হবে।' পরদিন রাউণ্ডে ডাঃ সিনহা দুঃখিত ভাবে জিজ্ঞেস করলেন,'কী, কতক্ষণ পরে মারা গেল?'। আসলে চিনতেই পারেননি। ডায়ালিসিসে সুস্থ হয়ে সে তো তখন বেডে বসে পাঁউরুটি কলা খাচ্ছে।
আশ্চর্য হয়ে ভাবি, আমরা সবাই ডাক্তার। কই কেউই তো রোগের সেই গন্ধ বুঝতে পারিনি। সেই দাদা আড়ালে মন্তব্য করেছিলেন শুধু, 'হবে নাই বা কেন? দু'হাজারটা অমন গন্ধ শুঁকেছিলেন যে আগে'।
এই এতদিন বাদেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে স্যারের আলোয় আলো হয়ে ওঠা সেই সব অলৌকিক দিনের কথা ভাবলে।