মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৬

একবগ্‌গা - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

বাবুসোনা ইশকুলে রোজ মার খেতো। মার বলে মার? সাধু স্যারের খেজুর ছড়ির মার, হেডস্যারের ডাস্টারের বাড়ি, লক্ষিকান্ত স্যারের কানমোলা, এমনকি রামচন্দ্র স্যারের মত ভালমানুষ লোকের কাছেও চড়-থাপ্পড় জুটিয়ে নিত কিছুনা কিছু করে। কিন্তু এত মার পড়া সত্ত্বেও বাবুসোনা একটা দিনের জন্যেও বদমায়েশি বন্ধ করেনি। মার খেয়েও বসে পড়তনা, মার এড়াতে চেষ্টা করতনা। চোখে চোখ রেখে শাস্তি নিতো প্রতিবার। ক্লাস সিক্সে উঠে দুজনের আলাদা আলাদা ইশকুল হয়ে গেল। মাঝের ক বছর আর তার দেখা পাইনি। শেষে উচ্চমাধ্যমিকের সময় আবার দুজনে একই ইশকুলে একই ক্লাসে এসে বসলুম। তখন অবিশ্যি বয়স অনেক বেড়ে গেছে। কিন্তু কদিন যেতেই বুঝলুম, বাবুসোনা বদলায়নি। নিয়ম না মানায় সিদ্ধহস্ত বাবুসোনা নিয়ম করে কিছুনা কিছু করে বসত যাতে গোটা ইশকুলে হুলুস্থুলু । হাজার শাস্তি পেয়েও সে শুধরোয়নি। এরকম একবগগা ছেলে খুব কমই দেখেছি।  

সোমবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১৬

নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য ~ পুরন্দর ভাট

নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর ফাইল প্রকাশ হওয়ার পর সেই নিয়ে অনেকের মতো আমারও কৌতুহল ছিলো। গত দু দিন ধরে মোটামুটি গোটা পঞ্চাশেক প্রকাশিত নথি ঘেঁটে দেখলাম। প্রচুর সময় গেলো কিন্তু সুভাষ বসু আমার মত কিঞ্চিত মানুষের কাছে এইটুকু সময় এবং মনোযোগ অবশ্যই দাবি করেন। জানি না যারা এই ফাইল প্রকাশ করে সুভাষ বসুকে নিজেদের লোক দেখানোয় সবচেয়ে উত্সাহী সেই দেশপ্রেমিকরা আদেও একটিও ফাইল পড়ে দেখেছে কিনা।

ফাইলগুলো দেখে যা বুঝলাম তা হলো প্রায় ৯৯%-ই অত্যন্ত সাধারণ ফাইল। এগুলো এতদিন সিক্রেট নথি হিসেবে লোকানো থাকার ব্যাখ্যা একটাই তা হলো বেশিরভাগ নথিতেই বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে কিছু যোগাযোগের রেকর্ড রয়েছে এবং কুটনৈতিক নিয়ম মেনে সেগুলো প্রকাশ করা হয়নি। কোনো ফাইলেই গোপন কোনো ষড়যন্ত্রের হদিস এখনো অবধি নেই। ফাইলগুলি পড়তে পড়তে বার বার যেটা মনে হচ্ছিলো যে নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য ভেদ করতে এতো মানুষ এতো সময় ব্যয় করেছে যে গোটা বিষয়টা অপচয় বলেই মনে হয়। একের পর এক প্রধানমন্ত্রী, বিশেষ করে নেহেরুর লেখা গুচ্ছ চিঠি আর তত্পরতা দেখে সত্যি যে কারুর মনে হবে যে সদ্য স্বাধীন হওয়া দরিদ্র্য এক রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কি এইরকম একটা বিষয় নিয়ে এতোখানি সময় ও মনোযোগ ব্যয় করা সাজে? সুভাষ বসুর অন্তর্ধানের পেছনে নেহরুর কিছু ষড়যন্ত্র আছে এই অভিযোগ অসত্য প্রমান করতেই বোধয় উনি এতখানি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা আর যত্ন নিয়েছিলেন রহস্যের সমাধান করতে। আরো আশ্চর্য্যের বিষয় হলো যে যখনই বিষয়টার একটা নিষ্পত্তি করে নেতাজীর স্মৃতিকে যথাযোগ্য সম্মান দেওয়ার চেষ্টা করেছে সরকার তখনই একাধিক জন মামলা মোকদ্দমা করে ফের বিষয়টাকে ঘেঁটে দিয়েছে এবং পাছে নেতাজীর অপমান হয় এই ভয়ে সরকারও এইসমস্ত গুচ্ছের মামলা মোকদ্দমাকে গুরুত্ব দিয়ে অভিনিবেশ করেছে। সমস্তটা দেখে এটাই বার বার মনে হচ্ছিলো যে দেশের এতো সমস্যা যেখানে সরকারের মনোযোগ পায় না সেইখানে এই বিষয় নিয়ে এতখানি সময় দেওয়া বোধয় বাহুল্য।

যাই হোক, আনন্দবাজার এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে দেখলাম নেহরুর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এটলিকে লেখা একটা চিঠি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্ঠি হয়েছে। চিঠিতে নেহেরু নেতাজীকে "যুদ্ধ অপরাধী" বলে সম্মোধন করেছেন। চিঠির বয়ানটি হলো :

"Dear Mr Attlee,
I understand from reliable sources that Subhas Chandra Bose, your war criminal, has been allowed to enter Russian territory by Stalin. This is a clear treachery and betrayal of faith by the Russians as Russia has been an ally of the British-Americans, which she should not have done. Please take note of it and do what you consider proper and fit."
Your's Sincerely,
Jawaharlal Nehru

কংগ্রেস বলেছে এইরম কোনো চিঠি নেহেরু লেখেননি। আমি ফাইল ঘেঁটে এই চিঠি তিন জায়গায় পেলাম। এই তিন জায়গা বাদ দিয়ে এই চিঠি আর কোথাও নেই। আপনারা খুঁজে নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করতে পারেন অথবা আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন।

১. এই চিঠির প্রথম উল্লেখ রয়েছে শ্রী রুদ্রজ্যোতি ভট্টাচার্য্যের ১৯৯২ সালে করা কলকাতা হাই কোর্টে একটি পিটিশনে (লিংক: http://netajipapers.gov.in/pdfjs/web/viewer.html…)। সেই সময় নেতাজীকে মরনোত্তর ভারত রত্ন দেওয়ার কথা উঠেছিলো সরকার থেকে আর তা ঠ্যাকাতে বেশ কিছু মামলা হয় যার মধ্যে এইটি একটি। এই পিটিশনে কিন্তু সরাসরি বলা হয়নি যে নেহেরু এরকম কোনো চিঠি দিয়েছিলেন। যা বলা হয়েছে তা হলো ১৯৭০-এ গঠিত খোসলা কমিশন, যার কাজ ছিলো নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্যভেদ, সেই কমিশনের সামনে নেহরুর ব্যক্তিগত স্টেনোগ্রাফার শ্যামলাল জৈন এইরম একটা চিঠি টাইপ করার কথা বলেছেন। যে বয়ানটা ওপরে দিলাম নেহেরু সেই বয়ানটি একটি প্যাডে হাথে লিখে শ্যামলালকে দেন এবং তিনি সেটা টাইপ করে নেহরুকে ফেরৎ দেন। নেহেরু তারপর সেই চিঠি নিয়ে কি করেছিলেন শ্যামলাল জানেন না। শ্যামলাল কিন্তু এই বয়ান স্মৃতি থেকে বলেছেন খোসলা কমিশনের কাছে, তাঁর কাছে সেই চিঠির কোনো প্রমাণ নেই। যদি ধরেও নি যে শ্যামলাল সত্যি বলেছেন তবুও ১৯৪৫-এ লেখা একটি চিঠি হুবহু ১৯৭০-এ এসে স্মৃতি থেকে আওড়ানো সোজা কথা না। কিছু শব্দের এদিক ওদিক যে হবেনা কেউই হলপ করে বলতে পারে না। যেটা আশ্চর্য্যের বিষয় তা হলো রুদ্রবাবু কোথা থেকে শ্যামলালের বয়ানের কথা জানলেন সেটা রহস্যময়। খোসলা কমিশনের রিপোর্টের মধ্যে শ্যামলালের বয়ানের কোনো উল্লেখ নেই। এই হলো খোসলা কমিশনের রিপোর্টের লিংক : http://subhaschandrabose.org/report-one-man-commission-inqu

২. দ্বিতীয়বার এই চিঠির উল্লেখ রয়েছে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীকে লেখা নেতাজীর ভাই সুরেশ চন্দ্র বসুর ছেলে প্রদীপ বসুর ৯৮ সালের একটি চিঠিতে (লিংক: http://netajipapers.gov.in/pdfjs/web/viewer.html… , পৃষ্ঠা - ১১২)। প্রদীপ বসুও সেই খোসলা কমিশনকে দেওয়া শ্যামলাল জৈনের বয়ানকেই তুলে দিয়েছেন চিঠিতে কিন্তু তিনিও শ্যামলাল জৈনের বয়ানের কোনো রেফারেন্স দেননি, খোসলা কমিশনের রিপোর্টে ওই বয়ান কেনো নেই তাও লেখেননি।

৩. তৃতীয়বার এই চিঠির উল্লেখ রয়েছে আবার শ্রী রুদ্রজ্যোতি ভট্টাচার্য্যের করা ২০১৩ সালে কলকাতা হাইকোর্টে একটি পিটিশনে। নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্যের কি কিনারা হলো তা জানতে চেয়ে সেই পিটিশন। এখানেও সেই শ্যামলাল জৈনের বয়ানকেই উধৃত করা হয়েছে যদিও শ্যামলাল জৈনের ওই বয়ান কোথায় পাওয়া গেছে তার কোনো উল্লেখ এখানেও নেই। (লিংক : http://netajipapers.gov.in/pdfjs/web/viewer.html… ) যেটা আশ্চর্য্যের বিষয় তা হলো শ্যামলাল জৈনের ওই বয়ান কিন্তু আদেও গোপন কিছু নয়। যেহেতু হাই কোর্টের পিটিশন তাই সেটা পাবলিক ডকুমেন্ট এবং সেই ডকুমেন্টে শ্যামলালের বয়ানের উল্লেখ থাকবে। একটু ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম যে যা সন্দেহ করেছিলাম তাই, এই পিটিশন নিচের দেওয়া India Kanoon ওয়েবসাইটে রয়েছে আর তাতে ওই শ্যামলালের তথাকথিত বয়ানও রয়েছে। অর্থাৎ নেহেরু সত্যি শ্যামলালকে এরকম বলেছেন কিনা জানা নেই আর শ্যামলালও এরকম কোনো কথা খোসলা কমিশনের কাছে বলেছেন কিনা তাও পরিষ্কার না কিন্তু এই তথাকহিত বয়ান পাবলিক ডকুমেন্টের মধ্যেই ছিলো, তার জন্যে ফাইল প্রকাশের প্রয়োজন ছিলো না। লিংক : http://indiankanoon.org/doc/176710997/

নেহেরু সুভাষ বসুকে যুদ্ধ অপরাধী বলেছেন এর কোনো সরাসরি প্রমাণই প্রকাশিত ফাইলে নেই, উল্টে যা আছে তা হলো সুরেশ চন্দ্র বসুর এক প্রশ্নের জবাবে নেহরুর চিঠি যাতে উনি লিখেছেন যে নেতাজীকে যুদ্ধ অপরাধী বলবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না এবং অন্য কোনো দেশ যদি তা মনেও করে তাদের হাতে নেতাজীকে খুঁজে পাওয়া গেলে তুলে দেওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। নেহেরু গঠিত শাহ নওয়াজ কমিশনে সুভাষ বসুর দাদা সুরেশ চন্দ্র বসু একজন সদস্য ছিলেন এবং সেই কমিশনের কাজ শুরুর আগে তিনি নেহেরুকে প্রশ্ন করেছিলেন যে নেতাজীকে যদি জীবিত খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে ভারত সরকার তাকে যুদ্ধ অপরাধী বলে ধরবে কিনা। তার উত্তরে নেহেরু ওই চিঠি লেখেন। লিংক : http://netajipapers.gov.in/pdfjs/web/viewer.html… পৃষ্ঠা ১৩০।

উপরন্তু, ভারত সরকার একাধিকবার জাতিসংঘ এবং মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকারকে চিঠি লিখেছে জানতে চেয়ে যে আদেও যুদ্ধ অপরাধীর তালিকায় সুভাষ বসুর নাম আছে কিনা এবং প্রত্যেকবারই তারা জানিয়েছে যে এরকম কোনো তালিকায় সুভাষ বসুর নাম নেই। এইসবও বেশ কয়েকটা ফাইলে আছে। এমন কি ফাইলের মধ্যে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিদের মধ্যে একাধিক চিঠিপত্রও ফাইলগুলির মধ্যে রয়েছে যেগুলো সুভাষ বোস বেঁচে থাকতে লেখা। সেগুলোয় তাদের মধ্যে আলোচনা দেখা যাচ্ছে যেখানে তারা বলছেন যে কোনো আইনেই সুভাষ বসুকে যুদ্ধ অপরাধী হিসেবে ধরা যাবে না, ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরোধিতা করবার কনস্পিরাসির কেস দেওয়া যেতে পারে কিন্তু সেরকম কোনো কেসের ট্রায়াল মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে সেই নিয়ে তারা চিন্তিত।

অমর্ত্য সেন যে মন্তব্য করেছেন তার সাথে একমত। নেতাজীকে সংকীর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে ব্যবহার করা বন্ধ করা হোক, দিন কে দিন মানুষের বিরক্তিই এতে বাড়বে আর সেই বিরক্তির ভাগীদার অকারণে নেতাজীকে হতে হবে। তাঁর কাজকম্ম, আদর্শ নিয়ে আলোচনা হলে সেটা অনেক বেশি লাভজনক।

মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারী, ২০১৬

ইউ.এফ.ও, নোবেল ও টেনিদা ~ আশিস দাস

চাটুজ্যেদের রোয়াকে একলা বসে সামনের ত্রিফলাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হঠাৎ কেমন একটা ভাব চলে এল। সবে বেশ মেজাজে রঙ দে তু মোহে গেরুয়া গানটা শুরু করতে যাব মাথায় খটাং করে এক গাঁট্টা! "কে বে" বলে চিৎকার করে পিছন ঘুরেই দেখি তিনি। কে আবার? সেই আদি ও অকৃত্রিম টেনি মুখুজ্জে।
রোয়াকে বসে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠল, "এটা গান হচ্ছে? মনে হচ্ছে তো গলায় দুটো কোলাব্যাং ঢুকে হানি সিং এর গানের তালে ডিস্কো নাচছে!"
আমার মাথাটা গেল গরম হয়ে। মনে হল বলি,"এসব সূক্ষ কলার তুমি কি বুঝবে? সারাদিন শোন তো পাগলু আর খোকাবাবু!" তবে কিনা আগের গাঁট্টায় তো পেটের পিলে অব্দি চমকে উঠে এক্সকিউস মি বলে উঠেছিল তাই হালকা চেপে গেলাম।
টেনিদা জিগেস করল, "হাবুল আর ক্যাবলা বাছাধনেরা গেল কই?"
আমি ব্যাজার মুখে বললাম,"দুজনেই বেড়াতে গেছে, তাও আবার বিদেশ। হাবুল নেপাল আর ক্যাবলা সিঙ্গাপুর-ব্যাঙ্কক।"
টেনিদা নাকমুখ কুঁচকে বলল, "সবকটাকে মোদীরোগে ধরল নাকি? যাকগে যাক। তুই তো আছিস, তুই আমার সেরা চ্যালা রে প্যালা।"
আমি খুশি হয়ে বললাম," তাতো বটেই। কিন্তু ওরা কি বিশ্বাসঘাতক ভাবো একবার তুমি!"
টেনিদা ভাবুক মুখ করে বললো,"হ্যাঁ, তাও গেল কোথায়? না নেপাল আর সিঙ্গাপুর। তাও যদি ইকিয়াং টুচিস্কি তে যেত না হয় বুঝতাম।"
গল্পের গন্ধ পেয়ে আমি টেনিদার দিকে সরে বসলাম। নিরীহভাবে বললাম, "সেটা কোথায় গো টেনিদা? চীন না আফ্রিকা?"
কিন্তু টেনিদা তো আর দেশের জনগণ নয় যে নেতা থেকে জুকারবার্গ সবাই বোকা বানিয়ে চলে যাবে! সঙ্গে সঙ্গে বলে, "অত সোজা নয় বাবা প্যালারাম বাঁড়ুজ্জে। ফ্রিতে গপ্প শোনার মতলব? বড় রাস্তার লেবানিজ রোলের দোকানটা থেকে চটপট ঘুরে এস একবার দেখি।"
ব্যাজার মুখে চিকেন র‍্যাপটা নিয়ে ফিরতেই ছোঁ মেরে নিয়ে গপ গপ করে তিন কামড়ে গোটাটা সাবাড় করে দিয়ে হাতটা আমার জিন্সেই মুছে শুরু করল টেনিদা," সেবার যখন নোবেল চুরি গেল রবীন্দ্রনাথের, সিবিআই তো অনেক খুঁজেও কিছুই করতে পারলো না। সবরকম চেষ্টার পর শেষে মুখ্যমন্ত্রী আমায় ডেকে বললেন, 'টেনি, দেখো গত ৩৪ মাস ধরে নোবেল পাওয়া যাচ্ছেনা। এর পিছনে সিপিয়েমের চক্রান্ত আছে আমি জানি, সব সাজানো ঘটনা। কিন্তু প্রমাণ পাচ্ছিনা। তোমাকেই নোবেলটা খুজে আনতে হবে, আমি তোমাকে নোবেলশ্রী উপাধি দেব।'
বার খেয়েই হোক আর কৌতুহলেই হোক আমি রাজী তো হয়ে গেলাম। কিন্তু খুজি কোথায়? ব্যাপারটা ভীষণ পুঁদিচ্চেরি হয়ে উঠছে দেখে একদিন মেট্রো করে ময়দান গেলাম ব্রেনটা ফ্রেশ করে নিতে একটু। তো ময়দানে শুয়ে শুয়ে খুব ভাবছি খুব ভাবছি। রাত হয়ে গেছে আশপাশে কেউ নেই বুঝলি! হঠাৎ দেখি আকাশে চাকতি মতো কি একটা জ্বলজ্বল করছে। প্রথমটায় ভাবলুম হয়তো এই বিশ্ববাংলা টাংলার জন্য ফানুস উড়িয়েছে হয়তো। কিন্তু একটু বাদেই সেটা মাঠে নেমে এল। দেখি সেটা একটা ইউ.এফ.ও-"
আমি খাবি খাওয়া কাতলার মত ঢোঁক গিলে আঁতকে উঠলাম, "কি! ময়দানে ইউ.এফ.ও!!"
দাঁত খিঁচিয়ে টেনিদা চেঁচিয়ে উঠল, "কেন শুনি? ওগুলো কি শুধু নিউ ইয়র্ক আর এল.এ তেই নামতে পারে? বঙ্কুবাবুর বন্ধু পড়িস নি? বাংলায় এত শিল্প আসছে আর একটা এলিয়েন এলেই দোষ?"
আমি মনে মনে ভাবলাম "ঢপ তো এবার স্মৃতি ইরানির লেভেলে যাচ্ছে মাইরি!" কিন্তু টেনিদার চোখে (মোদি প্রধানমন্ত্রী হবার পর আডবানির চোখের মত) হিংস্র আগুন দেখে থেমে গেলাম। বরং বললাম, "হ্যাঁ হ্যাঁ তাতো বটেই। তাছাড়া এলিয়েন তুমি ছাড়া আর কার কাছেই বা আসবে?"
টেনিদা বলল, "লাস্ট ওয়ার্নিং প্যালা। আর একবার কুরুবকের মত বকবক করলে এক চড়ে তোর কান-"
"কানহা রিসার্ভ ফরেস্টে বাঘের মুখে গিয়ে পড়বে", শেষ করলাম আমি।
বদরাগী হলেও টেনিদা গুনের কদর করে। তাই খুশি হয়ে বললো,"এটা বেশ নতুন দিলি তো, আচ্ছা গপ্প শোন। তো ইউ.এফ.ও থেকে কটা লিকলিকে চেহারার পিঁপড়ের মত দেখতে লোক এসে প্রথমে বলে 'ইস্টাকু হুপিয়াকু চিং?' আমি তো বললাম, 'যা বলবে বাংলায় বল বাপু'। তখন কি একটা মাথার নব ঘোরালো আর বলতে শুরু করল, 'মহাশয়, আপনার শুভ নাম কি ভজহরি মুখার্জী?' আমি বললুম, 'হ্যাঁ'। ব্যাস কি একটা লেসার মত তাক করল আমার দিকে আর আমি পুরো ফ্ল্যাট। জ্ঞান আসতে দেখি আমি বন্দি। বাইরে আকাশে দেখা যাচ্ছে কিন্ত কি আশ্চর্য! আকাশের রঙ নীল সাদা ডোরা কাটা! সে যাই হোক খানিকবাদে আমাকে ওরা নিয়ে গেল ওদের রাজার কাছে। সে বললো, 'মহাশয় শুনুন। আমাদিগের গ্রহের নাম ইকিয়াং টুচিস্কি। আমরা অতীব নিরীহ প্রাণী, আমরাও রবীন্দ্রনাথ পড়িয়া থাকি। কয়েক বৎসর পূর্বে আমাদিগের জ্যোতিষী ভবিষ্যৎবাণী করিয়াছিলেন যে আপনাদিগের গ্রহে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ঘোর দুর্দিন আসিতেছে। রাস্তার মোড়ে হিসি করা প্রৌঢ় হইতে গাছের আড়ালে কিসি করা যুগল সকল ব্যক্তিকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনিতে বাধ্য করা হইবে। অতএব প্রতিবাদস্বরুপ আমরা নোবেল হরণ করিয়া লইয়া আসি। আপনাকেও আমরা যাইতে দিতে পারিবনা, আপনাকে আজীবন বন্দি থাকিতে হইবে।'
আমি প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেলাম। তারপর হঠাৎ মাথায় একটা সাংঘাতিক বুদ্ধি খেলে গেল। আমি বললাম, 'দেখুন স্যার আমি কিন্তু শিল্পী মানুষ, এখানে আমার শিল্পসাধনা করতে পারব তো?' ওরা খুশি মনে সায় দিল। আমিও একটু পর থেকে কাজ শুরু করলাম, একটা হতে না হতেই খেল খতম। চেয়ে দেখি মেঝেতে পড়ে সব ব্যাটা চিঁ চিঁ করছে! কেউ কান চেপে বসে, কেউ মাথার চুল ছিঁড়ছে। ব্যাস আর আমাকে পায় কে। বললুল,'দেখুন স্যার এখানে আমাকে রাখলে কিন্তু এই রকমই চলবে সারাদিন।' ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে সেই রাতেই ব্যাটারা আমাকে ময়দানে নামিয়ে দিয়ে গেল! নোবেলটাও চাইলে দিয়েই দিত, কিন্তু ভাবলাম যা খিল্লি হচ্ছে বুড়োকে নিয়ে ওটা অন্যগ্রহেই থাক।"
আমি কৌতুহল চাপতে না পেরে বলেই ফেললুম, "কিন্তু কি করলে তুমি ওদের?যার এত ক্ষমতা?"
টেনিদা কেজরিওয়ালের মত হালকা হাসি দিয়ে বলল, "আরে বোকা যখন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গেছিলাম তখন উনি ওনার লেখা কবিতার ২টো বই গিফট দিয়েছিলেন তো! সেটারই একটা মুখস্ত করে ঝেড়ে দিয়েছিলাম! হু হু বাওয়া, এ হল টেনি শর্মা! আমার সাথে পাঙ্গা!"

রবিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০১৬

উন্নয়নের জোয়ার ~ সুশোভন পাত্র

আদর করে প্রেমিকার নাম রাখল সে 'রাজকন্যে'। কিম্বা ধরুন 'ডার্লিং'। নিদেনপক্ষে 'সোনা','রূপা'। এর নিচে জাস্ট আর নামা যায় না। প্রেমিকের নাম আর যাই হোক 'লোহা-লক্কড়' তো হতে পারে না। বিয়ের পর নববধূর নবীকরণ। নতুন নাম 'সুইট বাবি'। কাউন্টার পার্টের তুমুল জবাব ওয়ান অ্যান্ড অনলি আমার 'হাবি'। কনটেম্পোরারি সময়ে, জীব প্রেমের ঈশ্বর সেবাতে মানুষ যখন পোষা কুকুরের নাম রাখে 'পেপসি' কিম্বা 'পোস্ত', তখন প্রেম রাখতে, প্রেমে থাকতে মানুষ স্বাভাবিক কারণেই 'নামকরণে' ব্যস্ত। আর নামকরণ শুধু নামকরণই নয়। নামকরণ তো আর্ট। উপরন্তু এ রাজ্যে নামকরণ আবার উন্নয়নেরও পার্ট। ঐ যে যেমন চার মাসেই দিদিমণির ৯৯% কাজ –আগের প্রকল্পের নতুন নামকরণে কিসেরই বা লাজ ?
আমেরিকায় এখন বাচ্চাদের নামা রাখা হচ্ছে বন্দুকের থিমে। পিস্তল, ট্রিগার, শুটার। 'শর্ট অ্যান্ড প্রিসাইস'। যেমন ধরুন ইউপিএ-১ সরকারের 'কমন মিনিমাম প্রোগ্রামের' অংশ 'বালিকা সমৃদ্ধি যোজনার' নতুন নাম পড়ল 'কন্যাশ্রী'। 'শর্ট অ্যান্ড প্রিসাইস'। ২০১৩-১৪ এ রাজ্যে কনাশ্রী প্রকল্পে মোট আবেদনপত্র জমা পড়েছে ১৯.৮৮ লক্ষ। মঞ্জুর হয়েছে ১৮.৩ লক্ষ। আর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে ১০,২৮৬। হল তো, ৯৯% কাজ? 'বালিকা সমৃদ্ধি যোজনা'য় যেখানে চতুর্থ শ্রেণীর কন্যা শিশুরা পেত ৫০০ টাকা আর নবম-দশম শ্রেণীর কন্যা শিশুরা ১০০০ টাকা, সেখানে এখন সবাই হাতে পরার বালা পায়, কেউ আবার সাইকেলও পায়। সে সাইকেল বিক্রি করতে OLX –এ বিজ্ঞাপনও পড়ে। এটাই তো উন্নয়ন যজ্ঞ। সাবড়াকোনের সালমা খাতুনের সাইকেল চালাচ্ছে মনিপুরের ইয়াইফাবা প্যাংগাম্বম। 'বালিকা সমৃদ্ধি যোজনার' মোট খরচের ১০% পণপ্রথা ও শিশু বিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি তে তথ্য ও সম্প্রচার দপ্তরের থেকে খরচা হবার কথা ছিল। এখন ১০%'র বেশী হয়। সচেতনতা বাড়াতে নয়। গজলের জলসা বসাতে। হল, শিল্পও হল। সিঙ্গুর না হোক। গুলাম আলি তো হল।
বাঙালি তো আবার ডাকনাম ছাড়া কাজ চলে না। বিখ্যাত কিছু ডাক নাম যেমন পচা, ক্যাবলা, নন্টে ফন্টে, গাবলু , হাবলু এবং 'আনন্দধারা'। ১৯৯৯'র 'স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্ব-রোজগার যোজনা'র বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে ২০১০ কেন্দ্রীয় সরকার নাম দিল, 'ন্যাশনাল লাইভলিহুড মিশন'। বাংলার কৃষ্টি ও ঐতিহ্যে বিশ্বাসী আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর আবার ঐ শক্ত নাম পছন্দ হল না, নাম রাখলেন 'আনন্দধারা'। আগে রাজ্যের সব জেলায় যে প্রকল্প চালু ছিল। পরিসংখ্যানে দেশের মধ্যে ছিল প্রথম সারির এখন তা সর্বসাকুল্যে চালু আছে ২৪ টি ব্লকে। কিন্তু তাতে কি ? নাম তো বদল হল। অতএব, আবার উন্নয়ন হল।
বাচ্চা ছেলের নাম 'গুগল'। গুগলের গার্লফ্রেন্ড 'কিউটি পাই'। ঠিক যেমন কন্যাশ্রীর সুরে সুরে মিলিয়ে 'বেকার ভাতা' আর' যুব উৎসাহ প্রকল্পের' নতুন নাম 'যুবশ্রী'। ২০১০'র বাজেটে এই প্রকল্পের  আর্থিক বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হয়েছিলো। আর নতুন মুখ্যমন্ত্রী ঐ প্রকল্পের সুবিধা পাবার শর্ত হিসেবে 'সম্পূর্ণ বেকার' শব্দবন্ধ কে বদলে দিয়ে শুধু 'বেকার' করেছেন। আফটার অল তোলাবাজরা তো আর 'সম্পূর্ণ বেকার' না। উন্নয়নের দ্রবণ, আদিবাসী তপশিলি দরিদ্র বেকার থেকে শুরু করে তোলবাজ হয়ে সাম্বিয়া সোহরাব, সবার জন্যই তো হোমজিনিয়াস হওয়া উচিত। সুতরাং তোলাবাজরাও পয়সা পেল। হল,আবার 'পরিবর্তন' হল।    
২০০৬ সাল থেকেই বৃষ্টির জল ধরে রেখে, সেচের মাধ্যমে রাজ্যের প্রায় ৭২% জমিতে চাষ যোগ্য জল পৌঁছে দেওয়া গিয়েছিলো। এখন কত শতাংশ জমি সেচের আওতায়? সরকারী তথ্য কি বলে? জানেন? ছাড়ুন তো। এই প্রকল্পেরও নতুন নাম তো পড়েছে। 'জল ধর জল ভর'। নাম যখন  নতুন,তখন নিশ্চয় উন্নয়নও হয়েছে। ৯৯% জমিতেই সেচের জলও পৌঁছে গেছে। আগের 'স্বনির্ভর গোষ্ঠীর' উন্নয়নও হয়েছে, "আত্মমর্যাদা"। প্রতি ব্যক্তির ঋণ পিছু প্রকল্পেরও উন্নয়ন আজ "আত্মসম্মান"।
আসলে কি জানেন, হিজিবিজ্‌বিজ্‌ বলল, 'একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত। তার জুতোর নাম ছিল অবিমৃষ্যকারিতা, আর ছাতার নাম ছিল প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু- কিন্তু যেই বাড়ির নাম দিয়েছে 'নবান্ন', অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে...

বৃহস্পতিবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৬

ঋণ নিয়ে ডাহা মিথ্যা ~ পুরন্দর ভাট

• তৃণমূলীরা বারবার প্রচার করে, বামফ্রন্ট সরকার ১লক্ষ ৯২হাজার কোটি টাকা ঋণ করে গেছে। বাস্তবে সেই ঋণ স্বাধীনতা প্রপ্তির সময় থেকে ২০১১ সালের ১১ই মে পর্যন্ত সময়ে করা। বাজার থেকে করা ঋণের পরিমাণ তুলনায় কমই ছিল।

• বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে স্বল্পসঞ্চয়ে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল। চিটফান্ডগুলির রমরমা ঠেকাতে তা কাজে এসেছিল। অথচ, কেন্দ্রীয় সরকারের বিচিত্র একতরফা আইন অনুসারে রাজ্যে যত অর্থ স্বল্পসঞ্চয়ে সংগৃহীত হতো, তার একটি অংশ বাধ্যতামূলকভাবে রাজ্য সরকারকে নিতে হয়। সেই কারণে, কেন্দ্রীয় আইন অনুসারে ৭৯হাজার কোটি টাকা ঋণ হয় কেন্দ্রের কাছে। এই ঋণ বাজার থেকে করা ঋণ নয়।

• কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা খাতের বরাদ্দের ৭০শতাংশ রাজ্য সরকারকে নিতে হতো ঋণ হিসাবে। সেই ঋণের পরিমাণ বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে ছিল ১২হাজার ৩০০কোটি টাকা।

• নাবার্ডসহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের সাহায্য থেকে রাজ্যের ৩৪বছরে ঋণ দাঁড়ায় ৮হাজার ৫০০কোটি টাকা।

• পি এফ তহবিলে ঋণের পরিমাণ বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে ছিল ৮হাজার কোটি টাকা।

• কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক বছরের শেষ লগ্নে টাকা পাঠানোয় কখনও কখনও টাকা খরচ করা যায় না। খরচ না হওয়া ওই টাকা পরের আর্থিক বছরের ধারের তালিকায় ঢুকে পড়তো। এমন ১২হাজার কোটি টাকাও চৌত্রিশ বছরে ঋণের তালিকায় রয়েছে।

• এইসব নিয়ে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১লক্ষ ৯২হাজার কোটি টাকা।  তার মধ্যে বাজার থেকে ধারের পরিমাণ ৭২হাজার কোটি টাকা।

• তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির প্রশ্ন ছিল ঋণভারে জর্জরিত অর্থনীতির সাহায্যে কি কোনো উন্নতি করা সম্ভব? রাজ্যের বহুল প্রচারিত একটি সংবাদপত্র সেদিন তাদের  প্রতিবেদনে লিখেছিল, ''সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বৈঠকে রাজ্যের আর্থিক পরিস্থিতি বোঝাতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন রাজ্যের এক টাকা আয়ের ৯৪ পয়সাই চলে যায় বেতন পেনশন, সুদ ইত্যাদি যোজনা বহির্ভূত খরচ মেটাতে। তাঁর প্রশ্ন ছিল, ৬ পয়সায় কি উন্নয়ন সম্ভব? (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ অক্টোবর, ২০১১)

• সত্যিই কি এক টাকা আয়ের ৯৪ পয়সাই চলে যায় বেতন, পেনশন, সুদ ইত্যাদি যোজনা বহির্ভূত খরচ মেটাতে? ডাহা মিথ্যা কথা।  তৃণমূল রাজ্য সরকারেরই তথ্য বলছে, ২০১৪-১৫ আর্থিক বর্ষে  ঋণ, বেতন, পেনশন বাবদ রাজ্য সরকারের খরচ হয়েছে মোট  ৭৪ হাজার ৮৮৮ কোটির সামান্য বেশি। সেখানে  ২০১৪-১৫ আর্থিক বর্ষে রাজ্য সরকারের  মোট আয় ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। (সূত্র : বাজেট অ্যাট এ গ্লান্স ২০১৫-১৬, পৃ: ১ ও পৃ: ১৩) অর্থাৎ, বেতন, পেনশন, সুদ এই তিনটি খাতে রাজ্য সরকারের খরচের পরিমাণ আয়ের ৫৮ শতাংশ, মমতা ব্যানার্জি কথিত ৯৪ শতাংশ নয়।

• বর্তমানে ধার করার হিসেবে তৃণমূল-শাসিত পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে 'এক নম্বর'। বামফ্রন্ট সরকার বিদায় নেবার সময় (২০১১ সালের ১১ মে) সব মিলিয়ে (স্বাধীনতার পর কংগ্রেসী আমলের ঋণসহ) রাজ্যের পুঞ্জিভূত ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ৯২ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের বাজেটে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালের ৩১শে মার্চ পর্যন্ত রাজ্যের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লক্ষ ৯৯ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। সরকারি তথ্যই জানিয়ে দিচ্ছে মমতা ব্যানার্জির সরকার পাঁচ বছরে রাজ্যবাসীর মাথায় অতিরিক্ত ১ লক্ষ ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ চাপানোর ব্যবস্থা করেছে। সবটাই বাজার থেকে নেওয়া ধার।

• ২০১১সালের ২০শে মে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। ক্ষমতায় আসার প্রথম ১০মাসে নতুন সরকার বাজার থেকে ধার করেছিলো ১৭হাজার ৫০০কোটি টাকা। ২০১২-১৩আর্থিক বছরে রাজ্য ধার করে প্রায় ২১হাজার কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ আর্থিক বছরে  বাজার থেকে মমতা ব্যানার্জির সরকারের ধারের পরিমাণ ছিলো ২১হাজার ৫৫৬কোটি ৪২লক্ষ টাকা। ২০১৪-১৫-তে বাজার থেকে রাজ্য সরকার ধার নিয়েছিল ২১হাজার ৯০০কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ আর্থিক বর্ষের প্রথম মাসে, অর্থাৎ ২০১৫-র এপ্রিলে, রাজ্য সরকার ১০০০কোটি টাকা ধার করে। তারপর প্রায় প্রতিমাসেই ধার।

• ১৯৪৭ থেকে ২০১১ পর্যন্ত রাজ্য সরকার  গড়ে প্রতি বছর ঋণ নিয়েছিল  ৫ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে বছরে গড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিচ্ছে।

ঋণের টাকা কোথায় গেল?

• লক্ষাধিক কোটি টাকা রাজ্য সরকার ধার করলেও কাজ কী করলো? প্রশ্ন সেটাই। নতুন কোনো স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি হয়নি বলেই চলে। শুধু শিলান্যাস হচ্ছে। বামফ্রন্টের আমলে তৈরি সরকারী বাড়ি, হাসপাতাল, সেতুতে নীল-সাদা রঙ চাপিয়ে পাথরে মন্ত্রী-নেতাদের নাম খোদাই চলছে। রেগার মজুরি দেওয়া হয়নি। সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলি বন্ধ হবার মুখে, উন্নয়নমূলক কাজে টাকা নেই। টাকা ঢালা হচ্ছে  সরকারী মেলা, মোচ্ছব আর উৎসবের নামে  এবং চক্ষু লজ্জাহীন সরকারী প্রচারে।  মুখ্যমন্ত্রীর জেলা সফর ঘিরে কোটি কোটি টাকা উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

• পরিকল্পনা বহির্ভূত খরচে রাশ না টানার ফলেই প্রতি মাসে নিয়ম করে বাজার থেকে টাকা ধার করছে রাজ্য সরকার। ২০১৪-১৫সালের রাজ্য বাজেটে পরিকল্পনা উন্নয়ন খাতে সরকার ৪২হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার উদ্যোগ নিয়েছে। আর উলটোদিকে পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে রাজ্য সরকারের ব্যয় বরাদ্দ ১লক্ষ ১৪হাজার ৩১৯কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে খরচ করার মধ্য দিয়েই বেহিসাবি খরচে কোনো লাগাম নেই।

• সরকারি হিসাব অনুযায়ী এক শতাংশ মহার্ঘ ভাতা বাবদ মাসিক ব্যয়ের পরিমাণ ২৫ কোটি টাকা বা বছরে ৩০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এর জন্য বছরে ১৬ হাজার ২০০ কো‍‌টি টাকা সরকারের হাতে রয়ে গেছে। বর্তমানে বকেয়া ৫৪ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দিয়ে ২০১২ সালের জুলাই মাস থেকে ২০১৫ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত সাশ্রয়ের পরিমাণ ৩০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এত টাকা কোথায় নয়ছয় করলো তৃণমূল সরকার?

চর্বিতচর্বণ ~ মনিপর্ণা সেনগুপ্ত মজুমদার

" আমার বর না ... বিছানায় পড়লেই বাঘ ! "

উঁহু উঁহু, আঁতকে উঠবেন না, নীল ছবিজনিত কোন দৃশ্যকল্প বা আলোচনা নয়, এ এক গভীর সমস্যা। এবং উপরোক্ত মন্তব্যটি নেহাতই বাস্তব।
এ সমস্যা যে কী নিদারুণ তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেন না ...রাতের বেলা ঘুমের মাঝে কী ভয়ানক আতঙ্কে চমকে চমকে উঠতে হয় বা হঠাৎ মনে হয় বুঝি অনেকগুলো বাঘ ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে আছে ...এই ঝাঁপিয়ে পড়লো বলে! ভয়ে শিঁটকে গিয়ে সঙ্গীকে ঠেলে তুলে দিতে হয় , যাক্‌ বাবা ...কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চিন্তি। সবে চোখ বুঁজে এসেছে , এমন সম, আবার আবার "ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে " ...ঘুমের দফারফা ।

আরে হ্যাঁ রে বাবা, নাক ডাকার কথাই বলছি। বিভিন্ন স্টাইলের নাক ডাকা আছে , বেশীরভাগই অবশ্য গোদা টাইপ "ঘোঁঊঊঊঊঊঊ " করে এক ভয়ানক চিক্কুর ছেড়ে পর মুহূর্তেই "ভা ভা ভা ভা ঘঁতঘঁতঘঁত হুঁ হুঁ হুঁ " । কিছু ওস্তাদ ডাকিয়েও আছেন । প্রথমে মিঠে তান ধরেন, তারপর আস্তে আস্তে ক্রমশঃ উচ্চকিত হয় স্বর...ঠমক-গমক শুনে বাচ্চারা রাত-বিরেতে ভয়ে চিল্লিয়ে ওঠে। ঠাট্টা - মস্করা করছিনা মশাইরা, জানি নাকের গঠনজনিত কারণে বা ঘুমের সময় মুখের ভেতরের মাংসপেশি শিথিল হয়ে পড়ায় শ্বাস প্রশ্বাসে অসুবিধা হওয়ায় বা এরকম আরো একশো আটটি কারণে মানুষ নাক ডাকে বা ডাকতে বাধ্য হয়। কিন্তু তার ফলে অন্য মানুষের যে জীবনমরণ সমস্যা উপস্থিত হতে পারে তার কথাই বলছি আর কী। সম্মানহানিও হতে পারে। বিশ্বাস না হলে স্বচক্ষে দ্যাখা বা স্ব কর্ণে শোনা দু- একটি ঘটনার উল্লেখ করছি । সঙ্গত কারণেই নাম গোপন রাখতে হচ্ছে ...

'ক' বাবু বাবা হয়েছেন খুব বেশীদিন নয়, কন্যাটির সবেমাত্র আধো বুলি ফুটেছে মুখে । শ্রীমতি 'ক' যেখানে পারছেন সেখানেই এই ক্ষণজন্মা কন্যাটির নানাবিধ গুণপনা ব্যক্ত করছেন এবং বিস্ময়ের অতলে গিয়ে ভাবছেন '' এ মেয়ে বড় হয়ে আইনস্টাইন না হয়ে যায়না '' । তা এরকমই এক সময়ে 'ক' পরিবার নিমন্ত্রণ রক্ষায় এক সান্ধ্যবাসরে উপস্থিত। 'ক' গিন্নী হাসি হাসি মুখে বেড়াল দেখিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করছেন " বল তো সোনা ওটা কী " ...মেয়েও ঝট্‌পট্‌ জবাব দিচ্ছে । আচমকা কছেই কোথাও গভীর, গম্ভীর এক হাম্বারব শোনা যায় এবং খুকি হাততালি দিয়ে বলে ওঠে , "বাবা ডাকছে , বাবা ডাকছে, বাবা আত্তিবেলায় এইলোম কয়ে ডাকে " । তারপরের ঘটনা আর নাই বা বললাম, সহজেই অনুমেয় ।

পতিব্রতা ভার্‌তীয় নারীরা মানিয়ে গুছিয়ে নেন ভাগ্যকে অভিশাপ দিয়ে। গর্জনের সঙ্গে ঘর করতে প্রথম প্রথম অসুবিধে হলেও ( আমার এক বন্ধু তো এক রাতে ' চীঁচঁঈঈঈঈ হোয়াও হোয়াও হোয়াও ঘ্যাস ঘ্যাস ঘ্যাস ' এরকম আওয়াজ শুনে ভেবেছিল ঘুমের মধ্যে বুঝি বা তার বরের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে , অন্তিম সময় উপস্থিত ...তাকে জাগানোর চেষ্টায় বিছানায় জল-টল ঢেলে একাক্কার কান্ড! ) । একেকজন অভ্যস্ত হয়ে যান এমনই যে একসময় ওই বীভৎস আওয়াজ না হলে তাঁদের ঘুমই আসতে চায়না। অনেকে ' শব্দই ব্রহ্ম ' এই তত্ত্ব মেনে নিয়ে যাহোক একটা রফা করে নেন নিজের সঙ্গে বা নিজের নিদ্রাজনিত শান্তির সঙ্গে। বাকিরা গুম্‌রে মরেন এবং ক্যানো বিয়ের আগে একবার ঘুমিয়ে দ্যাখেননি হবু বরের সঙ্গে ( মাইন্ড ইট্‌, ঘুমিয়ে বলা হয়েছে ) সেই ভেবে কপাল চাপড়াতে থাকেন।

এতক্ষণ ধৈর্য ধরে পড়ার পর (যদি আদৌ এতটা পড়ে থাকেন কেউ ) কোন পুরুষ পাঠক আমায় একচোখো ভেবে হয়তো মনে মনে একচোট খিস্তিই দিয়ে ফেলেছেন আর ভাবছেন " বললেই হল , মেয়েরা নাক ডাকে না নাকি !" অবশ্যই ডাকে। এবং সময়ে সময়ে তা অতীব ভয়ংকর হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়ে সামান্য একটি ঘটনার উল্লেখ করছি ।

দিল্লী চলেছি , রাজধানী থ্রী টায়ার এসি কামরা। প্রায় সকলেই খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েছে, ইতিউতি দু-একটা রিডিং ল্যাম্প ছাড়া সব বড় আলোই প্রায় নেভানো। নাইট বাল্‌ব গুলোর আলো-ছায়ায় বেশ একটা মায়াময় আবহাওয়া। হঠাৎ অন্ধকারের বুক চিরে, ট্রেনের আওয়াজ কে ছাপিয়ে এক হৃদয়-বিদারক আর্তনাদ "আআআআআআউঁঁউঁউঁউঁ ওঃওঃওঃ"। সে যে কী পৈশাচিক লিখে বোঝানোর ক্ষমতা নেই আমার !! আশপাশের প্রায় সকলেই প্রচন্ড আতঙ্কে ঘুম ভেঙ্গে কাঠের মত শক্ত হয়ে শুয়ে আছে বেশ বুঝতে পারছি ... আমার উল্টোদিকের বার্থে এক অবাঙালী ভদ্রলোক ছিলেন , তিনি নামতে যেতেই তাঁর স্ত্রী শক্ত ভাবে চাপা কন্ঠস্বরে বললেন, "আরে রহ্‌নে দো জী, উঠো মৎ"। আমি নিজেও ঘুম ভেঙ্গে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এমন সময়ে আচম্বিতে আবার সেই চীৎকার! এবার অনেকেই বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। শব্দের উৎস স্থল দু-তিনটি বার্থের পরে একটি সাইড-আপার বার্থ। দুজন ভদ্রলোক এগিয়ে গেলেন, যদি ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে কিছু উপকার হয় ...কারণ ওই আর্তনাদ বা নাক-নিনাদের মধ্যে ট্রেনে অন্য সহযাত্রীদের ঘুমানো অসম্ভব। কিন্তু পরক্ষনেই জানা গেল যে উনি একজন ভদ্রমহিলা। ' ও দিদি , ও দিদি , ও ভাবীজি , ম্যাডাম ম্যাডাম করে হাঁকডাঁক করেও তার ঘুম ভাঙ্গানো গেলনা। কামরার সকলেই প্রচন্ড বিরক্ত । তারমধ্যে দ্যাখা গেল মহিলার সঙ্গী কেউ-ই নেই যিনি তাঁকে সজোরে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে একটু সাহায্য করতে পারেন । মহিলার ঠিক নীচের বার্থের ভদ্রলোক সকলের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলতে লাগলেন যে এই ধরণের মানুষের ট্রেনে উঠে ঘুমানো প্রায় একটা পানিশেব্‌ল ক্রাইমের মধ্যে পড়ে। যাইহোক , উপায়ান্তর না থাকায় কোনক্রমে রাত টা কাটলো ।
সকালবেলায় আর কেউ-ই ব্যাপারটা নিয়ে ঘাঁটালোনা ; কারণ সত্যি কথা বলতে কী সারারাত প্রায় জেগে থাকা আমরা , মানে ভদ্রমহিলার আশপাশের যাত্রীরা সকালের দিকে প্রায় সক্কলেই ঘুমিয়ে কাদা হয়ে ছিলাম। ওদিকে ট্রেন রাইট টাইম যাকে বলে । বেলা দশটায় দিল্লী।

যাইহোক , ভালোয় ভালোয় পৌঁছে ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নামতে একটু দেরি হচ্ছিল আমার, হঠাৎ দেখি যে ভদ্রলোক গতরাত্রে ভদ্রমহিলার বাপান্ত করছিলেন তিনি হাঁচোড়পাঁচোড় করে তিনখানা মস্ত স্যুট্‌কেস টেনে নামাতে গলদঘর্ম হচ্ছেন এবং মহিলাকে বলছেন "আরে তুমি আগে নামো তো, যত্ত গন্ধমাদন বয়ে নিয়ে এসোছো"! অপার বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকাতেই চোখাচুখি হয়ে গেল। যে মিনতি ভরা দৃষ্টিতে তিনি করুণ ভাবে আমার দিকে তাকালেন তাতে বোধহয় পাষাণও গলে জল শুধু না...একেবারে বাষ্পীভূত হয়ে হাইড্রোজেন -অক্সিজেনে পরিণত হবে! যা বোঝার বুঝে নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে নেমে গেলাম তাঁদের পাশ দিয়ে। শুধু ভাবলাম কী সাংঘাতিক এই নাক-নিনাদ ...!

যার জ্বালা সেই বোঝে ।

রবিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৬

টেনিদার জঙ্গিদমন ~ আশিস দাস

চাটুজ্জদের রোয়াকে আমরা তিন জন বসেছিলাম। পাঠানকোটে জঙ্গিহামলা নিয়ে জোর তর্ক হচ্ছিল। হঠাৎ পিঠে জোর চাপড় খেয়ে চমকে তাকিয়ে দেখি স্বয়ং টেনিদা দাঁড়িয়ে। রোয়াকে পা ছড়িয়ে বসেই বললো, "খুব জঙ্গি নিয়ে ভাটাচ্ছিস দেখছি? নিজেদের কি অর্ণব গোস্বামী ভেবেছিস? যুদ্ধের আর আসল জঙ্গিদের খবর পেতে চাইলে আমাকে বল।"
হাবুল সেন বলে উঠল, "তুমি তো ক্যামোফ্লেজ কইর‍্যা জাপানি মারছিলা, জঙ্গির খবর তোমার কাছে আসে ক্যামনে শুনি সেডা?"
টেনিদা বলে, "হু হু বাওয়া আমি পাগল না মদন মিত্র? এসব সিক্রেট খবর অমনি অমনি হয়? যা প্যালা মোড়ের মাথার কেএফসি থেকে একটা জেঙ্গার বার্গার নিয়ে আয় দেখি।"
আমি জানতাম, সকালে উঠেই আনন্দবাজারে প্রথম পাতায় দিদির মুখ দেখা মানেই দিনটা অশুভ। কি আর করা, গচ্চা গেল ১৫০ টাকা।
বার্গারে মস্ত একটা কামড় দিয়ে টেনিদা শুরু করল, "জানিস তো আমার ছাতি ৫৬ ইঞ্চি-"
বেরসিক ক্যাবলাটা সাথে সাথে বলে কিনা, "ডাহা মিথ্যে, এই তো সেদিন পাড়ার নাটকে ড্রেস বানানোর সময় ৪২ মাপল দেখলাম"।
টেনিদা উদুম ক্ষেপে গিয়ে বললো, "শাট আপ ক্যাবলা, আর একবার বাজে বকবক করলে এক ঘুষিতে তোর নাক-"
"নাগপুরে চলে যাবে", কমপ্লিট করলাম আমি।
হাবুল সেন জুড়ে দিল, "আর মোহন ভাগবত সেডা লইয়্যা লোফ্যালুফি খেলবে। তুমি থাইম্যো না টেনিদা, ক্যাবলাডা পোলাপান। রামদেবের মত ইগনোর কর ওডাকে।"
নাকমুখ কুঁচকে টেনিদা বলল, "আর বেশি বকলে জলপান করে ফেলব একদম। সব ব্যাপারে চেতন ভগতের মত ফোড়ন কাটা বেরিয়ে যাবে তখন। যাই হোক ৫৬ ইঞ্চি ছাতি নিয়ে তখন আর্মিতে পোস্টেড আমি। তখন তো যা দিন গেছে, উঠতে জঙ্গি মারছি, বসতে জঙ্গি মারছি, ফেসবুকেও জঙ্গি মারছি-"
"ফেসবুকে? সে আবার কেমন?" - আমি আর থাকতে না পেরে বললাম।
টেনিদা ফিচকে হেসে বললো," আরে মেয়েদের ফেক প্রোফাইল বানিয়ে জঙ্গিগুলোকে রিকোয়েস্ট পাঠাতাম, ব্যাটারা ফ্রেন্ড হয়ে চ্যাট শুরু করত। কিছুদিন বাদেই হ্যাপি নিউ ইয়ার, কিক, চাঁদের পাহাড় এসব সিনেমার ডাউনলোড লিঙ্ক পাঠাতাম। ব্যাস আর যায় কোথা, ব্যাটারা নিজেরাই সুইসাইড করে মরতো।"
ক্যাবলা বললো," বেড়ে বুদ্ধি তো"।
টেনিদা হেভি খুশি হয়ে বললো,"হু হু বাওয়া, পটলডাঙার টেনি মুখুজ্যের ব্রেন এটা। তারপর শোন। একটা জঙ্গি ঘাঁটি আমাদের পাশের পাহাড়ে অনেকদিন ধরে রয়েছে। ব্যাটারা আমাদের ওয়্যারলেস ট্যাপ করে শোনে সারাদিন আর মাঝে মাঝেই নিচের গ্রামে হামলা চালায়। কর্নেল জবরদস্ত সিং একদিন আমাকে ডেকে বলে, ক্যাপ্টেন টেনি আপহি হামারে ভরোসা হো, কুছ করো আপ। আমি তো বার খেয়ে রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু কি করা যায় বুঝতে পারলাম না। ব্যাটারা রাত জেগে আমাদের ওয়্যারলেস ট্যাপ করে আর পাহারা দেয়। আচমকা হামলাও করা যাবেনা। তার উপর ওদের ডেরা এমন একটা গুহার আড়ালে যে আমাদের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে বেশি পাঁয়তাড়া করলে। কি করি কি করি ভাবতে ভাবতে চোখ পড়ল রেডিওটার দিকে। দেখেই চট করে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। সেই রাতেই ১০ জন সেনাকে নিয়ে আমি হামলা করলাম ওদের ডেরায়। ব্যাস সবাই ডেড। মিশন সাক্সেসফুল যাকে বলে।"
সবাই সমস্বরে বললাম, "কি করে হল? রাত জেগে পাহারা দিত যে ওরা?"
টেনিদা বললো,"ওই যে রেডিও।"
আমি বললাম,"তাতে কি?"
টেনিদা ধ্যানগম্ভীর বুদ্ধের মত হেসে বললো, "আরে রেডিও তে মোদিজির মনকি বাত চালিয়ে ওয়্যারলেসের সামনে লাগিয়ে গেছিলাম। ব্যাটারা ওয়্যারলেস ট্যাপ করে ওই শুনে শুনে বোর হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল তো! পাহারা আর দেবে কে? আমাকে তো পরমবীর চক্র দিয়েই দিত। নেহাত দাদরি হল, তাই ফিরিয়ে দিলাম ওটা দেবার আগেই। বুঝলি?  এ হল সত্যিকার জঙ্গি মারার গল্প।এই এই.. ক্যাবলা ক্যুইক, কোয়ালিটি ওয়ালশের গাড়ি যাচ্ছে একটা"।

রবিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১৬

বাঘ ~ প্রকল্প ভট্টাচার্য

আমি বাঘকে ভয় পাই না। কখনোই পেতাম না।
শীতের ছুটিতে বাবা চিড়িয়াখানায় নিয়ে গেছিল, দেখিয়েছিল কেমন করে অসহায়ভাবে খাঁচায় বন্দী হয়েও পশুটা রাজকীয় ভঙ্গীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে লোকেরা চেঁচামেচি করছে, কেউ কেউ ঢিল ছোঁড়ার চেষ্টা করছে, হাততালি দিয়ে, শিস দিয়ে বিরক্ত করছে। বাঘটা পাত্তাও দিচ্ছে না। একবার একটু গা-ঝাড়া দিতেই সবাই হূরমুড়িয়ে পালালো।
বাবা বলেছিল, "দেখেছিস! সত্যিকারের সাহসী যারা, পরিস্থিতিও তাদের চরিত্র বদলাতে পারে না! অন্যায় কৌশলে ওকে বন্ধ করে রেখেছে, কিন্তু ওর সাহস, ওর তেজ কমাতে পেরেছে কী? বরং খাঁচার বাইরে, নিরাপদে থাকা লোকেরা ওকে এতদূর থেকে দেখেও ভয় পাচ্ছে!" 
আমার বাবার খুব সাহস। বাবার বন্ধুরা বাবাকে বলে 'বাঘের বাচ্চা!'
আর আমি তো তারই ছেলে, আমি কেন বাঘকে ভয় পাব!
বাবার একটা বুলেট মোটরবাইক আছে। আমাকে সামনে বসিয়ে যখন সেটা চালিয়ে ভটভট করে বড় রাস্তা দিয়ে যায়, লোকেরা রাস্তা ছেড়ে দেয়। কেউ ভয়ে, কেউ সম্ভ্রমে।
বাবার নাম বিপ্লব, অনেকে ডাকে বুলেট বিপ্লব বলে।
আমাদের স্কুলে মিস সকলের নামের মানে জেনে আসতে বলেছিলেন। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "বাবা, বিপ্লব মানে কি?"
একটু হেসেছিল বাবা, তারপর বলেছিল, "তোকে এবার থেকে ক্লাবে নিয়ে যাব।"
শুনে মা খুশী হয়নি, "আবার ওকে টানছ কেন..."
বাবা শুনেও শোনেনি।
আমি ভেবেছিলাম, বিপ্লব মানে ক্লাব।
রাত্তিরে বাবার পাশে শুয়ে বাবার বুকে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলাম। একটা কাটা দাগ আছে বাবার বুকে, আগেও দেখেছি, কিন্তু প্রশ্ন করিনি। সেদিন জানতে চাইলাম, "বাবা, এই দাগটা কিসের?"
একটু হেসে বাবা বলেছিল "ওটা একটা বাঘের থাবার দাগ।"
-"তোমাকে বাঘে থাবা মেরেছিল?"
-"না, মারতে পারেনি। চেষ্টা করেছিল।"
-"তারপর! বাঘটার কি হলো?"
-"আর কী, এমন তাড়া করলাম, পালিয়ে গেল আমার ভয়ে!"
-"বাবা, পুরো গল্পটা বলো, আমি শুনবো!"
-"আজ নয়, আর একদিন বলব, কেমন?"
আমি ভেবে নিলাম, বিপ্লব মানে বাঘ।
বাবা খুব মোটা সোটা ছিল না, কিন্তু হাতদুটো ছিল লোহার মতো শক্ত, আর পরিশ্রম করতে পারতো খুব। যখন রাস্তার মাঝখান দিয়ে বুলেট বাইক চালিয়ে যেত, সামনে বসে আমি বাবার শক্ত হাতদুটো ধরে থাকতাম। গাড়ি যতোই জোরে যাক না কেন, আমার ভয় করতো না। সেদিনও ঐভাবেই ক্লাবে নিয়ে গেল বাবা। যেতে যেতে আমার মনে হল, বিপ্লব মানে নিশ্চয়ই ভরসা, সাহস!
আমি ভাবতাম ক্লাবে দোলনা থাকে, ছোটরা খেলাধুলো করে, বড়রা গান গায়, খাওয়াদাওয়া হয়। কিন্তু এই ক্লাবে দেখি সবাই অনেক বড়, খুব গম্ভীর আলোচনা করছে। এক একজন করে উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলছে, আর সকলে হাততালি দিচ্ছে। আমার বাবাও কিছুক্ষণ কথা বললো, সবাই খুব হাততালি দিল। তারপর বললো, 'ইঙ্কলাব জিন্দাবাদ'। আমিও বললুম তাদের সঙ্গে।  দু'জন কাকু সেটা দেখে আমার গাল টিপে আদর করে বললো, হবে না! বাঘের বাচ্চা তো!
ফেরার সময় বাবাকে বললাম, "বাবা, ক্লাবের মধ্যে বলে ইন ক্লাব বলতে হয়, তাই না?"
বাবা হা-হা করে হেসে বললো, "আরে না না, কথাটা ইনকিলাব জিন্দাবাদ, তার মানে বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক!'
ভালো লাগলো যে এতজন কাকু চাইছেন আমার বাবা দীর্ঘজীবি হোন! বিপ্লব মানে তাহলে দীর্ঘজীবি!
তার কয়েকদিন পরেই শুনলাম "অবরোধ অবরোধ"। ভোরবেলা বাবা বেরিয়ে গেল। মা ফুঁপিয়ে কাঁদছিল আর গজগজ করছিল। সারাদিন কেটে গেল, বাবা ফিরলো না। সন্ধ্যেবেলা দু'জন কাকু এসে মা-কে কীসব বলল, মা তাড়াতাড়ি শাড়ি বদলে, একটা ব্যাগ নিয়ে, আমাকে ঘরের পোশাকে নিয়েই কাকুদের সংগে একটা গাড়িতে উঠে চলল। আমি কিছু বুঝতে না পেরে চললাম চুপচাপ। মা মুখে শাড়ির আঁচল চেপে কাঁদছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর একজন কাকুকে জিজ্ঞেস করলাম, "আমরা কোথায় যাচ্ছি?"
-"তোমার বাবাকে দেখতে।"
-"বাবা কোথায়? কী হয়েছে বাবার?"
-"কিছু খারাপ লোক তোমার বাবাকে মেরেছে, বাবা হাসপাতালে ভর্তি।"
-"কেন! আমার বাবাকে অন্যরা মারবে কেন!"
-"তোমার বাবা তো ভাল লোক, তাই খারাপ লোকেরা বাবাকে ভয় পায়। সেই ভয় থেকেই মারে। তোমার বাবা মানুষের ওপর অত্যাচার মেনে নেয় না, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। তাই খারাপ লোকেরা বাবাকে ভয় পায়। "
-"খারাপ লোকেদের পুলিশ ধরে না কেন? কেন তারা অন্যায় করবে?"
-"পুলিশও যে তাদের কথা শুনে চলে! তারাই যে দেশ চালায়, আতি তাদের অনেক ক্ষমতা! তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস লাগে, আর সেই সাহস সকলের থাকে না। তোমার বাবার আছে।"
-"হ্যাঁ, বাবার খুব সাহস। জানো কাকু, একবার বাবা একটা বাঘের সংগে লড়াই করেছিল, বুকে কাটা দাগ আছে!"
-"বাঘ নয়, ওই খারাপ লোকেরাই আগে একবার বাবাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল, পারেনি। ওটা তারই দাগ। বাঘ তো সাহসী, আড়ালে লুকিয়ে মারে ভিতুরা। তোমার বাবার মতো যারা প্রতিবাদ করে, তাদের মারার চেষ্টা করে।"
-"কাকু, বিপ্লব মানে কি প্রতিবাদ?"
কাকু হাসলো। "ঠিক বলেছ। বিপ্লব মানে প্রতিবাদের লড়াই। একে চেপে রাখা যায় না।"
হাসপাতালে মাথায়, হাতে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা বাবাকে শুয়ে থাকতে দেখে কেমন অচেনা লাগছিল, সারা গা কাঁপছিল আমার রাগে, অসহায়তায়। বাবা ইশারায় আমাকে কাছে ডাকল, মাথায় হাত রেখে ধীরে ধীরে, কেটে কেটে বলল, "ভয় পাসনা, আমি সেরে উঠব শিগগির! পড়াশোনা করবি, মায়ের খেয়াল রাখবি, কেমন?"
আমার বলতে ইচ্ছে করল, "ইনকিলাব জিন্দাবাদ!" কিন্তু গলায় কী যেন আটকালো, তাই বলতে পারলাম না। 
মনে পড়লো খাঁচায় বন্দী সেই অসহায় বাঘটার কথা। কৌশলে বন্দী করে রেখে সক্কলে মজা দেখছে আর টিটকিরি দিচ্ছে। যদি একবার বাবা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে...
বিপ্লব দীর্ঘজীবি হবে। হবেই!!