শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫

হারজিৎ ~ মধুবনী ঘোষ

​সারা রাত জেগে শেষে এই পরিণতি ?
শিখরে ভিরাট ছিল অগতির গতি
কিন্তু অবুঝ প্রেম অনুশকা শর্মা
মনঃসংযোগ গেল সিডনি টু বর্মা
বজ্র আঁটুনি দিয়ে এই প্রেম বাঁধলে
কিউই পাখি রোস্ট করে খাওয়া যেত খাবলে
কিন্ত বিরাট প্রেম জব্বর গরমা
যত দোষ ওই শালা অনুশকা শর্মা
আমাদের খোকা যদি মন দিয়ে খেলত
নাক ও চোখের জল এভাবে কি ফেলত ?
গোদের ওপরে আরও আছে বিষফোঁড়া
বাংলাদেশেতে নাচে ইলিশের জোড়া
আজ যদি কোনভাবে জিততাম ফাইনাল
বুক হত চেতানো হাসি হত এক গাল
চিত্কার করতাম সিডনি টু বর্মা
আমাদের জিতিয়েছে অনুশকা শর্মা !!!!



বৃহস্পতিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৫

করবী ~ অবিন দত্তগুপ্ত

​ মাটির দোতলা বাড়ি । দোতলার বাইরের রেলিঙটায়, ভিজে জামারা এলোমেলো হাওয়ায় জড়সড় । পেছনের ঘরের জানলাটার একটা পাট্‌ , সবসময় বন্ধ-ই থাকে । ছোট্ট ওমর জানে , মাঠে খেলতে নামলে ,আম্মি ওই অর্ধেক জানলাটা দিয়েই ওর উপর নজর রাখে । জানলাটা দিয়ে শুধু মাঠের বাঁ দিকটাই দেখা যায় । পড়া ফাঁকি দেওয়া দুপুরে , তাই ওমর রাইট হাফ । এমনিতে ,বাঁ পায়ের প্লেয়ার । মাঝমাঠ থেকে সত্যজিৎ একটা দারুণ থ্রু দিল । বল তাড়া করেও ধরতে পারল না ওমর । বলটা , মাঠের পাশের বটগাছ পেরিয়ে গেল । থ্রো-ইন । বলটা আনতে , বটগাছ পেরোতেই ওমর আরেকটা মাঠ দেখতে পেল । একদম একরকমের । সেই মাঠের-ও উত্তর দিকে ওর বাড়ি । সেই মাঠের-ও ডান পাশে একই রকমের বটগাছ । বলটা বটগাছের দিকে ছুটেই চলেছে । ওমর তাড়া করল । ধরতে পারল না । আবার বটগাছটা পেরলো , আবার একটা মাঠ দেখতে পেল । বল তাড়া করে সেটাকে পেরোতে , আরেকটা । তারপর আরেকটা,তারপর আরেকটা । সব একরকমের । বলটা গড়িয়েই চলেছে । "ওমর...ওমর, হতচ্ছাড়া ছেলে । পড়তে না বসে আবার মাঠে নেমেছিস ? এক্ষুনি ফিরে আয় । " আম্মির রাগী গলায় ভয় পেয়েই বোধহয় বলটা পেছন দিকে গড়াতে আরম্ভ করল । ওমর-ও পেছোতে লাগল পেরিয়ে আসা মাঠের পর মাঠ । বাস্তবের মাঠটায় পৌছতেই , একটা বিচ্ছিরি কড়া নাড়ার শব্দ । মোবাইল ঘড়ি বলেছে প্রায় ১১টা বাজে । বাইরে ভ্যাপসা গরম । ওমরের বাঘাযতীনের মেস-এ ফ্যান নেই । দরদর করে ঘামছে । অভ্যাসবসত বিছানার তলার মোটা লাঠিটা হাতে নিয়ে ওমর ছিট্‌কিনি খুললো । "রতন কাকু , তুমি ? "

বলেই খেয়াল হল দাঁত মাজা হয়নি । বাসি মুখে  কারো নাকের সামনে ফস্‌ফস্‌ করলেই , নাজিয়া পিট্টি দিত ছোটবেলায় । নাজিয়া , ওমরের আম্মি । 

 

                                                                                          ২

 

                         নাজিয়ার বয়স তখন ২০ । মেটে মেটে গায়ের রঙ । চোখ দুটোই কথা বলে । কিন্তু রতনের ভালো লাগত অর স্লোগান দেওয়ার ভঙ্গি । গলার শিরা ফুলিয়ে, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে স্লোগান দিত নাজিয়া । রতন নাজিয়াকে ভালোবাসত । খোঁপায় মাঝে সাঁঝে লাল গোলাপ লাগাত নাজিয়া । লাল রঙটা ভালোবাসত ওরা দুজনেই । রতন দারুণ পোস্টার লিখতে পারত । ওর ঝাঁকড়া চুল মাথা , রুক্ষ মুখ , আধখাওয়া বিড়ি --- সব কিছুকেই ভালোবাসত নাজিয়া । ওরা একসাথে ছাত্র ফেডারেশন করত । বাড়ি থেকে ওদের সম্পর্ক মেনে নেয়নি । অনেক লড়েও হেরে গিয়েছিল রতন । তিন বোনের দাদার পক্ষে বাড়ি ছাড়া সম্ভব ছিল না । নাজিয়া , ওসমান কে বিয়ে করে ।  ওসমান-ও মিছিলে হাঁটত । তখন ভরা জোয়ারের সময় । সক্কলে বাম ।

 

                          তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় বছর কুড়ি । নাজিয়া আর ওসমানের ছেলে ওমর । বয়স ১৫ । নাজিয়া এখন মহিলা সমিতি করে । মিড ডে মিলের রান্নার কাজ করে স্থানিয় একটি স্কুলে । রতন কাজ করে কারখানায় । সিটু করে রতন । ওসমান কন্ট্রাক্টর । ক্লাস নাইনে পড়ে ওমর । রতন আর নাজিয়া তখনো কমরেড । ওসমান নাজিয়ার স্বামি, কমরেড নয় আর ।

 

                          সালটা ২০০৯ ।  গ্রামে অপিরিচিত মুখের আনাগোনা বেড়েছে বেশ কিছুদিন হল । আশেপাশের চেনা মুখগুলো বদলে যাচ্ছে , আলোর গতিতে । বহুদিন বিস্মৃত হায়নারা, নখে শান দিচ্ছে । ওসমান দারুণ ঘুড়ি ওড়াতো । হাওয়ার দিক নির্ণয় করার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল ওসমানের । ওসমান দল বদলালো । বহুদিন ধরেই নাজিয়া আর ওসমানের সম্পর্কে চিড় ধরছিল ।ওসমানের ধারনা ছিল, কারণটা রতন । নাজিয়া জানত , কারণটা শিরদাঁড়া । দলবদলানোর ঘটনা চিড়কে , ফাটলে পরিণত করলো । এক ছাঁদের তলায় , ওরা দুজন তখন সম্পূর্ণ অন্য গ্রহের বাসিন্দা । শুধু ওমরের জন্য-ই ছাঁদ ভাগ হয়নি ।

 

                          আরও দু-বছর কাটলো । সেবার নির্বাচনে প্রচার করতে গিয়ে ,বেদম মার খেল নাজিয়া । রতনের মনে আছে, দিনটা ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০১১ । সরকারি স্বাস্থকেন্দ্রে রক্তাক্ত নাজিয়াকে দেখতে ছুটে এসেছিল রতন । স্মিত হেসে নাজিয়া জানতে চেয়েছিল , " কেমন লাগছে আমায় দেখতে ? "

"রক্তিম ...  কি হয়েছিল ?"

"ওরা আমায় পার্টি ছাড়তে বলেছিল । বলেছিল প্রচার করা যাবে না । "

"কি জবাব দিলে ? "

"বলেছি , বাড়ির লোকের আদেশ অমান্য করে , আমি আমার প্রেমিকের সাথে দেখা করেছি । কেউ আটকাতে পারেনি । লাল ঝাণ্ডা , আমার প্রথম প্রেম । তোমরা আটকাবে কি করে ? ঝাণ্ডা ছাড়ব না । "

সেদিন রাতেই রতনদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় । গ্রাম ছাড়ে রতন । দু-মাস পরে নাজিয়ার চাকরি চলে যায় । এখন বাড়ি বাড়ি কাজ করে খায় , ছেলেকে পড়ায় । ওসমানের একটা পয়সাও নেয় না । নাজিয়া এখনো শিরা ফুলিয়েই স্লোগান দেয় ।

 

                                                         রতন আর নাজিয়ার গ্রামের নাম করবী । জেলা বর্ধমান ।

 

                                                                                         ৩

 

                              দারুণ ছবি আঁকে ওমর । পড়াশুনাতেও খারাপ নয় । ফুটবলটা বেশ ভালোই খেলে । হাতে-পায় দুরন্ত । লোকে বলে ওমরের চোখ দুটো ওর আম্মির মতো । ওমর আম্মির হাত ধরে মিছিলে যায় । আব্বু ওকে ঘুড়ি ওড়াতে শিখিয়েছে ।রতন কাকু, ফুটবল খেলা । ওমরের মিছিল ভালো লাগে না । স্লোগান ভালো লাগে না । ছবি আঁকতে , আর পাশে বাড়ির সাল্‌মাকে ওর বেশ ভালো লাগে ।

 

                              ঝরঝরে তরুণ , বেশ ভালোই কেটেছে জীবনের ১৫টা বছর । হঠাত-ই একদিন তাল কাটলো । স্কুল থেকে সাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে , সেদিন ওকে ঘিরে ধরে চারটে ছেলে । ওরা এ-গাঁয়ের নয় । কোন কথা না বলে , প্রথমেই দুটো চড় মেরেছিল ওরা । তারপর কলার চেপে ধরে, খিস্তি করে বলেছিল "তোর মাকে বলিস্‌ ,বেশী না উড়তে । হাল খারাপ হয়ে যাবে । সময় বদলাচ্ছে । " প্রচণ্ড অপমানিত হয়েছিল সেদিন ওমর । কোনদিন-ও রাজনীতি করেনি,শুধু আম্মির ছেলে বলেই মার খেয়েছিল সেদিন । " গ্রামের মানুষ তো তোমায় এত্ত ভালোবাসে , তবু কেন ওরা তোমায় গালি দিল আম্মি ? " - জানতে চেয়েছিল ওমর । উত্তরে নাজিয়া  নিঃশব্দে , গলির মোড়ে বাশের মাথায় বাঁধা, একটা  জরাজীর্ণ লাল ঝান্ডার দিকে আঙুল দেখিয়েছিল । তার পরদিন-ই স্বেচ্ছায় প্রথম মিছিলে হেঁটেছিল ওমর । আম্মিকে প্রচন্ড ভালোবাসত । আম্মির ঝান্ডাকে ভালোবেসেছিল সেদিন প্রথমবার । 

 

                              পরের দুবছরের ইতিহাস , শুধুই ভাঙ্গার । কখনো পরিবার ভেঙ্গেছে , কখনো সাইকেল তো কখনো পা । কিন্তু মন ভাঙ্গেনি ওমরের । লোকে বলত ওমরের চোখ দুটো ওর আম্মির মতো । ওমর জানতো , ওর ভেতরটাও আম্মি মতোই , ইস্পাতের । ২০১১র ১২ই ফেব্রুয়ারি আম্মিকে মেরেছিল ওরা । সেদিন স্বাস্থকেন্দ্রে ডাক্তারের চোখে চোখ রেখে ,ওমর বলেছিল " ওষুধ কেনার টাকা আমাদের নেই । লাল ওষুধ লাগিয়ে দিন । আম্মি ভালো হয়ে যাবে । " দিন দশেক বাদে পরীক্ষা দিতে স্কুলে গিয়ে ওমর জানতে পারে , তার নাম কাটা গেছে ।  সেদিনের সন্ধ্যা ওমর কোনদিন-ও ভোলেনি । সেদিন রাতেই তাকে খুনের ভুয়ো কেসে ফাঁসানো হয় । সেদিন-ই রাতে ওমর শেষবার সাল্‌মাকে দেখেছিল , সেদিন রাতেই শেষ দেখেছিল তার আম্মিকে । করবীকে ।

 

                               তারপর শুধুই পালিয়ে বেড়ানোর গল্প । এখন ওমর বাঘাযতীনে থাকে । ঘরে কোন ফ্যান নেই । ব্যাগে একটা লাল পতাকা আছে আর খাটের তলায় রাখা থাকে একটা মোটা লাঠি । শহরে কোন লাল মিছিলের খবর পেলে , মোটা লাঠিতে পতাকার কাপড় জুরে, সে মিছিলের পিছে পিছে হাঁটে । এভাবেই সে শহর চিনেছে । শহরের জল , খাওয়ারের স্বাদ , আকাশ ,পাখি , হাওয়া কোনটাই করবীর মতো নয় । শুধু মিছিলের মানুষ গুলোকে ওমরের আপন মনে হয় । ওমর প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখে । সাল্‌মার । আম্মির । করবীর । স্বপ্নের ভোরের ।

 

                                                                                         ৪

 

                                    রতনকাকুকে আজকে অন্যরকম লাগছিল । দরজা খুলে দেওয়ার পর অনেকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে মুখের দিকে চেয়েছিল । প্রায় মিনিট দশেক চুপ করে থাকার পর কথা বললো রতন কাকু , "একটা খারাপ খবর দেওয়ার আছে ওমর । "

"কী ? "

"কাল রাতে ... " বলেই চুপ করে গেল রতন কাকু । দুগাল বেয়ে অবারিত ধারা । কাল রাত থেকেই কিছু খায় নি ওমর , তাই হয়ত মাথাটা ঘুরছিল । মনে হল , রতন কাকুর চোখ বেয়ে , গাল বেয়ে রক্তের ধারা বইছে যেন ... " কী, কী হয়েছে কাল রাতে ? "

"কাল রাতে , তোর আম্মিকে হায়নার বাচ্চারা ছিড়ে খুড়ে গেছে । নাজিয়া আর নেই । "

হঠাত-ই একটা সিনেমার মতো ঘটনা ঘটল । ওমরের চোখের সামনেটা সম্পূর্ণ অন্ধকার হয়ে গেল । তারপর স্পট পড়ল একে একে ৮বি মোড়ে , বাঘাজতিনের চায়ের দোকানে , ধর্মতলায় গড়িয়াহাটে , সারা শহর জুড়ে । সর্বত্র আকাশ থেকে পলাশ ফুল বৃষ্টি হচ্ছে । হচ্ছে তো হচ্ছেই । আকাশ ভেঙ্গে মাটি ভাসছে রক্ত পলাশে ।   জ্ঞান ফেরার পরে ওমর জিজ্ঞেস করেছিল " কাকু এ শহরে কোথাও পলাশ গাছ, আছে কি ? " রতনের কাছেও এই প্রশ্নের উত্তর ছিল না । 

 

 

                                     মা কে কবর দিতে যাওয়া হয়নি ওমরের । এই ঘটনার প্রায় এক মাস বাদে গ্রামে ফিরেছিল রতন আর ওমর । মানুষের মিছিল তাদের নাজিয়ার কবরের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল । একটা মাঠ । তার উত্তর দিকে ওমরের বাড়ি । দোতলার জানলার ডানদিকের পাট্‌টা বন্ধ । মাঠের ডান কোনে একটা বুড়ো বটগাছ । বটগাছটা পেরোলেই --- আম্মির কবর ।  ওই বটগাছটা ছাড়া , আশেপাশে একটি গাছ-ও ছিল না । আম্মির কবরের বুকে , একটা লাল পলাশ পড়েছিল । কোথা থেকে , কত দূর থেকে উড়তে উড়তে এসেছে কেউ জানে না । গন্তব্যে পৌঁছতে এক মাস সময় লেগেছে , ওমর জানে । 

 

                                    লাল পলাশটাকে রতনের গোলাপের মতো লাগছিল । কবরটা------ নাজিয়ার কালো খোঁপা ।    

সোমবার, ২৩ মার্চ, ২০১৫

পোলাপান ~ তিতলী রায়চৌধুরী

এ যুগের পোলাপান ভয়ে সন্ত্রস্ত,
বুকস্থ বিদ্যা, করছে মুখস্থ।
ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া চাই, বাপ-মা'র হুমকি,
জানে না সে খেলা ধুলো, বোঝে না সে ঘুম কি!
সকাল ও সন্ধ্যা, গরুতাড়া খাচ্ছে,
স্কুল থেকে ফিরে ফের টিউশন যাচ্ছে।
কোনটা যে কেন হয় যায় না সে প্রশ্নেই,
নম্বর পেলে পরে কিছুতেই দোষ নেই।
যত পারো ঠেসে দাও, মাথা যেন বস্তা!
অসহায় খোকাদের করুণ অবস্থা!

সোমবার, ৯ মার্চ, ২০১৫

"রাজ্যটা এখনও গুজরাট হয়ে যায়নি"... স্যার ~ সুশোভন পাত্র

কিন্ত স্যার...

আপনি তো এখন প্রধানমন্ত্রী স্যার। গলার অনেক জোর। মিডিয়ার পালিশে চকচক করেন। আম্বানিদের টাকায় দশ লাখি স্যুট পরেন। কাজেরও অনেক চাপ। কত দিকে খেয়াল রাখতে হয়। কত শত জায়গায় ৫৬ ইঞ্চির ছাতি ফুলিয়ে বক্তৃতা দিতে হয়। তাই আপনার একটু আধটু স্মৃতিভ্রম তো হতেই পারে। রাজ্যসভায় উঠে দাঁড়িয়ে, "বিদেশ থেকে আমদানি করা আদর্শের" গর্ভজাত সন্তানদের  "তিন দশকের"  পশ্চিমবঙ্গের পিছিয়ে পড়া নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতেই পারেন তাঁদের  চোদ্দো পুরুষ কে নেতিয়ে নব্বই, হেদিয়ে হান্ড্রেড সেভেন আপনি করতেই পারেন স্যার। কিন্তু অঙ্ক যে বড় কঠিন স্যার ... 


আয়নায় মুখ দেখুন...


নভজোৎ সিং সিধু একবার বলেছিলেন ক্রিকেটে পরিসংখ্যান নাকি "Statistics are like mini skirts my friend. It reveals more than what it hides." রাজ্য পরিচালনার সাথে না হয় ক্রিকেটের দূরত্ব কয়েক যোজন, কিন্তু আজ আপনি  যে গুজরাট মডেলের গল্পের গরু কে গাছে চড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন আসুন আপনাকে সেই আয়নায় আপনারই মুখ দেখাই স্যার। 

আপনার সময়েই গুজরাটর আর্থিক উন্নয়ন হার  ছিল (১০.১%) । জাতীয় গড়ের ( ৮.৩%) থেকে অল্প বেশী হলেও তামিলনাড়ু (১০.৩%), মহারাষ্ট্র (১০.৮%) এমনকি আপনার অপছন্দের নিতিশ কুমারের বিহারের (১১.৪%) থেকেও অনেক পিছনে। ২০০০ থেকে ২০১১ পর্যন্ত গুজরাটে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছে ৭.২ বিলিয়ন ডলার এই একই সময় মহারাষ্ট্রতে ও দিল্লীতে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছে  যথাক্রমে  ৪৫.৮ বিলিয়ন ডলার ও ২৬  বিলিয়ন ডলার।  মানব উন্নয়ন সূচকে গুজরাটের অবস্থা ভয়ঙ্কর। ২০০৮ -র তথ্য অনুসারে ০.৫২৭ সহ বড় রাজ্য গুলির মধ্যে দশম স্থানে রয়েছে গুজরাট। কেরালা প্রথম (০.৭৯২) এমনকি হিমাচল প্রদেশ (০.৬৫২) পাঞ্জাব(০.৬০৫), মহারাষ্ট্র(০.৫৭২) হরিয়ানা (০.৫৫২) সবাই গুজরাটের থেকে ভালো জায়গায়। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া ২০১৩-র হিসাব অনুযায়ী মাথাপিছু ঋণের  শীর্ষে রয়েছে মোদীর গুজরাট(২৯২২০ টাকা)  সাক্ষরতাতে গুজরাট (৭৯.৩%) রাজ্য গুলির মধ্যে রয়েছে ১৮ তম স্থানে। জনগণনা ২০০১ গুজরাটে প্রতি হাজার পুরুষের তুলনায় মহিলা সংখ্যা ছিল ৯২০। ২০১১ এর টা কমে দাঁড়িয়েছে ৯১৮ তে। যেখানে জাতীয় গড় ২০০১ (৯৩৩) থেকে ২০১১ তে বেড়ে হয়েছে ৯৪০। এনএসএসও রিপোর্ট অনুসারে গুজরাটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার গত ১২ বছরে প্রায় শূন্য তে এসে ঠেকেছে। এটা বাস্তব যে গুজরাটে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকে। কিন্তু টা সাধারন মানুষের কাছে পৌছায় না। এখানেও গুজরাটের স্থান রাজ্যগুলির মধ্যে ১৬তম।  ২০১২-১৩ র প্ল্যানিং কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে গুজরাটে দারিদ্র্য সীমার নিচে থাকে প্রায় ২৩% মানুষ যা অন্ধ্র, হরিয়ানা, কেরালা, ত্রিপুরা, হিমাচল প্রদেশ থেকে অনেক বেশী। এমনকি বিশ্ব ক্ষুধার সুচকে  গুজরাট ১৯৯৪ সালে  যেখানে ছিল দশম  স্থানে মোদীর উন্নয়নের চোটে তাঁরা আরও নেমে এখন ১৩ তম।  দ্রুত বেড়েছে নিরক্ষরের সংখ্যা। ১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত গুজরাটে বাজেটের মাত্র .৭৭% ব্যায় করা হত স্বাস্থ্য খাতে যা তুলনামূলক ভাবে গরীব বিহার(১.১%) ও ওড়িশার( ১.৬৬%) থেকেও কম। আপনার গুজরাটেই ৪২% শিশুর ওজন স্বাভাবিকের থেকেক কম স্যার সে খবর রাখেন আপনি ? জন্মের সময় শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৪৪। অনূর্ধ্ব ৫ বছরের ৫০% অপুষ্টিতে ও ৭৫% রক্তাল্পতার শিকার। মাত্র ৫০% শিশু হাসপাতালে জন্মায়। প্রসব কালীন মায়ের মৃত্যু প্রতি হাজারে ৬২.৮ । ৬৭% গ্রামীণ পরিবারে নেই শউচালয়। আর আমুল,আম্বানি,আদানি, নিরমা, টরেন্ট, জাইদাস, ক্যাদিলা, আইপিসিএল, জিএসএফসি , জিএনএফসি এমনকি রাজকোটের মেশিন শিল্প বা ডিসেল ইঞ্জিন শিল্প, সুরাটের ও ভাবনগরের হীরা প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র ; এসবই আপনি  মুখ্যমন্ত্রী হবার আগেই গুজরাটে ছিল। তাই আগে আয়নায় নিজের মুখটা দেখুন স্যার...  



দাঙ্গাবাজের সার্টিফিকেট...


৫০-র দশকে  রাজনৈতিক বন্দীদের নিঃশর্তে মুক্তির দাবী, ঐতিহাসিক শিক্ষক আন্দোলন, ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ক্যালকাটা ট্রামওয়েসের রাষ্ট্রীয়করনের দাবীতে আন্দোলন, ১৯৫৯-র খাদ্য আন্দোলন, বাংলা-বিহার সংযোজনের বিরুদ্ধে এমনকি পর্তুগীজ শাসন মুক্ত গোয়ার দাবীতে প্রতিবাদ গড়ে তোলাতে কোনও ভূমিকাই কি থাকেনি এই "বিদেশ থেকে আমদানি করা আদর্শের" গর্ভজাত সন্তানদের ?  ৭৭-এ দলমত  নির্বিশেষে ১৭০০০ রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি এবং সংশ্লিষ্ট ১০০০০ এর বেশী মামলা প্রত্যাহারও করেনি এই বিদেশ থেকে আমদানি করা নীতি'র গর্ভজাত সন্তানরা ?  দেশে প্রথম ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং ১৮ বছরের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পৌরসভা নির্বাচন,মহিলাদের জন্য অর্ধেক আসন সংরক্ষণও  চালু হয়নি এই "তিন দশকে" ? দেশের মোট কৃষি জমির  ৪% -র কম পশ্চিমবাংলাতে হওয়া সত্ত্বেও ২০১১ পর্যন্ত দেশের ২৩% এবং উপকৃত ৫৫% (মোট ৫০ লক্ষ) মানুষের স্বার্থে ভূমি সংস্কারও হয়নি এই  "পিছিয়ে পড়া রাজ্যে ?" ২০০৫-০৮ সময়কালে যখন তৎকালীন রাজ্যসরকারের বিরুদ্ধে শিল্পায়নের জন্য কৃষকদের জমি থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠেছিল তখনও ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে ৩০,০০০ একর জমি বণ্টন করেছিলো এই "বিদেশ থেকে আমদানি করা নীতি'র" গর্ভজাত সন্তানরাই। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের উৎপাদিত খাদ্যশস্যের পরিমান (১৭০ লক্ষ টন) সারা দেশের মোট উৎপাদিত খাদ্যশস্যের  ৮% । ২০১০-১১ সালে  চাল, পাট, আলু, সবজি, ফল, মাছ  উৎপাদনে  পশ্চিমবঙ্গ কে দেশের  সেরা করেনি "বিদেশ থেকে আমদানি কর আদর্শের" গর্ভজাত সন্তানরা ?  ৭০০০ সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি, ৩৭টি বহুমুখী হিমঘর, নেতাজী সুভাষ কৃষি বিপনন কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি এই "পিছিয়ে পড়ার তিন দশকে" ?

আপনার, কেন্দ্রীয় সরকারের রেজিস্টার জেনেরল অফ ইন্ডিয়ার সার্ভে রিপোর্ট অনুসারে  ১৯৯৭-২০০৯ স্থূল জন্ম  হ্রাসের জাতীয় গড় যেখানে ২০% সেখানে  পশ্চিমবঙ্গের  ২৫%, দেশে চতুর্থ। ২০০৮ সালে গ্রাম ও শহরের মৃত্যু হারের পার্থক্যের জাতীয় গড়ের (২৬.২%) তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে (৭.৫%)। ওই একই সার্ভে রিপোর্ট অনুসারে জাতীয় গড় ২.৫৪-র তুলনায় তৎকালীন  পশ্চিমবঙ্গে মাতৃত্বকালীন মৃত্যু হার, ১.৪১ ছিল দেশের মধ্যে অন্যতম সেরা এবং শিশু মৃত্যু হার হ্রাসে তামিলনাড়ুর পরেই ছিল পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যের ৭৩% মানুষের কাছে সরকারী চিকিৎসা সহজলভ্য।

ন্যাশানাল স্যাম্পেল সার্ভের তথ্য অনুসারে "বিদেশ থেকে আমদানি করা নীতি'র" গর্ভজাত সন্তানদের আমলেই ১৯৯০-২০০৪ সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে জনগণের মাথা পিছু আয় এবং গ্রামীণ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার বেড়েছে জাতীয় গড়ের থেকে দ্রুত। একাদশ প্ল্যনিং কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে ১৯৯৫-৯৬ থেকে ২০০৪-০৫ সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে উন্নয়নের হার ছিল ২.৬৭% যা জাতীয় গড় ১.৮৭% থেকে অনেক বেশী ও বৃহৎ রাজ্যগুলির মধ্যে তৃতীয়। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ ১৯৯০-র দশকে( ৬.৭৫%) এবং ২০০০-র দশকে( ৬.৬১%)  আভ্যন্তরীণ মোট উৎপাদনে ছিল দেশের অন্যতম সেরা। এই পিছিয়ে পড়ার সময়েও  ২০১১ তে পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্র সীমার নিচে মানুষের সংখ্যা ২৮.৬% যা ১৯৭৩-৭৪ এর কংগ্রেস শাসিত বাংলার ৭৩.২% থেকে ঢের ভালো। ২০১১ তে এই "বিদেশী আদর্শের" গর্ভজাত সন্তানদের রাজ্যেই সাক্ষরতার হার (৭৭.১%) শুধু ৭০-র দশকের (৩৩.২%) থেকে শুধু  উন্নতই ছিলনা জাতীয় সাক্ষরতার হারের (৭৪.০৪%) থেকেও ছিল ভালো। ১৯৭৬-৭৭ সালে আদিবাসী ও পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য বরাদ্দ (৮.৫ কোটি) এবং মাদ্রাসা শিক্ষায় বরাদ্দ (৫.৬ লক্ষ)  ২০১১-তে বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৬৭৪ এবং ৬১০ কোটিতে। এই "বিদেশী আদর্শের" গর্ভজাত সন্তানদের  আমলেই ২০০৯-১০ এর তথ্য অনুসারে সারা দেশে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পে সংগৃহীত অর্থের (৩৬,৩৩৩.৩৯ কোটি) সর্বাধিক ২৫% ( ৮,৮৫৬.২১ কোটি) সংগ্রহ হত। এছাড়াও ৬১টি অসংগঠিত শ্রমিকের জন্য চালু হয় স্বাস্থ্যবীমা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, ১ লক্ষ ২১ হাজার বৃদ্ধ আদিবাসীর জন্য পেনশেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজে মহিলাদের অংশগ্রহন, নারী নিরাপত্তা,  ১৪ লক্ষাধিক স্বনির্ভর গোষ্ঠী, মাত্র ৪% হারে ঋণের ব্যবস্থা, চা বাগিচার শ্রমিকদের জন্য ভাতা চালু হয়নি এই "তিন দশকে" ? এরাজ্য শুধু অস্পৃশ্যতার অভিশাপ মুক্তই ছিল না,ছিল সাম্রদায়িক দাঙ্গা মুক্তও। দেশে শিখ বিরোধী দাঙ্গা  হয়েছে, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হয়েছে, গুজরাটেদাঙ্গা হয়েছে – এরাজ্য ধিক্কার জানিয়েছে।"বিদেশ থেকে আমদানি করা আদর্শের" গর্ভজাত সন্তানদের জন্যই কিন্তু রাজ্যটা কিন্তু আজও গুজরাট হয়ে যায়নি। তাই আপনি আজ প্রধানমন্ত্রী হলেও, আপনার মত দাঙ্গাবাজের সার্টিফিকেট  আর যাই হোক "বিদেশ থেকে আমদানি করা আদর্শের" গর্ভজাত সন্তানদের লাগবে না স্যার।


ঐ ৩৪


হ্যাঁ এরপরও অনেক জরুরী কাজ বাকি রয়ে গিয়েছিলো।শিল্পায়ন, কৃষকের মালিকানা ভিত্তিক কৃষিব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে সমস্যা ছিল।  রাজনৈতিক  বিচ্যুতিও হয়েছে একাধিক। কর্মসূচী সফলভাবে রুপায়নের দ্রুততা ও অনেক ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা সহ কিছু বিষয়ে ভুল ত্রুটিও হয়েছে। তাই অনেক কাজই হয়নি। তবে তার সাথে আরও যেটা হয়নি স্যার,"রাজ্যটা এখনও গুজরাট হয়ে যায়নি..."তাই ৫৬ ইঞ্চির বুকের ছাতি নিয়ে  সাদা কে সাদা আর কালো কে কালো বলার সাহস যে দেখাতে হবে স্যার। তথ্যের আর ইতিহাসের বাস্তবতার ভিত্তিতে বিচার করতেহবে স্যার ৩৪ কে। আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন স্যার আপনি সারা দেশের প্রধানমন্ত্রী ? এবার তো অন্তত সঙ্ঘপরিবারের দাঙ্গাবাজ থেকে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠুন...