সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০১৩

কঠিন বাঁচা ~ অনামিকা মিত্র

কঠিন ব্যথা্ দেবার আগে
রাষ্ট্র দারুণ আদরকারী 
সুখের ছোঁয়ায় ঘুম পেয়ে যায়
ব্যথার আগে তা দরকারি 

কঠিন কথা বলার আগে 
রাষ্ট্র তখন বড্ড নরম
তোমরা বোঝো সার কথাটা 
শাসন মানে ঠাণ্ডা গরম। 

কঠিন ক্ষতি দেবার পরে 
রাষ্ট্র মাতে শিলান্যাসে
ক্ষতর ওপর বসছে মাছি 
তোমার থোড়াই যায় বা আসে

কঠিন দহন দেবার পরে 
রাষ্ট্র শেখায় ছোট্ট ছ্যাঁকা
ধরপাকড়ের মজার খেলায়
মন্ত্রীসান্ত্রী বড্ড ন্যাকা।

কঠিন ভাবে বাঁচার সময় 
রাষ্ট্র রাখে দারুণ ত্রাসে
তবুও দেখ, বাঁচব বলেই
জড়িয়ে যাচ্ছি সর্বনাশে।

শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৩

প্রার্থনা সঙ্গীত ~ অনামিকা মিত্র

দাওয়ায় বসেছি এসে। বরাবরই আমি ঘরকুনো।
ভাত দেবে বলেছিলে, শাক সেদ্ধ ... ছিটেফোঁটা নুনও

সেই শুনে কাঁপা হাতে ধরে আছি টুটাফাটা বাটি
যদি নেমে আসে স্বপ্ন, সাদা রঙ ... ধোঁয়া ওঠা ... খাঁটি ...

বলেছিলে শীত এলে কাঁথা দেবে, বর্ষা এলে মাথা ঢাকা ছাদ
সে আশায় কেটেছে বিষাদ

বলেছিলে কাজ দেবে। ঘরে ঘরে জ্বলে যাবে আলো।
সূর্য গিয়েছে পাটে। গল্পের বেলাটি ফুরালো।

বিশ্বাসে মেলেনি কৃষ্ণ, নিভছে না পোড়া পেটজ্বালা।
নীরো রাষ্ট্র, কত কাল বাজাবে হে পুরোনো বেহালা?

শনিবার, ৯ মার্চ, ২০১৩

রাজীব ... শোনো ... ~ অনামিকা মিত্র

অক্ষর না আগ্নেয়াস্ত্র? ল্যান্ডমাইন না ভালবাসায়
শেষ অবধি থাকব আমরা? ভাবতে ভাবতে দিন কেটে যায়।

আগুন খেলে ঝলসে যাব। এগিয়ে গেলে? কেউ জানে না ... 
হয়তো বা জল ... হয়তো পাথর ... পথের শেষে শান্তিসেনা।

এগিয়ে গেলে আর কি পরে ফেরবার পথ কোথাও আছে?
কিম্বা সকল পথ পুড়ে যায় বাঁচতে থাকার তুমুল আঁচে!

সবার ঘরেই চার দেয়ালের মধ্যে মজুত ঘুমের বড়ি 
দোয়া দরুদ জ্বিন কাফিলের অলীক জীবন বেহেস্ত পরী 

নাস্তিক নয় আস্তিকও নয় বন্ধু এবং বান্ধবেরা
সবাই তবু ঘর ছেড়ে এই শাহবাগেই বাঁধছে ডেরা 

এক জীবনে মরতে মরতে বাঁচার হিসেব নিচ্ছে বুঝে
চক্ষে আগুন কন্ঠে শ্লোগান মুঠোয় নিশান লাল সবুজে

বোমায় তাদের ত্বক পুড়ে যায়, অস্ত্র ছেঁড়ে গলার নলি
অমর পথিক রাজীব শোনো তোমার গল্প তোমায় বলি ...

মঙ্গলবার, ৫ মার্চ, ২০১৩

নৈমিত্তিক ~ সংগীতা দাশগুপ্তরায়

অমৃত আর বিষের যুদ্ধে রোজ
বিষ জিতে যায় কাঁটার মুকুট পরে
দমকা হাওয়ার দাপট হাতে নিয়ে
চোখের পাতায় লজ্জা নিশান ওড়ে

দুপুর রোদে অমৃত তাই একা
ছাদের কোনে বয়ামে মুখ ঢাকে
জোর তামাসায় রোজ হেরে যায় তবু
কাল জিতবই... এই আশাতে থাকে

আমরা আছি, শাহবাগেই আছি ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

বাংলাদেশের প্রজন্ম চত্বরে
মৌলবাদের তুমুল বাঁধন ছিঁড়ে
বেঁচে থাকার আগুননদীর তীরে
স্বপ্নদেখা লক্ষ চোখের ভিড়ে
তোমার আমার ভালোবাসারা ওড়ে ...

আমরা আছি, শাহবাগেই আছি
দৃপ্ত স্লোগান গানের সুরে সুরে
ইন্টারনেট ব্লগ-এর পাতা জুড়ে
বাংলাদেশের নিকট এবং দূরে
রাজীব হয়ে ... আগুন হয়ে বাঁচি

রবিবার, ৩ মার্চ, ২০১৩

আজি হতে শতবর্ষ আগে ~ অমিতাভ প্রামাণিক

দুই – যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে

যদি প্রেম দিলে না প্রাণে, কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে? না, আলফ্রেড এই গান এই সুর শোনেন নি, এ অনেক পরের রচনা, কিন্তু তার অবচেতনে বেজে যায় এই সঙ্গীতেরই মূর্ছনা। অকৃতদার, সফল পুরুষদের জীবনের লক্ষ্য কী? আরও অর্থ, যশ, সম্মান, প্রতিষ্ঠা? ঠিক কতটা হলে তাকে বলা যায় যথেষ্ট?

নিজের সম্বন্ধে তার ধারণা ভারি অদ্ভুত। পারিবারিক ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য মেজদা লুডুইগ যখন তাকে একটা আত্মজীবনী লিখে দিতে বললেন – আর আলফ্রেড যথেষ্ট ভালো লেখেন – তিনি নিজের সম্বন্ধে লিখলেন মাত্র এই কটি বাক্যঃ করুণা-উদ্রেককারী চরিত্র, পৃথিবীতে আসার সময় ডাক্তারের উচিৎ ছিল শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলা; সবচেয়ে বড় গুণ – নখ কেটেকুটে পরিস্কার রাখা আর কারও বোঝা হয়ে না থাকা; সবচেয়ে বড় দোষ – বৌ-বাচ্চা, রৌদ্রোজ্জ্বল স্থিতিশীলতা বা হার্দিক ক্ষুধা, এর কোনটাই না থাকা; সনির্বন্ধ অনুরোধ – জ্যান্ত কবর যেন না দেওয়া হয় তাকে; সবচেয়ে বড় অপরাধ – ম্যামনদেবতার (যিনি লোভ বা সম্পত্তির দেবতা) পুজো না করা; জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা – নাথিং!

বলাই বাহুল্য লুডুইগ এটা পড়ে একদমই খুশি হননি। যেমন খুশি হননি প্রিয় ভাইটির সঙ্গিনী হিসাবে এক সামান্য ফুলওয়ালীকে দেখে। ভাই আলফ্রেড কিন্তু ফুলের ঘায়ে মূর্ছা গেছে প্রথম দর্শনেই। মেয়েটির নাম সোফি হেস, অস্ট্রিয়ার এক ফুলের দোকানের সেল্‌স্‌গার্ল, তার সাথে মোলাকাৎ এক স্বাস্থ্যচর্চাকেন্দ্রে। আলফ্রেডের বয়স তখন তেতাল্লিশ, সোফির কুড়ি। কিন্তু তাতে কী, ভাল লাগালাগির আবার জাতি-ধর্ম-বয়স আছে নাকি?

লুডুইগ বললেন, রাস্তা থেকে একটা মেয়েকে কুড়িয়ে আনলি ভাই! তোকে নির্ঘাৎ ফাঁসিয়ে বিয়ে করার জন্যে ঝুলোঝুলি করবে, জীবন দুর্বিষহ করে দেবে। একে নিয়ে তুই সুখী হবি ভেবেছিস? ওরে, ভদ্র ঘরের ভালো মেয়ে পছন্দ করে ঘর বসা, তাতেই তুই সুখ পাবি। আমাকে ওর সঙ্গে দেখা করার জন্যে অনুরোধ করিস না, সে অনুরোধ আমি রাখতে পারব না। মেয়েটা ভেবেই বসবে যে আমরা তাকে আমাদের পরিবারের একজন সদস্যা করতে রাজি, আমি তা মোটেও নই।

আলফ্রেড যে মেজদার কথা উড়িয়ে দিয়ে বলিউড স্টাইলে সেন্টু ঝাড়বেন বা অ্যাংরি ইয়াং ম্যানের মত 'মেরে পাস সোফি হ্যায়' বলে তার হাত ধরে ড্যাং ড্যাং করে অন্য জায়গায় গিয়ে বাসা বাঁধবেন – তা করতেই পারতেন, তাঁর পয়সার অভাব ছিল না – কিন্তু পারলেন না, তিনি নিজেও নিঃসন্দেহ নন। সোফিটা যেন কী! হাতের লেখা কাগের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং, আলফ্রেডের লেখা সুন্দর সুন্দর চিঠিগুলো পড়ে কী বোঝে খোদায় মালুম, তার উত্তর বড়ই সাদামাটা। আলফ্রেড যখন তার মধ্যে খুঁজছেন ভালবাসার অতলান্ত সমুদ্র, সে তখন আলফ্রেডের কাছে চাইছে টাকা! শরীর খারাপ টাকা দাও, ঘরভাড়ার টাকা দাও, এটা দাও, ওটা দাও। না বোঝে কবিতা, না বোঝে জীবনদর্শন, শতচেষ্টা করেও আলফ্রেড তার মধ্যে বিদ্যাবুদ্ধি ঢোকাতে পারেন না।

পাঁচটা ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন আলফ্রেড, মাতৃভাষা সুইডিশ ছাড়াও ইংরাজী, রাশিয়ান, জার্মান, ফ্রেঞ্চ। লিখতে পারেন কবিতা। এদিকে বয়স বেড়ে যাচ্ছে। জীবনসঙ্গিনী যদি করতেই হয়, এমন একজনের সঙ্গে করতে হয়, যে তাঁর কথা বুঝবে, সুযোগ্য জবাব দেবে, একটা মানানসই কথোপকথন তো হতে হবে। প্যারিসে থাকাকালীন আলফ্রেড সেই মর্মে এক বিজ্ঞাপন দিলেন – ধনী, উচ্চশিক্ষিত প্রৌঢ় ভদ্রলোক খুঁজছেন ভাষা ও সাহিত্যনিপুণা ভদ্রমহিলা, ব্যক্তিগত সচিব হওয়ার ও গৃহস্থালী দেখভাল করবার জন্য। ১৮৭৬ সালের কথা। অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা থেকে বার্থা কিন্সকি নামে এক মহিলা তাঁর বিজ্ঞাপনে সাড়া দিয়ে আলফ্রেডের সেক্রেটারি নিযুক্ত হলেন। দুদিনের মধ্যেই এদের দু জনকে দেখা গেল গাড়িতে লম্বা ড্রাইভে বেরোতে, অথবা বাসন্তী সন্ধ্যায় নিভৃতে বই-দে-বুল্যঁয় শহরে পাশাপাশি হেঁটে যেতে। আলফ্রেডের বাড়ির ব্যক্তিগত বইয়ের লাইব্রেরির সংগ্রহ দেখে বার্থা তো মহাখুশি। যুদ্ধমত্ত মানুষ দেখে বীতশ্রদ্ধ আলফ্রেড বার্থাকে বোঝালেন, এরা ভাবে যুদ্ধ যেন একটা খেলা। এমন জিনিস তিনি আবিস্কার করতে চান, যার বীভৎসতায় মানুষের মনে ভয় ঢুকবে, চরম ভয়, যাতে যুদ্ধ করার চিন্তাই আর না আসে এদের মনে।

প্রথম দিন থেকেই বার্থাকে ভীষণ পছন্দ হল আলফ্রেডের, এতদিনে মনের মত এক সঙ্গিনী পেয়েছেন যার সঙ্গে কথা বলে আরাম পাওয়া যায়, যার মাথায় বেশ বুদ্ধি আছে। বার্থাও উচ্ছ্বসিত তার মনিবের সুস্থ চিন্তাভাবনা আর বাক্‌পটুত্বে। তিনি তার ডায়েরিতে লিখলেন, পৃথিবী বা মানুষ, জীবন বা শিল্প, আজকালের সমস্যা বা চিরন্তন সমস্যা, যা নিয়েই এর সঙ্গে কথা বলি, এত সুন্দর ব্যাখ্যা আর কোথাও শুনিনি।

লজ্জা লজ্জা মুখ করে আলফ্রেড একদিন বার্থাকে একটা চিরকুটে তার লেখা একটা কবিতা পড়তে দিলেন। তার প্রথম লাইনে আছে – তুমি বলো আমি যেন এক অপার বিস্ময়। বার্থা তার চোখ মেলে আলফ্রেডের দিকে চাইতেই আলফ্রেড আরো লজ্জা পেয়ে বললেন, খারাপ লাগল? কী বলব বল, একা থাকি, এটাই আমার এক উদ্ভট শখ। আমি এক আশাহত পুরুষ, মানবজাতির ভবিষ্যতের দিকে নতুন আশা নিয়ে চেয়ে থাকি আমি। 

বার্থার বয়স কম নয়, তিনি বুঝতে পারেন, আলফ্রেডের চাই একজনকে যে তাকে বুঝবে, তাকে আদরে সোহাগে যত্ন করে রাখবে। ব্যক্তিগত সচিব নয়, আলফ্রেড খুঁজছে আরো বেশি অন্তরঙ্গতা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই অবধারিত প্রশ্নটা এসে গেল, তোমার মনের মন্দির কি খালি আছে, বার্থা? তেত্রিশ বছর বয়সের অভিজ্ঞতা দিয়ে কোনরকমে তিনি বললেন, না, তিনি আর্থার ফন সাটনার নামে এক অস্ট্রিয়ান কাউন্টের বাগ্‌দত্তা। আর্থারের মা নিমরাজী, তাই বার্থা কিছু টাকাপয়সা রোজগার করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চান।

ব্যবসার এক জরুরী কাজে আলফ্রেডকে সেই সময় তিন সপ্তাহের জন্য প্যারিসের বাইরে যেতে হল। ফিরে এসে দেখলেন বার্থা তার ব্যাগ প্যাক করে নিজের দেশে ফিরে গেছেন। ফেলে রেখে গেছে্ন একটা চিরকুট। দু'সপ্তাহের মধ্যে তার বিয়ের খবরও কানে এল তার। ভগ্নহৃদয় আলফ্রেড ধরেই নিলেন এ জন্মে প্রেম-ট্রেম আর তার দ্বারা সম্ভব হবে না। এত অসুখে ভোগেন তিনি, তাকে দেখতে নিশ্চয় বিচ্ছিরি, কোন মেয়ে তাই তাকে পছন্দই করবে না। সেই বছরেই কয়েক মাস বাদে অস্ট্রিয়াতে ভিয়েনার কাছে এক স্বাস্থ্যচর্চাকেন্দ্রে যে মুহূর্তে কুড়ি বছরের তরুণীটির দেখা পেলেন তিনি, তার ওপরেই গিয়ে পড়ল তার সমস্ত উৎসাহ, অনুরাগ।

এর পর যে কোন ছুতোয় অস্ট্রিয়া চলে যেতেন আলফ্রেড, সোফির সঙ্গে সময় কাটানোর জন্যে। কয়েকদিন দেখা না হলেই লিখতেন লম্বা চিঠি। শুধু প্রেমের কথা নয়, জীবনের কথা, ব্যবসার কথা, ভবিষ্যতের কথা। এ রকম চলতে থাকল সুদীর্ঘ আঠার বছর ধরে।

বদলে জুটল শুধুই হতাশা। সোফির সঙ্গে পরিচয়ের সাড়ে চার বছর পরে – আলফ্রেডের পঞ্চাশ বছর পুরতে মাত্র আড়াই বছর বাকি – গ্লাসগোর এক হোটেল থেকে তিনি সোফিকে চিঠিতে লিখলেন, কাল ট্রেনটা এত লেট করল যে কানেকটিং ট্রেনটা মিস করলাম, না হলে লন্ডন চলে যাওয়া যেত। ঈশ্বরভীরু এই দেশে রোববারে ট্রেন চলে না, ফলে আমি বোকার মত এক বিশাল হোটেলের এক কোণে বন্দী। তোমার জন্যে আমি সমাজে মেলামেশা এক রকম বন্ধই করে দিয়েছি। আর তার ফলে আজকাল টের পাই, আমার কী দুর্বিষহ অবস্থা। কারও সঙ্গে ঠিকমত কথা বলতে পারি না, কেউ ডাকলেও এড়িয়ে চলি, আমি কি আর কোনদিন আমার নিজস্ব আধ্যাত্মিক চেতনার জগতেও ঢুকতে পারব? তোমাকে দোষ দেব না, আমার ছোট্ট সোফি সোনা, এ আমারই দোষ, তোমার এতে কোন হাত নেই। জীবন সম্বন্ধে আমাদের দু'জনের ধ্যানধারণা – আমাদের চেতনার নিয়ত উন্মেষ, মানুষ হিসাবে আমাদের দায়িত্ববোধ, আমাদের শিক্ষাদীক্ষা – সবই এত আলাদা যে আমরা কেউ কাউকে বুঝে উঠতেই পারব না কোনদিন। আমার নিজের ওপরেই লজ্জা হয়, ঘৃণা হয় যে আমি শিক্ষিত লোকের সংসর্গ থেকে এতদূরে সরে এসেছি। কেন তোমাকে এসব লিখছি কী জানি, এ লেখার কোন মানেই হয় না। তুমি এসব বুঝবে না, নিজেরটা ছাড়া তুমি বোঝোই বা কী? আমি যে আমার সময়, যশ, শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে আমার ওঠাবসা আর আমার প্রিয় ব্যবসাও জলাঞ্জলি দিতে বসেছি, সে তোমার বোঝার সাধ্য আছে? আমার হৃদয় থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে বলেই আজ এই তেতো কথাগুলো লিখছি তোমায়, রাগ কোর না। আমারই প্রশয়ে তুমি আমার আধ্যাত্মিক শক্তিকে উপেক্ষা করেছ এতকাল। এ রকমই হয়। যখন কেউ শিক্ষিত সমাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়, চিন্তা ও ভাবের আদানপ্রদান বন্ধ করে দেয়, সে তা ফিরে পাওয়ার শক্তিও হারায়। সোফি, আমার পুতুলসোনা, তোমার সামনে দীর্ঘ পথ, আমি চাইনা আমার মত তোমার দশা হোক। 

জীবনের হাফ-সেঞ্চুরির কাছে এসে এক প্রাজ্ঞ, অন্য বহুবিষয়ে সফল পুরুষ যখন নিদারুণ প্রেমহীনতায় এক আনপড় যুবতীকে এইসব কথা শোনাচ্ছেন, ঠিক সেই সময় পৃথিবীর আর এক প্রান্তে এক টীন-এজার বাঙালি তরুণ লিখে শেষ করে ফেলেছে তার প্রেমের প্রথম পাঠ – ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী। জীবনের সঙ্গে তার অদ্ভুত ভালবাসা, তাই মৃত্যুকে সে অবহেলায় বলতে শিখে গেছে, মরণ রে, তুঁহু মম শ্যামসমান। 

সোফিকে লেখা আরও বহু চিঠিতে আলফ্রেডের হতাশা ফুটে উঠত স্পষ্ট হয়ে। মেজবৌদি এডলাকেও লিখেছিলেন – তোমার আর আমার মধ্যে কত তফাত দেখ, বৌদি। তোমাকে ঘিরে আছে প্রেম, আনন্দ, গুঞ্জন, মধুময় জীবন। তুমি আদরযত্ন করছ একজনকে, সেও তোমাকে করছে। আর আমি, দিকশূন্য জাহাজের মত ভবঘুরে এক। আমার অতীতের কোন সুখস্মৃতি নেই, নেই ভবিষ্যতের রঙীন স্বপ্নও। 

আলফ্রেডের ছোটবেলার কাহিনী আরো করুণ। মা-অন্ত প্রাণ ছিল তার। রোগে ভুগে ভুগে জরাজীর্ণ চেহারা ছিল যে, মা ছাড়া গতিও ছিল না। আঠার বছর বয়সে মা-কে নিয়ে চারশো ঊনিশ লাইনের এক দীর্ঘ কবিতা লেখেন ইংরাজীতে, তাতে শেলীর প্রভাব স্পষ্ট। তার কয়েকটা লাইন এই রকম –
তোমার জন্যে, মাগো, জানো তুমি, ভয় পেয়েছিল যমও,
নয়তো আমার দোলনাটা ছিল মৃত্যুশয্যাসম।
নিবু নিবু সেই প্রদীপের আলো হাওয়াতে বুঝিবা হারায়
তুমি তুলে নিলে কোলে, ভরে দিলে স্তন্যদুগ্ধধারায়।
জ্ঞান হারাই যত, ফিরে চেয়ে দেখি চারিদিকে শূন্যতা –
মৃত্যুর পথে শীর্ণতনুটি, কান্নাও নীরবতা।

মা আন্দ্রিয়েতা পাখির মত আগলে রাখতেন সবকটা ছেলেকেই। আলফ্রেডের অস্পষ্ট মনে আছে, সে তখন চার বছরের বাচ্চা, বড়দা রবার্ট আট আর লুডুইগ ছয়, তাদের তিন ভাই আর মা-কে রেখে বাবা ইমান্যুয়েল ফিনল্যাণ্ডের টুর্কু বলে এক জায়গায় চলে গেলেন ভাগ্যান্বেষণে, চাকরির খোঁজে, স্টকহোমে ব্যবসায় ভরাডুবি হওয়ায়। কী করে তাদের সংসার চলবে, চারটে মুখে দুবেলা রুটি জুটবে কিভাবে, তার কোন হদিশ না দিয়েই।

সে এক অসম্ভব দুঃসময়। নিজের বাবার কাছে কিছু টাকা ধার নিয়ে একটা খাবারের দোকান দিলেন আন্দ্রিয়েতা। ভোরবেলা থেকে রাত্রি অবধি সেখানে হাড়ভাঙা খাটুনি। সঙ্গে তিন ছেলের দেখভাল। একদিন দোকানে বসে আছেন, কে খবর দিল তাদের বাড়ি আগুন লেগে গেছে। পাগলিনীর মত বাড়ি ছুটে গেলেন, সেটা তখন দাউ দাউ জ্বলছে। রবার্ট আর লুডুইগ বাইরে, আলফ্রেডকে দেখতে পেলেন না। আগুন ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ভেতরে ঢুকতে যাবেন, পড়শিরা বাধা দিচ্ছে, এই আগুনে ভেতরে যাওয়া মানেই পুরো পুড়ে যাওয়া। কিন্তু আলফ্রেড তো নিশ্চয় ভেতরে, সে তো অর্ধেক পঙ্গু! সব বাধা ছাড়িয়ে আগুনের হলকার মধ্যে ভেতরে ঢুকে গিয়ে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে এলেন আলফ্রেডকে। একটাও আসবাব বাঁচেনি আগুনের হাত থেকে। দোকানটা একটু থিতু হয়েছিল, আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে এই ভাঙা সংসার! 

সাত বছর বয়সে যে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল আলফ্রেড আর তার আগে তার দুই দাদাও, সেই জেকব প্যারিশ অ্যাপোলোজিস্ট স্কুলে ভদ্রলোকের ছেলেরা পড়তে যায় না। কিন্তু সম্ভ্রান্ত বাড়ির বাচ্চাদের ক্লারা স্কুলে তো অনেক বেশি খরচা, আন্দ্রিয়েতার সাধ্য নেই সেখানে পড়ানোর। দেড় বছর সেই স্কুলে পড়ে ক্ষান্তি দিল আলফ্রেড। ধুর ধুর, ওখানে পড়াশুনা কিছুই হয় না, শুধু গালাগালি আর মারামারি। শিক্ষকরা বাচ্চাদের বেত পিটিয়েও ঠাণ্ডা করতে পারতেন না। তিন রকমের বেত ছিল – লম্বা, মাঝারি আর বেঁটে। ছ'টা বানান ভুল হলেই ডাক পড়ত শিক্ষকের ডেস্কে, তার একধারে হাতের আঙুল বিছিয়ে ধরতে বলা হত, আর বেত দিয়ে সেই আঙুলের ওপর নেমে আসত ছ' ছটা সপাং সপাং বেতের বাড়ি। 

ন'বছর বয়সে আলফ্রেড মা আর দাদাদের সাথে চলে গেল রাশিয়ায়, বাবা ইমান্যুয়েল বেশ কিছুদিন আগেই টুর্কু থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে এসেছেন আর বেশ ভালোই গুছিয়ে নিয়েছেন সেখানে। আবার পুরো নোবেল পরিবার একত্র হল। রাশিয়ার সাথে ইংল্যাণ্ডের গণ্ডগোল লেগেই থাকে, তাই অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবসা বেশ লাভজনক। ব্যবসায় মাঝে মাঝে মার খেলে কি হয়, ইমান্যুয়েল করিৎকর্মা মানুষ, খুব ছোটবেলা থেকেই তার প্রবল সৃজনীশৈলীর উদাহরণ পাওয়া গেছে। তিনি আবিস্কার করেছেন আধুনিক প্লাইউড, যদিও বিস্ফোরকের দিকেই তার নজর বেশি। রাশিয়ায় তখন অস্ত্রশস্ত্রে নতুন জিনিস উদ্ভাবকদের খুব সম্মান। সেই সুযোগে তিনি রাশিয়ার জেনারেলের সঙ্গে দোস্তি পাতিয়ে ফেলেছেন। ফলে তার ব্যবসাও বাড়ছে। সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রাইভেট টিউটরের তত্ত্বাবধানে শুরু হল আলফ্রেডের পড়াশুনা। পদার্থ-রসায়ন আর ইংরাজী সাহিত্য হয়ে গেল ওর সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। সেখানেই পরের বছর জন্মালো ওদের ছোট ভাই এমিল।

বাবা বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রপাতি আর যুদ্ধাস্ত্র, বিশেষ করে সী- আর ল্যাণ্ডমাইনের ব্যবসা করেন, তার ভাল লাগল না যে আলফ্রেডের মন ক্রমাগত সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, সে নাকি লেখক হতে চায়। পড়াশুনায় সে তুখোড়, বিজ্ঞানে তো বটেই, এইসব ফালতু সাহিত্য-টাহিত্য করে কোন লাভ আছে? পেটের ভাত জুটবে না লেখালিখি করে। সতের বছর বয়স পুরাতেই তাই বাবা তাকে বললেন, আমেরিকা যাবি? জন এরিকসন বলে এক বিজ্ঞানী দারুণ সব গবেষণা করছেন শুনেছি। তাঁর কাছে কাজ শিখবি। আজন্ম গৃহবন্দী আলফ্রেডের কাছে আমেরিকা তো স্বপ্ন। বাবা ইমান্যুয়েলও ভাবলেন, যাক বাবা, সাহিত্যের ভুতটা এবার ঘাড় থেকে নির্ঘাৎ নেমে যাবে। শিখতে যাচ্ছে তো রসায়ন। আমেরিকাতে ক'বছর রসায়নের পাঠ নিয়ে বাড়ি ফিরে এল আলফ্রেড।

ইমান্যুয়েলের সী-মাইনের ব্যাপারটা এই রকম। আগে যে নাইট্রোসেলুলোজের কথা বলেছি, যা দিয়ে বানানো হত নাইট্রো-ফিল্ম, তার আবিস্কার হয় ১৮৪৬ সালে। অন্যান্য দেশে সী মাইন বানাতো লোহার তৈরী খোলের মধ্যে এই নাইট্রোসেলুলোজ পাউডার ভরে দিয়ে। সিঙাড়ার মত জিনিস, পুরের জায়গায় বিস্ফোরক পাউডার। ইমান্যুয়েল এর ডিজাইন পালটে দিলেন। চৌকো বাক্সের মধ্যে ভরলেন এই পাউডার, তার এক প্রান্তে একটা লম্বা লোহার ডাণ্ডা বেরিয়ে থাকল। ঐ বাক্সটার আর একটা ছোট্ট খোপে রাখলেন পটাশিয়াম ক্লোরেট, গন্ধক, চিনি আর একটা কাঁচের অ্যাম্প্যুলে ঘন সালফিউরিক অ্যাসিড। কোন ডুবোজাহাজ ঐ বেরিয়ে থাকা লোহার ডাণ্ডায় ধাক্কা মারলে সেটা গিয়ে ধাক্কা মারতো কাঁচের অ্যাম্প্যুলটায়। সেটা ফেটে অ্যাসিড বেরিয়ে এসে মিশে যেত বাকি জিনিসগুলোর সাথে আর তার ফলে একটা ছোটখাট একটা বিস্ফোরণ ঘটত। এর ধাক্কা গিয়ে পড়ত ঐ বাক্সের নাইট্রোসেলুলোজের ভান্ডারে, আর সেটা মহানন্দে ফাটত তখন প্রবল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। 

১৮৪৭ সালে আবিস্কার হয় নাইট্রোগ্লিসারিন বলে এক তরল, ইটালিতে। এ এক আজব বস্তু। বিশুদ্ধ নাইট্রোগ্লিসারিনে আগুন দাও, তেলের মত জ্বলবে, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। কিন্তু বোতলে ভরে রাখ, এমনিতেই, আর যদি তার সঙ্গে একটু নাইট্রিক অ্যাসিড বা ঐ রকমের কিছু অশুদ্ধতা মিশে থাকে, তাহলে তো বটেই, কথা নেই বার্তা নেই, বিশালভাবে ফাটবে। কখন সেই বিস্ফোরণ ঘটবে, তা আগে থেকে বলা যায় না। সবাই ধরে নিল, এ রকম যার বেয়াদপি, তাকে দিয়ে কাজের কাজ কিছু করানো যাবে না। মাইনের কাজে নাইট্রোগ্লিসারিন ব্যবহারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সবাই হাল ছেড়ে দিল। ব্যতিক্রম ইমান্যুয়েল, তিনি হাল ছাড়ার পাত্র নন। আর আলফ্রেড কেমিষ্ট্রি শিখে এসে এসব ব্যাপারে উৎসাহ পেয়ে গেলেন। নিকোলাই জিনিন বলে এক ফরাসী বিজ্ঞানীর কাছে কিছুদিন তালিম নিয়েছিলেন আলফ্রেড, তিনিও উৎসাহিত করলেন আলফ্রেডকে। ১৮৬০ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গেই একটা ছোটখাট সফল পরীক্ষা করে ফেললেন তিনি নাইট্রোগ্লিসারিন নিয়ে। 

এর মধ্যে আবার এক ঝঞ্ঝাট ঘটে গেছে। ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়া হেরে গেছে, আর তার ফলে যুদ্ধের আগে ব্যবসায়ীদের দেওয়া সমস্ত কন্ট্রাক্ট নাকচ করে দিয়েছে দেশের অধিকর্তারা। ইমান্যুয়েল আবার ব্যাংক্রাপ্ট! ফলে ঘটিবাটি বেচে স্টকহোমে চলে আসতে বাধ্য হলেন ইমান্যুয়েল। সঙ্গে আলফ্রেড ও তার মা। রবার্ট আর লুডুইগ থেকে গেল রাশিয়াতেই, যদি কোনভাবে ভাগ্য ফেরানো যায়, সেই আশায়। 

এর পরের ইতিহাস অতিশয় চমকপ্রদ। ১৮৬৩ সালে নাইট্রোগ্লিসারিন ডিটোনেটর আবিস্কার করলেন আলফ্রেড। পরের বছর সেপ্টেম্বরে সেই ফ্যাক্টরিতে কাজ করছেন, হঠাৎ ঘটল বিশাল এক বিস্ফোরণ। আলফ্রেডের আঘাত ততটা গুরুতর নয়। কিন্তু পাঁচজন মারা গেল, তার মধ্যে একজন আলফ্রেডের চেয়ে দশ বছরের ছোট কনিষ্ঠ ভাই এমিল। শোকের ছায়া নেমে এল নোবেল পরিবারে।

কিন্তু আলফ্রেড দমলেন না। এই বিস্ফোরককে কী করে আরো নিরাপদ বানানো যায়, তার ওপর চলতে লাগল তার নিরন্তর গবেষণা। লাইসেন্স পেয়ে জার্মানীর হামবুর্গ শহরের বাইরে ক্রুমেল শহরে এক বিশাল কারখানা খুললেন তিনি। ১৮৬৬ সালে আবিস্কার করলেন নাইট্রোগ্লিসারিনের সাথে ডায়্যাটোমেশিয়াস আর্থ (এক ধরণের ক্ষুদ্র জীবাণুর মৃত শরীরের খোলস, ধুলোর মতই দেখতে)-এর এমন এক মিশ্রণ, যা বিস্ফোরণ নিয়ন্ত্রণে বহুধাপ এগিয়ে গেল। আলফ্রেড এর নাম দিলেন ডিনামাইট। পরবর্তী দু'তিন বছরে ইংল্যাণ্ড আর আমেরিকা থেকে এর পেটেন্ট পেয়ে গেলেন তিনি। খোলা হল আরো কারখানা। নাইট্রোগ্লিসারিনের সাথে অন্যান্য নাইট্রো- যৌগের মিশ্রণে আরো বিভিন্ন বিস্ফোরক তৈরী করলেন। তার মধ্যে যেটা স্বচ্ছ জেলির মত, তার নাম দেওয়া হল জেলিগ্‌নাইট বা বিস্ফোরক জিলেটিন। সেটা ১৮৭৬ সালে। খননকার্য, পাথরের চাঙড় ভাঙা ও যুদ্ধাস্ত্র – সব রকমের কাজেই ব্যবহৃত হতে লাগল এই সব আবিস্কারের বস্তু। এর পরেও তিনি আবিস্কার করেন ব্যালিস্টাইট, ধূমহীন বিস্ফোরক ও রকেটের প্রোপেল্যান্ট হিসাবে এর ব্যবহার এখনও হয়।

রবার্ট আর লুডুইগ সেই যে রাশিয়াতে থেকে গেছিল, ওরাও কম এলেমের ছেলে নয়। পৃথিবীতে খনিজ তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা দেখে রাশিয়ার বেশ কিছু তৈলখনি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে তারা ইতিমধ্যে বেশ দু'পয়সা কামিয়ে নিয়েছে। সে সময় সারা পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি পেট্রোলিয়াম তোলা হত রাশিয়া থেকেই। সুযোগ বুঝে আলফ্রেড তার ডিনামাইট বিক্রির মুনাফা বিনিয়োগ করল দাদাদের সেই তেলের কোম্পানীর শেয়ারে, আর দিনকে দিন লাল হতে লাগল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বানানো হল তাঁর কারখানা, কিনে ফেললেন অনেক কোম্পানী, তারমধ্যে অন্যতম হল বোফর্স। কপর্দকহীন নোবেল পরিবার আবার উঠে এল পাদপ্রদীপের আলোয়। 

১৮৮৮ সালে ফ্রান্সের কান শহরে বেড়াতে দিয়ে লুডুইগ হৃদরোগে মারা যান। তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হওয়ার আগেই আলফ্রেড দেখলেন ফরাসী খবরের কাগজে বড় বড় হেডলাইন – Le marchand de la mort est mort অর্থাৎ মৃত্যুর কারবারীর মৃত্যু হল। নীচে কয়েক কলম জুড়ে আলফ্রেডের সমস্ত বিস্ফোরক নিয়ে ব্যবসার নিন্দা ফলাও করে ছাপা। আলফ্রেডকে মানুষ মারার প্রযুক্তি থেকে মুনাফা লোটার তীব্র সমালোচনা হয়েছে।

প্রথমে বিস্মিত হলেন আলফ্রেড, ব্যাটারা ধরে নিয়েছে তাঁরই মৃত্যু হয়েছে। পরক্ষণেই ক্রোধে লাল হয়ে গেল তাঁর মুখ। ভেবেছে কী এরা, এর আগে যুদ্ধ, হানাহানি, মানুষের আকস্মিক মৃত্যু এসব কিছু ছিল না বুঝি! আর এই আবিস্কারের ফলে খনিগর্ভ খননের কাজ যে ত্বরান্বিত হয়েছে কতগুণ, প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার বেড়ে গেছে, পাহাড়ি দুর্গম অঞ্চলে রাস্তাঘাট বানানো হচ্ছে, প্রকৃতির ওপর মানুষের অধিকার স্থাপিত হচ্ছে, এসবের কোন মূল্য নেই? উজবুকের দল এসব কবে বুঝবে? ক্রোধ প্রশমিত হলে মনে জাগল অনুতাপ। এত সম্পত্তির মালিক তিনি, সারা জীবনের এত পরিশ্রমের ফসল তাঁর সাড়ে তিনশোর অধিক পেটেন্ট নেওয়া আবিস্কার, এসব কেউ মনে রাখবে না। দেখাই তো যাচ্ছে, তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁকে সবাই জানবে মৃত্যুর কারবারী হিসাবে। অসহ্য!

ফ্রান্স ছেড়ে পাকাপাকি ইটালি চলে গেলেন তিনি। পরিবারের কাউকে না জানিয়ে গোপনে এক উইল বানালেন। সেই উইল পরের কয়েক বছরে পাল্টানোও হল কয়েকবার। ১৮৯৬ সালের তারিখে সান রেমো শহরে তাঁর শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে যাওয়ার পর সেই উইল দেখে পরিবারের সবাই তো হতবাক। কুড়িটা দেশের নব্বইটা কারখানা তাঁর, বিভিন্ন কোম্পানীর নামে। তাঁর সমস্ত সম্পত্তি, যার পরিমাণ তখন ৩১ বিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনারেরও বেশি (প্রায় পৌনে দুই বিলিয়ন পাউণ্ড সেই যুগে), তার ৯৪ শতাংশ তিনি দিয়ে গেছেন এক ট্রাস্ট বানাতে, যার নিরাপদ বিনিয়োগের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি, তার বাৎসরিক আয় থেকে পাঁচটা পুরস্কার দেওয়ার জন্য – আগের বছর যার অবদান সেই বিষয়ে পৃথিবীশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবে, তাদের। বিষয়গুলি হল পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, সাহিত্য ও বিশ্বশান্তি। 

যে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ ছিলেন আলফ্রেড, তার এই পুরস্কারগুলির মধ্য দিয়ে তিনি অমর হয়ে রইলেন। যে দুজন নারীকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে চেয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর তাদের জীবন দু খাতে বয়ে যায়। বার্থার সাথে আলফ্রেডের চিঠিতে যোগাযোগ হয়েছিল আগেই, যুদ্ধের বিরুদ্ধে আর বিশ্বশান্তির সপক্ষে বার্থার আন্দোলন ছিল তীব্র, আর সেই আন্দোলনে সে চেয়েছিল আলফ্রেডের সক্রিয় সাহায্য। ১৮৮৯ সালে তার লেখা 'লে ডাউন আর্মস' বইটা সাড়া ফেলে সারা পৃথিবীতে। তিন বছর পরে বার্ণে শান্তি কংগ্রেসের মুখ্য আয়োজিকা বার্থা অর্থসাহায্য চেয়েছিল আলফ্রেডের কাছে। টাকা দিয়েছিলেন আলফ্রেড, সঙ্গে নোট – তোমার এই কংগ্রেস যদ্দিনে শান্তি আনবে, তার অনেক আগেই আমার কারখানাগুলো তা করে ফেলবে। এই সব চিল্লামিল্লি করে শান্তি আসে না। যখন এক সেকেণ্ডের মধ্যে দু'দল সৈন্য একে অপরকে ধ্বংস করে ফেলতে পারবে, তখন উপায়হীন মানুষ বাপ বাপ বলে শান্তির উপাসনা করবে, তার আগে নয়। আলফ্রেড তাঁর তালিকায় যে 'বিশ্বশান্তি'তে অবদানের জন্য পুরস্কার যুক্ত করেছিলেন, তার পেছনে নিঃসন্দেহে বার্থার প্রভাব ছিল। ১৯০৫ সালে – যে বছর বাংলা ভাগ হয়ে যাওয়ায় ভারতে অশান্তি চরমে – নোবেল শান্তি পুরস্কার যার হাতে উঠে এসেছিল, তার নাম বার্থা ফন সাটনার। অন্যজন সোফি হাঙ্গেরির এক ক্যাভালরি অফিসারকে বিয়ে করে ঘরসংসার শুরু করে। সে সংসার কতটা সুখের হয়েছিল, সে বিবরণ লিখে রাখার সাধ্য তার ছিল না। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার খবর যখন এল শান্তিনিকেতনে, তার বছর খানেক আগে সে মারা যায়। 

টেলিগ্রাম পাওয়ার ঠিক একমাস আগে বিদেশ থেকে ফিরে রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছিলেন –
কেন তারার মালা গাঁথা
কেন ফুলের শয়ন পাতা
কেন দখিন হাওয়া গোপন কথা
জানায় কানে কানে
যদি প্রেম দিলে না প্রাণে ...
এ যেন তাঁর পুরস্কারদাতা আলফ্রেড নোবেলের সারা জীবনের গান, এক অতৃপ্ত আত্মার আত্মকথন। 

পনেরই নভেম্বর টেলিগ্রাম পাওয়ার দুদিন পরেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্মতি তার করে দিলেন। কুড়ি তারিখে এল আরও একখানা টেলিগ্রাম, সুইডিশ অ্যাকাডেমির সেক্রেটারির কাছ থেকে। তাতে লেখা, 'Nobel Prize will be solemnly handed over Stockholm 10th of December Invite you heartily though fear time will not allow your coming'. ঠিক হল কবির পক্ষে স্টকহোমে ব্রিটিশ দূতাবাসের প্রতিনিধি এই পুরস্কার গ্রহণ করবেন। তিনি বাংলার তখনকার গভর্ণর লর্ড কারমাইকেলের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন কবির কাছ থেকে ধন্যবাদজ্ঞাপক একটা বার্তা আহ্বান করে। কবি সেই চিঠি পেয়ে তার নিজের লেখার টেবিলে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। কী লেখা যায়? পরিচিতদের বাচ্চাদের নামকরণ বা আশিস্‌ চেয়ে একটা কাগজ বাড়িয়ে ধরলে যিনি মুহূর্তের ভিতর খসখস করে লিখে দিতে পারেন অনবদ্য কবিতা, এখন তাঁর কলম দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। 

দশই ডিসেম্বরে নিয়মমাফিক নোবেল পুরস্কারের সম্মানসভায় সে বছরের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারবিজয়ীর নাম যখন ঘোষিত হল, পুরস্কার নিতে এলেন সুইডেনে ব্রিটিশ অ্যাম্বাসাডার ক্লাইভ। তাকে দেওয়া হল একটা স্বর্ণপদক আর একটা ডিপ্লোমা। ডিপ্লোমার ওপর সুইডিশ ভাষায় লেখা, প্রাপক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তাঁর অনবদ্য সংবেদনশীল, তরতাজা সুন্দর কাব্যরচনার জন্য, অসামান্য দক্ষতা ও কাব্যশৈলী দিয়ে যিনি নিজস্ব ইংরাজী শব্দে প্রকাশ করেছেন পাশ্চাত্য সাহিত্যের অংশ। ক্লাইভ পাঠ করলেন রবীন্দ্রনাথের বার্তা – সুইডিশ অ্যাকাডেমিকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই সেই বাণী হৃদয়ঙ্গম করার জন্যে, যা দূরকে করে নিকট, অপরিচিতকে সহোদর।

ঠিক এর তিরিশ দিন পরে, ১৯১৪ সালের জানুয়ারির নয় তারিখে কলকাতায় গভর্ণরের বাসভবনে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের হাতে তুলে দেওয়া হয় সেই স্বর্ণপদক ও ডিপ্লোমা। 

প্রাতিষ্ঠানিক যে শিক্ষাব্যবস্থা ছিল রবীন্দ্রনাথের দু'চক্ষের বিষ, ছাত্র হিসাবে তিনি যার অন্দরমহলে পা রাখতে চাননি কোনদিন, তার আমূল পরিবর্তন করে শিক্ষক হিসাবে নতুন ধ্যানধারণা প্রবর্তনের অমোঘ যজ্ঞে মেতে আছেন তিনি। না চাহিলে যারে পাওয়া যায়, তার তালিকায় তিরস্কারের সংখ্যাই বেশি, পুরস্কার মেলে কদাচিৎ। নোবেল পুরস্কার তাঁর হস্তগত হলেও তিনি জানতে পারলেন না, এর পেছনে ঘটে গেছে অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনাবলী। 

(ক্রমশঃ)
 

আজি হতে শতবর্ষ আগে ~ অমিতাভ প্রামাণিক

এক – বাজিলো কাহার বীণা

তেরো সংখ্যাটা নাকি অশুভ। শ্বেতকায় বোদ্ধারা বলেন, আনলাকি থার্টীন। দু'হাজারের পর তেরো বসালে সেটা লাকি না আনলাকি, সেটা বছর না গেলে তো বোঝা যাবে না। তবে মিটারের কাঁটা ঘুরিয়ে দিয়ে সিনেমার মত ফ্ল্যাশব্যাকে যদি দেখি একশো বছর আগে! কেমন ছিল সেই সময়টা?

সিনেমার জগতের খবর দিয়েই শুরু হয়েছিল ঊনিশশো তেরোর প্রথম দিনটা। পয়লা জানুয়ারি ব্রিটিশ বোর্ড অফ ফিল্ম সেন্সরস্‌ পেলো সিনেমাকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে তালিকাভুক্ত ও সেন্সর করার অধিকার। মজার ব্যাপার, এখন যেমন সেন্সর কথার মানেই হচ্ছে অতিরিক্ত শরীর প্রদর্শনের বা জঘন্য রকমের মারপিটের বিরুদ্ধে কাঁচি চালানো, এর শুরুর উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল বেশ আলাদা। তখন আধুনিক ফিল্মের উপযোগী প্লাস্টিক রোল আবিস্কার হয়নি। তুলোর সেলুলোজের সঙ্গে নাইট্রিক অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় প্রাপ্ত নাইট্রোসেলুলোজ ছিল হোমিওপ্যাথি ডোজের বিস্ফোরক। জাপানের কোডাক কোম্পানি এই নাইট্রোসেলুলোজের সাথে কর্পূরের মিশ্রণে তৈরী করল ফটোর উপযুক্ত ফিল্ম, তার নাম হল নাইট্রেট ফিল্ম। এই নাইট্রেট ফিল্ম দিয়েই তৈরী হতে লাগল সিনেমাও। আর তখন সিনেমাহল বলেও নির্দিষ্ট কোন জায়গা ছিল না। একটা ঘুপচি দোকানঘর বা গুদামঘর বা কারও বাড়ির বেসমেন্টেও সিনেমা দেখানো যেতে পারত। কিন্তু এই নাইট্রেট ফিল্ম জাতে তো বিস্ফোরক, ঘষাঘষি হলেই এই ফিল্মে আগুন লেগে যেত, ফলে একের পর এক এই সব মেকশিফ্‌ট্‌ সিনেমাহলে দুর্ঘটনা ঘটতে লাগল। এর হাত থেকে বাঁচার উপায় হিসাবেই তৈরী হল সেন্সরশিপ, কোথায় কেমন পরিবেশে সিনেমা দেখানো যেতে পারবে, তার নিয়ম বানিয়ে। শীঘ্রই অবশ্য সিনেমার বিষয় ও তাতে যৌনতা ও ভয়াবহতাও সেন্সরশিপের আওতায় এসে যায়।

সিনেমার ব্যাপারেই আরো দুটো 'পয়লা' ঘটে গেল ব্রিটিশ ভারতেও। পয়লা মে রাওয়ালপিণ্ডি শহরে এক পাঞ্জাবী ক্ষত্রি পরিবারে জন্ম হল যুধিষ্ঠির সাহনির, আমরা যাকে পরে চিনলাম বলরাজ নামে। আর পয়লা অগাষ্ট মুম্বইয়ের শহরতলিতে কাপড়ের কলে চাকরি করা আভাজী পালব-এর ঘরে জন্মালেন ভগবান, ক্রমে সে হয়ে গেল ভগবান দাদা। 

না, শুধু ভবিষ্যৎ নায়কের জন্ম দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি ভারতীয় সিনেমা। মে মাসের তিন তারিখে ভারতের ইতিহাসে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি রিলীজ হল সিনেমাহলে, তার নাম রাজা হরিশচন্দ্র, পরিচালক দাদাসাহেব ফালকে। এ ছবিটি ছিল অ-বাক, ভারতীয় ছবিতে সংলাপ শুরু হওয়া আরো পরের ঘটনা, কিন্তু সেই যুগে পরাধীন ভারতে এটাও এক অবাক কাণ্ডই বটে। 

আরও আছে। মহীশূরের উপকণ্ঠে ধারোয়ার ও হুবলি দুই পাশাপাশি শহর, যমজ ভাইয়ের মত। দাক্ষিণাত্যের কৃষ্ণমৃত্তিকা তুলোচাষের পক্ষে উৎকৃষ্ট, এ ছাড়াও লৌহসমৃদ্ধ এই মাটিতে অনেক কিছুর চাষবাস হয়। চিক্কুরাও নাদিগার নামে এক ভদ্রলোক, তার বাড়ি ধারোয়ারে, চাষবাস নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, পরীক্ষানিরীক্ষা করেন। স্ত্রী অম্বাবাঈ ভালোবাসেন গান, কর্ণাটকী ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত। দুর্ভাগ্য তার, যে পরিবারে অম্বা-র জন্ম হয়েছিল, সমাজের চোখে সেটা নীচু জাত, তাদের গান গাওয়ারই অধিকার নেই, স্টেজে পরিবেশন তো দূরের কথা। লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেন তাই অম্বাবাঈ, আর সাধনা করে যান শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। হয়ত এমন দিন আসবে, যখন এই নিষ্ঠুর জাতপাতপ্রথা দূর হয়ে যাবে। তার নিজের জীবিতকালে না হলেও, হয়ত পরবর্তী প্রজন্মে।

মার্চের পাঁচ তারিখে তার কোল আলো করে এল এক কন্যাসন্তান। চিক্কুরাও তার নাম রাখলেন গাঙ্গুবাঈ। 

বিজ্ঞানের দুনিয়াতেও নিঃশব্দে বিপ্লব ঘটে যাচ্ছিল। ঊনিশশো তেরোতে নিল্‌স্‌ বোর প্রকাশ করলেন তার কোয়ান্টাম মডেল। মিলিক্যান মেপে দেখালেন ইলেকট্রনের চার্জ। পিতাপুত্র দুই ব্রাগ মিলে বের করলেন এক্স-রের জোরালো প্রতিফলন পাওয়ার শর্তাবলী। জে জে টমসন মাস স্পেক্ট্রোমেট্রি বলে এক প্রকৌশলের সন্ধান দিলেন, যা দিয়ে আয়নিত পদার্থকে পৃথক করে তাদের সম্বন্ধে বিশদ জানা সম্ভব হয়। আর বিজ্ঞানের জগতের রাজপুত্র অ্যালবার্ট আইনষ্টাইন শুরু করলেন আপেকিক্ষতাবাদের ওপর তার নতুন কাজকর্ম, প্রচলিত তত্ত্ব থেকে এটা আলাদা বোঝাতে এর নাম দিলেন স্পেশ্যাল থিওরী অফ রিলেটিভিটি। 

যদি মনে হয় এসব বেশ বোরিং তাত্ত্বিক ব্যাপার, তবে প্রযুক্তির দিকে চোখ মেলা যাক। সেই বছরের শেষের দিকে মাত্র ঊনিশ বছর বয়সী নিউ ইয়র্কের এক তরুণী মেরী ফেল্প্‌স্‌ জেকব মহিলাদের প্রথম আধুনিক বক্ষবন্ধনী ডিজাইন করে তার পেটেন্ট নেন। এর আগে ফ্যাশনদুরস্ত মহিলাদের ঊর্ধাঙ্গে অন্তর্বাস হিসাবে ব্যবহৃত পোষাক ছিল কর্সেট, তা শুরু করেছিলেন ফরাসী রাজা দ্বিতীয় হেনরির পত্নী রাণী ক্যাথেরিন। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের সরু কোমর বীভৎসভাবে আঁটসাঁট করে রাখা। তাতে ব্যবহৃত হত তিমিমাছের কাঁটা অথবা ধাতব সরু রড, মাঝে মাঝেই সেগুলো হয় শরীরে ফুটে যেত, বা পোশাক ভেদ করে দৃষ্টিকটু হয়ে শজারুর মত খাড়া হয়ে থাকত। দীর্ঘ সাড়ে তিনশো বছর ধরে ফ্যাশনের নামে মেয়েরা সহ্য করে এসেছে যে যন্ত্রণা, মেরীর এই আবিস্কার তা থেকে তাদের মুক্ত করে। দিনে দিনে এর চাহিদা বাড়তে থাকলেও মেরী এই ব্যবসা চালাতে পারেনি। মাত্র পনেরশো ডলারে সে তার পেটেন্ট বিক্রী করে দেয় ওয়ার্ণার ব্রাদার্স নামে এক কোম্পানীকে (এরা সিনেমা বানানোর ওয়ার্ণার ব্রাদার্স নয়)। পরবর্তী তিরিশ বছরে তারা দেড় কোটি ডলারের বাণিজ্য করে শুধু এই বক্ষবন্ধনীরই। ১৯১৭ সালে পুরনো কর্সেট ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বছরে প্রায় আঠাশ হাজার টন ষ্টীল অন্য কাজে ব্যবহৃত হওয়ার সুযোগ পায়। 

রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত ঘোরালো এই সময় সমগ্র বিশ্বে। হিন্দু-মুসলমান দুই জাতিকে আলাদা করতে ঊনিশশো পাঁচে বাংলাকে কেটে দুভাগ করার জন্য ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে তীব্র বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূচনা হয়, ঊনিশশো এগারোতে তার ফলে দ্বিখণ্ডিত বাংলা আবার জোড়া লেগে যায়। সমস্যা হল, আলাদা হওয়ার জন্য যারা কিছু অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করছিলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গে, তারা এই জোড়া দেওয়াটা মেনে নিতে পারছিলেন না। এ নিয়ে সমস্যা লেগেই ছিল। কিন্তু ব্রিটিশরাজের এ নিয়ে তখন নাক গলানোর তেমন সময় নেই। কেননা তাদের নিজের ঘরের সামনে ততদিনে বিশাল আগুন লেগে গেছে। 

ইওরোপের বিভিন্ন দেশে বেশ কয়েক দশক ধরে অশান্তি লেগেই আছে। বুলগেরিয়া-গ্রীস-মন্টেনিগ্রো আর সার্বিয়া, যারা তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনতামুক্ত হয়ে তৈরী করেছে বলকান জোট, তারা অটোমানদের বিরুদ্ধে চোরাগোপ্তা হামলা লাগিয়েই চলছিল। গত বছরেই পুরোপুরি যুদ্ধ লেগে গেছে, ছাব্বিশে মার্চ বুলগেরিয়া ছিনিয়ে নিল আড্রিয়ানোপল। অটোমানদের অবস্থা যায় যায়, তিরিশে মে লণ্ডন চুক্তি স্বাক্ষর করে তাদের অনেক জমিজিরেত বলকানদের উপঢৌকন দিয়ে সেই যুদ্ধ শেষ হল। অবশ্যই এতে মদত জোগাল পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী রাজ্যগুলি যাদের মধ্যে ব্রিটেন এক নম্বরে। সঙ্গে জার্মানী, রাশিয়া, অষ্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি, ইটালি। কিন্তু শেষ হলে কী হয়, বলকানরাও চারটে দেশ। অটোমানদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জমির বিলিবন্দোবস্ত পছন্দ হল না বুলগেরিয়ার। সার্বিয়া আর গ্রীস নিজেদের মধ্যে ম্যাসেডোনিয়ার ভাগবাঁটোয়ারা করে নিয়েছিল। ক্ষেপে গিয়ে দু সপ্তাহের মধ্যেই বুলগেরিয়া আক্রমণ করে বসল মাত্র কিছুদিন আগেই যারা তার মিত্র জোটের সদস্য ছিল, সেই সার্বিয়া আর গ্রীসকে। তারাও পালটা হানা দিল বুলগেরিয়ায়, সঙ্গে জুটে গেল রোমানিয়া। ফলে বুলগেরিয়া অটোমানদের কাছ থেকে অল্প যা কিছু পেয়েছিল, তার প্রায় সবটাই হারালো। অগাষ্টের দশ তারিখে বুখারেষ্ট চুক্তিতে সেই যুদ্ধ শেষ হল। ম্যাসেডোনিয়া পেয়ে গেল সার্বিয়া আর গ্রীস, উত্তর ইপিরাস চলে গেল আলবেনিয়ার ভাগে, দক্ষিণ ডব্রুজা কেড়ে নিল রোমানিয়াও।

এই সব অশান্তি আর তার প্রত্যক্ষ মদত সূচনা করল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রঙ্গমঞ্চ।

ভারতের রাজনীতির আকাশে উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক মোহনদাস গান্ধী সে বছর দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে আনপড় শ্রমিকশ্রেণীর ভারতীয়দের ওপর দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গদের বঞ্চনার ইতিহাস অনেক পুরনো। তাদের ওপর ধার্য হয় অহেতুক কর, ভারতীয় মতে অনুষ্ঠিত বিবাহ তাদের দেশে গ্রহণযোগ্য নয়, ইংরাজীতে নাম সই না করতে পারলে সে দেশে ঢোকাও অসম্ভব। এর বিরুদ্ধে গান্ধী শুরু করলেন পদযাত্রা, চার্লসটাউন শহর থেকে। সঙ্গে ২০৩৭টি পুরুষ, ১২৭ জন মহিলা এবং ৫৭টি শিশু। সকাল ছটায় শুরু হওয়া পদযাত্রা পুলিশের কর্ডন অতিক্রম করে ফোক্সরাষ্ট বর্ডার পেরিয়ে গেল। সন্ধ্যে সাড়ে আটটায় গান্ধী গ্রেফতার হলেন পামফোর্ড রেলষ্টেশনের কাছে। ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ পুলিশের এই নীতির নিন্দা করায় গান্ধী ও দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার এক টেবলে আলোচনায় বসতে পারে। গান্ধীর সত্যাগ্রহে অনেক দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয় সরকার।

প্রচণ্ড পরিশ্রমী গান্ধী, তাঁর পায়ের নীচে সর্ষে। তাঁকে যিনি মহাত্মা বলে অভিহিত করেছেন, তাঁর পরিশ্রমও নেহাৎ কম নয়। সারাটা বছর এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরেই কেটে গেল রবীন্দ্রনাথের। এদিক ওদিক মানে আমেরিকা আর ইংল্যাণ্ডে। এর তোড়জোড় শুরু হয়েছিল বছর দুই আগে। ইংল্যাণ্ড থেকে চিত্রশিল্পী রথেনষ্টাইন আর জার্মানী থেকে দার্শনিক কাউন্ট হারম্যান কিসেরলিং এসেছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে, তাদের সঙ্গে অনেক কথাবার্তা হয় কবির। ব্রাহ্মসমাজের বার্ষিক অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ কর্মযোগ শীর্ষক ভাষণ দিলেন। শান্তিনিকেতনে কবি ও আর একজন শিক্ষকের সহযোগিতায় আনন্দ কুমারস্বামী রবীন্দ্রনাথের শিশু কাব্যগ্রন্থের কিছু কবিতার ইংরাজী তর্জমা করলেন, সেগুলো ছাপা হল মডার্ন রিভিউ পত্রিকায়। পঞ্চাশ বছর বয়স হল তাঁর, মহা ধুমধাম করে সেই রৌপ্যজয়ন্তী পালন করা হল, কলকাতা থেকে তাতে যোগ দিতে এসেছিল অনেকেই, তার মধ্যে তাঁর অন্যতম ভক্ত রায়বাড়ির ছেলে সুকুমার। তাঁর লেখা রাজা নাটক মঞ্চস্থ করা হল, তিনি নিজে সাজলেন ঠাকুর্দা। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর ঘাড়ে, লিখলেন অচলায়তন নাটক। এই সময় তাঁর বেশ অর্থকষ্টে গেছে। প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর আত্মজীবনী, জীবনস্মৃতি। শান্তিনিকেতনে শারদোৎসবে তিনি সাজলেন সন্ন্যাসী, লিখলেন ডাকঘর নাটক আর ভারতী আর প্রবাসী পত্রিকার জন্যে অনেকগুলো ছোটগল্প। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে তাঁর লেখা ও সুর দেওয়া গান জনগণমন-অধিনায়ক প্রথম গাওয়া হল এই সময়।

পরের বছরের অর্থাৎ ১৯১২র শুরুতেই বাংলার প্রায় দুশোজন বুদ্ধিজীবী কলকাতায় তাঁকে সম্বর্ধনা দিলেন, মডার্ণ রিভিউতে তা একজন ভারতীয় সাহিত্যিকের প্রতি অভূতপূর্ব সম্মানপ্রদর্শন বলে বর্ণিত হল। সাধারণ ব্রহ্মসমাজের সভায় তিনি আত্মপরিচয় বলে একটা প্রবন্ধ পাঠ করলেন। বাংলা ও অসমের সরকারী আমলারা শান্তিনিকেতনকে তাদের পরিবারের সন্তানদের পড়াশুনার অযোগ্য ঘোষণা করলেও মাইরন ফেল্প্‌স্‌ নামে এক আমেরিকান আইনজীবী শান্তিনিকেতন সফর করে এর ন্যায়নীতিমূলক শিক্ষাব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করে প্রবন্ধ লেখেন। ভারতীয় ইতিহাসের মূল্যায়নের ওপর রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার ইংরাজী তর্জমা করে যদুনাথ সরকার মডার্ণ রিভিউতে প্রকাশ করেন। তা উচ্চপ্রশংসিত হওয়ায় তাঁর বন্ধুবান্ধব তাঁকে ইংল্যাণ্ড ভ্রমণের পরামর্শ দেন। জোরজার করে টিকিট কাটা হয়ে গেলেও কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাঁর বিদেশযাত্রা পিছিয়ে যায়। 

ইংল্যাণ্ড যাত্রা ঠিক হয়ে আছে, ওদেশে শোনাতে হবে তাঁর নিজের লেখা, ওদের ভাষায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানগুলির ইংরাজী অনুবাদ শুরু করলেন। এ কাজটা তাঁর খুব পছন্দের নয়, কিন্তু এ ছাড়া উপায়ই বা কী? ইংল্যাণ্ডে যাওয়ার পূর্বে লেখেন যাত্রার পূর্বপত্র, তাতে বর্ণনা করেন তাঁর এই সফরের উদ্দেশ্য শান্তিনিকেতনে তাঁর শিক্ষাসংক্রান্ত কাজের সঙ্গে পশ্চিমী মহলকে অবহিত করা। যাত্রাপথেও তাঁর কবিতার অনুবাদ করতে থাকেন ইংরাজীতে। লণ্ডনে পৌঁছে সেগুলির পাণ্ডুলিপি তিনি দেন রথেনষ্টাইনকে। রথেনষ্টাইন সেগুলি টাইপ করে পড়তে দিলেন উইলিয়াম ইয়েট্‌স্‌, স্টপফোর্ড ব্রুক আর অ্যান্ড্রু ব্র্যাডলিকে। সকলেই মুগ্ধ হয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ কেমব্রিজে গিয়ে দেখা করলেন বারট্রান্ড রাসেলের সঙ্গে। রথেনষ্টাইন কবির কিছু কবিতাপাঠের আসরের আয়োজন করলেন, সেগুলো সব দারুণভাবে প্রশংসিত হল। জর্জ ক্যালডেরন তাঁর ছোটগল্প ডালিয়ার নাট্যরূপ দিলেন মহারাণী অফ আরাকান নাম দিয়ে, সেটা রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে অভিনীত হল। কবি দেখা করলেন বার্ণার্ড শ', এইচ জি ওয়েলস ও আরো অন্যান্য পণ্ডিত ব্যক্তিদের সাথে। রাজা আর ডাকঘর নাটকেরও ইংরাজী অনুবাদ হল। ১৯১২র ২৮শে অক্টোবর তিনি ইংল্যাণ্ড থেকে আমেরিকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ইলিনয়ের আর্বানা শহরে আধ্যাত্মিকতার ওপরে একগুচ্ছ প্রবন্ধপাঠ করেন, যা পরে সাধনা নামে প্রকাশিত হয়। 

ইংরেজ কবি ইয়েট্‌সের উদ্যোগে গীতাঞ্জলির বেশ কিছু কবিতার ইংরাজি অনুবাদ সং অফারিংস নামে প্রকাশিত হল ইংল্যাণ্ডে, ইয়েট্‌স্‌ নিজেই তার ভূমিকা লিখে দিলেন, সেই বই ইংরেজ শিক্ষিত সমাজে অসম্ভব প্রশংসা লাভ করল। শিকাগোর পোয়েট্রি পত্রিকায় গীতাঞ্জলির ছখানা কবিতার ইংরাজী তর্জমা ছাপা হল। কবির বন্ধু অ্যান্ড্রুজ দেশে ফিরে কবির কথা ফলাও করে লিখলেন লাহোরের সিভিল অ্যাণ্ড মিলিটারি গেজেট পত্রিকায়। 

১৯১৩ সালের প্রথম দিকে আমেরিকাতে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কবি প্রাচীন ভারতীয় নীতির ওপর বক্তৃতা করলেন। শিকাগোতেই ইউনিটারিয়ান হলে বক্তৃতা করলেন ইভিল বা মন্দের সমস্যা নিয়ে। উদার ধর্মীয় গোষ্ঠী কংগ্রেসের অধিবেশনে অংশগ্রহণ করে জাতিবৈষম্যের ওপর বক্তৃতা করলেন রচেষ্টারে। তারপর গেলেন বষ্টনে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এমার্সন হলে একগুচ্ছ প্রবন্ধপাঠ করলেন। গেলেন নিউ ইয়র্কে। সেখান থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি আমেরিকা থেকে ফিরে আবার গেলেন লণ্ডন। লণ্ডনের ম্যাকমিলান অ্যাণ্ড কোম্পানী প্রকাশ করল গীতাঞ্জলীর এক পপুলার সংস্করণ। দ্য গার্ডেনার, দ্য ক্রেসেন্ট মুন আর চিত্রাও প্রকাশ করল ম্যাকমিলান। আইরিশ থিয়েটারে মঞ্চস্থ হল তাঁর নাটক দ্য পোষ্ট অফিস। ক্যাক্সটন হলেও তিনি দিলেন একগুচ্ছ বক্তৃতা। 

কম কাজ? বয়স তো কমছে না, কত আর দৌড়াদৌড়ি করবেন?

রবীন্দ্রনাথের তরুণ ভক্তদের অন্যতম, যাকে আমরা হাস্যরসের সম্রাট হিসাবে পরে জানতে পেরেছি, সেই সুকুমার রায় তখন ইংল্যাণ্ডে। রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি নাটকের অনুসরণে পিতা উপেন্দ্রকিশোর তার ডাকনাম রেখেছেন তাতা, দিদি সুখলতার ডাকনাম হাসি। রবীন্দ্রসাহিত্যে অনুপ্রাণিত এই যুবক ইংল্যাণ্ডের ইষ্ট অ্যাণ্ড ওয়েষ্ট সোসাইটির এক অধিবেশনে এক বক্তৃতা দিলেন, তার শীর্ষক হল 'দ্য স্পিরিট অফ রবীন্দ্রনাথ'। বক্তৃতার শুরুতে তিনি শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় দিলেন এইভাবে – In the midst of all our work and all our pleasures, we are often unconscious that we are ever carrying with us the burden of an eternal question. Very few of us indeed have anything more than a vague consciousness of its existence and most of us are satisfied with an occasional mild intellectual interest in the problem. But in some lives – and these lives are only truly great – the question has assumed an imperative form; and wherever the demand for an answer has been thus insistent, we have had one of those contributions to human thought that leave a definite impression on the ever-changing ideals of humanity.

রবীন্দ্রনাথের কবিতা সম্বন্ধে তিনি বললেন - Where poetry is coextensive with life itself, where art ceases to be the mere expression of an imaginative impulse, it is futile to attempt a comprehensive analysis. Rabindranath's poetry is an echo of the infinite variety of life, of the triumph of love, of the supreme unity of existence, of the joy that abides at the heart of all things. The whole development of his poetry is a sustained glorification of love. His philosophy of love is an interpretation of the mystery of existence itself. 

সেপ্টেম্বরে জাহাজে রবীন্দ্রনাথ দেশে ফিরলেন, সহযাত্রী ছিলেন সুকুমার। কিছুদিন আগেই উপেন্দ্রকিশোর সন্দেশ নামে একটা শিশুদের পত্রিকা শুরু করেছেন, তিনি চান সুকুমার দেশে ফিরে তার ভার নিক। ভারতবর্ষে মুদ্রণশিল্পে চাঞ্চল্যকর অভিনবত্ব এনেছেন উপেন্দ্র, হাফটোন মুদ্রণে তিনি সৃষ্টি করেছেন নতুন প্রযুক্তি, তাঁর প্রবন্ধ ছাপা হয় লণ্ডনের নামী পত্রিকায়। এই শাস্ত্র শিক্ষা করতেই সুকুমারের ইংল্যাণ্ডে আসা, তিনি ইতিমধ্যেই পদার্থ ও রসায়নে যুগ্ম স্নাতক। সাহিত্য রচনার ব্যাপারে অবশ্য তার এখনো কিছু উৎসাহ দেখা যায়নি। 

পুরনো লেখার অনুবাদ আর বক্তৃতা করেই চলে যাচ্ছে বছর, নতুন লেখার সময়ই হচ্ছে না, রবীন্দ্রনাথ স্বস্তি পান না। ইংল্যাণ্ড ছাড়ার আগে ২৪শে অগাষ্ট – সেদিন রবিবার – সারাদিন বসে লিখে ফেললেন কয়েকটি নতুন গান। মনে বাজছে রাগাশ্রয়ী সুর। লিখলেন ইমনকল্যাণের সুরে এ মণিহার আমায় নাহি সাজে, খাম্বাজে অসীম ধন তো আছে তোমার, তাহে সাধ না মেটে, খাম্বাজেই বাউল-অঙ্গে তোমারি নাম বলব নানা ছলে। পরদিন জন্মাষ্টমী। সেদিন লিখলেন আশাবরী-ভৈরবীতে ভোরের বেলা কখন এসে পরশ করে গেছে হেসে, ভৈরবী-রামকেলীতে প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে। তার দুদিন পরে দেশ রাগে জীবন যখন ছিল ফুলের মত। ফেরার পথে জাহাজে বসেও কয়েকটি কবিতা ও গান রচনা করলেন। বাজাও আমারে বাজাও, ভেলার মত বুকে টানি কলমখানি মন যে ভেসে চলে, রামকেলীতে কীর্তন-অঙ্গে জানি গো দিন যাবে এ দিন যাবে, ইমন রাগে বাউল-অঙ্গে নয় এ মধুর খেলা তোমায় আমায় সারাজীবন সকাল সন্ধ্যাবেলা। 

দেশে ফিরেই সোজা চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে। বহুদিন দেশছাড়া, হাতে এখন অনেক কাজ। একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানো কি মুখের কথা? তিনি না থাকলেই অনেক কাজ পড়ে থাকে, সব কিছুর ব্যাপারেই তাঁর মতামত চাওয়া হয়। মত দিতে অসুবিধে নেই, কিন্তু তাইজন্যে কাজ পড়ে থাকবে? গীতার কর্মযোগ এদের শেখাতেই হবে। শান্তিনিকেতনে বসে তার কলম চলতে লাগল। দুর্গাপুজো পেরিয়ে গিয়ে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর শারদ পূর্ণিমায় ইমন রাগে বাউলাঙ্গের সুরে লিখলেন নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে, কয়েকদিন পর পরজ রাগে আমার যে কাছে আসে, যে যায় চলে দূরে, বাউল অঙ্গের আরেকটি গান তুই কেবল থাকিস সরে সরে। লেখালিখির পাশাপাশি শান্তিনিকেতনের পড়ে থাকা কাজ জোরকদমে শুরু করে দিলেন। 

তেরোই নভেম্বর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিশেষ অধিবেশনে কবিকে সাম্মানিক ডি লিট উপাধি দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হল। তার দুদিন পর, সেদিন বৃশ্চিক সংক্রান্তি, আগের দিন পূর্ণিমা ছিল, কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর পরের পূর্ণিমা, কবি বসে আছেন শান্তিনিকেতনে তাঁর নিজস্ব কক্ষে। কে এসে খবর দিল পিওন এসেছে তাঁর নামে এক টেলিগ্রাম নিয়ে। প্রতিদিন গোছা গোছা চিঠি আসে কবির নামে, কিন্তু টেলিগ্রাম শুনলেই এখনও মন অস্থির হয়ে যায়। আবার কি কোন অশুভ খবর? স্ত্রী, কন্যা রাণী, কনিষ্ঠ পুত্র শমীর অকালে মৃত্যু হয়েছে। আর কত সহ্য করবেন তিনি?

বাইরে এসে সই করে টেলিগ্রাম নিলেন তিনি। মুহূর্তেই তাঁর মুখের অভিব্যক্তি পালটে গেল। এ যে অভাবনীয়। টেলিগ্রামে আগের দিন অর্থাৎ চোদ্দই নভেম্বরের তারিখ। দুই লাইনের টেলিগ্রামে লেখা – সুইডিশ অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডেড ইউ নোবেল প্রাইজ লিটারেচার প্লীজ অয়্যার অ্যাক্সেপ্টেশন সুইডিশ মিনিষ্টার। 

এশিয়া মহাদেশে প্রথম কেউ এই সম্মানে সম্মানিত হতে চলেছে, তাও পরাধীন জাতির একজন হিসাবে। বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথের মন তোলপাড় হতে লাগল। এ কি সত্যি! ধীর পায়ে উঠে গেলেন তিনি নিজের ঘরে। এক অদ্ভুত আনন্দে তাঁর প্রাণমন উদ্ভাসিত হয়ে যাচ্ছে, কার সঙ্গে ভাগ করে নেবেন এই আনন্দ? আশেপাশে লোকের অভাব নেই, কিন্তু হঠাৎ যেন নিজেকে একা বোধ করতে লাগলেন। দেয়ালে একের পর এক সারি সারি তৈলচিত্র। দাদামশাই, বাবামশাই, যুবতী মায়ের ছবি, মৃণালিনী। এঁদের সবাইকে ফেলে তিনি গিয়ে দাঁড়ালেন তাঁর বাল্যের খেলার সাথীর ছবির সামনে। দু চোখ বোঁজা, মনে মনে বললেন, দেখো, নতুন বৌঠান, এরা আজ আমাকে কত বড় সম্মানটা দিচ্ছে। তোমার জন্যেই তো এত কিছু। তবে কিসের অভিমানে তুমি সব ছেড়ে চলে গেলে? কেন আজ আমার এই আনন্দের দিনে তুমি নেই?

বাহান্ন বছর ধরে পৃথিবীর অনেক রূপ-রস দেখেছে তাঁর চোখ, সয়েছে অনেক অপ্রত্যাশিত দুঃসহ বেদনা। আজ এই আনন্দের দিনে সেই চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ল অঝোরে। 

(ক্রমশঃ)

[কৈফিয়ৎ - যা শুরু করি, অনেক সময় তাতে সাময়িক বিরতি দিতে হয়। গীতার অনুবাদ শুরু করেছিলাম ছড়ায়, একশো শ্লোকের অনুবাদের পর সেটা থেমে আছে। 'আপনাকে এই জানা আমার' বলে আত্মজীবনীমূলক সুলুক-সন্ধান, সেটাও গোটা আটেক এপিসোডের পর আটকে গেল। আর এই 'অনন্ত জীবন' শুরু করেই মুখ থুবড়ে পড়ল। 

পড়ুক। যে কাজটা যখন করা উচিৎ, তার আগে বা পরে করলে অনেক সময় তা অর্থহীন হয়ে যায়। যে সব মনীষীদের চরণস্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়নি বলে স্রষ্টাকে ধমকাই, তাঁদের কিছু কথা যথাযথ সময়ে শোনানোর সুযোগ পাওয়াও তো কম ভাগ্যের নয়। যে মানুষটা জন্মেছিলেন বলে আজ আমি ও আমার মত আর পাঁচজন রসায়নের ছাত্র 'করে খাচ্ছি', সেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সার্ধশতবার্ষিকী চলে গেল সামনে দিয়ে, অঞ্জলি দেওয়া হয় নি। এই রকম ভুল বার বার না হয়, সে জন্যেই এ লেখাটার শুরু...]