সোমবার, ২১ জুন, ২০১০

ভোপাল গ্যাস কান্ড: কিছু তথ্য ~ রঞ্জন রায়


---------------------------
আমেরিকা ও ভারত-- নাগরিকদের কি চোখে দেখে
-------------------
মেক্সিকো উপসাগরে তেল বয়ে দূষণ! মারা গেলেন ১১ জন আমেরিকান নাগরিক। দোষী ব্রিটিশ পেট্রোলিয়ম।
ভোপাল গ্যাস কান্ডে মারা গেলেন ১৫ হাজার ভারতীয়।


আমেরিকা সরকার কি করল? লুইসিয়ানা সমেত আশপাশের গোটা চারেক রাজ্যের ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্ভাবনায় বৃটিশ পেট্রোলিয়াম কোম্পানীর ঘাড়ে আরো বড় ক্ষতি চাপালো। চাইলো ৩৪ বিলিয়ন ডলার । তেল কোম্পানী না মানায় ওদের চেয়র্ম্যান কার্ল টেনরিক স্বানবর্গ আর সি ই ওটোনী হেওয়ার্ডকে সোজা হোয়াইট হাউসে ডেকে এনে ৫০ জন অফিসারের সামনে এক এক পাইয়ের হিসেব কষিয়ে প্রাইমারি লেভেলে ২০ বিলিয়ন ডালর এর ক্ষতিপূরণ নির্ধারণ করল। এর ৩বিলিয়ন তো এই ত্রৈমাসিকের মধ্যেই দিতে হবে। এর বিতরণের জিম্মেদারীও ঐ বৈঠকেই এক ফান্ড এর ঘাড়ে চাপাল। এর মনিটরিং কড়া ধাতের ইন্ডিপেন্ডেন্ট অ্যাডভোকেট কেনেথ ফিনবর্গ করবেন। ইনি ৯/১১ হামলার ক্ষতিপূরণ খুব ভালভাবে মনিটর করেছিলেন।

কিন্তু ওবামা ২০ বিলিয়ন ডালরকেও অন্তিম রাশি মানেন নি। তদন্ত চলতে চলতে যেমন যেমন তথ্য বেরুবে, রাশিও বেড়ে যাবে, আর ক্রিমিনাল লায়াবিলিটির মামলাও চলতে থাকনে।

আমরা কি করলাম?

চেয়ারম্যান অ্যান্ডারসন ভারতে এলে বিদেশ সচিব রসগোত্র সবচেয়ে আগে ওকে নিরাপদে ফেরত্ যাওয়ার গ্যারান্টি দিলেন।

মধ্যপ্রদেশের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিং লোকদেখানো গ্রেফতার করে ওকে ইউনিয়ন কার্বাইডের রেস্ট হাউসেই রাখলেন। আমেরিকান দূতাবাস আমাদের পররাষ্ট বিভাগের আমলার কাছে ওকে ছেড়ে দেয়ার অনুরোধ করলেন। সেটাকে ভারত সরকার আমেরিকান চাপ মনে করলেন। বিদেশমন্ত্রী নরসিং রাও সেক্রেটারি রসগোত্রের দেয়া ওয়াদা নিভাতে বদ্ধপরিকর যে! ধারা হাল্কা করে দেয়া হল। সরকারী অফিসাররা ওনাকে প্লেনে তোলার সময় সী-অফ করতে গেলেন।
প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সব শুনলেন। হা-ঁনা কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।

এবার ক্ষতিপূরণের ব্যাপারটা দেখুন।

ওবামা প্রারম্ভিক ক্ষতিপূরণের পর আরও চাইছেন। ভারত সরকার প্রথমে চাইল ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। তারপর ৫ বছরের মধ্যেই আধা বিলিয়ন ডলারের( ৪৭০ মিলিয়ন ডলার) কমে আদালতের বাইরে সমঝোতা করে নিল। ওদের ক্রিমিনাল লায়বালিটি থেকে মুক্তিও দিল। কেন? কোন জনাব নেই।

বাকি তো আন্দোলনের চাপে সুপ্রীম কোর্ট আবার শুরু করলো। কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের চিফ জাস্টিস আহমদী রায় দিলেন যে কোম্পানী জানতো না যে দোষ্যুক্ত সেফটি সিস্টেম থেকে মিক গ্যাস তৈরি হয়ে হাজার লোকের জান যেতে পারে। তারপর উনি ঐ কার্বাইড পরিচালিত হাসপাতালের চেয়ারম্যান হয়ে গেলেন। ইদানীং উনি বড় গলা করে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন যে চাকরের দোষে মালিকের শাস্তি হয় কি? রায় যদি ভুল ছিল তো কেন রিভিশন পিটিশন হয় নি?

হায় অন্ধ! আইনের প্রথম ক্লাসের ছাত্রও জানে যে (ল' অফ টর্টস্দেখুন) ভিকেরিয়াস লায়বিলিটি বলে কথা আছে। অর্থাত্, গাড়ির ড্রাইভার অ্যাকসিডেন্ট করলে বা পোষা কুকুর কামড়ালে মালিকের দন্ড হয়।

মোদ্দা কথা, নিজের দেশের ব্যাপারে আমেরিকা মাত্র ৫৩ দিনে যে ক্ষতিপূরণ আদায় করলো আমরা ২৬ বছরে তার আদ্দেকও করতে পারলাম না।

আর ৭ ডিসেম্বরের ৬ ঘন্টায় কি কি ম্যাজিক কল, তার চেইন এ কারা কারা বাঁধা ছিলেন তা আলাদা করে লিখছি।
( ঋণ স্বীকার: ভাস্কর পত্রিকা, ভোপাল)

--------------------------------
সেই ছয় ঘন্টা: ৭/১২/১৯৮৪
------------------------------
১) ওয়ারেন অ্যান্ডারসন, চেয়ারম্যান; কেশুব মহিন্দ্রা, নান-এক্সিকিউটিভ ডায়রেকটর; বিজয় গোখলে, ম্যানেজিং ডায়রেকটর।
ভোপাল যখন লাশ বিপণী হয়ে গেছে তখন এঁরা একসঙ্গে ভোপালে এলেন অপরাধী নয়, সম্মানিত অতিথি হয়ে। সেইসময় আমেরিকান দূতাবাসের ভারপ্রাপ্ত রাজদূত গর্ডন স্ট্রীভ জানাচ্ছেন যে অ্যান্ডারসন নাকি দুর্গতদের আর্থিক সহায়তা ও অনুসন্ধানে মদদ করতে এসেছিলেন। আসলে দেশি আমলাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে ধামাচাপা দেয়াই উদ্দেশ্য ছিল। সেটা করে মাত্র ৬ ঘন্টার মধ্যে উনি ভোপাল ছাড়েন। রসগোত্র জানাচ্ছেন যে দিল্লিথেকে দেশে ফেরার আগে উনি সাউথ ব্লকে ( যেখানে প্রধান মন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী বসেন) ২০ মিনিট সময় কাটান। তার আগে উনি তখন মীডিয়াকে বলেছিলেন--
No arrest, no bail, am free to go home.

২)জেমস বেকার, আমেরিকার বাণিজ্যদূত। মুম্বাইয়ে আমেরিকা সরকারের প্রতিনিধি।দিল্লিতে দূতাবাসের সঙ্গে যুক্ত। ৭ তারিখ ইউপিআই থেকে ডেনবারে কার্বাইডের হেডকোয়ার্টারে খবর গেল যে এরা তিনজন গ্রেফতার হয়েছেন। অ্যান্ডারসন কে ছাড়াতে ইনিই ভোপালে সরকারী আমলাদের সঙ্গে আমেরিকান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কথাবার্তা চালান।

৩) গর্ডন স্ট্রীভ, চার্জ ডি অ্যাফেয়ার্স।
রসগোত্র ও বিদেশমন্ত্রী নরসিং রাওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমেরিকার বিদেশ বিভাগের স্বার্থ দেখছিলেন। ভোপাল থেকে জেমস বেকারের খবর পেয়ে রসগোত্রদের সংগে ফলো আপ করেন।

৪)এম কে রসগোত্র, বিদেশ সচিব। রাজীব গান্ধী তখন বিদেশ মন্ত্রক দেখছিলেন, আর নরসিং রাও গৃহমন্ত্রী। ইনি আমেরিকান দূতাবাস, প্রধান মন্ত্রী ও গৃহমন্ত্রীর মধ্যে সতত সম্পর্কে ছিলেন। গর্ডন স্ট্রীভের অনুরোধ এঁর কাছে আমেরিকান প্রেসার মনে হয়েছিল। আসল নাটের গুরু ইনিই। আজকে ইনি সী এন এন/আইবিএন কে বলছেন যে উনি রাজীব গান্ধীকে জানান নি। সম্ভবত: রাষ্টপ্র্তি রীগান বলে থাকতে পারেন। কিন্তু অ্যান্ডারসন ভারতে আসার আগে নিরাপদে ফেরার গ্যারান্টি ইনিই ভারত সরকারের তরফ থেকে দিয়েছিলেন--- যা প্রধানমন্ত্রী/ বিদেশমন্ত্রীর স্পষ্ট নির্দেশ বিনা দেয়া সম্ভব নয়। হ্যা,ঁ অ্যান্ডারসন দিল্লি ছাড়ার আগে এনার কাছে বড় ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা দিয়ে গিয়েছিলেন।

৫) নরসিং রাও, গৃহমন্ত্রী; ইনি রসগোত্রের থেকে সব জেনেছেন। ডিজিপি বি কে মুখার্জি আজও বলছেন যে গেস্ট হাউসের জায়গায় কোন পুলিস স্টেশনে রাখলেও জনতা অ্যান্ডার্সনের ওপর হামলা করতো। ইনি তো তড়িঘড়ি কোন নির্ণয় নিতেন না। পরে বাবরি মসজিদের সময়েও না। খালি আমেরিকার ব্যাপারে সব অন্যরকম হয়ে যায়!

৬)অর্জুন সি,ং মুখ্যমন্ত্রী;
এই রাজনীতির চাণক্যটি এক ঢিলে তিন পাখি মারলেন। প্রথমে গ্রেফতার করে জনতার মন জিতলেন, কয়মাস পরে নির্বাচন যে! অ্যান্ডারসনকে পাঠিয়ে দিয়ে আমেরিকার মন জিতলেন, যেতে যেতে ও ব্যাটা এঁকে গুড গভনেসের সার্টিফিকেট দিয়ে গেল। কংগ্রেসের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখায় প্রধানমন্ত্রীও খুশি। কুলোকে তখনই বলেছিল যে আগে থেকেই কার্বাইডের মোটা ডোনেশন ওনার গৃহনগর চুরহাটের হাসপাতালে( ওনার ছেলে চালায়) যেত। সুব্রামনিয়ম স্বামীর কথা মানলে ছাড়ার ব্যাপারে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল।
( বয়স্ক বাঙালীদের মনে থাকতে পারে বছর বিশেক আগে চুরহাট লটারি কান্ডে এক মালদহের ভদ্রলোক প্রথম প্রাইজ জিতেও টাকা না পেয়ে মামলা করেছিলেন, ওর ছেলে অজয় সিং ছিল প্রধান আসামী)।

৭) রাজীব গান্ধী, প্রধান তথা বিদেশমন্ত্রী;
শুনেছেন সব, কাউকে কিছু বলেন নি, মানা করেন নি, নির্দেশ দেন নি। অ্যান্ডারসনের সুরক্ষার জন্যে ভোপাল থেকে দিল্লি এনে রাখা যেত, তা নয়-সোজা আমেরিকা পাঠিয়ে দেয়া হল। কারণটি রসগোত্র নিজেই বলেছেন--- আমেরিকান পুঁজি বিনিয়োগ এবং আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক ।

৮)সী আর কৃষ্ঞাস্বামী রাও, কেবিনেট সচিব। কেন্দ্র সরকারের শীর্ষস্থ আমলা। রাজীব গান্ধীর সঙ্গে যুক্ত। ইনিই ভারত সরকারের ইচ্ছে মধ্যপ্রদেশ সরকারের মুখ্যসচিবকে জানিয়েছিলেন।

৯)ব্রহ্মস্বরূপ, মুখ্যসচিব; ম প্র সরকার। ভোপালের সর্বোচ্চ আমলা। কেন্দ্র সরকারের নির্দেশ যাতে ভোপালের কলেকটর-এস পি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে সেটা দেখলেন।

১০)মোতীসি,ং কলেক্টর ও স্বরাজ পুরী, এস পি। এরা মুখ্যসচিব ব্রহ্মস্বরূপের আদেশ পালনকেই বিধিসম্মত ভাবে ডিউটি করা মেনে অ্যান্ডারসনকে সম্মানের সঙ্গে প্লেনে তুলে দেন। যদিও এদের আসল দায়িত্ব ছিল ওনাকে থানায় এবং আদালতে পেশ করা। এরা ঠিকমত রিটায়র হন। বিজেপি সরকার স্বরাজ পুরীকে দু'বছর আগে নর্মদা ঘাটি বাঁধ উদ্বাস্তুদের সমস্যা নিরাকরণের কমিটির অধ্যক্ষ বানিয়েছিলেন। এখন বের করে দিয়েছেন।

১১)সুরেন্দ্র সি,ং থানেদার; হনুমানগঞ্জ থানা, ভোপাল। এ'ব্যাপারে সবচেয়ে ছোট আমলা। এত বড় হাই প্রোফাইল মামলায় ওর সাধ্য কি যে এস পি সাহাবের আদেশের অবহেলা করে!

১২) হোয়াইট হাউস।
তখন রোনাল্ড রীগান প্রেসিডেন্ট। ভারতের পালা ঝুঁকে ছিল সোভিয়েতের দিকে। তেমন কোন চাপ দিয়েছিল মনে হয় না। ছাড়া পাওয়ার পর ল্যারি স্পীকস্, প্রবক্তা, হোয়াইট হাউসের বয়ান পিটস্বার্গ পোস্ট গেজেটের হেডলাইন ছিল। ওনার হিসেবে আমেরিকা ভারত সরকারের সঙ্গে কথা বলেছিল বটে, কিন্তু তার জন্যে ছাড়া পেয়েছে এমন মনে হয় না।
অর্থাত্ আমেরিকার সামান্য নিবেদনকে আমাদের সরকার আদেশ মনে করে অনুপালন করেছিল।

১৩) যাদের জন্যে সিবিআইয়ের কেস দুর্বল হল:
ক) অশ্বিনী কুমার এবং প্রাক্তন জয়েন্ট ডায়রেক্টর মাধবনের মতে চার্জশীট দেয়ার সময় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পাক্কা প্রমাণ যাতে দেয়া হয় তা' খেয়াল রাখা হয়েছিল। কোর্টের বর্তমান ফয়সালা থেকেও এটা স্পষ্ট যে কার্বাইড ফ্যাক্টরির ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইন ও গ্যাস লীক হওয়ার সম্ভাবনা আছে এই খবর ম্যানেজমেন্টের কাছে অনেক আগে থেকেই ছিল। কেস রি-ওপেন হলে অভিযুক্তদের শাস্তি বাড়াতে প্রসিকিউশনের বড় দায়িত্ব আছে।

খ) সোলী সরাবজী, প্রাক্তন এটর্নী জেনারেল; আগে ভারত স্রকারকে বল্লেন--- অ্যান্ডার্সনকে ফেরত আনানো যেতে পারে, আবেদন করা হোক। পরে বল্লেন- উনি আমেরিকান নাগরিক। কোন আমেরিকান ল' ফার্মের পরামর্শ নেয়া হোক। তারপরে বল্লেন-- না:, সিবিআইয়ের যা সাক্ষীসাবুদ তা আমেরিকান কোর্টে ধোপে টিঁকবে না। কাজেই সরকারের আইডিয়াটিড্রপ করা উচিত্।

গ)জাস্টিস এ এম আহমদী, সর্বোচ্চ আদালতের প্রাক্তন ন্যায়াধীশ। সমস্ত প্রমাণকে চোখবুঁজে খারিজ করে ১৯৯৬তে রায় দিলেন যে কার্বাইড জানতনা গ্যাস লিক হয়ে এমনটি হবে। ফলে ধারা ৩০৪, পার্ট ২ ( culpabale homiside, not amounting to murder) থেকে সরিয়ে ৩০৪এ( death caused by negligence/accident) লাগানো হল। অর্থাত্, ২০১০ এ অভিযুক্তদের মাত্র দু'আড়াই বছরের জেল
হওয়ার স্ক্রিপ্ট সেই ১৯৯৬তেই লেখা হয়ে গেছিল। এই রায় দেবার পরে পরেই ওনাকে কার্বাইড কোম্পানী ২৫০ কোটি টাকার ভোপাল মেমোরিয়াল হসপিটাল ট্রাস্টের প্রধান ট্রাস্টি করা হল। সে'পদেও ওনার অনেক ফয়সালা বিবাদাস্পদ হয়েছে।

আমি খালি গণনাট্য সংঘের প্রয়াত বিনয় রায়ের বিখ্যাত গানটা গাইছি-- " কেকরা কেকরা নাম বাতাউঁ, জগমেঁ সারা লুটেরা হো।''


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন