সোমবার, ২৯ অক্টোবর, ২০১২

ভুলিনি ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

ভুলিনি

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়


বেশ একটা পুজো পুজো মরশুম। মা দুগ্‌গা সবে বাপের বাড়ি থেকে কৈলাসের পথে পা বাড়িয়েছেন। বিজয়ার মিস্টিমুখ চলছে। লক্ষ করেছি, বেশী মিস্টি খেলে, স্বভাবও খানিকটা মোলায়েম হয়। গতকাল এক দাদা এসেছিলেন। ছুটির সকালে বেশ নাড়ু নাড়ু মুখ করে আড্ডা দিচ্ছি। দাদা বই টই নিয়ে চর্চা করেন। তাঁর কাছেই খবর পেলাম, ১৯৪৬-৪৭ সালে অমৃতবাজার পত্রিকায় তৎকালীন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে যে সব লেখা বেরিয়েছিলো, তার একখানা সংকলন বেরিয়েছে। ওই দু বছর কেন? তার আগে বা পরেও তো কতকিছু ঘটেছে, বা ঘটছে। শুধু ওই দুটো বছরকে ধরে টানাটানি কেন বাবা?


ভাবতে গিয়ে দেখলাম, আমাদের পাঠ্যবইতে (স্কুলের বই মশায়, তার পরে আমার বিদ্যে খুব বেশীদুর যায়নি। আর এই বাবদে আমি কিন্তু এদেশে সংখ্যাগুরুর দলে) এই দু বছরের ইতিহাস বলে যেটা লেখা হয়, সেটার সঙ্গে করিনা কাপুরের বেশ মিল আছে। দুজনেই সাইজ জিরো। ফাজলামো থাক, এমনিতেই আমি যাই লিখি, সেটা ফাজলামো টাইপ হয়েই যায়। যাই হোক, সরকারি ইতিহাস নিশ্চুপ। সংবাদ মাধ্যম নিশ্চুপ না হলেও কিছু ঘটনা (দেশভাগ) নিয়ে বড্ড বেশী ব্যতিব্যাস্ত, আর বাকি গুলো নিয়ে মোটেই সময় পায় না কথা বলার। কাজেই, আস্তে আস্তে যেন অনেক কিছুই মানুষ ভুলতে শুরু করেছে। এই পোড়া দেশের ইতিহাস, বেশিটাই বড়-মানুষ, রাজা-রাজড়া, নেতা-নেতৃবৃন্দের ইতিহাস। সাধারন মানুষের স্থান বড় কম ইতিহাসে। ঔরঙ্গজেব সারা জীবনে কতগুলো যুদ্ধ করেছিলেন, সেটা আপনি এক লহমায় বলে দেবেন। কিন্তু সেই আমলে সাধারন মানুষের আর্থিক অবস্থা কেমন ছিলো, সেটা একটু মাথা চুলকোনোর বিষয়। সে আমলে গোটা পৃথিবীর উৎপাদনের ২৫.১% উৎপন্ন হতো এই ভারতে [Madison, Angus (2006). The world economy, Volumes 12. OECD Publishing. p. 638. ISBN 92-64-02261-9.] আকবরের আমলে দেশের আয় পৌঁছয় ১৭.৫ মিলিয়ন পাউন্ডে, আর সেই যায়গায় পৌঁছতে গ্রেট বৃটেনের লাগে আরো ২০০ বছর, তাও অর্ধেক ভারত সমেত বাকি দুনিয়ার বেশকিছুটা পকেটে পোরার পরে


তা সে যাই হোক। ফিরি ১৯৪৬-৪৭ এ। এই নাম দিয়ে জীবনানন্দ দাশের একখানি কবিতা আছে। মুশকিল হলো, এসব কবিতা ঠিক সুবিধের না। তাই কবি কে বনলতায় বেঁধে রাখাই ভালো। এরকম ভাবে যে কতকিছু বাঁধা পড়ে আছে। এই ধরুন না ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। বৃটিশ সিংহ অ্যায়সা ঝাড় খেয়েছে বাঁটকুল জাপানী আর গোঁয়ার জার্মানদের হাতে, যে নিজেদের দ্বীপে ফিরে গিয়ে আহত জায়গা গুলো ভালো করে চাটতেও পারছে না। ওদিকে সাইলকের বাপ, সাগরপার থেকে হাওয়া বাতাস জলপটি দিয়ে কোনক্রমে সিংহকে বাঁচিয়ে রেখেছে আর ভাবছে, নেহাত মাথামোটা কাঠগোঁয়ার স্তালিনটা ছিলো, না হলে হিটলুদা প্রায় তেরোটা বাজিয়েই দিয়েছিলো। আমাদের দেশে একটা তালগোল পাকানো অবস্থা। একটা করে মিটিং হয়, আর কংগ্রেস-লীগের কাজিয়া বাঁধে। সমাধান কিছু এগোয় না। ওদিকে নেতাজীর আজাদি সৈনিকদের বিচার চলছে লাল কেল্লায়। সাধারন মানুষের মনে ধোঁয়াসা। কারা এরা? ফ্যাসিস্ট পঞ্চম বাহিনী? না কি অন্য কিছু? যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ভারতীয় বাহিনীর সিপাহীরা দেশে ফিরেছেন।তখনো সেনাবাহিনী পুরোদস্তুর যুদ্ধসাজে। যদি স্তালিন পশ্চিমে পা বাড়ান? কিম্বা পুবে? কামানের খাদ্য তৈরি রাখা ভালো। তা, সে প্রস্তুতি তখনো তুঙ্গে। লোকাভাবে নিতান্ত বাধ্য হয়ে কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয়দের আধুনিক যুদ্ধবিদ্যা সম্পর্কিত কারিগরী সেখানো হতে লাগলো। এতকাল স্রেফ রাইফেল হাতে কামানের খাদ্য হয়েছে ভারতীয় সেপাই, আর গাদা গাদা যুদ্ধের মেডেল পরে ব্রিটিশ অফিসারকূল নিজের বিবেক ঢেকেছে। আজ তাদেরই কিছু ক্ষেত্রে রাইফেল এর থেকে একটু এগিয়ে সামান্য কিছু আধুনিক কারিগরী সেখানো শুরু হলো। যদিও যুদ্ধের কয়েক বছর আগে থেকে, বাছাই করা কিছু অভিজাত ভারতীয় পরিবারের সন্তান ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু সে সংখ্যা ছিলো নগন্য। প্রথমদিকে এনারা সবাই শিক্ষা লাভ করতেন ইংল্যান্ডে, স্যান্ডহার্স্টে। পরে দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে এনারা ঢুকতে থাকেন। শিক্ষায় এবং আচারে এনারা কাছাকাছি ছিলেন ব্রিটিশ অফিসারদের, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারন সিপাহীদের প্রতি এনাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যবহার শ্বেতাঙ্গ অফিসারদের থেকে আলাদা কিছু ছিলো না। 


নৌ-বাহিনীর সংকেত আদানপ্রদানের জন্য দরকার হয় দক্ষ সিগনালার। ১৯৪৬ সালের ১৬ই জানুয়ারি ৬৭ জন নৌবাহিনীর নাবিক এসে উঠলেন মুম্বাই এর ক্যাসল রোডস্থ মিলিটারি ব্যারাকে। মুম্বাইয়ে এইচ এম আই এস তলওয়ার ট্রেনিং জাহাজে শুরু হলো শিক্ষার কাজ। নিয়ম মতো শিক্ষা এগোচ্ছিলোকিন্তু এতদিনের অশিক্ষিত মাল্লারা হঠাৎ মিলিটারি টেকনিশিয়ান হয়ে উঠবে, এটা ঠিক সবার কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে ওঠেনি। পুর্বতন অফিসারদের ব্যবহার রইলো আগের মতোই, বরং আরো খারাপ হতে লাগলো। কায়েমি স্বার্থকে ছাড়তে কে চায় বলুন? অসন্তোষ বাড়ছিলো ভারতীয় নৌ-সৈনিকদের মধ্যে। ১৮ই ফেব্রুয়ারির শুরুটা হলো আপাত নিরীহ ভাবে। খাওয়া এবং রান্নার চুড়ান্ত খারাপ অবস্থা নিয়ে নাবিক সৈয়দ মকসুদ বুখারি তাঁর অফিসারের কাছে অভিযোগ জানান। অফিসারের এই অভিযোগ পছন্দ হয়না, এবং সৈয়দ মকসুদ বুখারি অফিসারের কাছে যাহারপরনাই অপদস্থ হন। জাহাজের বাকি নৌ-সৈনিকরা প্রতিবাদ জানালেন, কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করলেন এবং অনশনে সামিল হলেন। আজ্ঞেঁ হ্যাঁ, সেনাবাহিনীতে ধর্মঘট, অনশন ধর্মঘট। দাবী খুব সামান্য, রান্না এবং খাওয়ার সুব্যবস্থা, এবং দুর্ব্যবহারের জন্য দুঃখ প্রকাশ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ধর্মঘট ছড়িয়ে পড়লো। গোটা জাহাজের হাজার খানেক নৌ-সৈনিকের মধ্যে মাত্র সতের জন রাত্রের খাবার নেন। বাকিরা বয়কট করেন, এবং খাবার উপযোগী খাদ্যের দাবীতে অটল থাকেন।


অফিসাররা বেয়াদপি বরদাস্ত করেননি। কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হতে থাকে, কিন্তু এতে হিতে-বিপরীত হয়। ১৯শে ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট চেহারা নেয় বিদ্রোহের, এবং তা অন্যান্য জাহাজে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, এমনকি অন্য শহরেও। করাচি শহরের উপকন্ঠে মানোরা দ্বীপে নোঙর করে থাকা হিন্দুস্তান, বাহাদুর ইত্যাদি জাহাজগুলো বিদ্রোহে সামিল হয়। ওই ১৯শে ফেব্রুয়ারি তারিখেই ধর্মঘটি নাবিকরা গঠন করলেন কেন্দ্রীয় কমিটি, যাতে করে বিভিন্ন জাহাজের বিদ্রোহীদের মধ্যে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়। কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব দিলেন সিগনালম্যান এম এস খান এবং পেটি-অফিসার মদন সিং। কমিটি নিজেদের বলতে থাকেন ভারতীয় নৌবাহিনী, এবং উর্ধ্বতন অফিসারদের বাঁ হাতে স্যাল্যুট জানাতে থাকেন। পরের দিন মুম্বাইয়ের ক্যাসল রোড এবং ফোর্ট ব্যারাকের নাবিকরাও বিদ্রোহের সমর্থনে এগিয়ে এলেন এবং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ছবি ও  আজাদ হিন্দ বাহিনীর ঝান্ডা উড়িয়ে দিলেন, সঙ্গে উড়লো লীগ, কংগ্রেস এবং কম্যুনিস্ট পার্টির ঝান্ডা, একই সঙ্গে, একই লাঠি তে বেঁধে। সেই দিনই, মুম্বাইয়ের বিভিন্ন জাহাজের হাজার হাজার নৌ-সৈনিক যোগ দিলেন বিদ্রোহে। রাত পোহাতে না পোহাতে খবর এলো বিশাখাপটনম, করাচি এবং কোচি থেকে। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে বিদ্রোহ। এইচ এম আই এস তলওয়ার জাহাজ থেকে বেতারের মাধ্যমে সমস্ত শহরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছিলো, এবং সৈনিক সুলভ কুশলতায় বিদ্রোহীরা শৃংখলা রক্ষা করছিলেন। খবর চাপা দেবার চেষ্টা হয়ত হয়েছিলো, কিন্তু শেষ পর্যন্ত খবর ছড়িয়ে পড়লো। মুম্বাই শহরের সাধারন মানুষ দলে দলে সামিল হতে শুরু করলেন বিদ্রোহী সৈনিকদের সঙ্গে। শুধু নৌবাহিনীই না, মুম্বাইয়ে বিদ্রোহে যোগ দিলেন বিমান বাহিনীর জওয়ানরাও। মুম্বাই শহর দাপিয়ে বেড়ালেন বিদ্রোহীরা, সঙ্গে সাধারন মানুষ। ফ্লোরা ফাউন্টেনের সামনে ডাক গাড়ি থামিয়ে সরকারি চিঠি পোড়ানো হলো। ব্রিটিশ সৈনিকদের সাধারন মানুষ ঘেরাও করে ধরে "জয় হিন্দ" ধ্বনি দেওয়ালো। কিন্তু কারোর গায়ে হাত দেওয়া হলো না। কোন ব্যক্তিগত সম্পত্তি লুঠের খবর নেই কোথাও। চার দিনের মধ্যে, গোটা মুম্বাই শহরের সমস্তকিছুর দখল নিল বিদ্রোহী কমিটি (মিল পাচ্ছেন? বিপ্লবী সামরিক কমিটিও দখল নিয়েছিলো একটি শহরের, পরে গোটা দেশের। জন রীডের লেখায় রয়েছে)ইতিমধ্যে গোটা দেশ উঠে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ বিষ্ময়ে দেখছে, ভারত শুধু আবেদন নিবেদন (পড়ুন দহরম মহরম) নয়, দরকার হলে তার রূদ্ররূপ ও দেখাতে পারে, যদিও অনেক উন্নততর চেতনায় উদবুদ্ধ হবার কারনে সেই রূদ্ররূপের সঙ্গে ফ্যাসিস্ট হিংসার কোথাও কোন মিল নেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, যে  সাধারন মানুষ এক সপ্তাহ আগে অবধি কখনো হিন্দু হয়ে কখনো মুসলিম হয়ে কখনো শিখ হয়ে একে অপরের মুন্ডুপাত করতে ব্যস্ত ছিলেন, তাঁরাই মুম্বাই এর রাস্তায় মিছিল বের করলেন একই ডান্ডায় কংগ্রেস, মুসলিম লিগ ও কম্যুনিস্ট পার্টির ঝান্ডা বেঁধে মিছিল করলেন, প্রথমে মুম্বাইয়ের রাস্তায়, পরে দেশের অন্য শহরগুলোতে। কাঁপতে লাগল কলকাতা থেকে করাচি। কোথায় গেলো দ্বিজাতি-তত্ত্ব? কোথায় গেল কংগ্রেস-লীগের বেইমানির রাজনীতি? কোথায় গেলেন গান্ধী-নেহেরু-জিন্না ?


২২শে ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সরকার মুম্বাই শহরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নামালেন। গোলা দাগা হলো ক্যাসল ব্যারাকের ওপর। ভারতীয় সৈনিকের ওপর আর ভরসা করা যাচ্ছে না। অন্য জায়গা ছেড়ে দিন, ভিন্ডি বাজারের মত এলাকায়, যা কিনা পাকিস্তান দাবীর অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি বলে চিহ্নিত করা হতো, সেখানে সদ্য মহাযুদ্ধ জয়ী মহাশক্তিধর ব্রিটিশ বাহিনী কে থামালেন বোরখা পরিহিত বাড়ির সাধারন মেয়ে বউরা। হাতের কাছে যা পেলেন, তাই নিয়ে আক্রমন চালানো হলো সাঁজোয়া গাড়িতে চাপা সরকারি সেনাদের ওপর। বাড়ির ছাদ থেকে, গলির ভেতর থেকে আক্রমন চালানো হলো ব্রিটিশ সেনাদের ওপর। কয়েক ঘন্টার তীব্র লড়াইয়ের পর সরকারি বাহিনী রনে ভঙ্গ দিলো। না মশায়, নিকারাগুয়া নয়, কিউবা নয়, ভিয়েতনাম নয়। উদ্ধত মিলিটারি বেয়নেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে বিদ্রোহী দামাল সৈনিক সন্তান ও ভাইদের রক্ষা করেছিলেন আমাদেরই ঘরের মা বোনেরা। কোথা থেকে এল এই সাহস? কে দিল নেতৃত্ব? কে সেখালো গেরিলা কৌশল? কেউ না। চেতনায় বিপ্লব যখন জেগে ওঠে, যুগ যুগ ধরে অপমানিত ব্যক্তি সত্ত্বা ও মানুষের অধিকারকে মুক্ত করার লক্ষে, সেই বিপ্লবী চেতনাই সেখায় লড়তেমানুষ স্বাভাবিক ভাবেই বিদ্রোহী এবং প্রতিবাদী, বাকি শিক্ষা লুকিয়ে আছে আমাদের ভেতরে কোথাওপথে নেমে লড়তে শিখেছেন মানুষ। মরেছেন, কিন্তু পিছু হঠেননি। সাবাশ বিদ্রোহী, সাবাস বিপ্লবী, ইনকিলাব জিন্দাবাদ।


আমাদের মহান দেশ-নেতারা তখন কি করছিলেন? যে শব্দ সমস্টি মানসপটে ঘোরাফেরা করছে, সেটা লিখলে পুলিসে ধরবে। তাই ওই নেতাদের পরিশীলিত ভাষারই শরনাপন্ন হই। সেই সময় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং বাকি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা সতর্কভাবে পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছিলেন। এ ছাড়া কিছুই করেন নি। গান্ধী বলে বসলেন, এই বিদ্রোহীরা লুটেরা এবং এরা অরাজকতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এদের উচিত এখুনি বিদ্রোহ থামানো। যদি রাজনৈতিক আন্দোলন করতেই হয়, তাহলে তার পন্থা আছে, নেতা আছে, দল আছে। সেখানে তাদের সঙ্গে মিলে আন্দোলনে যাওয়া উচিত। হা হতস্মী, ভুখা বে-ইজ্জ্বত বিপ্লবী সিপাহীকে গান্ধী "টুপি" পরানোর চেষ্টা? অনেক চেষ্টায় তারা ব্রিটিশের টুপি খুলেছে, আর একটা পরতে আর রাজি নয় কেউ। নেতাদের মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়ে রইলেন অরুনা আসফ আলী। মুম্বাইতে দাঁড়িয়ে তিনি খোলা গলায় সমর্থন জানালেন বিদ্রোহী সৈনিকদের। স্পস্ট ভাষায় জানালেন, এই চরম দুঃসময়ে, যখন দেশের মানুষ বিভ্রান্ত এবং নেতারা মেতেছেন দেশকে টুকরো করার খেলায়, তখন এই বিপ্লবী চেতনায়, সাধারন মানুষ আবার এক হয়েছেন। নিজের পরিচয় খুঁজে পাচ্ছেন ভারতীয় হিসেবে। হিন্দু বা মুসলিম হিসেবে নয়। তাঁর ভাষায় "হিন্দু এবং মুসলিমরা সাংবিধানিক পথে নয়, এক হোক ব্যারিকেডে" ("would rather unite Hindus and Muslims on the barricades than on the constitutional front")দেশ তখন ফুটছে উত্তেজনায়। এ বিদ্রোহ আর শুধু খারাপ খাবার আর ব্যবহারের প্রতিবাদ নয় আর, এ বিদ্রোহ শুধু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নয়। এ বিদ্রোহ সমাজের সমগ্র প্রতিক্রিয়াশীল অংশের বিরুদ্ধে, যার অংশ একদিকে যেমন ব্রিটিশ শাসক, অন্যদিকে দেশের প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব, যারা নিজেদের বহু আগেই বিকিয়ে দিয়েছে কায়েমি স্বার্থ আর বেনিয়ার কাছে। ধ্বংশ হোক প্রতিক্রিয়াশীল শাসক। মুক্ত দেশে, মুক্ত সমাজে জন্ম নিক নবীন ভারতবর্ষ।


সাধারন মানুষের ঝোঁক দেখে পা ফেলতে হয়। এটা ভারতের পাকা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী মাত্রই জানেন, এবং মানেন (গান্ধীই হোন বা আমাদের বর্তমান "জননেত্রী"পাবলিক সেন্টিমেন্ট যেদিকে, ওনারাও সেদিকে। সুনীল বাবুর শেষকৃত্যটাই মনে করুন)গান্ধী ঢোঁক গিলে বললেন, ব্যারিকেডের এক হওয়ার মধ্যে যদি সততা থাকে, তাহলে সাংবিধানিক পথেও নিশ্চই সেটা সম্ভব হবে। সুরে সুর মিলিয়ে একই কথা বললেন লীগ নেতৃত্ব। তাঁরাও বললেন, বিদ্রোহীদের এখুনি বিদ্রোহ শেষ করে বৃহত্তর আন্দোলনের পথে ফিরে আসা উচিত। ব্যারিকেডে মিলে গিয়ে এক হলেন হিন্দু-মুসলিম সাধারন মানুষ, আর অন্যদিকে বেগতিক দেখে এক হলেন নেহেরু-জিন্না-গান্ধী। ভারতের বিপ্লবী জনসাধারন যখনই নিজেদের মত করে আন্দোলনে যেতে চেয়েছে, ভারতীয় নেতারা তখনই বিপ্লবী জনসাধারনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। বার বার করেছেন। ১৯২৭ সালে এই ভাবেই থামিয়ে দেওয়া হয়েছিলো অসহযোগ আন্দোলন। ভারত-ছাড়ো আন্দোলনেরও সেই একই দশা হয়। পেছন থেকে নেতারা ছুরি না মারলে হয়ত এই ভাবে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগটা ঠেকানো যেত। এবারেও নেতারা পাশে দাঁড়ালেন না বিপ্লবী ভারতের। আবার সমর্থনের বহর লক্ষ্য করে সরাসরি বিরোধীতাও করতে পারলেন না। চেষ্টা করতে লাগলেন, কোনক্রমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যদি শান্ত করা যায় বিদ্রোহকে।     


বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়তে লাগলো গোটা দেশে। চেন্নাই (তখন মাদ্রাজ), কলকাতা, তিরুচিরাপল্লী, করাচি এবং আমেদাবাদে দেখাদিলো রাস্তায় রাস্তায় মিছিল ও ব্যারিকেড। কংগ্রেস, লীগ ও কম্যূনিস্ট ঝান্ডা একসঙ্গে উড়িয়ে সভা হতে লাগলো। ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ জ্বলে উঠল মাদুরাই, কানপুর সহ আরো অনেক গুলো শহর। ২৬ তারিখে সেই আগুন গিয়ে পৌঁছলো সুদুর আসাম পর্যন্ত। ভারতবর্ষ বিদ্রোহকে সমর্থন জানালো খোলা গলায়। গোটা দেশের মানুষ সামিল হলেন ধর্মঘট, মিছিল আর ধর্নায়। রাস্তায় রাস্তায় দেখা দিলো ব্যারিকেড, ঢুকতে দেওয়া হবেনা সরকারি ফৌজ, ব্যারিকেডে উড়তে লাগলো লীগ-কংগ্রেস-কম্যুনিস্ট ঝান্ডা। কেঁপে উঠলো দেশ। কেঁপে উঠলো শাষক। কিন্তু সেই ভারতীয় নেতারা, যাঁরা না থাকলে, আমাদের ইতিহাস বইতে, ব্রিটিশ রাজ নিয়ে হয়তো অধ্যায়টা হতো অনেক ছোট, তাঁরা এগিয়ে এলেন সামাল দিতে। বল্লভভাই প্যাটেল সহ কংগ্রেস নেতারা বোঝালেন, তাঁরা দেখবেন যেন শান্তিপুর্ন সমাধানের পথে যাওয়া যায়। লীগ নেতারাও একই পথ অনুসরন করলেন। বোঝানো শুরু হলো বিদ্রোহী সৈনিকদের। তাঁরা যোদ্ধা, গুলি নিতে জানেন বুক পেতে, কিন্তু কুটীল ফন্দিবাজ নেতাদের সঙ্গে লড়াইয়ের কায়দা কানুন তাঁদের অজানা। আস্তে আস্তে কথায় ভুলতে শুরু করলেন। বন্ধ করলেন প্রতিরোধ। উঁচিয়ে থাকা কামান গুলো নিচু হয়ে এলো বিদ্রোহী জাহাজগুলোর। রাতের অন্ধকারে সরকারী সেনারা ঘিরে ফেললো নৌ-সৈনিকদের। গ্রেফতার হলেন সকলে।


এর পরবর্তি ইতিহাস খুব সংক্ষিপ্ত। সেনাবাহিনীর বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেন বিদ্রোহী কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও আরো বহু সৈনিক। সাজা খুবই সহজ-সরলবেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফাঁসি। কিছু ক্ষেত্রে ফায়ারিং স্কোয়াড। আমরা খুব একটা ভালো করে জানিও না সেই তথ্য। শুধু জানি, তাঁরা হারিয়ে গেলেন। চিরকালের মত। বাকি সৈনিকদের বরখাস্ত করা হলো। এই বরখাস্ত হওয়া সৈনিকদের কাউকে "স্বাধীন" ভারত বা পাকিস্তানে সেনাবাহিনীতে স্থান দেওয়া হয়নি। কারন এনারা নাকি "বিশ্বাসঘাতক"। লক্ষ্য রাখুন ২৫ শে মার্চ প্রকাশিত সরকারের একটি গোপন ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টের দিকে। যা প্রায় ৫০ বছর পর প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে -  "ভারতীয় সেনাবাহিনি, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনী আর বিশ্বাসযোগ্য নেই, এবং এখন কেবল মাত্র দিনের দিন বাহিনীর প্রস্তুতি মাপা সম্ভব, তার বেশী নয়যদি ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের মত বড় ধরনের কোন বিদ্রোহাত্মক আন্দোলন দেখা দেয়, তাহলে শুধুমাত্র ভারতীয় সেনাদের ওপরে আর ভরসা করা সম্ভব নয়। টাইগার লিজিয়ন (জার্মানিতে আজাদ হিন্দ বাহিনী), আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং নৌ-বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা সেটাই সমর্থন করে।"   ("the Indian army, navy and air force units were no longer trust worthy, and, for the army - only day to day estimates of steadiness could be made. It was decided that; if wide-scale public unrest took shape, the armed forces (including the air force- for Quit India had shown how it could turn violent) could not be relied upon to support counter-insurgency operations as they had been during the Quit India movement of 1942, and drawing from experiences of the Tiger Legion, INA and the Navel Mutineers, their actions could not be predicted from their oath to the King emperor.") ক্লেমেন্ট অ্যাটলি, তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রি, অনেক কারন দেখিয়েছিলেন পরের বছর ক্ষমতা হস্তান্তরের (স্বাধীনতা বলে মানেন এটাকে? নিজেকে প্রশ্ন করুন) সময়। কিন্তু সবচেয়ে বেশী জোর দিয়েছিলেন ভারতীয় ফৌজের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যাওয়াতে, যার পেছনে ছিলো নেতাজীর আজাদি ফৌজের হাত, এবং শেষে নৌবিদ্রোহ ব্রিটিশ ভারতীয় ফৌজের বিশ্বাসযোগ্যতার কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে দেয়।


১৯৪৬ এর নৌবিদ্রোহ আমাদের এক গৌরবের ইতিহাস। একই সঙ্গে লজ্জারও। সেই নেতারাই আমাদের শাসন করেছেন, করছেন। সেই লজ্জা। আর গৌরব? সেই রং ফিকে হবে না। দেবেন না ফিকে হতে। সলিল চৌধুরি গান বেঁধেছিলেন সেই বিদ্রোহ নিয়ে - "ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, আলো ফুটছে..."হেমাঙ্গ বিশ্বাস এবং গননাট্য সংঘ ঝাঁপিয়ে পড়েন বিদ্রোহের সমর্থনেউৎপল দত্ত ১৯৬৫ সালে লেখেন বিখ্যাত নাটক কল্লোল, ওই নৌবিদ্রোহের ওপরেই লেখা। সে নাটক নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন তৎকালীন কংগ্রেসী পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মিনার্ভা থিয়েটারে ঢুকে কংগ্রেসী গুন্ডারা হামলা চালায়। উৎপল দত্ত কারারুদ্ধ হন নাটক লেখার অপরাধে। ব্যস, এই পর্যন্তই। আর কিছু নেই। মুছে দেবার চেষ্টা কিন্তু আছে। দেখো ভারতীয়রা, কখনো তোমাদের পিতৃ-পিতামহ বিপ্লবাত্মক আন্দোলন করেনি। আমরা যেমন বলেছি, তারা চলেছে। তোমরাও তাই করো। সংস্কৃতি তোমার কাছে হোক কোঁচানো ধুতি পরা বাবু কালচার। ভুলে যাও অগ্নীযুগ, ভুলে যাও আজাদি ফৌজ ভুলে যাও নৌবিদ্রোহ, ভুলে যাও তেভাগা, ভুলে যাও তেলেঙ্গানা। এসব ছিলোনা তোমার।


ভুলে যাবেন না পাঠক। ভুলে যেতে দেবেন না। কেন লিখলাম এরকম একটা সৃষ্টিছাড়া লেখা? যাতে না আছে সুনির্দিষ্ট কোন ঐতিহাসিক তথ্য, না আছে কোনো সুনির্দিস্ট বার্তা, না আছে কৌতুক। কিস্যু নেই। শুধু পাবেন নিজের কিছু যন্ত্রনা, অক্ষমতা আর জ্বালা। যা ঠিক সাজিয়ে বলার ক্ষমতাও নেই আমার। ক্ষমা করবেন পাঠক। আশা করিনা কখনো এগুলো বিস্তারিত এবং নিরপেক্ষ ভাবে কোনদিন স্কুলের পাঠ্যসূচি তে আসবে। আসা করি না এ নিয়ে ভালো ছবি হবে। তবে আশা রাখি, এ নিয়ে লেখা হবে। যাঁরা এখনো মানুষের কথা ভাবেন, ফেব্রুয়ারির ওই কটা দিন স্মরন করবেন। কল্লোল নাটকের ছোট রুপান্তর করে, কম বয়সি কিছু তাজা ছেলে মেয়ে পাড়ায় পাড়ায় পথনাটিকা করবে। ১৯৪৬ এর জ্বলন্ত দিনগুলোর দাবী যে আজো তেমনই প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। পরিশেষে সেলাম জানাই নাম না জানা শহীদ বৃন্দকে, যাঁরা সবকিছু দিয়ে গেলেন, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন। ভুলতে পারবোনা কিছুতেই। ইনকিলাব জিন্দাবাদ। 

শুক্রবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১২

চলো যাই ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

চলো যাই

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

 

আগের রাজ্য-সরকার টা ছিলো অপদার্থ

মানুষ ভুগেছে বন্যা,খরা আর

শিল্পায়নের ঝোঁকে।

তখন বিরোধীপক্ষ ,

বেসরকারী বলে ছিলো দায়হীন,

খবরে প্রকাশ।

হাত মুঠো করে বিপ্লবী ধমক দিতো,

"বাপ রে, কি তেজ!!"

 

এখন, এই সময়টায়, আজ,

শান্তিতে বসবার দিন নয় মোটে

সকালেই বেরোতে হবে অনেকটা দূর

রাই তুমি বানভাসী মালদহে যেও

আমার ভাগ্যে থাক বাঁকুড়ার খরা

 

 

 

বুধবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১২

ভ্যালেন্তিনা সেরোভা কে (বাংলায় অনুবাদ – সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়)


ভ্যালেন্তিনা সেরোভা কে
কন্সতান্তিন সিমোনোভ
(বাংলায় অনুবাদ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়)

প্রতিক্ষায় থেকো, আমি আসবই ফিরে
প্রতিক্ষায় থেকো, হৃদয়ের গভীরে
প্রতিক্ষায় থেকো, যখন বৃষ্টির ফোঁটা
বলে "প্রতিক্ষার কুয়াশা শেষ ভোরের শিশিরে"
প্রতিক্ষায় থেকো, প্রখর দাবদাহে, যখন গ্রীষ্মকাল
প্রতিক্ষায় থেকো,যখন তুষারে ঢাকা দিকচক্রবাল
প্রতিক্ষায় থেকো, যখন গতকাল হবে, আগামীরা অন্তে
প্রতিক্ষায় থেকো, যখন আমার খোঁজ নিয়ে দিগন্তে
কোন ডাকহরকরা দেখা দেবে না
প্রতিক্ষায় থেকো, যখন বাকিরা বলবে
"ও মানুষ টা আর বেঁচে ফিরবে না"

প্রতিক্ষায় থেকো, আমি আসবই ফিরে
প্রতিক্ষায় থেকো, প্রত্যাশী শরীরে,
যখন সবাই বলবে তোমাকে
"মন থেকে ওকে মুছে ফেলো"
আমারই কাছের মানুষজন বলবে-
"আর আশা নেই, এবার মানুষটাকে ভোলো"
বন্ধুরা হাল ছাড়বে একে একে,
লাভ ক্ষতি দেনা পাওনার হিসেব কষা হবে
তিক্ত সুরার স্বাদের সঙ্গে
স্মৃতিটুকু শুধু ধুলোমাখা ছবি হয়ে যাবে
প্রতিক্ষায় থেকো, সুরার পাত্র দিও ফিরিয়ে
প্রতিক্ষায় থেকো, আমি ফিরবই স্বশরীরে

প্রতিক্ষায় থেকো, আমি আসবই ফিরে
ধ্বংসের গদ্যকে জীবনি-ছন্দে ভরে।
ওরা বলবে "ভাগ্যি আপনার মশায়"
যারা ফিরলনা, তাদের সঙ্গে তুলনায়।
কেউ বুঝবেনা তারা সূচরিতাষু
আমাকে ফিরিয়ে আনবে তোমার প্রতিক্ষা -
প্রতিটি মুহুর্ত বলছে আমাকে কানে কানে
"প্রতিক্ষায়" আছো তুমি,
শুধু আমিই জানি এই অপেক্ষার মানে।

Wait for me (Жди меня), written by the Soviet poet and playwright turned war correspondent, Konstantin Simonov, is one of the best known World War II poems.

It was written by Simonov in 1941 after he left his love Valentina Serova behind to take on his new duties of war correspondent on the battlefront.

শুধু কবিতার জন্য ~ অনামিকা

শুধু কবিতার জন্য
----------------------

তার বিবাগী চলন ছিল আমার পাড়া জুড়ে।
কুড়িয়ে নেওয়া শব্দমালা শুকোতো রোদ্দুরে।
আল্পনার ভেতরে আঁকা বোহেমিয়ান ছক ...
পিপাসা পেলে ঠোঁটে তুলত আগুন হেমলক

ভেসে যাবার ডাক শুনেছে সকালবেলা থেকে
তবু ভাষার হাত ছাড়েনি, বলেছে কাছে ডেকে
... শুধু মাত্র কবিতাতেই লগ্ন হয়ে আছি।
এক জীবন বাঁচলে যেন কবিতা হয়ে বাঁচি।

আগলহীন ভালোবাসায় আলোর মত মিশে
ঝঞ্ঝা ঝড়ে দুর্বিপাকে কলম ছাড়েনি সে।
শোকে পাথর বর্ণমালা দুচোখে এঁকে নিক
নিঃশব্দে ফিরে চলেছে শব্দসৈনিক।

পেছনে পড়ে থাকুক কাদা, আগুন আর জলও।
বাঁচার কথা বলতো, ওকে সেই কথাই বলো!
তার দুপাশে সামনে পিছে জড়ানো ইতিহাস
বেঁচে থাকার ... ভালোবাসার সমূহ নির্যাস।

এই সে'দিনও নীললোহিত ... আমার পাড়া জুড়ে।

শনিবার, ২০ অক্টোবর, ২০১২

শোনো সৌদামিনী ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী


বিদ্যুৎলতা শোনো,
এইখানে ... এই ঘরে ... এসো না কখনও! 

জানালার শার্সি ভাঙ্গা, আরসিতে কুয়াশার দাগ ...
সিন্দুকে মলিন ধূলো চাপা পড়ে রয়েছে যে সোনা,
হয়তো তোমারই দেওয়া ...
তবু শোনো, এখানে এসোনা!

বেসিনে বমির ছিটে। গতরাত্রে তরল আগুন
দাপাদাপি তীক্ষ্ণদাঁতে চেতনা খেয়েছে।
স্বীকার করতে হবে, যার যেটা গুণ ...
প্রত্যেকেই পারঙ্গম, এমনকি তুমিও
আগুনের কোল পেতে নির্বিকার বলেছ ... "ঘুমিয়ো"

এই যে আমাকে দেখছ,
কিছুটা গোঁয়ার, কোনও নির্দেশে থামিনা ...
এটা কিন্তু আসলে আমি না!

কোটি কোটি অর্বুদ ভিতু আর বোকা অনুপ্রাণী
একা একা বেঁচে থাকা অসম্ভব জেনে আশাহত, হয়নি তবুও!
ভাগ করে নিল কাজ ... রেচন জনন
গাঢ় রক্ত চলাচল, মন্দ্রিত মনন!
যৌথখামার এক ... এ শরীর নেহাত্ই কলোনি!
অভিশাপ বাক্য যত, জেনে রাখো, ওদের বলেছ ...
কোনও দিনই ... আমাকে বলোনি!

মহামারী উল্কাপাত যুদ্ধ ঝড় ... ইতিহাস ... বোবা সাক্ষী থাকে,
অভিশাপ ছুঁইনি তাই, বিশালাক্ষি আমিও তোমাকে,
নালন্দা তক্ষশীলা নদীতীরে সমুদ্রে গুহায়
স্থাপন করেছি নির্দ্বিধায়।

মেঘের নিবাস ছেড়ে ,ভুল করে ... যদি ঘরে আসো সৌদামিনী ...
দেখে যেও বেঁচে আছি।
অন্বেষণ করে যাচ্ছি ... এখনও থামি নি

শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১২

আয় ফজল আল গুলো কেটে ফেলি ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

আয় ফজল আল গুলো কেটে ফেলি

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

 

মেঘ নেই, মেঘ করেনি,

এ বছর বৃষ্টি আসবে না।

এবার ধান জমি, কচি ধান,

হাঁটু জলে ভাসবে না।

আকাশে মেঘ নেই,

জল নেই, প্রান নেই।

তবু আছে।

রক্ত আছে, শুকনো জমি আছে,

পাড়াগাঁ আছে, আদিবাসী আছে,

মমতা-মাও-মার্ক্স আছে

জমি তে আল আছে।

জমি তে হাল নেই, হাল চলে না,

শুকনো মাটিতে শুধু

পেট ভরা খিদে জন্মায়।

 

জমিতে আল আছে,

আলের ওধারে,

ওটা ওর জমি, এটা আমার।

ওর ঈদের দিনে নতুন লুঙ্গি,

আমার পুজোয় নতুন জামা,

হচ্ছে না এবারে।

আল দিয়ে ভাগ করা গ্রাম,

পাশের গ্রাম, বাংলা,

তামাম মুলুক।

 

বৃষ্টি তে আল দেওয়া যায়নি কেবল।

রোদেও আল দিতে পারিনি আমরা।

এটা সত্যিই ব্যর্থতা।

অনেক বছর আগে কেউ বলত,

ঠিক আকাশের মত,

জমির আল থাকবে না।

যৌথ হবে সবকিছু, বৃষ্টির মত।

ও পেলে, আমিও পাবো,

আমরা সবাই পাবো।

 

আয় না ফজল তোর কোদাল নিয়ে

আয় না আল কাটতে থাকি।

একশ দিনের কাজ নেই? আমি দেব কাজ।

চল, কেটে ফেলি আল।

আকাশের মত, বৃষ্টির মত,

জমি আর ভাগ হবে না।

একশ দিনে সবাই আল কাটলে

ঠিক পৌঁছে যাবো দিল্লি।

ওখানে এখন বন্যা হচ্ছে।

এদেশ কৃপন নয়, কোথাও না কোথাও

ঠিক দিয়েছে, প্রয়োজনের চেয়ে ঢের বেশি।

 

আল না থাকলে, সে বানের জল

আটকাবে কিসে?

জল ছড়িয়ে পড়বে গোটা মুলুকে,

আমাদের বাংলাতেও আসবে।

জল আসবে, ধান হবে, জামা-লুঙ্গি হবে।

আমরা নবান্নের দিন

খুব ধুমধাম করব স্বাই মিলে।

আয় ফজল, আল গুলো কেটে ফেলি।

 

বৃহস্পতিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১২

রেসিপি ~ অরুণাচল দত্তচৌধুরী

প্রথমেই জীবনটাকে লম্বালম্বি চিরে নিন। অনেককটা টুকরোয়। কটা টুকরো? গোনা বারণ। কারণ, এই রান্নাটা হিসেব মাফিক এগোবে না। হাতের কাছে সুবিধামত ধারালো ছুরি না থাকলে, মনে সাহস না থাকলে, ভুল করে জড়িয়ে ধরুন খুব নরম মায়াবী কাউকে। পেলবতার আড়ালে বাঁধন আলগা হলে বুঝে নেবেন শত টুকরো হয়ে গিয়েছে জীবন। 

এক নম্বর টুকরোটা কুচিকুচি করে চওড়া থালার ওপর শুকোতে দিন। একটু চোখের জল মাখিয়ে নিন। ওতে নুন থাকে। শুকোনোটা এক দিনে হবে না। অনেকদিন ধরে। প্রখর রোদে। একলা ছাদে। কার্নিসের পাশে। কাছেই তারের ওপর ভুলে যাওয়া শাড়ি হাওয়ায় দুলবে। তারপর, সেই কাঠশক্ত দানাগুলো পিষে নিতে হবে। পাউডারের মত মিহি করে। মিক্সিতে হবে না কিন্তু। শিলনোড়া চাই। 

এবার দ্বিতীয় টুকরোটা। তাকে ম্যারিনেট করুন ঝাল ঝাল ঈর্ষা , ট্যানজি পরশ্রীকাতরতা আর স্পাইসি পরনিন্দার কেচাপ দিয়ে। কতক্ষণ? রুচি অনুযায়ী। এবার সাঁতলে নিন। মৃদু উপেক্ষার আঁচে। সেদ্ধ হয়ে ক্রমশঃ শুকিয়ে আসবার মুখে, সামান্য সমবেদনার তেল ছিটিয়ে, কষে ফেলুন। বেশি তেল দেবেন না, সেটা কিন্তু স্বাস্থ্যবিরুদ্ধ। দেখবেন এমনিতেই এতক্ষণ ধরে কষে জিনিসটা দুষ্পাচ্যরকমের মুখরোচক হয়ে উঠেছে। 

পরের খন্ডটাকে ফিলের জন্য আলাদা করে রাখুন। উচ্ছ্বাসের কিম্বা হাহুতাশের অ্যারারুটগুঁড়ো মাখিয়ে, সেগুলোকে ভাজতে হবে, অতিথিরা আসার ঠিক আগে আগে। যাতে গরম গরম সার্ভ করা যায়, আনন্দ বা দুঃখের টপিং দিয়ে। স্ন্যাকস হিসেবে ওঁদের ভালোই লাগবে বোধহয়। 

এই ভাবে রান্না এগোতে থাকুক। জীবনের টুকরো তো অজস্র অগণন। তা' দিয়ে আরও নানা পদ ... সামোসা ... ভাজি ... নান ... ভর্তা ... দো পিয়াঁজা ... । নানা প্রনালী ... ভাপানো ... ভাজা ... ঘৃতপক্ক ... শূল্যপক্ক ... ডিপ ফ্রাই ... আপসাইড ডাউন ... বেক ... সিজানো ... । নানান অনুপান ... রায়তা ... সম্বর ... স্যুপ ... জ্যাম ... জেলি ... ব্র্যান্ডি। আপনার রান্না শেষই হতে চাইবে না। 
ইতিমধ্যে অতিথিরা এসে গেছেন। তাঁরা পৌরুষেয় ... রাজপুরুষ ... আমিষাশী ... শাকাহারী ... মাদমোয়াজেল ... শ্রীমতী ... বেগমসাহেবা ... পাতকুড়ানি ... উচ্ছিষ্টভোজী ... । 

আপনি তড়িঘড়ি সবাইকে যথাযোগ্য আসনে অভ্যর্থনা করে বসান। পরিবেশন করুন আপনার উথালপাথাল পরিশ্রমের ফসল। তাঁরা আপনাকে, মানে আপনার জীবনের টুকরোগুলোকে চিবিয়ে চুষে অবলেহন করে পান করে, চলে যাবার পর সবিস্ময়ে দেখুন, তখনও প্লেটগুলোতে, একটা দু'টো করে টুকরো পড়ে রয়েছে। আপনারই জীবনের টুকরো! 

ফেলবেন না। হোক না এঁটো, হোক না ঠান্ডা, এমনকি ছিবড়েও যদি হয়, কিই বা আসে যায়। রাত্রি ঘননির্জন হয়ে এসেছে এতক্ষণে। ঘর অন্ধকার। 

সেই প্রায় স্বাদহীন জীবনের টুকরো গুলো নিজের সামনে সাজিয়ে নিন। চোখ ঝাপসা? তাতে কি? ঘরে তো বাতি নেই। চাঁদ নেই জানালায়। একটা জোনাকিও ভুল করে আলো দিতে আসেনি এখানে। 

কাঁপা হাতে একটু জীবন তুলে নিন নিজের লালা শুকিয়ে যাওয়া জিভের ওপর।

শুক্রবার, ১২ অক্টোবর, ২০১২

কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও সরকারি ডাক্তারদের মিছিল ~ অনামিকা

সংখ্যালঘুর ইমামকে ঘুষ দিলে ভোট বাড়ে যদি
যেই না ভেবেছি, অভিসারে যেতে ডাকে নরেন্দ্র মোদি।
কোনদিকে যাই, ভেবেই না পাই, মেনিকে ডাকছে হুলো!
গোদের ওপর বিষফোঁড়া এই মিটিং মিছিলগুলো।

তদুপরি মহা "পবলেম" আমি কেন্দ্রে খেয়েছি তাড়া।
এখানে ত্রিফলা পুকুরচুরিতে রাজ্যে পড়েছে সাড়া।
তবু অকাতর পুঁতছি পাথর হেথায় হোথায় সেথা।
কোচ ফ্যাক্টরি হাওয়া হয়ে গেছে সন্ধান পায় কে তা'?

স্বপ্নেও আমি ভাবিনি তোরা যে এতখানি বেয়াদব
মিটিংমিছিল নিষেধ, তবুও করছিস কলরব।
"গরমেন্ট" আছে ভুলে গিয়েছিস, ঠিক কী ভূমিকা তার।
মিছিলের মানে বোঝাবো এ'বার ... সরকারি ডাক্তার!

গ্রেপ্তার হবি, জেল হবে সাথে সাতটি দিনের ফাঁসি
কমপালসারি ওয়েটিং আর সাসপেন্ড পাশপাশি।
কেমন ভীষণ শাস্তি যে দেব মনে পড়ছে না আর
ইতিহাস বই খুলে দেখে নিস কী করত হিটলার।

বৃহস্পতিবার, ১১ অক্টোবর, ২০১২

আধুনিক চম্পলা ~ অনামিকা

ঘাগু বিধায়ক ঘটনা ঘটার আগেই হাজির থানায়। 
"গাড়িচাপা দিয়ে শ্লীলতাহানি"র আজব নালিশ শানায়।
মহানেত্রীর হুকুমমাফিক মিথ্যে এক ডজন 
কেসে ঠিক মত সাজালে পুলিশ পেতে পারে প্রোমোশন। 

কাজেই এখন দারুণ সুবিধে ... তৈরি রয়েছে মামা 
বিরোধীকে দাও মিথ্যে কেসের হিটলারি হাঙ্গামা। 
সবাই বুঝুক এ'রাজনীতিতে কে যে ঠিক বস কার! 
তৃণমূল করে ... পেয়ে যাবে খুকি অভিনয়ে অস্কার।

বড় চেনা এই যাত্রাপালাটা ... এর আগাপাশতলা।
বিধাননগরে অ্যাকটিং করে আধুনিক চম্পলা।

সোমবার, ৮ অক্টোবর, ২০১২

নভেম্বরের নয় তারিখ ~ অনামিকা

বিশ্বে প্রথম আমার পেটেন্ট ... ভাবিস কার?
স্যান্ডউইচের হাঙ্গার স্ট্রাইক আবিষ্কার
ছাব্বিশ দিন মাঝরাস্তায় শোয়ার হক
একলা আমার। তোদের কেন ও'সব সখ?

স্বৈরতন্ত্র মন্ত্র আমার ... আমার ধ্যান।
আমার মুখোস ছিঁড়তে যারাই করিস প্ল্যান
জানবি আমরা নপরাজিত অ্যাটেনশন
ভরসা লাঠির ... বন্দুকেরও ... নো টেনশন!

তৈরি আমরা ... তৈরি টিভির সাংবাদিক
হচ্ছে দেখা নভেম্বরের নয় তারিখ

চৌর ... পৌর ... ভাষণ ~ অনামিকা

দুই লক্ষ চাকরি দেবার ফানুশ ফুটো
চেঁচাক মানুষ। তুলোয় ঢাকিস কর্ণদুটো
এফডিআইএর বিরোধিতার মুখোস পরে ...
হিলারিদের গলা জড়াই সাড়ম্বরে!

মার্কিনিদের আদরকাড়া বাদশজাদী
আমিই তো সেই বিশ্বসেরা মিথ্যেবাদী
কর্পোরেশন কলকাতাতে পুকুর চুরি
ত্রিশুল আলোর আবছা আলোয় ছলচাতুরি

এই সমস্ত নীলচে রঙের চুরির ফাঁকে
ডেঙ্গি জ্বরে অর্ধবেঁহুশ কলকাতাকে
জাগায় কারা? শোভন ওদের রুখতে হবে!
পুলিশ দিয়ে গুন্ডা দিয়ে সগৌরবে।

ভয় লাগছে ভয় লাগছে বেজায়। তাই
চমকে উঠি ধমকে উঠি ... " কে যায় ভাই?"

বৃহস্পতিবার, ৪ অক্টোবর, ২০১২

ক্যাম্পে যাত্রা ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

বিশ কিম্বা শতজনই হবে তারা 
অথবা শত  সহশ্র নগ্ন শীর্ণকায়
বন্ধ ওয়াগনে ত্রাসে কম্পমান
এবং দিশাহারা
বসে শুধু নখ দিয়ে রাত্রি খামচায়

বিশ কিম্বা শতজনই হবে তারা
একদা নিজেদের ভাবত মানুষ বলে
এখন অবশ্য শুধু নিছক সংখার ধারা
সুখের দিনগুলো আড়ালে গিয়েছে চলে
হায়রে পাশার দান চালা সারা

একঘেঁয়ে সময় দ্রুতলয়ে বয়ে যায়
কাটে আরেকটি দিন ছায়ায় আলোয়
ভাবে ঘন্টায় চাকা কতবার ঘোরে?
ঘুরে যায়  ঘুরে যায়।

থামাও ওগো থামাও এ ঘুর্নন
শেষহীন রেশ অফুরান