বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

"ইন্টারনেট.অর্গ" - জুকার্বার্গের মহানুভবতা? - পুরন্দর ভাট

"ডিজিটাল ইন্ডিয়া" নিয়ে ফেসবুক সরগরম। অনেকেই ফেসবুক কর্তা জুকারবার্গের দেখাদেখি নিজেদের প্রফাইল পিকচারে তেরঙ্গা লাগিয়েছেন এই প্রকল্পের সমর্থনে। আবার অনেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ অভুক্ত শিশু বা আত্মঘাতী কৃষকের ছবি লাগিয়েছেন তাঁদের প্রফাইলে। প্রথমেই বলে নি যে আমি মনে করি না যে দেশে অভুক্ত শিশু রয়েছে বলে ইন্টারনেটের প্রয়োজন নেই। ইন্টারনেটের মাধ্যমে, ফেসবুকে বসে, যখন অভুক্ত শিশুদের কথা বলছি তখন স্বীকার করে নেওয়ার সৎ সাহস থাকা উচিত যে ইন্টারনেট একটা প্রয়োজনীয় জিনিস। ইন্টারনেট মানুষকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে, মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বাড়িয়েছে বহু গুন। গত ৫০ বছরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্ঠি হলো ইন্টারনেট। যে যুক্তিতে লোকে বলে যে লক্ষ লক্ষ অভুক্ত শিশু যেখানে রয়েছে সেখানে "ডিজিটাল ইন্ডিয়া"-র কি প্রয়োজন তারা ভেবে দেখবেন যে একই যুক্তিতে কেউ বলতে পারে যে যদ্দিন না সবাই খেতে পরতে পাচ্ছে তদ্দিন শিক্ষা দীক্ষার কি প্রয়োজন। ইন্টারনেটের অধিকার শিক্ষার অধিকারের মতোই একটা মৌলিক দাবি হওয়া উচিত আমার মতে। হ্যা এটা হতে পারে যে অনেকেই অভুক্ত শিশুদের ছবি লাগাচ্ছেন এটা মনে করিয়ে দিতে যে ভারতবর্ষের মানে সিলিকন উপত্যকায় বসবাসকারী প্রযুক্তি তারকারা নয় ভারতবর্ষ মানে হলো অপুষ্টিতে ভোগা শিশু, নিরক্ষর নারী এবং ঋণগ্রস্ত কৃষক। তাদের সাথে আমি একমত, সরকারের হাবভাব দেখে মনে হয় আজকাল যে সেটা তারা ভুলেই গেছে। এটা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার কিন্তু "ডিজিটাল ইন্ডিয়া"-র বিরোধিতা অভুক্ত শিশুদের জন্যে করবো না। তাহলে ডিজিটাল ইন্ডিয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, তাকে সকলেরই সমর্থন করা উচিত?


এই আলোচনায় ঢোকবার আগে কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার করে নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, অনেকেই শুনেছেন যে ফেসবুক "ইন্টারনেট.অর্গ" বলে এক প্রকল্প শুরু করেছে যার উদ্দেশ্য হলো ঘরে ঘরে বিনামূল্যের মোবাইল ইন্টারনেট পৌছে দেওয়া। এবার অনেকেই ভাবছেন যে মোদির ঘোষিত "ডিজিটাল ইন্ডিয়া" প্রকল্প আর ফেসবুকের "ইন্টারনেট.অর্গ" একই। এই ধারণা ভুল, "ডিজিটাল ইন্ডিয়া" প্রকল্পের লক্ষ্য সবার কাছে ইন্টারনেট পৌছে দেওয়া হলেও তার সাথে ফেসবুকের কোনো সরাসরি সম্পর্ক নেই। এটা সরকারী প্রকল্প এবং সরকার সবার কাছে ইন্টারনেট পৌছে দিতে শুধু ফেসবুক না আরো অনেকগুলো কোম্পানির সাথেই কথা বলছে, সরকার নিজেও টাকা ব্যয় করবে এতে। এ এক বৃহত প্রকল্প যার মধ্যে ট্রেনের স্টেশনে, ইস্কুলে, বাস টার্মিনাসে বিনামূল্যে ইন্টারনেট পরিসেবা পৌছানো হবে সরকারী এবং বেসরকারী উদ্যোগে। এরকম প্রকল্প মোদি প্রথম নন এর আগের কয়েকটা সরকারও নিয়েছে, মোদি যেটা ভালো পারেন তা হলো ব্র্যান্ডিং সেটা করেছেন। আসলে ফেসবুকের "ইন্টারনেট.অর্গ" এবং সরকারের "ডিজিটাল ইন্ডিয়া" প্রকল্প এক ও অভিন্ন এই ধারণা তৈরী করার পেছনে ফেসবুকের চালাকি আছে। মোদিকে নিজেদের অফিসে ডেকে, তার সাথে প্রশ্ন উত্তর পর্ব করে এবং তারপর নিজের প্রফাইলের ছবি তেরঙ্গা করে জুকারবার্গ এই ধারণা মানুষের মধ্যে তৈরী করেছে। মোদি হয়ে গেছেন ফেসবুকের "ইন্টারনেট.অর্গ"-এর একজন দূত। সেটা স্বেচ্ছায় না অজান্তে তা বলতে পারবো না। তার ওপর আরেকটা গুজব রটেছিলো যে যারা নিজের ছবি তেরঙ্গা করছে তারাই ফেসবুকের "ইন্টারনেট.অর্গ"-এর স্বপক্ষে নিজেদের অজান্তে ভোট দিয়ে দিচ্ছেন। সেটা নেহাতই গুজব, চিন্তার কিছু নেই। তো যাই হোক, প্রথমেই এই বিভাজনটা করা প্রয়োজন "ইন্টারনেট.অর্গ" আর "ডিজিটাল ইন্ডিয়া"-র মধ্যে।

দ্বিতীয়ত, আসা যাক "ইন্টারনেট.অর্গ" প্রসঙ্গে। জিনিসটা কি? এটা হলো স্মার্ট ফোনের জন্যে একটা এপলিকেশন (App) যা দিয়ে বিনাপয়সায় কিছু নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট খোলা যাবে। ভারতবর্ষে ফেসবুক রিলায়ান্সের সাথে পার্টনারশিপে এই এপলিকেশন গ্রাহকদের কাছে দেওয়া শুরু করেছে। ফেসবুক আরো ৮০টির মতো ওয়েবসাইটের সাথে হাত মিলিয়েছে এই প্রকল্পের জন্যে। এই ৮০ খানা ওয়েবসাইটের কিছু কিছু অংশ আপনি বিনামূল্যে ইন্টারনেট.অর্গ-এর মাধ্যমে ব্যবহার করতে পারবেন। এই ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে যেমন জনকল্যানমূলক ওয়েব পেজ রয়েছে যেমন সরকারী ওয়েব পোর্টাল, গর্ভবতী মায়েদের কি কি প্রয়োজন ইত্যাদি তেমনই উইকিপিডিয়া, বানিজ্যমূলক যেমন OLX, খেলাধুলোর জন্যে ESPN, আবহাওয়ার জন্যে AccuWeather, খবরের জন্যে Aaj Tak ইত্যাদি ওয়েবসাইটও আছে। এসব ওয়েবসাইটগুলোর সমস্ত কিছু যদিও আপনি বিনামূল্যে দেখতে পাবেন না, অল্প কিছু অংশ পারবেন বাকিটার জন্যে যেরকম মোবাইল ডেটা প্ল্যান থাকে সেগুলো নিতে হবে। প্রথম ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন কি কি ওয়েবসাইট বিনামূল্যে পাচ্ছেন যার মধ্যে একটি ফেসবুক আবার দেখুন দ্বিতীয় ছবিতে যে ফেসবুকেরই কিছু অংশ ব্যবহার করতে গেলে ডেটা প্ল্যান নিতে বলছে।






এই হলো মোটের ওপর ইন্টারনেট.অর্গ। এই ৮০ খানা ওয়েবসাইট বাদ দিয়ে দুনিয়ায় যে তামাম ওয়েবসাইট রয়েছে তা ব্যবহার করার জন্যে আপনাকে যেরম ডেটা প্ল্যানে এখন পয়সা কাটে সেরকমই কাটবে।

তা এতে সমস্যা কি? একটা কথা ভাসছে সেটা হলো "নেট নিউট্রালিটি", “ইন্টারনেট.অর্গতার ক্ষতি করবে। আমি প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র নই, এই বিষয়ে কিছু জানি না এবং বাকি সাধারণ মানুষের মতোই "নেট নিউট্রালিটি" বিষয়টা খুব পরিষ্কার বুঝতে পারছিনা। তবে বানিজ্য এবং অর্থনীতি নিয়ে সামান্য জ্ঞান আছে এবং তার সঙ্গে সাধারণ বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে যা বুঝছি সেটাই লিখছি। একটা প্রশ্ন সকলেরই মাথায় আসবে এই যে ইন্টারনেট.অর্গ” -এর মাধ্যমে বিনামূল্যে যে ইন্টারনেট গ্রাহকরা পাচ্ছেন তার খরচটা কে দিচ্ছে? অর্থাৎ ইন্টারনেট.অর্গ” -এর মাধ্যমে আপনি যে ওয়েবসাইটগুলো ঘুরবেন তার জন্যে তো কিছু ডেটা খরচ হবে তো সেই ডেটা কি রিলায়ান্স নেটওয়ার্ক বিনামূল্যে দিচ্ছে? রিলায়ানস তো জিন্দেগীতে কাউকে বিনাপয়সায় কিছু দেয়নি, তাহলে? ফেসবুক জানাচ্ছে যে এই খরচ তারা এবং তাদের বাকি ৮০ জন পার্টনার ওয়েবসাইট দেবে। তাদের এই আশ্চর্য্য মহানুভবতার কি কারণ? একটু ভাবলেই বুঝে যাবেন কি কারণ। আগেই লিখেছি যে এই ৮০ খানা ওয়েবসাইটের কিছু স্বল্প অংশই আপনি বিনামূল্যে পাচ্ছেন, পুরোটা না, বাকি অংশে যেতে চাইলে আপনাকে ডেটা প্ল্যানের পয়সা দিতে হবে। তার অর্থ হলো যে আসলে গোটা বেপারটাই বিজ্ঞাপন। উদাহরণ দিচ্ছি, ধরুন আপনি OLX-এ বিনামূল্যের পেজে গেলেন। সেখানে বিভিন্ন আইটেম আপনি বিনামূল্যে দেখছেন, এবার যখনই কোনো কিছু পছন্দ হলো এবং সেটাকে বাছাই করতে চাইলেন তখনই আপনাকে সাধারণ ডেটা প্ল্যানে টাকা কাটবে। অথবা ধরুন AajTak-এর ওয়েবসাইটে আপনি বিনামূল্যে বিচরণ করছেন, সেখানে খবরের হেডলাইন পড়তে পারছেন। কিন্তু যেই কোনো খবরে ক্লিক করে বিস্তারিত পড়তে যাবেন অমনি সাধারণ ডেটা প্ল্যানে আপনার পয়সা কাটবে। এই জন্যেই "নেট নিউট্রালিটি"-র প্রশ্ন আসছে, কিছু মানুষ বলছেন যে এতে ওই পার্টনার ৮০ টি কোম্পানির বাড়তি সুবিধে হবে, যারা বিনামূল্যের ওয়েবসাইট দিতে পারছে না তারা বঞ্চিত হবে, একটা অদৃশ্য দেওয়াল তুলে দেওয়া হচ্ছে যেনো, লোকে সেই দেওয়ালের ওপারে বাকি দুনিয়াটা আর দেখতে চাইবে না। জুকার্বার্গের এই জনকল্যানের প্রকল্প, সকলের জন্য বিনাপয়সায় ইন্টারনেট পৌছে দেওয়ার অঙ্গীকার আসলে মুখোশ, আসল উদ্দেশ্য বাজার বাড়ানো। বিষয়টা অনৈতিক সন্দেহ নেই, কিন্তু আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে এক্সট্রা পয়সা তো কিছু দিতে হচ্ছে না, যারা অন্য ওয়েবসাইট দেখতে চায় তারা এখন যেরকম পয়সা দিয়ে ডেটা প্ল্যানের মারফত দেখে সেরকমই দেখবে। বরং "ইন্টারনেট.অর্গের" মাধ্যমে কিছু ওয়েবসাইটের কিছু অংশ অন্তত বিনামূল্যে দেখা যাবে যা দেখতে এখন ডেটা প্ল্যানে পয়সা লাগে, something is better than nothing তাই না?

এই একই যুক্তি জুকারবার্গও দিয়েছেন বিভিন্ন ইন্টারভিউ বা লেখায় এবং বলতে দ্বিধা নেই যে এই যুক্তি যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে একটা সমস্যা আছে। তা হলো যে এতে ছোটো ছোটো কোম্পানি, নতুন ওয়েবসাইট, নতুন ব্যবসায়ী এরা মার খাবেন। কিরকম? ধরা যাক আপনি আঞ্চলিক ভাষায় এক ছোটো সংবাদমাধ্যম শুরু করলেন । তাতে বড় সংবাদপত্রগুলি যে ভাবে ঘটনা উপস্থাপনা করে তার চেয়ে ভিন্নভাবে করতে চান। ধরা যাক জমি নিয়ে আন্দোলনে পুলিশ লাঠি চালালো, বড় সংবাদমাধ্যমগুলোতে বিষয়টা উপস্থাপনা এমন ভাবে করলো যেন লাঠি চালিয়ে পুলিশ ঠিকই করেছে। আপনি আন্দোলনকারীদের পক্ষ টেনে লিখলেন। দুটো খবরের লিংকই ফেসবুকে ছড়ালো। এবার একজন সাধারণ মানুষ যখন পাশাপাশি দুটো লিংক দেখবেন এবং ক্লিক করতে গিয়ে দেখবেন যে একটায় (বড় সংবাদপত্রে) অন্তত কিছুটা অংশ বিনাপয়সায় পড়া যাচ্ছে এবং অন্যটায় (আপনার সংবাদপত্রে) ঢুকতেই পয়সা লাগছে তখন তিনি কোনটা ব্যবহার করবেন? সেরকমই ধরা যাক আপনি একজন নতুন ব্যবসায়ী যে ইন্টারনেটে কিছু বিক্রি করা শুরু করেছেন। OLX আপনার প্রতিযোগী। OLX-এ অন্তত আইটেমগুলো দেখতে কোনো ডেটা চার্জ লাগছে না কিন্তু আপনার ওয়েবসাইট খুলতেই ডেটা খরচ হবে। যিনি ক্রেতা তিনি এই অবস্থায় কি করবেন? তাহলে বুঝতেই পারছেন যে জুকার্বার্গের "ইন্টারনেট.অর্গ"-এর বানিজ্য মডেলে বড় ব্যবসায়ী, বড় কোম্পানিগুলোর লাভ বেশি। ছোট সংস্থা শুরুই করবে অনেক পিছিয়ে থেকে।


তবে হ্যা যেটা প্রথমেই বললাম যে "ডিজিটাল ইন্ডিয়া" এবং "ইন্টারনেট.অর্গ" এক নয়, যদিও মোদিজির কাজকম্ম মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরী করেছে, সেটা ইচ্ছে করেও হতে পারে কারণ মোদিজি আফটার অল ইজ মোদিজি। আমাদের সকলের উচিত "ইন্টারনেট.অর্গ"-এর বানিজ্যিক মডেলের বিরোধিতা করা। শুধু বয়কট করে হবে না। যেহেতু ভারতের সমস্ত মোবাইল ইন্টারনেট প্রদানকারী সংস্থা সরকারী ফাইবার নেটয়ার্ক ব্যবহার করে তাই সরকার যদি চায় এটা বন্ধ করতে পারে, তাই আমাদের উচিত সরকারকে চাপ দেওয়া এর ওপর বাধা নিষেধ চাপাতে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন